Skip to content Skip to footer

মিশর- এক অবাক পৃথিবী

লিখেছেন ঋতা বসু

বারো বছর আগে চার বন্ধু মিলে ইজিপ্টে এসেছিলাম আর এক বন্ধুর বাড়ি। সে ভ্রমনে দেখা যতটা হা হা হি হিও ততটাই। স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম দড়ি ছেঁড়া গরুর মত।আফ্রিকার আরবভাষী দেশকে মনে হত কোন একটা আধা ইওরোপীয়ান শহর। স্থানীয় পোশাক থাকলেও নারী পুরুষ কারো মধ্যেই হিজাব ও দাড়ির বাহুল্য ছিল না। তারপর বারো বছরে নীলনদে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ইজিপ্ট অশান্ত হয়েছে বারবার। দূর থেকে সে খবর পেতাম। ২০১১ র পর থেকে নাশকতা বেড়ে গিয়েছে অনেকটা।জঙ্গীরা পিরামিড ভেঙ্গে দেবার হুমকি দিয়েছে। কায়রো মিউজিয়মে ভাংচুর হয়েছে। সব মিলিয়ে সারা পৃথিবীর সঙ্গে ইজিপ্টের সমাজের ছবিটাও বদলে গিয়েছে অনেকটা। ইজিপ্টের অন্যতম আয়ের উৎস পর্যটন একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে আবার তা শুরু হয়েছে। এইরকম সময়ে আবার ইজিপ্ট দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চাইল না। তবে নানা দিক বিবেচনা করে এবার দলের সঙ্গে আসাটাই ঠিক হল। এইভাবে আসার সুবিধে আর অসুবিধে দুইই আছে।থাকা খাওয়া চলাফেরা নিয়ে কোনরকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই দ্রষ্টব্য দেখে বাড়ী ফেরা। তবে নতুন জায়গায় একা ভ্রমণের যে উত্তেজনা অজানার মুখোমুখি হবার অনিশ্চয়তায় যে বুক ধুকপুক এসব হবে না জেনেই এবার ইজিপ্ট ভ্রমণে এসেছি। তা সত্ত্বেও আমরা থাকাকালীনই ঘটল পূর্ব ইজিপ্টের সিনাইয়ে মারাত্মক বম্বিং যা ইদানীং কালের মধ্যে ইজিপ্টের ইতিহাসে সবথেকে প্রাণঘাতী। তার ফলে সে রাতেই ইজিপ্ট তার সীমান্ত ঘেঁষা পূর্ব প্যালেস্টাইনের একটা অংশ একেবারে ধ্বংস করে দিল। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে সাঙ্ঘাতিক উন্নত প্রাণঘাতী সব মারণাস্ত্র।তাই এভাবেই চলবে আঘাত আর পাল্টা আঘাত। মারা যাবে শয়ে শয়ে নিরীহ মানুষ। হয়ত এই কারণেই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে ইজিপ্টের পাঁচহাজার বছরের পুরোন সভ্যতার আশ্চর্য সব নিদর্শন-যা ঝড় জল যুদ্ধ বন্যা ভূমিকম্পকে তুচ্ছ করে অটল ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। যা দেখলে মনে হয় আহা কি দেখিলাম যাহা জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। আরবভাষী ইজিপ্ট আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম মরুদেশ যার তুর্কি নাম মিশর। আমরা মিশর বলতে এতটাই অভ্যস্ত যে লেখার মধ্যে মিশর নামটাই চলে আসে বারবার। বম্বে থেকে মাঝরাতে প্লেন ছাড়ল। যে প্লেনটিতে আমরা এলাম সেটাতে আমরা ছাড়া প্রায় সবাই আরব। গতবার ছিল পশ্চিমী পর্যটকদের ভীড়। আমরা পৌঁছলাম ভোরবেলা। আমাদের গাইড ডালিয়া দক্ষিণ ইজিপ্টের নুবিয়ান ট্রাইবের মেয়ে। লম্বাটে মুখ,বাদামী রঙ,মায়াবী চোখ হিলহিলে শরীর নিয়ে সে ভারি আকর্ষনীয়। তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল একজন ইজিপ্টোলজিস্ট বলে।পরে দেখেছি ইজিপ্ট সম্বন্ধে তার জ্ঞান পাণ্ডিত্য প্রচুর। তবে এখানে বোরখা পরে বেলি ডান্স করতে আসা নর্তকীর মত গল্প বলা গাইডরাও নিজেদের ঘষামাজা করে ইজিপ্টোলজিস্ট বলে পরিচয় দেয় প্রায়ই। বিশ্রাম নিয়ে সন্ধেবেলা আমরা গেলাম গিজার পিরামিডের সাঊন্ড এ্যান্ড লাইট শোতে। সেদিন বিকেলে আচমকা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে মরভূমির ঠাণ্ডাটা আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। কনকনে হাওয়ায় হাড়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছিল। গায়ের গরম জামা যে যথেষ্ট নয় বুঝতে পেরে যত ভাল বিনোদনই হোক না কেন বসা যাবে না বুঝলাম। তবে এরকম প্রায়ই হয় বলে কম্বল ভাড়া দেবার ব্যাবস্থা আছে দেখে বেঁচে গেলাম। ইজিপ্টের প্রাচীন ইতিহাস পিরামিড ও স্ফিংক্সের জন্মকথা আলো বাজনা ভাষ্যপাঠের মধ্যে দিয়ে খুব সুন্দর করে বলা হল।

