Skip to content Skip to footer

বৃটেনে আমার সে শুরুর দিনগুলো

বৃটেনে আমার সে শুরুর দিনগুলো
মো: শাহজাহান

সময়টা ১৯৯১। লন্ডনে আমার আসা হিসাব বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়া। সাথে সাথে কাজ ও করতে হয়। তিন মাস বা তের সপ্তাহ কাজ আর তিনমাস পড়া। আমি কাজ নিয়েছি ওয়েলসের একটা গ্লাস ফ্যাক্টরীতে। লন্ডন হতে ওয়েলসে আমার কাজের দূরত্ব ১৫০ মাইলের মত। ঐখানেই এই তিনমাস থাকবো এটাই আমার ইচ্ছা। তারপর কলেজ খুলে যাবে। ফিরে আসবো লন্ডনে।
আমার যে সুপাভাইজার আছে সে ইংরেজ। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির মত লম্বা। বয়স ৫০ এর মত। গাত্র বর্ণ শুভ্র। মুখমন্ডল গোলাকার, অতি বদরাগী। কারণে অকারণে রেগে যায়। একবিন্দু ভূল হলে আর রক্ষা নেই। সারাদিন কি যেন একটা দুশ্চিন্তার ভিতর থাকে। এই কারখানার ২৮ জন অফিশিয়াল কর্মী এবং ৫০০ এর মত সাধারন কর্মী তার ভয়ে তটস্থ। সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে, কখন কাকে আক্রমন করে বসে। এমন একটা মানুষ আমার উপরস্থ কর্মকর্তা ভাবতে ও খারাপ লাগে।
বাংলাদেশ থেকে যখন লন্ডন আসি, সবেমাত্র এম.এ পাশ করেছি। কোন কাজের অভিজ্ঞতা নেই। জীবনের প্রথম অফিশিয়াল কাজ। যা-ই হোক অমাদের অফিসের সেক্রেটারী এমা স্কটল্যান্ডের। বয়স আনুমানিক ২০ বা ২২। এদেশে সেক্রেটারীর কাজ হলো আমাদের দেশের কেরানীর কাজের মত। এমা খুব ভালো মনের মেয়ে। কাজে অত্যন্ত-চতুর। প্রথম দিনেই বললো সুপারভাইজারের উপর অসন্তুষ্ট।
নাম বার্টন ম্যাককাঞ্জি। আমি তার নাম দিয়েছি মকুসারেং। একদিন দেখলাম তার মন খুব ভালো, জুয়া খেলায় কিছু টাকা জিতেছে। কাজে গেলাম। বললাম বার্টন আমি তোমাকে মকুসারেং নামে ডাকতে চাই। কারণ জিজ্ঞেস করলো। বললাম তুমি এই কারখানার প্রধান ব্যক্তি। অনেকটা ক্যাপ্টেনের মত। জাহাজে যেমন ক্যাপ্টেন থাকে ঠিক তেমনি। এই ক্যাপ্টেনকে আমাদের দেশে সারেং বলে। আর ম্যাককাঞ্জি নামটা আমার কাছে কঠিন মনে হয়। তাই তোমার নাম মকুসারেং।
তাকে ক্যাপ্টেন বলাতে খুব খুশি। এইদিকে মনে মনে শাস্তিÍ দেয়ার জন্য বাসনা আমাদের সকলের কিন্তু পেরে উঠিনা। নতুন হলেও আমাার কাজে যেন ভুল ধরতে না পারে তারজন্য সমস্ত প্রচেষ্ঠা। কাজ হলো অফিসের হিসাব নিকাশ করা এবং রাখা। তারপর সুপারভাইজারকে রিপোর্ট করা। কাজটা শক্ত হলেও অল্প দিনেই আয়ত্বে এসে গেছে। অন্যদিকে সবার সাথে মকুসারেং এর ব্যবহার দিন দিন অবনতির দিকে। খুবই চিৎকার করে। অসহ্য মনে হয়। তা ছাড়া হেড অফিসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত এই অফিসে কেউ নেই। ভাবছি পরোক্ষভাবে তাকে কিভাবে বশে আনা যায়। অবশ্যই তার জন্য দরকার কর্মচারীদের সহযোগীতা এবং নিজের কর্মক্ষেত্রের নিখুঁত কাজ করা।
হঠাৎ একদিন আমাকে কাছে ডাকলো, মন খুব খারাপ। বললো তার মাথা ধরেছে, বললাম ডাক্তরের কাছে যেতে। উত্তরে বললো অনেকবার গিয়েছে, কোন ফল হয়নি। মনে মনে ফন্দি আটলাম এখনই চিকিৎসাটা শুরু করা যাক। বললাম তুমি এক কাজ করতে পার।
