লিখেছেন: জামিউল আহমেদ
পর্যটন মেলা উপলক্ষে বারবার জার্মানীর বার্লিনে আসা হয়। অথচ পাশের দেশ ফ্রান্সে যাওয়া হয় না। মেলা শেষে হয়তো অন্য দেশ ঘুরে নয়তো সরাসরি দেশে ফিরা হয়। এবারও তাই হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ লন্ডন হয়ে দেশে ফিরবো। কিন্তু ভাগ্নে খোকনের বারবার টেলিফোন এবং মিনতির জন্য সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলো। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন-এর চেয়ারম্যান এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম-সচিবসহ দলের অন্যান্য সদস্য-সদস্যা দেশের পথে লন্ডন রওয়ানা হলেন। আমার সাথে থাকলেন পর্যটন মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং শেরাটন হোটেলের একজন আধিকারিক। তাদের খুব ইচ্ছে এই সুযোগে ইউরোপের দু‘একটা দেশ দেখে যাবেন। কারণ তারা দুজনই এই প্রথম ইউরোপ এসেছেন। এজন্য তাদেরকে সার্বিকভাবে গাইড করার দায়িত্ব বর্তালো আমার উপর। শুরুতেই আমরা বার্লিন থেকে রওয়ানা দিয়ে সারা রাত বাস জার্নি করে সাত সকালে এসে পৌঁছালাম প্যারিসে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ভাগ্নে খোকন তার সঙ্গি-সাথী নিয়ে এসে আমাদের রিসিভ করল। তখন সকালের শান্ত প্যারিসকে বেশ ভালই লাগলো। দেখতে দেখতে একসময় প্যারিস নগরীও ব্যস্ত হয়ে উঠলো। এই ব্যস্ততার মধ্যেই শুরু হলো আমাদের প্যারিস নগর-ভ্রমণ কর্মসূচী। তবে প্রথম দিন এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা, দাওয়াত খাওয়া এবং বিশ্রাম নিয়েই পার হয়ে গেল।
দ্বিতীয় দিন প্যারিসে সাইটসিয়িং শুরু হলো বিরাট গাইড বহর সাথে নিয়ে। অর্থাৎ ভাগ্নে খোকনের সাথে থাকলো আরো দুই যুবক। এদের মধ্যে একজন বলতে গেলে অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী। সে যে শুধু কথা বেশি বলে তা নয়। তার আচার-আচরণের মধ্যে পাওয়া গেলো এক ধরনের অসংলগ্নতা। যা দেখে হাসিও পাচ্ছিল আবার রাগও হচ্ছিল। তবে স্রেফ ছেলেমানুষি মনে করে ছাড় দেব সে সুযোগও পাওয়া যাচ্ছিল না। এক ফাঁকে খোকন মুচকি হেসে আমার কানের কাছে মুখ রেখে কিছু একটা জানান দিলো। যার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, ছেলেটা আসলেই ভীষণ চঞ্চল এবং একেবারেই ফানি ক্যারেক্টারের। অবশ্য এর সত্যতা পাওয়া গেল সে যখন পাতাল রেলের টিকেট সংগ্রহ থেকে বিরত থাকলো। এই নিয়ে খোকনদের হাসাহাসি আমাকে আরো ভ্যাবাচ্যাকা করে ফেললো। ভাবলাম হয়ত পরবর্তী কোন একটা ঘটনার জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এবার পাতাল রেলে চড়ে আমরা একটা স্টেশনে পৌঁছে দ্রুত অটো টিকেট চেকিং কাউন্টার দিয়ে পার হতে লাগলাম। তখনই ঘটলো দারুণ এক ঘটনা যা আসলেই অবাক হওয়ার মত। ফানি বয় চোখের পলকে লাফ দিয়ে পাশের বেষ্টনি পার হয়ে গেল। ঘটনার আকষ্মিকতায় মনে হল, কিছুই যেন বুঝতে পারলাম না অথচ খোকনরা সবাই এবারও মুচকি হাসলো।
কিছু দূর সামনে যাবার পর এক ফাঁকে খোকন আবার আমার কাছে আসলো। সে জানালো, এই কর্ম নাকি ফানি বয়‘র জন্য স্রেফ পানি ভাত। আরো জানা গেলো সে হরহামেশা এই কর্ম করে থাকলেও আজ অবধি ধরা পড়েনি। ফ্রান্সের মত দেশে এত উন্নত প্রযুক্তি থাকার পরও আমাদের তথাকথিত ফানি বয় এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে জেনে আমার তো আক্কেল গুড়–ম। যেজন্য মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিলাম আর ভাবলাম যদি একটিবার সে ধরা পড়ে তাহলে দেখা যাবে কি হয় তার পরিণতি। এভাবে সাইটসিয়িং চলাকালে ফানি বয় সুযোগ বুঝে আরো দু‘একবার বেশ গর্ব