পরদিন আমরা গেলাম কায়রো থেকে তিনশো মাইল দূরে ইজিপ্টের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়ায়। ভূমধ্যসাগরের বুকে লকেটের মত দোদুল্যমান জায়গাটির শোভা দেখে আলেকজান্ডার মুগ্ধ হয়ে নগর গড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ৩৩২ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে। তিনি সশরীরে আর ফিরতে না পারলেও তাঁকে তাঁর সাধের নগরীতেই সমাধিস্থ করা হয়। সেই সমাধি অবশ্য আধুনিক আলেকজান্দ্রিয়ার ইট কাঠের আড়ালে হারিয়ে গেছে। আলেকজান্ডারের পর শাসন ভার গেল তার সেনাপতি টলেমীর হাতে। টলেমীদের তিনশো বছরের শাসন কালে আলেকজান্দ্রিয়া জ্ঞান বিজ্ঞান সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় টলেমীর সময়ে হাতে লেখা হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি দিয়ে যে সমৃদ্ধ লাইব্রেরীটি গড়ে তোলা হয়েছিল দু দুবার তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল মানুষের অজ্ঞতা ও অহংকার। তৃতীয় খৃষ্টাব্দে খ্রিষ্ট ধর্মের মহিমা ঘোষণা করে খৃষ্টান শাসনকর্তা বললেন-জ্ঞানের শেষকথা বাইবেলেই আছে। বাকি সব বই শয়তানের লেখা। অতএব পুড়িয়ে দাও। ১৪৫৩ সালে তুর্কি আক্রমণের সময়ে ঠিক এই কথাটাই বলা হল-কোরানের বাইরে জানার কিছু নেই। অতএব দ্বিতীয়বার কপাল পুড়ল লাইব্রেরীর। যুগে যুগে এই ভাবেই মুক্ত চিন্তা জ্ঞান মৌলবাদের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়েছে বারবার। তবু মানুষের শুভবুদ্ধিকে এত সহজে হার মানানো যায় না বলেই আলেকজান্দ্রিয়ার সেই পৃথিবী বিখ্যাত লাইব্রেরীটির স্মৃতিতে তৈরি হয়েছে আজকের আধুনিক লাইব্রেরী। এটি শুধুমাত্র পাঠাগার নয় আধুনিক পৃথিবীতে যতরকমভাবে জ্ঞান আহরণ করা যায় তার এক বিপুল ভাণ্ডার।

বাড়িটির স্থাপত্যও দেখার মত। সূর্যের আলো আসার এমন ব্যাবস্থা যাতে বইয়ের ক্ষতি হবে না অথচ পাঠকক্ষ কোনরকম কৃত্রিম আলো ছাড়াই যথেষ্ট আলোকিত হয়ে আছে। পুরনো পাণ্ডুলিপি ছবি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো গ্যালারি করিডোর পার হয়ে আমরা বাইরে এলাম। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রীক রানী ক্লিওপেট্রা জুলিয়াস সিজার ও মার্ক এ্যান্টনির ত্রিভুজ প্রেমের বিখ্যাত সিনেমা আমরা সবাই দেখেছি। আলেকজান্দ্রিয়া নামের মধ্যেই সেই মোহময়তা।সিনেমার কারনে সেই এলিজাবেথ টেলার রূপী ক্লিওপেট্রা আমাদের মনে সব থেকে বেশি দাগ কাটলেও তিনি কিন্তু অন্য আরও ষোলজন ক্লিওপেট্রার মধ্যে একজন।যাই হোক সেই বিখ্যাত গ্রীক রানী ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রীক আমল শেষ হয়ে রোমান যুগ শুরু হল। অনায়াসেই প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী বলে আমরা সবসময়ে তার মূল্য বুঝি না। ইজিপ্ট দেখলাম আমাদের থেকেও উদাসীন এ ব্যাপারে। রোমান সেনাপতি পম্পিয়ের নামে একটি মাত্র গ্রানাইট পাথরে তৈরি ৭৫ ফুট উঁচু থাম দেখতে গিয়ে সেটা বুঝতে পারলাম। বাকি ১১০টা থাম বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ভগ্নস্তূপ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সামনে দুটি স্ফিংক্স আর শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তৈরি করা মাটির তলায় কয়েকটা মাত্র সুড়ঙ্গ অবশিষ্ট আছে।দুহাজার বছরেরও বেশি পুরোন এই হেরিটেজ ক্ষেত্রর গা ঘেঁসে অজস্র বহুতল বাড়ী। পম্পেই পিলার দেখাই যাবে না এই দেশলাই বাক্স গুলোকে বাদ দিয়ে। প্লাস্টারবিহীন বাড়ী করমুক্ত বলে প্রতিটি বাড়ীই ছাল চামড়া ছাড়ানো কুৎসিত দর্শন। দেখার কথা ছেড়ে দিলেও এইরকম জায়গায় বাড়ী তৈরির অনুমতি দেওয়াটাই আশ্চর্যের। ফেরার পথে আমরা ইজিপ্টে আবিষ্কৃত মানব সভ্যতার প্রথম কাগজ প্যাপিরাস তৈরির প্রণালী দেখলাম সরকারী ব্যবস্থাপনায়। ত্রিকোণ পিরামিড অমরত্বের প্রতীক। সুপ্রাচীন এই উদ্ভিদের কান্ডটিও দেখলাম তিনকোণা। ইজিপ্টের অন্যতম আকর্ষন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হল পিরামিড। আধুনিক মানুষ তার সমস্তরকম কারিগরী জ্ঞান প্রয়োগ করেও পিরামিডের তৈরির রহস্য আজও উদ্ধার করতে পারেনি। অনুমানের ওপর নির্ভর করেই তার নির্মান কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়।প্রায় পাঁচহাজার বছর আগে কি করে তারা বানালো মরুভূমির মধ্যে এই অতিকায় স্থাপত্য-সেটা যেমন আশ্চর্যের কেনই বা বানালো সেটাও ততোধিকই অদ্ভুত। আগের দিন অন্ধকারে আলো আর শব্দের মধ্যে একরকম লেগেছিল। আজ ভোরের আলোয় গিজার তিনটি অক্ষত পিরামিড তার সমস্ত রহস্য নিয়ে আমাদের চোখের সামনে ধরা দিল।পিরামিডের সামনে মানুষের মুখ আর অমিতবল পশুশক্তির মিলিত চেহারার স্ফিনক্স বসে আছে নিথর হয়ে সামনের দিকে তার স্থির পাথুরে দৃষ্টি মেলে।