উৎসাহের সাথে বলল কি? কি?
বললাম সূর্যের দিকি দুই কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক যতক্ষন ব্যাথা না কমে। দেখবে আস্তে-আস্তে ব্যাথা কমে এসেছে।
কথাটা শুনার সাথে সাথে বাইরে গিয়ে কথা অনুযায়ী দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের দেশে স্কুলে এই শাস্তি দেয়া হতো। অনেক আগে যদি কেউ দুষ্টুমী করতো। অবশ্য যুক্তরাজ্যে এইভাবে শাস্তি দেয়া হয়না। তাই মকুর ও ব্যাপারটা জানা নেই। বিষয়ই শুধু এমা কে জানালাম। এমা হেসে খুন। এমাকে আরো বললাম, ব্যাপারটা যাতে কেউ না জানে।
অন্য এক দিনের কথা, মুকুর খুব মাথা ঘুরছে আমার কাছে চিকিৎসা চাইলো। বললাম একটা টেবিলের উপর কান ধরে দাড়িয়ে থাক উপরের দিকে মুখ করে।
এমা হাসি থামাতে পারে না। তবুও একটা টেবিল এনে দিলো। টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে যেই মুখটা উপরের দিকে উঠিয়েছে। সেই ধপাস করে নিচে পড়ে গিয়েছে। আঘাত পেয়েছে নাকে মুখে রক্ত।
পাশে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। নেয়া হলো সেখানে। আস্তে করে কাছে গেলাম। ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে বললাম মকু মাথা ঘুরা কমেছে?
আস্তে করে হা করে বলল, নাকে মুখে খুব ব্যাথা। বললাম মকু কিছু পেতে গেলে কিছু দিতেও হয়। এটা আমার কথা নয় কবি রবীন্দ্রনাথের কথা। ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। এই প্রথম মকুর মুখে হাসি দেখলাম।
অন্য দিকে আমি একটা ভয়ের ভিতর অছি। সেটা হচ্ছে এমা সবকিছু জানে। যদি এই মেয়েটি শাস্তি সম্পর্কে মকুসারেংকে জানিয়ে দেয় তাহলে আমার আর রক্ষা নেই। পরদিন অফিসে গিয়েই জানলাম অনেকেই মকুর শাস্তির ব্যাপরটা বলতে গেলে অফিসের জানে অবশ্য মকুসারেং বাদে।
এখন আমাকে দেখলে সবাই হাসে। অবশ্য মকুসারেংকে দেখলেও হাসে, তবে গোপনে। দীর্ঘদিন পর এই অফিসের আবহাওয়া বদল হলো। সারেং এরও রাগ অনেকটা কমের দিকে। সময় পেলেই মকুসারেং সূর্যের দিকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকটা আযান দেয়ার মত। টেবিলের উপরের চিকিৎসাও চলছে নিয়মিত।
এই দিকে আমার কাজের সময় শেষ হয়ে আসছে। কলেজ খুলে যাবে। এক সপ্তাহ মাত্র বাকী। আবার ফিরে যেতে হবে লন্ডনে। সবার সাথে যে বন্ধুত্ব হলো তার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। মকুসারেং এখন আমার কাছের মানুষ। অনেক সুখ দু:খের কথা বলে। আমার সময় শেষ তা কিভাবে বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। তবুও বলতে হবে।
বললাম মকু আমি এক সপ্তাহ পরে কাজ ছেড়ে দেব। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের পরিস্থিতি বদল হয়ে গেল। বললো কেন? আসল ব্যপারটা গোপন করে বললাম প্রত্যেক দিন ঘুম হতে উঠেই খালি গাøস দেখতে হয়। আমাদের দেশে এটা একটা অমঙ্গল। আমি আর এই কাজ করতে চাইনা। তোমাদের অসুবিধার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বুঝলাম মকু খুব রেগে গেল।
ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক মকু সেদিন আর কোন কথা বলেনি।
পরদিন এমা আমার কাছে এসে বললো তোমার মকুসারেং অফিসে আসেনি। এমাকে মকু শব্দটা যেমনি শেখানো গেলনা তেমনি সারেংকে বলে সারাং।
এদিকে মেঘমুক্ত আকাশে সোনালী রোদের অবাধ আনাগোনা কিন্তু মকু নেই। কি হয়েছে। কিছুতেই বুঝতে পারছিনা। বাসায় কোন করলাম, কেউ ধরল না।
বেলা একটার দিকে মকু সারেং এর আগমন। মাথায় ব্যান্ডেজ। মন খারপ। আমাদেরকে বললো মকু আর এই অফিসে কাজ করবে না। কারন জানতে চাইলাম।
উত্তরে বললো, আজ সকালে অর্ধেক গ্লাস পানি দেখে এসেছি। এ জন্য মাথা ফেটে গেছে আকসিডেন্ট। খালি গ্লাস দেখলে বোধ হয় মারাই যেতাম। বিষন্ন মুখে কথাগুলো বললো।
আমি তাকে শান্তনা দিতে চাইলাম। বুঝাতে চাইলাম এগুলো আমি ও মানি না। কিন্তু মকুর একটাই বিশ্বাস তা হলো জীবন আগে তারপর চাকরী। অবশেষে আমার আগেই মকু সারেং এর বিদায় হলো।
মকুসারেং এর বিশ্বাস! সময় চলে আপন গতিতে। এ দিকে আমার বিদায়ের সময় হয়ে এলো। এবার বিদায়ের পালা। অফিস থেকে ষ্টেশন একমিনিটের পথ এমাকে দেখছিনা। তার রুম রান্নাঘর কোথাও নেই।
তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ গুচিয়ে বের হবে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নিচে নামলেই প্রকান্ড দরজা। দেখলাম দরজায় হেলান দিয়ে দাড়ানো। এমার চোখে জল। বললাম এমা তুমি কাঁদছো? আরো বললাম ক্ষমা করবে তোমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ভালো থেকো, বলে এমা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
এমার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে, হঠাৎ নজরে পড়লো বাঁয়ে সিঁড়ির নিচে মকু সারেং দাঁড়িয়ে বিদায় জানাতে এসেছে। বললাম মকু তুমিও? এখানে মকুর চোখেও জল।
বললাম মকু, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। আমি এতদিন যা বলেছি সবই বানানো। কথার কথা। কথাগুলো শেষ করার আগেই মকু আমাকে জড়িয়ে ধরেছ। আবেগের সঙ্গে বললো তুমি আমার জীবনদাতা। তোমার কারণে আমি রক্ষা পেলাম। আমি এগুলো বিশ্বাস করি। মকুকো কিছুতেই বিশ্বাস করানো গেলনা যে, সবই মিথ্যা এবং বানানো।
ওদিকে ট্রেনের সময় হয়ে গেছে, মাত্র দুই মিনিট বাকী। মকুকে বিদায় দিয়ে ফ্যাক্টরীর দরজা অতিক্রম করতে দেখলাম বাঁয়ে বারান্দায় অফিস কর্মচারী এবং শ্রমিকেরা হাত নাড়াছে। বিদায় জানাচ্ছে। ক্ষুদ্র একজন কর্মচারী হিসাবে এতটা আড়ম্বর আশা করিনি। মনে পড়লো শরৎন্দ্রের সেই অমর বাণী ‘‘সম্পর্কের গভীরতা কখনো কালের স্বল্পতা দিয়ে মাপা যায়না’’। ট্রেনে বসলাম। ছাড়লো লন্ডনের উদ্দেশ্যে। চোখে ভেসে উঠলো শত স্মৃতি, শত অনুভূতি। নিজের অজান্তে-ই দুচোখ বেয়ে পানির ফোঁটা পড়তে লাগলো। তাইতো, মিলনের আলোকে যে মমতার কথা জানতে পারিনি বিচ্ছেদের অন্ধাকারে তা-ই যেন শুকতারার মত ফুটে উঠছে।

-লন্ডন থেকে

সৌজন্যে: জাহাঙ্গীর আলম শোভন