ভরে তার নৈপুণ্য প্রদর্শন করলো। অবশ্য এর মধ্যে কোন অঘটন ঘটেনি যদিও আমার অপেক্ষার পালা তখনও চলছিল। এক সময় ‘ল্যুভ’ জাদুঘরে প্রবেশ করার পর আমাদের মন-মানসিকতায় আসল বেশ পরিবর্তন। কারণ গুণগতমান আর সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত চিত্রকর্মের সমাবেশ ঘটেছে এই জাদুঘরে। বিশেষ করে ‘মোনালিসা’ হচ্ছে সব দর্শনার্থীর লক্ষ্যবস্তু। তাই বিশ্বখ্যাত জাদুঘর ল্যুভ পরিদর্শনে এসে আমরাও তা থেকে বাদ গেলাম না। জাদুঘরের পুরোটা ঘুরে দেখা বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই অনেকের মত আমরাও সময়ের ব্যাপারটিকে মাথায় রেখে পরিদর্শন কাজ শেষ করলাম। এক সময় জাদুঘরের বাইরে এসে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হল এবং আমরা সামনে এগুতে থাকলাম। তারপর আমাদের সাইটসিয়িং-এর মূল আকর্ষণ অর্থাৎ আইফেল টাওয়ার পৌঁছার জন্য ফের পাতাল রেলের সাহায্য নিতে স্টেশনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হলাম।
পাতাল রেলে চড়ে ট্রকাডেরো স্টেশনে নামার পরপরই যেন কাকতালীয়ভাবে কিছু একটা ঘটে গেল। আমরা যখন প্রায় আত্মভোলার মত সামনে এগুচ্ছিলাম তখনই মিয়াধন ফানি বয় ফাঁদে আটকা পড়ে গেল। সাদা পোশাক পরা পুলিশ তার কাজকারবার চাক্ষুস দেখে ফেললো এবং তাকে আটক করতে এতটুকু দেরী করলো না। যাকে কি না বলে, চোরের দশ দিন আর গৃহস্থের একদিন। তখন আমাদের মনের মনিকোঠা একেবারেই দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। একদিকে ছেলেটার জন্য খারাপ লাগলো এবং অন্যদিকে তার পরিণতি প্রত্যক্ষ করার ইচ্ছাও মনে জাগলো। বলা যায় ড্রামা তখন ক্লাইমেক্সে গিয়ে পৌঁছালো। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় তা প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। প্রথমে ফানি বয়-কে জিজ্ঞাসাবাদ চললো এবং পরে সাথে থাকা কাগজপত্র দেখে তা আটক করা হলো। এতে পলিটিক্যাল এসাইলাম বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের স্বপক্ষে যে কাগজপত্র ফ্রান্স সরকার তাকে দিয়েছিল তার অসম্মান হল। কারণ তখন ফানি বয়‘র মত যুবকদের এদেশে এসে বৈধভাবে বসবাসের কোন সুযোগ না পেয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া এবং এদের পক্ষে এমন একটা কিছু ঘটানো যেন একেবারেই রীতিতে পরিণত হয়েছিল। তাই ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে হল, এমনতর দুষ্কর্মের ফল যা হবার তাই হয়েছে। কেন না শেষ পর্যন্ত সরকারী অনুদানের একটা বিরাট অংশ জরিমানা হিসেবে কেটে নেয়া হয়েছে। অথচ ফানি বয়‘র এই অপকর্ম আমাদেরকে ব্যথিত করলেও তা যেন একটুও তার গায়ে লাগলোনা। যা দেখে সত্যিই আশ্চর্য হলাম এবং মাথা নীচু করে সামনে পা বাড়ালাম।
এতকিছুর পরও স্টেশন থেকে রওয়ানা দিয়ে প্যালাইস ডি চেইলট দিয়ে হেঁটে যেতে চমৎকার লাগছিল। বিশেষ করে ট্রকাডেরোর ফোয়ারাগুলো তখন প্রাণপণে এবং আরো জোরে পানি ছিটাচ্ছিল। যার সৌন্দর্য যে কারো মন কাড়তে পারে। তবে বাড়তি হিসেবে ছিল বিনে পয়সায় পাওয়া নৃত্য এবং শারীরিক কসরত। কারণ উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরারা তখন প্রাণ খুলে নাচছিল অথবা ডিগবাজি খাচ্ছিল। অবশ্য এসবের মধ্যে শিল্পকলা উপস্থিত থাকায় তারা পথচারীদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হচ্ছিল। অর্থাৎ বিনে পয়সায় মুক্ত বাতাসে নৃত্য আর শরীর চর্চা দেখা যাচ্ছিল। অবশ্য কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে তখন বাতাস ছিল বেশ হালকা। আর পড়ন্ত বিকেলের সূর্য মেঘে ঢাকা থাকলেও ফাঁক