কত হাজার বছরের ইতিহাসের সে নীরব সাক্ষী। প্রথম পিরামিডটি বানিয়েছিলেন প্রথম রাজবংশের ফারাও মেনেস খ্রিষ্টের জন্মের ৩২০০ বছর আগে। ইনিই সেই বিখ্যাত রাজা যিনি উত্তর দক্ষিণ মিশরকে এক করে যে শাসনব্যাবস্থার পত্তন করেছিলেন মোটামুটি সেটাই চলেছিল পরবর্তী ৩০০০ বছর। সাকারা দাসুর ও মেম্ফিস প্রাচীনতম স্টেপ পিরামিড। গিজা থেকে সেটা বেশ দূরে। সেদিন কায়রোতে দূষণের মাত্রা কম ছিল বলে আমরা গিজা থেকে এই ত্রয়ীকে দেখতে পেলাম। আজ আমরা প্রাচীন ইজিপ্টের তিন হাজার বছরের সভ্যতার নিদর্শন দেখার জন্য বারবার করে সেখানে ছুটে যাই।এত অসাধারণ তার বিশালত্ব সৌন্দর্য আর টিকে থাকার ক্ষমতা অথচ সেই ইজিপ্টেরই সাধারণ ঘর বাড়ী এমনকি রাজা রাজড়াদের প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ কনাও চোখে পড়ে না।এমনকি ইতিহাস বিখ্যাত প্রাচীন ইজিপ্সিয়ান শহরগুলোরও কোথাও কোন চিহ্ন নেই। যাদের হাতে তৈরি পিরামিডের কাছে সময় হার মেনেছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের স্থাপত্যের কোন চিহ্ন থাকবে না এটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয় কি? অথচ ইজিপ্টের মাটি খুঁড়লেই বেড়িয়ে আসে সে যুগের কবরখানা। হাজার হাজার কবর আর তার মধ্যে সযত্নে রাখা আছে প্রতিদিনের জীবনের অজস্র জিনিস। এর পেছনে একটাই কারন প্রাচীন ইজিপ্টের মানুষেরা বর্তমান জীবনটাকে গুরুত্বই দিত না। তাই তাদের বাড়িঘর প্রাসাদ সবই তৈরি হত সাধারণ কাদামাটি ইট দিয়ে।সেগুলো কালের নিয়মে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।সমাধিগুলো তৈরি হত অত্যন্ত উৎকৃষ্ট পাথর দিয়ে ইজিপ্টে যার অভাব ছিল না। তাছাড়া সমাধিগুলো মাটির নিচে হত বলে ঝড় জলের ঝাপটা থেকেও বেঁচে থাকত। প্রাচীন ইজিপ্টের যাবতীয় খবর পাওয়া গেছে হাজার হাজার বছরের পুরোন এই কবরগুলো আর তার মধ্যে পাওয়া অজস্র জিনিস থেকে। মৃত্যু ,মৃতদেহ যে কোন জাতিকে এভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে তা প্রাচীন মিশরকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ক্রমশ এই জীবনের থেকে মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে চর্চা প্রাচীন মিশরীয়দের জীবনে জাঁকিয়ে বসছিল কারন তাদের মনে হত মৃত্যুর পরের জীবনটাই আসল জীবন। সেইজন্য মমি তৈরির কাণ্ডকারখানা আর কবরের ব্যাপারটাও সাঙ্ঘাতিক গুরুত্ব পেতে লাগল। সবথেকে প্রাচীন যে সমাধিগুলো আবিষ্কার হয়েছে সেগুলো খুব সাধারণ ছিল। বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে মৃতদেহটিকে মাদুরে জড়িয়ে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রাখা হত। সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র আর খাদ্য পানীয় রেখে দেওয়া হত। তারপর তা বালিমাটি দিয়ে চাপা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত।তখনও তারা পিরামিড বানাত না। কিন্তু এভাবে সমাধিস্থ করার ফলে একটা প্রকাণ্ড অসুবিধে দেখা দিল। ঝড়ে বালি উড়ে গিয়ে মৃতদেহটা বাইরে বেরিয়ে আসত। ফলে মৃতদেহটা অচিরেই নষ্ট হয়ে যেত। এরপর থেকে ক্রমশই দেখা গেল সিংহাসনে বসামাত্রই রাজাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো নিজেদের সমাধি তৈরি করা এবং বলাবাহুল্য তার সঙ্গে দামি জিনিসের তালিকাও লম্বা হচ্ছিল। ফলে রাজা এবং ধনীদের সমাধি ক্ষেত্র গুলো চোর ও লুটেরাদের কাছে সোনার খনি হয়ে উঠল।শেষে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সমাধিগুলো আরও সুরক্ষিত না করলে চলছিল না। এরপর উত্তরোত্তর আরও নিখুঁত আরও বিশাল হয়েছে পিরামিড। ইন্টারনেটের কল্যাণে বোতাম টিপলেই এক মুহূর্তে পিরামিডের নাড়ী নক্ষত্র জানা যায়। তার বিস্তারিত ইতিহাসে আমি যাচ্ছি না। শুধু ভাবি এই অতিকায় কর্মকান্ড সম্ভব করানোর জন্য হাজার হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন। শুধু গ্রেট পিরামিড করতে কুড়ি বছর ধরে একলক্ষ শ্রমিক দরকার হয়েছিল। কত উদ্বৃত্ত শস্য থাকলে এতগুলো লোকের খাওয়া পরার ভার নেওয়া যায়?