Skip to content Skip to footer

আপেলের স্বর্গ আলমেতি

২০০২ সাল। জুন মাসের চার তারিখ। কাজাকস্তানের আলমেতি শহরে চলেছে সিআইসিএ-র আলোচনাচক্র। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ উপস্থিত। রাশিয়া, চায়না, ইরান, তুর্কি, ইজিপ্ট ও মধ্য এশিয়ার অন্য অনেক দেশের বড় বড় মানুষেরা এসেছেন বর্তমান পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা, জঙ্গী হাঙ্গামা এসব নিয়ে আলোচনার জন্য আর প্রতিবেশী দুটি দেশে টেনশন কমানো যায় কী করে সেসব বিষয়ে পারস্পরিক মতামত প্রকাশ করে একটা পথ খুঁজে পাওয়া যায় কি না তার চেষ্টায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ঠিক এক বছর আগে আমরা ওই শহরে ছিলাম প্রায় দশদিন। ভ্রমন এর সম্পাদককে জানাতে বললেন তাড়াতাড়ি লিখে ফেলতে। এই হল আমার আলমেতি বেড়ানো নিয়ে লেখার সূচনা পর্ব।
২০০১ সালে জুলাই মাসে কাজাকস্তানে যাওয়ার নিমন্ত্রণ এল। ইউনেস্কোর কাজ সেখানে স্বামীর, আমার নতুন দেশ দেখা। আলমেতি চলেছি। সকল দশটা। প্যারিসে বেশ গরম। বত্রিশ ডিগ্রি হবে। রোদ খুব চড়া। শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টে নির্বিঘ্নে পৌঁনো গেল। ভিড় খুব। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি করে ছাড়বে, তখনই বুঝলাম সংযোগ বিমানটি ইংল্যান্ডে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বসে আছি। পিছনের সিটে অপক্ষোরত এক মহিলার কথা শুনে ফিরে তাকাতেই হল। ‘আপনার সুটকেসটা হয়তো আপনার সঙ্গে নিউইয়র্ক পৌঁছবে না মাদাম- পুরুষ কন্ঠ। মহিল এক গাল হেসে বললেন তাকে কী আছে! আমি পৌঁছলেই হবে। লাগেজই আমাকে খুঁজে বের করবে। ও মা এমনতর কথা তো সচরাচর শোনা যায় না! আলাপ করলাম। আমেরিকান চিত্রশিল্পী। ফ্রান্সে গ্রীষ্মবাস আছে, আছে ফ্লোরিডাতেও। নিউইয়র্কের বাসিন্দা মধ্যবয়স্কা মহিলার মধ্যে একটা সহজ ভাব আলাপ করতে আকৃষ্ট করে। টুকিটাকি গল্প চলছে, ইতিমধ্যে ডাক এসেছে প্লেন ধরার। উড়োজাহাজে উঠেই বুঝলাম চিয়াং মাই শহরতলির দোকান থেকে কেনা অতি পছন্দের সিল্কের কোটটি তাড়াতাড়িতে পড়ে থাকল এয়ারপোর্টেও লাউঞ্জে। এমনিতেই গ্যাটউইকে সংযোগ বিমান পাব কিনা তার দুশ্চিন্তা। তার ওপর আবার সাধের কোট হারানো। আর খেতে দিল কী! ন্যাতানো বাগেত রুটির মধ্যে হ্যাম আর কোল স্ল পোরা স্যান্ডউইচ। মুখে দেওয়া যায় না। আসলে মেজাজটাই খিঁচড়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম। আর ভাবছিলাম আবার কী সংকট এগিয়ে আসছে কে জানে।
গ্যাটউইক এসে নামলাম। সিকিউরিটি চেক আপ হবে। দেখি একজন অফিসার এগিয়ে এসে বলছেন, ‘আপনাদের প্লেনটি এইমাত্র আলমেতির দিকে উড়ে গেল। পর্দায় তাকে আর দেখা যাচ্ছে না- অথছ প্যারিস থেকে এতটা পথ এসে আশ্বাস দিয়ে গেছে, নিশ্চয় সংযোগ বিমানটি পাবেন, আপনাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে ইত্যাদি। আর এখন বোকার মতো মুখ করে শুনতে হল বিমান পনেরো মিনিট আগে ছেড়ে দিয়েছে। গ্যাটউইক যারা এসেছেন তারা নিশ্চয় টের পেয়েছেন অনেকটা পথ হাঁটা খুব জরুরি হয় প্লেন ধরতে বা