দিয়ে উকি দিচ্ছিল রঙ্গীন আভা। সব মিলিয়ে গোটা পরিবেশটাই ছিল দারুণ উপভোগের। তাই ধীর লয়ে পা ফেলে আমরা সামনে এগুচ্ছিলাম। কিন্তু একেবারে সামনেই আইফেল টাওয়ার থাকায় চোখের দৃষ্টি বার বার ঐ দিকেও যাচ্ছিল। এবার সিড়ি বেয়ে আইফেল টাওয়ারের সামনের মলে পৌঁছা মাত্র নিমিষেই মন থেকে সব কিছু যেন হাওয়া হয়ে গেল। শুধু চোখের দৃষ্টি নয়, মন-প্রাণ সব কিছুই চুম্বকের মত কি এক আকর্ষণে আকর্ষিত হয়ে টাওয়ারের উপর গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লো। তখন গোটা এলাকা জুড়ে ছিল হাজারো মানুষের উপস্থিতি। এদের সবার উপলক্ষ একটাই, আইফেল টাওয়ার পরিদর্শন করা। তবে ব্যতিক্রম ছিল শুধু কিছু হকারের প্রাণপণ ছুটাছুটি এবং এটাওটা বিক্রির চেষ্টা। অবশ্য এদের বেশিরভাগই এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এখানটায় জড়ো হয়েছে। যেজন্য সার্বিক পরিবেশই বলে দিচ্ছিল, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানটায় ছুটে এসেছেন আইফেল টাওয়ার চাক্ষুস দেখতে এবং এর সম্পর্কে জানতে। কারণ, আশ্চর্য এই আইফেল টাওয়ার সৃষ্টিকে জড়িয়ে দীর্ঘকাল ধরে জন্ম নিয়েছে নানা ঘটনাপ্রবাহ যা ইতিহাসেরও খোরাক বটে।
আইফেল টাওয়ার ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ তার যাত্রা শুরু করে মূলত ফরাসী বিপ্লবের উৎসব পালন উপলক্ষে বিশ্ববাসীর কাছে প্রদর্শনের জন্য। এটি উদ্বোধন করেন ওয়েলস-এর যুবরাজ, যিনি পরবর্তীতে ছিলেন বৃটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড। উচ্চতা এবং নির্মাণশৈলীর দিক থেকে আইফেল টাওয়ার বিশ্বের একটি উলে¬খযোগ্য আকর্ষণীয় বিষয় এবং ফরাসীদের গর্ব। এই বিস্ময়কর স্তম্ভটি প্রতি বছর প্রায় সত্তুর লক্ষ পর্যটক পরিদর্শন করে থাকেন। তাই যাত্রার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পরিদর্শনকারীর মোট সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যিনি এই স্তম্ভের নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ কাজ করেছেন তার নাম অনুসারেই নাম হয়েছে আইফেল টাওয়ার। এটির নির্মাতা ছিলেন গুস্তাভো আইফেল এবং সাই। আইফেলের পুরো নাম আলেকজা-ার গুস্তাভো আইফেল। তাঁর জন্ম ১৮৩২ সালের ১৫ ডিসেম্বর, ডিজনে এবং মৃত্যু হয় ১৯২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর, প্যারিসে। আইফেল টাওয়ারের প্রকৌশলী ছিলেন মাউরিস কোয়েসলিন এবং এমিলি নউগুইয়ার। আর স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন স্টিফেন সাউভেস্ট্রি।
আইফেল টাওয়ার নির্মাণের জন্য পরিকল্পনার কাজ শুরু হয় ১৮৮৪ সালে। নকশা প্রণয়নের জন্য আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন অন্তত ৩০০ প্রতিযোগী। তবে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় আলেকজা-ার গুস্তাভো আইফেলের নকশাটি। তারপর নির্মাণ কাজ চলে ১৮৮৭ থেকে ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত। এই নির্মাণ কাজে মোট সময় লাগে দুই বছর দুই মাস পাঁচ দিন। টাওয়ারটির মোট ওজন হচ্ছে ১০,১০০ টন। যার মধ্যে শুধু ধাতব কাঠামোর ওজন ৭,৩০০ টন এবং মূল ভিতের ওজন হচ্ছে ৩০৬ টন। ৭৯ ফুট এন্টেনাসহ পুরো কাঠামোর উচ্চতা হচ্ছে ১,০৬৩ ফুট। যা একটি ৮১ তলা বিশিষ্ট দালানের উচ্চতার সমান। টাওয়ারের চূড়া থেকে পরিষ্কার আলোতে ৬৭ কিলোমিটার বা ৪২ মাইল দূর পর্যন্ত দেখা সম্ভব। আইফেল টাওয়ার নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বর্তমান মুদ্রামান অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় বারো কোটি পচাত্তর লক্ষ টাকার সমান।