প্রয়োজন মেটাবার জন্য উন্নত সেচব্যাবস্থা করে জলের বিলিবন্টন ,দক্ষ প্রশাসন সবই তারা সম্ভব করেছিল ইতিহাসের সেই আদি পর্বে। সেইসময়েই তারা লোহা তামা সোনা রূপো আবিষ্কার করে প্রয়োগের দক্ষতায় আধুনিক মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বজ্রপাত আটকাবার জন্য গ্রেট পিরামিডের মাথার ওপর লোহার দণ্ডটা দেখলে সেটা বোঝা যায়। বেশ কিছু পিরামিড ভাঙ্গাচোরা পাথরের স্তূপ হয়ে গেলেও যে তিনটি অক্ষত রয়েছে সে গুলোর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত রাজা কুফুর পিরামিড। পিরামিড শব্দট গ্রীক। এর মানে খুব উঁচু। উঁচু মানে কত উঁচু সেটা বলতে লোভ হচ্ছে.২৮০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে ২,৩০,০০০০পাথর যা ওজনে ৬৮ থেকে ৯৪০০ মন পর্যন্ত তা দিয়ে ১৩ একর জায়গা জুড়ে এটা তৈরি হয়েছিল। পিরামিডের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় জাগে দুটি কারনে- এক এরা কি ভাবে সেই সুদূর আসোয়ান থেকে নীল নদের ঢেউয়ে বিশাল পাথরের চাঙ্গড়গুলো ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে।কোনরকম মিশ্রণ ছাড়া পাথরের সঙ্গে পাথর জুড়ে বানিয়েছে আকাশছোঁয়া স্তাপত্য।যার নিখুঁত মাপজোক কারিগরিকে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করে আজকের উন্নত দুনিয়া। দ্বিতীয় কারণটি হল কেনই বা তারা এগুলো বানালো? মিশরীয় সভ্যতায় মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতি গভীর বিশ্বাসের ফলে ইজিপ্টের ইতিহাস সারা পৃথিবীর কাছেই এক গভীর রহস্য। প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতাই বিস্ময়কর।কিন্তু প্রাচীন ইজিপ্টে মৃত্যুর পরেও দেহকে অক্ষত রাখার চেষ্টা সেই জীবনের জন্য ভোগ বিলাসের সমারোহের ব্যাবস্থা করে অমরত্বের সাধনার মধ্যে যে নাটকীয়তা এমনটি আর কোথাও নেই। আচমকা এই দর্শন কোথা থেকে এল? তাদের এই বিশ্বাসের মূলে আছে নীল নদ। চারদিকের রুক্ষ মরুভূমির মধ্যে নীল নদীই একমাত্র সবুজ শ্যামল প্রাণপ্রবাহ।মরুভূমির থেকে আশ্চর্য ভাবে নীলনদী যুগ যুগ ধরে মিশরকে রক্ষা করে আসছে। তাই প্রাচীন মিশরের জীবনে নীলনদীর প্রভাব ছিল সাংঘাতিক। গরমের সময়ে সেই নদী প্রায় মৃত।বন্যার জলে তার পুনর্জন্ম ঘটে। হাজার বছর ধরে এটি একটি অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। দুই মিশরের প্রচণ্ড রুক্ষ হাওয়া আর প্রায় বৃষ্টিহীন প্রাকৃতিক পরিবেশ। মাথার ওপর মোটামুটি সারা বছরই দিগন্ত বিস্তৃত নির্মল আকাশ আর প্রখর সূর্য।প্রতি সন্ধ্যায় যে জ্বলন্ত সূর্য মলিন হতে হতে অদৃশ্য হয় পরদিন সে আবার প্রচণ্ড তেজে ফিরে আসে।সন্ধেবেলার মৃত্যু সাময়িক বিরতি মাত্র সকালেই নবজীবন। এই বিশ্বাস থেকেই মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ধারনা মিশরের মাটিতে জাঁকিয়ে বসেছিল। ১২ বছর আগে গ্রেট পিরামিডের গর্ভস্থলে ভুলভাবে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এবার ডালিয়ার পরামর্শমত অপেক্ষাকৃত ছোট কুইন পিরামিডের সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে যেতে কোন কষ্ট হল না। তবে না নামলেও কোন ক্ষতি ছিল না।ধনরত্নে পূর্ন ফারাওয়ের শেষশয্যার যে কল্পনা তার সঙ্গে কোন মিলই নেই। শুধু মানুষ প্রমান গর্তটা দেখে বুঝলাম এখানেই ছিল কারুকার্য করা কফিন রাখার বাক্স। গ্রেট পিরামিডে ঢুকিনি তবে শুনেছি তার ভেতরের চেম্বারটি নাকি দেখবার মত। পিরামিড নিয়ে ইতিহাস আর কল্পনা মেশানো কত গল্প সিনেমা তৈরি হয়েছে তবু এর আকর্ষন একটুও কমেনি। এরপর আমরা গেলাম কায়রো মিউজিয়মে। ইজিপ্ট থেকে পশ্চিমের দেশগুলো বিশেষ করে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স প্রচুর পরিমাণে প্রত্নতাত্বিক সামগ্রী নিজেদের দেশ নিয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও ইজিপ্ট একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী প্রচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী বলে মিউজিয়মে যা রয়েছে তা দেখে শেষ করা যায় না। জঙ্গী হানায় শুনেছি অনেক কিছু নষ্ট হয়েছে তবে আমরা দেখে কিছু বুঝলাম না। আধুনিক এবং সুরক্ষিত একট নতুন মিউজিয়ম তৈরি হয়েছে। অনেক জিনিস সেখানে চলে গেছে বলে কিছু তাক খালি ছিল। ভাগ্যিস টুট আখ আমানের সমাধির জিনিসপত্রগুলো ছিল-দেখে বাক্যহারা হয়ে যাবার আনন্দ আবার উপভোগ করলাম।