পরবর্তী প্লেনের জন্য তদ্বির করতে। আলমেতি যাওয়ার পরবর্তী তারিখ ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে যেতে হলে ২৯ জুলাই। তা সম্ভব নয়। আমস্টার্ডাম থেকে এয়ার ফ্রান্স উড়বে পরদিন বেলা দুটোয় রিজারভেশন হয়ে গেল। এখন গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে বসে আছি পরবর্তী পরিবর্তনের জন্য। একজন রাস্তা চুলের বেণী বাঁধা যুবক আমাদের দুশ্চিন্তায় সঙ্গী হওয়ার জন্য বলে উঠল, ‘কাজাকস্তান জায়গাটা কোথায় বল তো? ‘উজবেকিস্তানের কাছে..’ আমার উত্তর। সবজান্তা ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, বড় হাই তুলে ‘তাই বল’।
এই ফাঁকে একটু ভূগোলের দিকে তাকানো যাক ভাবলাম। আলমেতি মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাকস্তানের বড় শহর। রাশিয়ান আমলে নাম ছিল আলমা-আতা। ১৯৯১ সালে কাজাকস্তান সোভিয়েতের হাত ছাড়িয়ে স্বাধীন দেশ। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এ শহর ছিল দেশের রাজধানী। এখন রাজধানী আস্তানা। কাজাকস্তান স্টেপস সেই আদিগন্ত তৃণভূমি আর যাযাবর মানুষের দেশ। উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে চিন, পশ্চিমে তুর্কমেনিস্তান, দক্ষিণে উজবেকিস্তান ও কিরঘিস্তান। প্রাচীন ইতিহাস। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের লেখায় উল্লেখ আছে পারস্য ও আরব দেশের উত্তরে সেই দূরদেশের কথা যেখানে বাস করে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতি, এক বিচিত্র জীবনধারা তাদের। কাজাকস্তানের মানুষদের পরিচয় এ ভাবেই দেখানো হয়েছে। আলমেতি সেই পুরনো দিনের রেশন পথের ওপর দাড়ানো। প্রাচীন সভ্যতার সমন্বয় ঘটেছে বারবার এ দেশে মধ্য এশিয়ার সঙ্গে, অন্যান্য অনেক দেশের মতো। সংস্কৃতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভাবনা চিন্তার বিনিময় ঘটেছে ইউরোপ আর এশিয়ার পুব আর পশ্চিমের সঙ্গে। খ্রিস্টের জন্মেও অনেক আগেই থেকেই এ দেশে এক পুরনো শক্তিশালী সাকা সভ্যতার নাম পাওয়া যায়। আজও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মৃত্তিকা খনন করে পেয়ে যান সেই সময়ের ব্রোঞ্জ বা সোনার শিল্পকাজ। আলমেতি হয়েছিল। তার পরের ইতিহাস ধ্বংসের। কত নাম, অ্যাটিলা দ্য হুন, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং এ দেশের পথ দিয়ে চলে যেতে নিষ্ঠুর ইতিহাস রচনা করে গেলেন। তবে আলমেতি ধ্বংসস্তূপ থেকে বারবার উঠে দাড়িয়েছে অবস্থান, বেশমপথের বণিক ও ভ্রমণকারীদের ক্ষণিক বিশ্রামের শহর। দেখা হবে ভাবতে ভালো লাগছে।
আমস্টার্ডামের বিমান দেরি করে ছাড়ল। সুটকেসের আদ্যোপান্ত বিবরণ আবার বলা হল বিমান সুন্দরীকে। ঠিক পৌঁছে যাবে ভরসা নিয়ে শিপাল এয়ারপোর্টে নামলাম। সুটকেস আসেনি। নিশ্চয় আলমেতি চলে গেছে, জানালেন বিমানবন্দরের কর্মচারী। ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তা থাকলে কী হবে ঘুম হল চমৎকার। সকালে আবার এয়ারপোর্ট, সুটকেসের খবর নেওয়া। ইতিমধ্যে প্যারিস থেকে সান্যালের সহকর্মিণী মিখায়েলা এল হাতে পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে। আমাদের ফোন করে সুটকেস হারানোর খবর পাওয়ার পর এই সতর্কতা। লাগেজে কিছু দেয়নি। বিমান যথারীতি দেরিতে ছাড়ল। তবে বসার জায়গাটি ভালো। পা ছড়িয়ে বসার বিলাসিতা আছে। অনেকটা জায়াগ। খাওয়া দাওয়ার স্বাদ আছে তবে মাঝে মাঝে ভারি দুটো সুটকেস সুদূরে কোথাও পড়ে আছে ভাবতেই মনটা খচখচ করে উঠছে। এত বছর বহু দেশভ্রমণে প্রথম অভিজ্ঞতা। বারবার উল্লেখ করেছি সে জন্যই বোধহয়। উড়োজাহাজ বোঝাই করে ফিরে যাচ্ছে কাজাকস্তানের বাসিন্দারা। রাশিয়ান ভাষার কথাবার্তা কানে আসছে। আর দু ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাব মধ্য এশিয়ার পূর্বতন রুশী শহর আলমেতি। ম্যাপে দেখছি দিল্লি, কাবুল, তেহরান, তাসখন্দ, আরাল সমুদ্রের নীল, কাসপিয়ান সাগর, কিরঘিজস্তান ও উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এসব নামের ওপর দিয়ে বিমান চলেছে। রাত কাটল আধা ঘুমে। অবশেষে আলমেতি।
আলমেতি কথাটার অর্থ হল আপেলের দেশ। পাহাড় আর নদী দিয়ে ঘেরা এই উপত্যকা শহওে প্রচুর আপেল ফলে জুলাই-আগস্টে। সেই থেকেই এই নাম। উড়োজাহাজ নামছে। বহু শহরের একটি নিজস্ব প্রতীক আছে যাকে বলা যায় ভিজিটিং কার্ড আর কি। প্যারিসের যেমন আইফেল টাওয়ার মস্কোর ক্রেমলিন ইত্যাদি। আলমেতির প্রতীক নিশ্চয় পাহাড়ের সারি। সারা শহর ঘিরে রেখেছে আলাতো বা মেচেতা পাহাড়। মাঝখানে গোল বাটির মতো শহর। কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখি বরফ ঢাকা পাহাড়চূড়ায় উদিত সূর্যের ফিকে কমলা রং ছড়িয়ে গেল। পাথরের চাঁই, তার গায়ে রুপোলি সুতোর মতো নদীরেখা, পাইন গাছের সারি। অবশেষে পাহাড় ছুঁয়ে যেন প্লেন নামল মাটিতে।
এয়ারপোর্টে পুলিশ প্রহরা রাশিয়ান আমলের মতোনই। কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে বেরতেই দেখি আমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। বিদেশে গাড়িচালকইে আপনজন মনে হয় তখন। কাজাক মুখের তরুণ পুলিশ ছেলেটি কপালের টিপের দিকে তাাঁকিয়ে হেসে বলল, ইন্দিয়া! সুটকেস না পাওয়া দুঃখটা একটু কম বোধ করলাম ওই সময় যেন। কত লোক দাঁড়িয়ে এত সকালেও। ট্যাক্সি ট্যাক্সি ফিসফিস আওয়াজ শুনছি, নো থাংকু য়ু, ও মা উল্টে হেসে বলছে নো থ্যাংক য়ু, আমরা কাজাকস্তান হোটেলের দিকে চলেছি। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত। দুধাওে দীর্ঘ সবুজ গাছের সারি। গাড়িচালক অন্দ্রেই বলল, ইতিহাস আছে এ শহরের। রাজা আদেশ দিয়েছিলেন একটি কওে গাছ পুঁতলে ভালো দক্ষিণা মিলবে। মানুষজন এগিয়ে এল বৃক্ষরোপণ কাজে। অজান্তে ঘটে গেল সবুজের অভিযান। এই পল্লবিত বনবীথির সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দিকে তাকিয়ে মনে মনে সেলাম জানালাম সেই নাম না জানা সম্রাটের প্রতি। কখনও ধবধবে সাদা প্রাসাদ, নীল আলোর বর্তিকা, মাথায় লৌহমিনার- ঘুমন্ত শহরে ঝমঝম বৃষ্টি। কাজাকস্তান হোটেলটিতে প্রাচীন প্রাসাদের সৌন্দর্য। ছিপছিয়ে মেয়েটি অত রাতে হোটেল ডেস্কে সজাগ। আমাদের চব্বিশ তলার ঘরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। জানালা খুলে দিতেই দেখি পাহাড়ের সারি। তারপর বিছানায় আছড়ে পড়ে ঘুম।