মজার ব্যাপার হল এটি নির্মাণে ৩০ লক্ষ রিভিট বা বল্টু ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই রিভিট ছাড়াও অন্তত ১৮,০৩৮ টুকরো ষ্টিল টাওয়ারটিতে যুক্ত করেছেন ৩০০ ইস্পাত শ্রমিক। এদের মধ্যে একজন শ্রমিক অবশ্য মারাও গেছেন। টাওয়ারের নীচ থেকে উপর পর্যন্ত ১,৬৬৫ টি সিঁড়ি রয়েছে। আবার নীচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত পরিদর্শকরা হাঁটতে পারেন এমন সিঁড়ি রয়েছে ৭০৪ টি। প্রতি পাঁচ বছর পর একবার এটি রং করতে রং লাগে ৪০ টন। পুরো টাওয়ারের রঙ হচ্ছে গাঢ় বাদামি। ২.৫ একর জায়গা জুড়ে এর বিস্তার হলেও ভিতটা ৪১২ ফুট ব্যাসার্ধের। টাওয়ারের উপর দিকটা বাতাসের সাথে দোল খায় ১২ সেন্টিমিটার বা ৪.৭৫ ইঞ্চি। তবে উচ্চতা ও তাপমাত্রার তারতম্য অনুসারে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কম-বেশি হয়ে থাকে। আবার মূল ভিতের উপর চাপের পরিমাণ হচ্ছে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ৪.১ থেকে ৪.৫ কিলোগ্রাম। ১৯৮৬ সাল থেকে “সিটি অব লাইটস” নামে এটিকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা শুরু হয়। এজন্য ১০০০ ওয়াটের ৩৫২ টি প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রাতে আলোকিত আইফেল টাওয়ার প্যারিসের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বস্তুতে পরিণত হয়। বিশেষ করে স্বর্ণালী আলোর ছটা ইস্পাতের কারুকার্যকে উজ্বল করে তোলে, যা দিনের আলোয় থাকে অনুপস্থিত।
আইফেল টাওয়ারের পূর্ব এবং পশ্চিম দিককার পিলার বা খুঁটির ভূগর্ভস্থ অংশে রয়েছে ১৮৯৯ সালে স্থাপিত বিশাল যন্ত্রপাতি যা লিফট চলার ক্ষমতার উৎস। বলা হয়ে থাকে এটি নাকি জুল ভার্নের উপন্যাসের স্মৃতি বিজড়িত অবাক করা এক দৃশ্যও বটে। অন্যদিকে টাওয়ারের রয়েছে তিন-তিনটি প্লাটফরম। বিশেষ করে উপরেরটি থেকে প্যারিসের সত্যিকার রূপ দেখে আশ্চর্য হতে হয় যে কাউকে। প্রথম প্লাটফরমটি ১৮৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখানে রয়েছে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র যা আইফেল টাওয়ারের গতি-প্রকৃতিকে জানতে সাহায্য করে। আরো রয়েছে কিওস্ক বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ছোট-ছোট দোকানপাট। তবে সিনেমায় ব্যবহৃত ফিল্ম’র মাধ্যমে ছবির মত ব্যতিক্রমী দৃশ্য অবলোকন করা সত্যিই মনে রাখার মত। তাছাড়া রয়েছে স্যুভেনির সপ, রেস্তোরাঁ ‘অ্যালটিটিউড-৯৫’, পোস্ট অফিস এবং প্যানারমিক গ্যালারী যেখানে প্যারিসের স্মৃতি ভাষ্কর্য প্রদর্শিত হচ্ছে। দ্বিতীয় প্লাটফরমটি ৩৮৯ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতায় অবস্থিত। এই প্লাটফরমে রয়েছে প্যারিসের প্যানারোমা, দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলো, দোকানপাট, এলিভেটর বা লিফট চালোনার উপর জীবন্ত প্রদর্শনী এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁ ‘জুল ভার্ন’ যেখানে অগ্রীম আসন সংরক্ষণ ছাড়া কোন সুযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সুভোজন বিদ্যা বিষয়ক এই রেস্তোরাঁটি মানের দিক থেকে এক তারকা মানের। এটি ২০০৭ সাল থেকে বিখ্যাত বাবুর্চি তথা ভোজন বিশারদ এ্যালান ডুকাসের নের্তৃত্বে খ্যাতির শিখরে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। আইফেলের তৃতীয় প্লাটফরমটি ৯০৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতায় অবস্থিত। এখান থেকে দিবা-রাত্রি গোটা প্যারিসের দৃশ্যাবলী ছবির মত দেখার সুযোগ রয়েছে। ইদানীংকালে এখানে গোস্তাভে আইফেলের একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে দেখানো হচ্ছে, আইফেল স্বাগত জানাচ্ছেন থমাস এডিসনকে।