মাত্র আট বছর বয়সে বালক রাজা টুটানখামুন রাজা হন। ১৮ তে তার মৃত্যু হয়। মাত্র ১০ বছর তিনি রাজত্ব করেছেন কিন্তু সবথেকে বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর সমাধি ক্ষেত্রের রত্নভাণ্ডারটির জন্য। আজকের দিনে আমরা কল্পনাই করতে পারব না প্রাচীন মিশরে মৃত্যু যে কোনভাবেই দুঃখের ঘটনা ছিল না। তা সে যতই অকাল অসময়ে হোক না কেন। সেইজন্যই একটি দশ বছরের বালকও সিংহাসনে বসামাত্রই তার মৃত্যুপরবর্তী জীবনের কথা ভাবতে পারে বা প্রস্তুতি নিতে পারে।আর সেই ভাবনাও যে কি রাজসিক ব্যাপার টুটানখামুনের সমাধি দেখলে তা বোঝা যায়। ভাগ্যিস এর সমাধির ওপর আর একজন রাজা সমাধি গড়ে তুলেছিলেন বলে চোরেরা এর সন্ধান পায়নি। তাই আমরা একদম অক্ষত অবস্থায় সমস্তটা দেখতে পাই। নিরেট সোনার খাট সিংহাসন দেখে চোখ ঝলসে গেল। সোনার কোলাপুরি চটিটা যে কি ফ্যাশনেবল আর গয়নার বাহারের কথা কি বলব। কি যে অপূর্ব নকশা।সোনা রূপো দামি পাথর দিয়ে তৈরি গয়না গুলোর থেকে চোখ ফেরানো যায় না। এখনকার অনেক গয়নার উৎস যে ওগুলোই তাতে কোন সন্দেহ নেই। সোনার ছাতাটিও অতি অপূর্ব। এ ছাড়া কত যে অজস্র পাত্র,রাজ কর্মচারী ও সেবকদের মূর্তি আরাম বিলাসের উপকরণ রয়েছে তা বলে শেষ করা যায় না। মিশর মানেই মমি।সবারই নিজের চোখে কাছ থেকে ইতিহাসবিখ্যাত ব্যাক্তিদের মমি দেখার দারুণ কৌতূহল।বুকের অপর হাত রাখার কায়দার দেখে পদমর্যাদার ফারাকটা বুঝতে হবে। চার পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই আশর্য দেহ গুলি খুব সামান্য কম্পন বা আলোতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মমির ঘরের জন্য ব্যবহার বিধির কঠোর নির্দেশিকা আছে। সেই বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে লুকিয়ে ছবি তোলা,চেঁচামেচি হট্টগোল,ভয় পাওয়া বাচ্চার কান্নাকাটি সবই চলছিল পুরোদমে। এই ঘরটিতেই সবথেকে বেশি গোলমাল। একটা দুটো মমি সব দেশের মিউজিয়মেই আছে।কিন্তু এখানে একসঙ্গে এতগুলো দেখে কেমন গা শিরশির করে। মৃতদেহ অক্ষত রাখার যে কৌশল এরা আবিষ্কার করেছিল তা সত্যিই অভিনব। প্রথমেই মাথার নিচে দু পাশে দুটো ফুটো করে শরীরের সমস্ত জল বার করে দিত। মুখ দিয়ে বার করে নিত শরীরের বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। অপরেশনের সেইসব যন্ত্রও সাজানো আছে যাদুঘরে। ফসিল হয়ে যাওয়া রাজকীয় কিডনি লিভার ঘিলু ইত্যাদিও কারুকার্য খচিত বড় বড় জারে সযত্নে রক্ষিত -পরে কাজে লাগবে এই বিশ্বাসে। সমস্ত কিছু বার করে দেহটাকে নুনে ডুবিয়ে রাখা হত। তারপর বিশেষ ওষধি আরকে ভেজানো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত নশ্বর দেহ। খাবারদাবার দাসদাসী প্রতিদিনের জীবনের সহস্র খুঁটিনাটির সঙ্গে কফিন বন্দী হত সেই দেহ। মিউজিয়মে ঘুরতে ঘুরতে মনে হল চারদিকেই মৃত্যুর পসরা।শিল্পনৈপূন্য,কারগরি,জ্ঞান বিজ্ঞান সমস্তই নিবেদিত মৃত্যুর পরের জীবনটার পায়ে যেন এই জীবনটার কোন দামই নেই। এরপরের গন্তব্য মাত্র ১৫০০ বছরের পুরোন খান আল খালিলির বাজার। নানারকমের খেজুর ইজিপ্সিয়ান মশলা শিল্পসামগ্রীতে ভর্তি।রাস্তার ধারে কাফেতে আড্ডা চলছে জোর কদমে। এ দিক দিয়ে বাঙ্গালির সঙ্গে তার বেজায় মিল। শুনেছি আমাদের গঙ্গার ঘাটের কথকঠাকুরের মতই বিখ্যাত ছিল কায়রোর কাফের গল্পবলিয়েরা।দিনের সঙ্গে অন্য বিনোদনের পাল্লা ভারি হওয়াতে কথকঠাকুরের মত তারাও প্রায় অদৃশ্য। এই বাজারটাতে আরও ঘুরে বেড়িয়ে কাফেতে আড্ডাবাজ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আর একটু সময় কাটাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পরদিন সকালেই আমাদের আসোয়ানের উড়ান অতএব হোটেলে ফিরতে হল নির্দিষ্ট সময়ে। আসোয়ানের ছোট্ট এয়ারপোর্ট থেকে আমরা সোজা এলাম ক্রুজে। এখানেও ১২ বছর আগের জৌলুস একটু ম্লান বলে মনে হল। সে সময় বিলাস বজরায় ভরা ছিল নীল নদী। এবার সার সার অন্ধকার নিস্তব্ধ জনহীন বজরা গুলো দেখে কষ্ট হল। পরের তিনদিন এখানে থাকা।বিলাস বজরা দেখে দলের অনেকেই হতাশ। খুবই সাদামাটা।আমার আগেরবারের দেখা ক্রুজের সঙ্গে কোন তুলনাই হয় না। যাই হোক- নির্দিষ্ট ঘরে মালপত্র রেখে মোটর বোটে করে যে জলযাত্রায় গেলাম তার আশ্চর্য সৌন্দর্য জীবনেও ভুলব না। একদিকে নুবিয়ান গ্রাম অন্যদিকে মরুভূমি। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নীলনদী। বলতে ভুলে গেছি মিশরের প্রাণ এই নদীর নাইল নামটি কিন্তু গ্রীকদের দেওয়া।