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই আইফেল টাওয়ারকে বেতার সম্প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রস্তুত এন্টেনা দিয়ে কাজ চালানো হতো। যা ছোট ছোট বাংকারের মধ্যে অবস্থিত দীর্ঘ তরঙ্গ সম্প্রচারের সাথে যুক্ত ছিল। এজন্য ১৯০৯ সালে দক্ষিণ দিককার খুঁটির কাছে স্থায়ীভাবে ভূগর্ভস্থ বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল এবং তা আজো টিকে আছে। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালের ২০ নভেম্বর আইফেল টাওয়ারে স্থাপন করা হয় প্যারিস অভজারভেটরী। উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার নৌ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সাথে টেকসই বেতার সংকেত বিনিময় করা। অবশ্য একাজে সহায়তার জন্য ভার্জিনিয়ার আরলিংটনে বসানো হয়েছিল শক্তিশালী এন্টেনা। এতে করে প্যারিস এবং ওয়াশিংটন ডি সি-র মধ্যেকার দ্রাঘিমাংশ পরিমাপ করার কাজ অত্যন্ত সহজ হয়ে আসে। ১৯০৯ সালে টাওয়ারটি মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার হুমকিতে পড়ে। তবে টেলিগ্রাফের জন্য ব্যবহৃত এন্টেনার জন্য সেই যাত্রা বেচে যায়। এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে টাওয়ারটি প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক সময়সেবার অংশীদার হওয়ার সুযোগ পায়। আবার ১৯১৮ সাল থেকে ফ্রান্স রেডিও এবং ১৯৫৭ সাল থেকে ফ্রান্স টেলিভিশন টাওয়ারটি ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে আসছে। আইফেল টাওয়ার তার দীর্ঘ চলার পথে বিচিত্র সব ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯২৩ সালে একজন সাংবাদিক টাওয়ারের প্রথম প্লাটফরম থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে নীচে নেমে আসেন। ১৯৫৪ সালে একজন পর্বতারোহী এটিকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেন। পরে ১৯৮৪ সালে দুজন ইংরেজ এখান থেকে প্যারাসুটিং করেন। এছাড়াও বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহ বিভিন্ন সময়ে আইফেল টাওয়ারকে স্পর্শ করেছে। যেমন:
১৮৮৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টমাস এডিসন টাওয়ারটি পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি পরিদর্শন বইতে মন্তব্য লিখতে গিয়ে আইফেলকে আধুনিক যুগের একজন মহান প্রকৌশলী এবং সাহসী নির্মাতা হিসেবে উল্লেখ করেন।
# ১৯০২ সালে টাওয়ারটি আলোকসজ্জার আঘাতে জর্জরিত হয়। পরিণতিতে উপরের অংশের অন্তত ৩৩০ ফুট সরাসরি পুন:নির্মাণের কবলে পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্থ সবগুলো বাতি অপসারিত হয়।
# ১৯১০ সালে ফাদার থিওডর উল্ফ টাওয়ারের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত রেডিয়েন্ট এনার্জি পর্যবেক্ষণ করেন যা তার আবিষ্কার কাজকে ত্বরান্বিত করে। অবশ্য এটি আজ আমাদের কাছে কসমিক-রে হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
# ১৯১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী ফ্রাঞ্জ রেইসেল্ট নামে অস্ট্রিয়ার একজন দর্জি তার ঘরে তৈরী প্যারাসুট ব্যবহার করে ৬০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত টাওয়ারের প্রথম ডেক থেকে লাফ দিয়ে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনেন।
# ১৯২৫ সালে শিল্পী ভিক্টর লাস্টিগ দুই-দুইবার টাওয়ারটি জঞ্জাল বা পরিত্যক্ত ধাতু হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
# ১৯৩০ সালে নিউইয়র্ক শহরে ক্রিসলার বিল্ডিং তৈরী হওয়ার পর পৃথিবীর সর্বোচ্চ কাঠামো হিসেবে টাওয়ারের যে স্থান ছিল তা হারাতে হয়।
# ১৯২৫ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত চার পাশের মধ্যে তিন পাশে চিট্রন কোম্পানীর আলোকিত প্রতীক ব্যবহার করে টাওয়ারটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিজ্ঞাপন স্থান হিসেবে জায়গা করে নেয়।
# ১৯৪০ সালে নাজি দখলদারিত্বের সময় ফরাসীরা লিফটের কেবল কেটে ফেলে যাতে হিটলার টাওয়ারের উপরে উঠতে না পারেন। তখন যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ স্থাপন করে তা মেরামত করা ছিল অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। তবে ঐ বছরই এক পর্যায়ে নাজি সৈন্যরা উপরে উঠে সোয়াসটিকা বা বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। কিন্তু পতাকাটির আকার বিরাট হওয়ার কারণে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তবে আবারো তারা ছোট আকারের পতাকা উড়িয়ে দেয়। এমতাবস্থায় হিটলার যখন প্যারিস আসলেন তখন তিনি মাটিতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর এজন্যই বলা হয়ে থাকে হিটলার ফ্রান্স দখল করতে পারলেও আইফেল টাওয়ার দখল করতে পারেন নি।
# ১৯৪৪ সালের আগষ্ট মাসে যৌথবাহিনী যখন প্যারিসের উপকন্ঠে পৌঁছে তখন হিটলার প্যারিসের সামরিক গভর্ণর ডায়ট্রিস ফন সলটিট্জকে আইফেল টাওয়ারসহ শহরের বাকি অংশ ধ্বংস করে ফেলার আদেশ প্রদান করেন। সামরিক গভর্ণর ফন সলটিট্জ এই আদেশ পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাই প্যারিস মুক্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টাওয়ারের লিফট সক্রিয় হয়ে উঠে।
# ১৯৫৬ সালের ৩ জানুয়ারী টাওয়ারের উপরের অংশ আগুনে পুড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
# ১৯৫৭ সালে টাওয়ার শীর্ষে বর্তমান রেডিও এন্টেনা স্থাপন করা হয়।
# ১৯৮০ সালে টাওয়ারের মধ্যভাগের একটি পুরাতন রেস্তোরাঁ এবং এর ভার বহনকারী লোহাকে টুকরো-টুকরো করে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এটিকে ক্রয় করে লুসিয়ানার নিউ অরলিয়নসের সেন্ট চার্লস এভিনিউতে পুন:নির্মাণ করা হয়। এর উদ্যোক্তা জন ওনোরিও এবং ডেনিয়াল বেনোট প্রথমে ‘ট্যুর আইফেল রেস্তোরাঁ’ নামে কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে এর নাম হয়েছে ‘রেড রুম’। রেস্তোরাঁটি ১১,০০০ টি টুকরোকে পুন:সংযোজন করে তৈরি করা হয় এবং এগুলো আটলান্টিকের ঐ পারে নিয়ে যেতে ৪০ ফুটের একটি কার্গো কন্টেইনারের প্রয়োজন হয়।
# ১৯৮০ সালে রজার মোর এবং গ্রেইস জোন্স অভিনীত জেম্স বন্ড এ্যাকশন ও এ্যাডভেঞ্চার ছবিটির মে দিবসের অংশটুকু আইফেল টাওয়ার থেকে ধারণ করা হয়। এই সময় নায়িকা প্যারাসুটের সাহায্যে টাওয়ার থেকে নীচে নেমে আসেন। এছাড়াও তার সাথে যোগ হয়েছিল ডুরান-ডুরান গ্রুপের বিশেষ ব্যান্ড শো-এর ধারণ করা ভিডিও দৃশ্যগুলো।
# ২০০০ সালে নববর্ষ পালন উপলক্ষে আইফেল টাওয়ার প্যারিসের শতাব্দী উদযাপন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করে। ঐ সময় গোটা টাওয়ার জুড়ে আতশবাজি এক চিত্তাকর্ষক প্রদর্শনীতে রূপ নেয়।
# ২০০০ সালে টাওয়ারটিতে ফ্লাশিং লাইট এবং চারটি উচ্চ ক্ষতাসম্পন্ন সার্চ লাইট স্থাপন করা হয়। তখন থেকে আলো প্রদর্শনী রাত্রিকালীন একটি বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া টাওয়ারের চূড়ার সার্চ লাইট প্যারিসের আকাশে এখন এক আলোক সংকেত হিসেবে পরিচিত।
# ২০০২ সালে আইফেল টাওয়ার তার বিশ কোটিতম মেহমানকে বরণ করে নেয়।
# ২০০৩ সালের ২২ জুলাই সন্ধ্যা ৭-২০ মিনিটে টাওয়ারের উপরে অবস্থিত সম্প্রচার যন্ত্রপাতির কক্ষে এক মারাত্মক অগ্নিকা- ঘটে। এজন্য গোটা টাওয়ারের সরঞ্জামাদি সরিয়ে ফেলা হয়। অবশ্য এতে কোন প্রাণহানি না ঘটলেও আগুন নেভাতে অন্তত ৪০ মিনিট সময় লাগে।
# ২০০৪ সাল থেকে আইফেল টাওয়ারের প্রথম তলা শীতকালীন স্কেটিং-এর জন্য বরফের পাত বা মেঝে হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। উল্লেখ্য যে, অবাধে স্কেটিং হচ্ছে প্যারিসের একটি ঐতিহ্য।
# ২০১৪ সালে ১৮৭ ফুটের নীচের রাস্তা দেখার সুবিধার্তে কাচের একটি ওয়াকওয়ে তৈরী করা হয়।
# ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের নজরে আসে টাওয়ার বেয়ে উপরে উঠছে তিন জন, যদিও নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের পাকড়াও করার আগেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এজন্য জরুরী নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা ব্যাপক নিরাপত্তা তল্লাশি শেষ না হওয়া পর্যন্ত টাওয়ার বন্ধ রাখা হয়।
# ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসে সন্ত্রাসী আক্রমণের জন্য আইফেল টাওয়ার দুই দিন বন্ধ রাখা হয়। তবে যখন খুলা হয় তখন ফরাসী পতাকার আলোক সজ্জ্বা করা হয়।
# ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারী প্যারিসের মেয়র এনি হিডালগো ঘোষণা দেন ৩০০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে ১৫ বছরের মধ্যে আইফেল টাওয়ারের বিশেষ সংস্কার কাজ করা হবে। যাতে থাকবে আরো উন্নত নিরাপত্তা এবং দর্শনার্থীদের অপেক্ষমান থাকার সময় কমানোর ব্যবস্থা।
# ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ঘোষণা আসে আইফেল টাওয়ারের নিরাপত্তার প্রয়োজনে এটির নীচের স্তম্ভে উত্তর-দক্ষিণে তিন ফুট উচ্চতার কাচের দেয়াল তৈরী করা হবে। সেই মোতাবেক ঐ বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর কাজ শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ২০ জুন তা শেষ হয়।
# ২০১৯ সালের ২০ মে আইফেল টাওয়ার আবার সাত ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখতে হয় অযাচিতভাবে এক ব্যক্তির টাওয়ার বেয়ে উপরে উঠার কারণে।
# ২০১৯ সালের ২১ মে মেয়র এনি হিডালগো ঘোষণা দেন একটি বিশেষ পরিকল্পনা। এতে রয়েছে ২০২৪ সালের মধ্যে একটি “গ্রীণ করিডোর” তৈরী করে ট্রকাডেরো স্কয়ার এবং টাওয়ারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা হবে। যা হবে জনসাধারণের জন্য শহরের সবচেয়ে বড় সবুজ ক্ষেত্র।
# ২০২০ সালের ১৩ মার্চ কভিড-১৯ মহামারির কারণে আইফেল টাওয়ারে সাধারণের পরিদর্শন বন্ধ করে দেয়া হয়।
# ২০২০ সালের ২৫ জুন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এত দীর্ঘ সময় আইফেল টাওয়ার সাধারণের পরিদর্শনের জন্য বন্ধ থেকে আবার সচল হয়ে উঠে।
অথচ বিশ্বখ্যাত এ টাওয়ারটি তৈরির বিরোধিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন প্যারিসের বরেণ্য সব লেখক, শিল্পী, চিত্রশিল্পী, স্থপতি এবং সুন্দরের পূঁজারীরা। তাদের বক্তব্য ছিল “আমরা যারা ফ্রান্সের রুচি, ইতিহাস ও শিল্পকে ভালোবাসি তারা এই অপ্রয়োজনীয় এবং বিরক্তিকর আইফেল টাওয়ার নির্মাণের প্রতিবাদ করছি”। হয়ত এজন্যই আইফেল টাওয়ার দাঁড়িয়ে থাকার অনুমতি পেয়েছিল মাত্র কুড়ি বছরের জন্য। তারপর মালিকানা যাওয়ার কথা ছিল সিটি অব প্যারিসের কাছে। অর্থাৎ ১৯০৯ সালে তা সরিয়ে ফেলার কথা ছিল। যেজন্য মূল প্রতিযোগিতায় নকশা প্রণয়ণের সময় বিধান হিসেবে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল যাতে পরবর্তীতে টাওয়ারটি সহজেই সরিয়ে ফেলা যায়। সেই মোতাবেক সিটি কর্তৃপক্ষ এটি গুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দেখা গেল যোগাযোগ ক্ষেত্রে টাওয়ারটি উলে¬খযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