মিশরকে তারা নীলনদীর দান বলেই মনে করত। সেই সুদূর অ্যাাবিসিনিয়ার পাহাড় থেকে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ধরে নীল নদী বয়ে এসেছে।সেইজন্য তার চলার পথে অনেকগুলি ছোট ছোট জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজিতে এগুলিকে বলে ক্যাটারাক্ট।প্রথম ক্যাটারাক্টের কাছেই গড়ে উঠেছে আসোয়ান। ক্যাটারাক্টের জন্য এখানে বড় জাহাজ স্টিমার কিছুই যেতে পারে না বলে পাখি ও জলজ উদ্ভিদের স্বর্গ রাজ্য। নদীর একদিকে মরা মাটি বালিতে ভর্তি। অন্যদিক শস্য শ্যামল। মাঝে মাঝে ঝলমলে রঙ করা নুবিয়ান গ্রাম। দূর থেকে দেখেই খুব যেতে ইচ্ছে করছিল। নুবিয়ান মেয়ে ডালিয়া তার উত্তরাধিকারের জন্য বেশ গর্বিত। তার আকর্ষনীয় চেহারা ও কণ্ঠস্বরের মাদকতায় দলের কয়েকজনের চিত্তে বেশ দোলা লেগেছে বোঝা যায়। আর সে যদি হয় গাইড তাহলে তো চোখ বুজে বলাই যায়–আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা-। সেইজন্য বাসে বসে বসেই সাঙ্ঘাতিক দাম দিয়ে তার আনা অখাদ্য খেজুর সবাই কিনল হাসিমুখে। তার ঠিক করা দোকাণেই হত যত কেনাকাটা। তবে তার জন্যই নুবিয়ান গ্রামে আমাদের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হল। সার সার উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নুবিয়ান ছেলের দল। আসোয়ান ড্যামের জন্য একদা যা ছিল নুবিয়া তা আজ নিশ্চিহ্ন।বারবার উছেদ হতে হতে নুবিয়ান গোষ্ঠীটার অবস্থা একবারেই হতদরিদ্র। পর্যটনের কল্যাণে ভিক্ষে করাটার হাত থেকে বেঁচেছে এটুকু বলা যায়। উটে চড়ে আমরা নুবিয়ান গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দেখছিলাম খুবই স্বল্প আয়োজনে গ্রামগুলো গড়ে উঠেছে।শুধুই ট্যূরিস্টদের ওপর নির্ভরশীল কয়েকটা নুবিয়ান শিল্পসামগ্রীর দোকান। তারা আমাদের মনোযোগ আকর্ষনের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একটা কোনরকম উপকরণ বর্জিত সাধারণ ঘরে আমরা সবাই বসলাম। সেটাই এখানকার স্কুল। মাস্টারমশাই মজা করে আমাদের আরবী শিক্ষা দিলেন। না বলা বানীটি ছিল-তুমি কিছু দিয়ে যাও। দলের কয়েকজন অবশ্য হৃষ্টমনেই স্কুলের নাম করে সাধ্যমত অনুদান দিল। আসোয়ান বিখ্যাত তার অত্যন্ত উৎকৃষ্ট তুলোর চাষের জন্য। যে ইজিপ্সিয়ন কটন সারা পৃথিবীর আদরের ও ইজিপ্টের বিদেশি মুদ্রা আমদানির একটা প্রধান রাস্তা ইদানীং কালে তার চাষ ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যে পরিমাণ জলে উৎকৃষ্ট উৎপাদন হয় সেটা হচ্ছেনা কারন ইথিওপিয়াও একটি ড্যাম তৈরি করেছে যার ফলে এদিকে জল কমে গিয়েছে।সেই চিরাচরিত রাজনীতি।ডালিয়া বিষণ্ণ মুখে বলল-ট্যুরিজম মার খাচ্ছে,নীলনদে জল নেই তার ওপর টেররিজম। ইজিপ্টে এখন সত্যিই মিরাকল দরকার। ইজিপ্টে জঙ্গী মৌলবাদ যে কতটা সক্রিয় হয়ে উঠছে তা বুঝতে পারি আট থেকে আশি মেয়েদের সবার মাথায় হিজাব দেখে। বারো বছর আগে এটা ছিল না বললেই হয়। সব জায়গার মত মেয়েদের ওপরেই চাপটা বেশি। আর অবদমনের নিয়মই হল এক জায়গায় চাপলে অন্য জায়গায় ফুলে ওঠে।যেখানেই গেছি আরব কিশোরীর দল অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে কখনও বা উপেক্ষা করেই আমাদের ঘিরে উছ্বসিত হয়ে ছবি সেলফি তুলেছে।উছ্বাসের কারন অবশ্য আমরা যে নই তা পরে বুঝলাম।দুর্বোধ্য আরবি ভাষার মধ্যে কতগুলো পরিচিত নাম শাহরুখ,করিনা ঐশ্বরিয়া,অমিতাভ শুনে বুঝলাম আমরা দেশোয়ালি হবার সূত্রে এদের গৌরবের ভাগীদার। এগুলোই একমাত্র যোগসূত্র।ভারত নয় শেষ পারানির কড়ি সেই বলিউডই। আমাদের দেশের চোদ্দ পনেরো বছরের কিশোরীদের মধ্যে কিন্তু এমন বাঁধনহীন ছায়ার মায়া দেখিনি। তারা অচেনা লোকজনদের নিয়ে এতটা প্রগলভও হয়না। আসোয়ান থেকেই যেতে হয় আবু সিম্বাল।মমি পিরামিড সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার ইজিপ্ট আসার প্রধান কারনই হল আবুসিম্বাল। প্রাচীন মানুষের কীর্তিকে অক্ষয় রাখার জন্য আধুনিক মানুষের কাণ্ডকারখানা কোনটা কোনটার থেকে ছোট নয়।জীবনে দুবার এমন জিনিসের মুখোমুখি হব এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।রাত সাড়ে তিনটেতে আমরা রওনা দিলাম।মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাত্রা।দক্ষিণ ইজিপ্টের এই জায়গা যার খানিকটা আবার এখন সুদানের অংশ সেই প্রাচীন কাল থেকেই সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল নানা কারনে। প্রথমত এর আকরিক সম্পদ ও পাথর,দ্বিতীয়ত এটাই ছিল প্রধান বাণিজ্যিক পথ তৃতীয়ত এখানকার পরিশ্রমী শক্ত সবল মানুষদের দাস হিসেবে ব্যবহার। ৩২৫০ বছর আগে রাজা দ্বিতীয় রামাসিস নীলনদীর বাঁদিকে পাহাড় কেটে এই বিশাল মন্দিরটা বানান। যখন আসোয়ান ড্যাম তৈরি হল তখন দেখা গেল ড্যামের জলাধারেই সমাধি ঘটবে এই আশ্চর্য মন্দিরটির। তখন ৫৫টি দেশ মিলে ইউনেস্কোর সাহায্যে কুড়ি বছর ধরে ১৫০০০টন পাথর ১০৩৬ ব্লকে কেটে নম্বর দিয়ে আবার মন্দিরটা গড়া হয়েছে। এই কাজটা করতে গিয়ে আশে পাশের ৩০০,০০০টন পাথর কেটে সরানো হয়েছে মন্দিরটাকে একদম আগের চেহারা দেবার জন্য। এ যে কি বিশাল কাজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এর আগের বার আবু সিম্বালের মত বিখ্যাত নয় অথচ চেহারা চরিত্রে সমান গুরুত্বপূর্ন ফিলাই মন্দির দেখতে গিয়েছিলাম মোটর বোটে করে। হাই ড্যামের জন্য ক্রমশ সে মন্দিরটিও জলের তলায় চলে গিয়েছিল এবং ষাট বছর ধরে সেখানেই ছিল।তারপর এটিরও পুনর্জন্ম ঘটে।শিল্প সৌন্দর্যের দিক দিয়ে ফিলাই আমার মনে বেশি দাগ কেটেছিল। কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে সাহায্যকারী দেশ গুলিকে ইজিপ্ট একটি করে উদ্ধার হওয়া মন্দির উপহার দিয়েছে। আসোয়ান হাই ড্যামের জন্য আরও কত স্থাপত্য,ঐতিহাসিক স্মারকের যে জলসমাধি ঘটেছে তার কোনদিন পুরো হিসেব পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় রামাসিস রাজত্ব করেছিলেন ৬৯ বছর। রাজত্বের আধাআধি সময়ে তিনি ১০০ ফুট উঁচু ১২০ ফুট চওড়া এই বিশাল কর্মকান্ডে হাত দেন। মন্দিরের প্রবেশ মুখে ৬৭ ফুট উঁচু চারটি মূর্তি-উত্তর দক্ষিণ ইজিপ্টের সর্বময় কর্তা দ্বিতীয় রামাসিস। তাঁর পাশে পুরোহিত, বাজ রূপী সূর্য ভগবান এদের সঙ্গে নেফারটারি আর পায়ের কাছে তাদের ছেলে মেয়েরা। রাজাদের রাজনৈতিক কারনে হামেশাই বিয়ে করতে হত। রামাসিসেরও অনেকগুলি বউ ছিল। কিন্তু তিনি মন্দির গড়েছিলেন শুধু তার প্রিয়তমা স্ত্রী নেফারটারির জন্য নিজের মন্দিরের পাশে। হাই ড্যামের ফলে বিশাল এক লেক তৈরি হয়েছে। তখনকার প্রেসিডেন্টের নামে এর নাম লেক নাসের। মন্দিরের সামনে বসে লেকের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এখান থেকে ২০০ ফুট দূরে ১০০ ফুট জলের নিচে ছিল আসল মন্দির। প্রায় সমস্তটাই অক্ষত রেখেছে আধুনিক প্রযুক্তি। প্রায় বললাম কারন বছরে যেদিনটায় সূর্যরশ্মি দ্বিতীয় রামাসিসের কপালে এসে পড়ত তার থেকে দুদিন পিছিয়ে গেছে। যেহেতু নিজের চোখে দেখিনি তাই বলতে পারব না শুনলাম রাজার কপালে এসে পড়ত সূর্যের আশীর্বাদ , এখন পায়ে এসে পড়ে।এটুকু ছাড়া সব অবিকল। ইজিপ্টের প্রতিটি মন্দির প্রতিটি ছবি মূর্তি লেখা দেখে অবাক হতে হয় এতটাই সমৃদ্ধ এর প্রাচীন ইতিহাস। উঁচু কারুকার্য করা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দির এডেফু দেখেও অবাক হয়েছি কিন্তু কমম্বোর দুটি জিনিস খুব অদ্ভুত বলে বিশেষ করে মনে দাগ কেটেছে। অতিকায় এক কুয়ো যা কিনা গ্রীক ফারাওদের আমলে আবিষ্কৃত বিখ্যাত নাইলোমিটার। কুয়োর ভেতরে দাগ কাটা আছে। নীল নদীর জলের উচ্ছ্বাস এখানে আছড়ে পড়ত। তখন সেই জলের ওঠা নামা দেখে প্রজাদের কাছ থেকে জলের ট্যাক্স নেওয়া হত। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কতগুলি কুমিরের মমি। দেখে সুন্দরবনের দেবতা দক্ষিণ রায়ের কথা মনে পড়ল। নীল নদী ছিল মিশরবাসীর প্রাণ।তাকে বাদ দিলে এরা বাঁচবে না। এদিকে তার জলে থিকথিক করছে কুমির। আমরা যেমন প্রিয়েরে দেবতা বানাই তেমনি আবার কালান্তক ভয়কেও ভগবান বানিয়ে তার দয়া দাক্ষিণ্য কামনা করি। কুমির যে সেসময় কতটা গুরুত্বপূর্ন দেবতা ছিল সেটা তাদের মমিগুলো দেখলে বোঝা যায়। নীল নদীর পশ্চিম দিকে আরও দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ন ও অসাধারণ মন্দির লাক্সার ও কারনাকের কথা একটু না বললেই নয়।লাক্সার দেখলাম রাতের বেলা থামের আড়ালে লুকোন মায়াবী আলোতে।। তার ভাঙ্গাচোরা চেহারাটা আড়াল করার জন্যই যে এই ব্যাবস্থা পরে দিনের আলোয় মন্দিরটা দেখে সেটা বুঝেছিলাম।লাক্সারের সঙ্গে লম্বা স্ফিংক্স এ্যাভেনিউ দিয়ে জোড়া ছিল কারনাক মন্দির। পাহাড় কুঁদে বড় মেজ ছোট অজস্র থাম দিয়ে প্রাচীন মিশরের সবথেকে শক্তিশালী দেবতা রা অর্থাৎ সূর্যের মন্দিরটি তৈরি।