এই বিবেচনায় আইফেল টাওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার পরও টিকে থাকতে সক্ষম হয়। এমনকি যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় বার্তা আদান-প্রদানে টাওয়ারটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়েছিল বলে পরবর্তীতে এটি একটি বিজয় স্তম্ভ হিসেবেও পরিচিতি পায়। গুস্তাভো আইফেল এমনি এক মহৎ মানুষ ছিলেন যিনি তার দ্বারা নির্মিত একটি বিশ্বখ্যাত টাওয়ারে নিজেই ফ্রান্সের ৭২ জন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য খ্যাতিসম্পন্ন মানুষের নাম খোদাই করে রেখেছিলেন। অথচ বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই খোদাই করা নামগুলো রং-এর আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তবে সুখের কথা এই যে, ১৯৮৬-৮৭ সালে টাওয়ারের ব্যবসায়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি কোম্পানী সে নামগুলো পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে আবার খোদাই করে দিয়েছে।
অবশ্য রাজনীতিও আইফেল টাওয়ারকে স্পর্শ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানরা টাওয়ারের গায়ে লিখে রেখেছিল যে, ‘জার্মানী সব রণাঙ্গনেই বিজয়ী’। ১৯৫৮ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্র ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস পূর্বে কিউবান বিপ্ল¬বীরা টাওয়ারের প্রথম অংশে তাদের লাল এবং কালো পতাকা মুড়িয়ে দিয়েছিল। তেমনি ১৯৮৯ সালে গ্রীণ পিসের আমেরিকান একজন সদস্য ‘সেভ দ্যা সীল’ শ্লোগানটি ঝুলিয়ে রেখেছিল। এছাড়াও আইফেল টাওয়ার চলচিত্র, ভিডিও গেম এবং টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠানসহ প্রচার মাধ্যমের নানা বৈশিষ্ট্যময় উপাদান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশ্ব জুড়ে এক মাইলফলক হয়ে আছে। যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ‘দ্যা ফোর হান্ড্রেড ব¬উজ’, ‘সুপারম্যান’, ‘টিম আমেরিকা: ওয়ার্লড পুলিশ’, ‘সেক্স এন্ড দ্যা সিটি’, ‘টুয়েন্টি উইকস লেইটার’ এবং ‘রাশ আওয়ার’-এর কথা। তবে ১৯৮৫ সালের ‘জেম্স বন্ড’ এবং আরেক বিখ্যাত ছবি ‘এ ভিউ টু এ কিল’ হচ্ছে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আর নামী-দামী ভিডিও গেম ‘টুইস্টেড মেটাল টু’-এর কথা উল্লেখ করারই দরকার পড়ে না।
শেষ কথা, আইফেল টাওয়ারে শুধু যে ১,৬৬৫ টি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয় কিংবা তাতে ৫ বিলিয়ন বাতি জ্বলে তাই নয়। এটি ইতিহাসের নানা ঘটনা প্রবাহেরও চাক্ষুস স্বাক্ষী। তাই এই টাওয়ার নিয়ে ফরাসীদের গর্ভ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই এই গর্ভের বস্তুকে ফরাসীরা একটি ছদ্ম নামে ডাকে। এই নামটি হচ্ছে ফরাসী ভাষায়, “লা ডামে ডে ফের” বা “দ্য আয়রন লেডি”। ১৯৮৯ সালে নানা স্মৃতি বিজড়িত এই আয়রন লেডির জন্ম শতবার্ষিকীও পালন করা হয় সঙ্গীতের মূর্ছনা এবং আতশবাজি দিয়ে। আর এই আয়োজনের মূল উৎসবটি চলে টানা ৮৯ মিনিট সময় নিয়ে। অতএব, এই আয়রন লেডিকে সময় পরিক্রমায় যুগ যুগ ধরে ফরাসীরা যে তাদের অন্তরে এবং বাহিরে বাঁচিয়ে রাখবে তা বলাই বাহুল্য।