ডালিয়া দেখাল শতাব্দীপ্রাচীন থামগুলোর গায়ে ক্ষয় রোগ কি ভাবে নিষ্ঠুর ভাবে থাবা বসিয়েছে।কোনোরকমে জোড়াতালি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু কতদিন থাকবে কে জানে। কত মূর্তি কত ছবি কোনটা ফেলে কোনটা দেখি? এত বিশাল কাণ্ডকারখানার সামনে কথা হারিয়ে যায়। আমার শুধু মনে হচ্ছিল আমাদের কোনারকও সূর্য মন্দির।কারনাকের সঙ্গে কি অদ্ভুত ধ্বনি সাদৃশ্য। আর একটি আশ্চর্য জায়গার কথা বলে আমার ইজিপ্ট বৃত্তান্ত শেষ করব সেটা হল ভ্যালি অফ কিং। ভ্যালি অফ কুইনও আছে কিন্তু সেখানে যাওয়া হয়নি। ১০৯০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে মিশরের অর্থনৈতিক অবস্থা পড়তে থাকে। তার অনেক আগে থেকেই পিরামিডগুলো তৈরি হবার পরে পরেই ধনরত্ন লুটপাট একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে রাজারা তাদের ধনরত্ন এবং তার সঙ্গে সমাধিগুলোকে আরও সুরক্ষিত রাখার জন্য আর একটি জায়গার কথা ভাবলেন। এখনকার লাক্সর তখন নাম ছিল থিবস তার পশ্চিম দিকে পিরামিড আকৃতির পাহাড়ের কোলে রাজারা বেছে নিয়েছিলেন তাদের মরদেহ রাখার জায়গা। সবসুদ্ধ ৬৩টি সমাধি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে। সবগুলোই লাইমস্টোন কেটে একই ভাবে তৈরি। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গ তিনটি লম্বা ধাপে ভাগ করা যা ক্রমশই নিচের দিকে নেমে গেছে। পাশে লাগোয়া ছোট ছোট ঘর। অনেকটা নিচে নামলে পর একদম শেষে মমি রাখার কফিন। সুড়ঙ্গের আপাদমস্তক মিশরের পৌরাণিক কাহিনী,মানুষের মৃত্যু পরবর্তী যাত্রা,সূর্য নদী,বাজ শেয়াল সাপ বেড়াল, কুমির ইত্যাদি আরও যত দেবতা যুদ্ধ এবং সে সঙ্গে অনিবার্যভাবে বন্দী ক্রীতদাস এইজাতীয় ছবিতে বোঝাই। আমাদের স্বর্গনরকের হিসেবের মত এখানেও একটা গল্পের ছবি দেখলাম সর্বত্র। মৃত্যুর পর মৃতের হৃদয় তুলাদণ্ডে চাপানো হত।অন্যদিকে থাকে একটি পালক। নির্দোষ হৃদয় হবে পালকের থেকেও হালকা।পুরোহিতরাই জড়িত থাকত এইজাতীয় কর্মকান্ডের সঙ্গে। বলাবাহুল্য কোন ছবিতেই রাজহৃদয় পালকের থেকে ভারী নয়। ছবি ছাড়াও ছবির মত হায়েরোগ্লিফিক্স লেখাতেও সুড়ঙ্গগুলোর সৌন্দর্য বেড়ে গেছে শতগুণ। ১৯২২ সালে বিখ্যাত বৃটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইজিপ্ট বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড কার্টার সারা পৃথিবীতে সোরগোল তুলে তুত আখ আমেনের সমাধি আবিষ্কার করেন। বন্যা বা লুটেরা কেউই একে ছুঁতে পারেনি। পুরো আট বছর ধরে এই সমাধির সমস্ত জিনিস বার করা হয়েছে। একেবারে অক্ষত থাকার কারনে তার ধন সম্পদের পরিমান দেখে সারা পৃথিবী একেবারে চমকে গেছিল। পরবর্তীকালে রোমান খৃস্টান আক্রমণের সময়ে মিশরীয়রা এখান থেকে মমিগুলো বার করে নিয়ে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে রাখত কারণ প্রাচীন মিশরের ধারনা ছিল ধনরত্নের বিকল্প আছে। কিন্তু দেহের আধারটি চলে গেলে প্রাণ আবার জেগে উঠবে কি করে? সেই জন্য ধনরত্ন অদৃশ্য হলেও প্রচুর মমি পৃথিবীর নানা দেশের মিউজিয়মে এখনও দেখতে পাই। পাহাড়ের গায়ে মমি লুকিয়ে রাখার অজস্র খোপগুলো আজও পরিষ্কার দেখা যায়। খুব সম্প্রতি এই ২০০৬ সালেই একটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেখানে পাঁচটি একবারে অক্ষত মমি সুদ্ধ কফিন, বিরাট বিরাট কুড়িটি ফারাও সিল লাগানো পাত্র আবিষ্কার হয়েছে। ভ্যালি অফ কিং ছেড়ে আসার সময় মনে হল চারদিকে কচ্ছপের পিঠের মত উঁচু গোলাকার পাহাড়গুলোর তলায় এখনও কত অজানা সম্পদ লুকিয়ে আছে।আবার হয়ত কোনদিন খবরে আসবে ছবি ও লেখায় সাজানো চার হাজার বছরের পুরোন ফারাওয়ের শেষ গন্তব্যের খোঁজ পেয়েছেন এক গবেষক। মিশর নিয়ে কত গবেষণা হল এবং এখনও পর্যন্ত হয়েই চলেছে তবু যেন এর শেষ কোথা এখনও বলা হয়নি। কয়েকদিন ধরে অনবরত মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস করে মনে হল প্রাচীন ইজিপ্টের এই দর্শনটা যদি জীবনে গ্রহণ করতে পারি তাহলে আমাদের জীবনের সবথেকে বড় মৃত্যুভয় আর মৃত্যুশোক থেকে মুক্তি পেতে পারি সহজে। কিন্তু তাহলে কি এই ধরনীর শ্যামলিমায় যে সৌন্দর্য, যে জোয়ার ভাঁটায় ভুবন দোলে,আমরা হাসি ,কাঁদি-সেই মধুর অপ্রাপ্তির যে রহস্য আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে তার অভাবে এই জীবনটা একেবারে বিবর্ন হয়ে যাবে না?