পরদিন সকালে প্রাতরাশের পর লবিতে বসে আছি। ইউনেস্কোর প্রতিনিধি লায়রা এল দুজন তরুণীকে নিয়ে। বেছে নিতে হবে কে আমার গাইড হবে। কী মুস্কিল! আইনুর আর গালিয়া দু জনেই কি সুন্দর দেখতে। প্রথম জনে মুখে তুর্কি ছাপ। দ্বিতীয়জনের চোখ মঙ্গোলীয় ধাঁচের। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি আন্তর্জাতিক ইতিহাসের ছাত্রী গালিনাকে বেছে নিয়েছি ততক্ষণে মনে মন্ েদেখে মনে হয় কিশোরী। বেলা দুটোয় অ্যাল্যা এল মা লায়লার সঙ্গে। আমাড়ের গাড়ি করে ঘুরিয়ে শহর দেখাতে অনেক জপিয়ে ছেলেকে রবিবারের দুপুওে রাজি করিয়েছে। জানলা থেকে এ প্রাসাদ ও প্রসাদ দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। বাইওে ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। লায়লার সঙ্গে গল্প করছি। নানা প্রশ্নের উত্তরে দেশটাকে জানার চেষ্টা। সে আলমেতি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবিভাগে অধ্যাপিকা, আবার ইউনেস্কোর হয়েও কাজ করে।
‘দেশটা রাশিয়ার হাতে ছিল অনেকদিন। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা এল। দেশটায় এখনও রাশিয়ার ছাপ আছে কিন্তু বিরোধী মনোভাব নেই। শিক্ষাব্যবস্থা রুশী কাঠামোয়, কৃষ্টিও অনেকটা। কিন্ত আমার জাতীয় পরিচয় কাজাক। কাজাকস্তানি বলতে গর্ব বোধ করি। রাজধানী আস্তানা অনেক দূর। কিন্তু আলমেতি সংস্কৃতির প্রাণভোমরা। কাজেই রাজধানী থেকে দূরে থাকার জন্য কোনও ক্ষোভ নেই আমাদের।’ শহরটাতে দেখতে পাচ্ছি, বেশ প্রাচুর্যেও ছাপ আছে। পুরনো প্রাসাদের সৌন্দর্য, তার পাশে নতুন তৈরি বহুতল বাড়িগুলো খাপছাড়া দেখাচ্ছে। সেখানেই নতুন পাওয়া ব্যক্তি স্বাধীনতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যে যার অর্থনৈতিক ক্ষমতায় সাজিয়েছে ব্যালকনি, দেওয়াল, ছাদের কোণ- যার পয়সা আছে সে একরকম, যার নেই সে ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে মালিন্য ঢাকছে। বিখ্যাত বাজার- জেলিয়োনির দিকে চলেছি। মধ্য এশিয়ার বাজার সে এক অন্য জগৎ। সব পেয়েছির দেশ। মাচা বেঁধে বসে আছে। পসরা নিয়ে। আমাদের সুটকেস না পৌঁছানোর জণ্য কিছু জামাকাপড় কিনতেই হবে। একটি দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পর দাম জানতে চেয়ে উত্তর এল হিন্দিতে। ‘উদু জানো উর্দু’!- কাজাক মুখের মহিলা বলে উঠলেন। হিন্দিতেই অষ্টরম্ভা, তাও দাম কমাবার জন্য চালালাম। গলির দু ধারে দোকান। চিৎকার চেঁচামেচি নেই, বিক্রিবাটা ভালোই হচ্ছে। শাক-সব্জি, মাছ-মাংস, জামাকাপড়, প্রসাধনের সামগ্রী, সোন-রুপোর গয়না, পাথরের মূর্তি কী যে নেই ওই বিশাল বাজারে! বেশি ঘুরতে পারিনি। ঝমঝম বৃষ্টি নামল। আমরা দৌড়ে গাড়িতে উঠতেই স্টিয়ারিং-্ বেসা অ্যালেন আমার হাতে খুদে ডিজিটাল ক্যামেরাটি তুলে দিয়ে জানাল, সেটি নাকি গাড়ির কাছে পড়েছিল, কোনও এক সহৃদয় পথচারী ফেরত দিয়ে গেছেন ওকে। ‘মধ্য এশিয়ায় যাচ্ছ, সাবধানে চলাফেলা করো, চোরছ্যাঁচড় আছে- এ সব কথা প্যারিস ছাড়ার আগে এত শুনেছি যে দাক্ষিণ্য্য অভিভূত করে দিল। চলেছি রেসপুব্লিকা অ্যালাঙ্গি অ্যাভেনিউ ধরে। চওড়া রাস্তা, সোভিয়েত আমলে তৈরি। থামলাম গোল চত্বরের কাছে। সামনে স্বাধীনতা মিনার। ১৯৯৬ সালে তেরি। মিনারের মাথায় শহরের প্রতীক স্বর্ণমানুষের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। সোনা রং জালি বর্ম গায়ে, মাথায় একই রঙের তৈরি মুকুট। কে এই সোনার মানুষ। আলমেতি থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে নেিসক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায়। খ্রিষ্ট্রপূর্ব পঞ্চম শতকের এক সোনার বীরপুরুষের পোশাক। চার হাজার টুকরো টুকরো সোনা জোড়া দিয়ে তৈরি পোশাকের গায়ে পশুপাখির ছবি আঁচড়ে খোদাই। মাথার মুকুটটি সত্তর সেন্টিমিটার লম্বা টুপির মতো দেখতে। তার ওপর আকাশের দিকে উঁচু কয়েকটি তীর, একজোড়া ব্যাদিত মুখ তুষার চিতাবাঘ আর দু মাথার উপকথার জীব তাদের কাঁধে ডানা। মূর্তিটি তৈরি করে প্রাচীন পোশাক পরানো। পরে বিশেষ অনুমতি নিয়ে কাজাকস্তান জাতীয় ব্যাঙ্কেও গর্ভগৃহে রাখা আসল পোশাকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল, সৌভাগ্য হয়েছিল সেই বৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার, যিনি ১৯৬৯-৭০ সালে মাটির নিচ থেকে আবিষ্কার করেছিলেন এই অমূল্য ঐতিহাসিক স্বাক্ষর। সে কথায় পরে আসছি। মিনারের কাছে বেশ ভিড়। বিয়ের ছবি তোলাতে আসে এখানে বর-কনে সহ বিয়ের পার্টি। বিশাল সাদা লিমুজিন থেকে নামল সুসজ্জিত। দম্পতি। মেয়েটি রাজকুমারীর মতো দেখতে। তাতার মুখের ছিপছিপে তরুনীর পাশে কাজাক মুখের বর। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ছবি উঠছে, আমার ক্যামেরাতেও ওদের ধরে রাখলাম। পাশে সাদা বিয়ের পোশাকে সেজে দাঁড়িয়ে ছিল আরেকটি মেয়ে, তার হাতে কারুকাজের খাঁচায় জোড়া পায়রা। ওকে নাকি ভাড়া করে আনা হয়েছে সবশেষে পায়রা দুটি উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। বন্ধনে মুক্তির স্বাদ অথবা তার উল্টো এ রকম আইডিয়া হবে বা। ছবি তোলার জন্য কিন্তু আমার কাছ থেকে এক ডলার চাইল। এক ডলার হল এ দেশে একশ তিরিশ তেনগে।
পরদিন সকাল দশটায় গালিয়া হোটেলে আসতে আমরা শহর দেখতে বেরলাম। বৃষ্টি পড়ে টিপটিপ করে। মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত জিপসি ট্যাক্সি নিলাম। সরকারি ট্যাক্সিওগুলোর ভাড়া বেশ চওড়া। অনেক প্রাইভেট গাড়ি পেট্রল খরচ কমানোন জন্য ব্যবসা করছে, পথচারীরা প্রসারিত হাতের ইঙ্গিতে থামে, সময় থাকেল যাত্রী তুলে নেয় কম ভাড়ায়। দামদর করে উঠতে হয়। সুবিধে অসুবিধে দুটোই আছে। দেশের লোক সঙ্গে থাকলে ভাষাটাষা নিয়ে মুস্কিল হয় না। ইতিহাস মিউজিয়ামে গেলাম। দেখলাম দেওয়ালে আঁকা প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে শুরু করে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সংগ্রহশালার রত্নভান্ডার। প্রত্নতাত্ত্বিক মিউজিয়ামে, মিউজিক মিউজিয়াম, শিল্প সংগ্রহশালা ঘুরে ঘুরে দেখছি। রাজপথের দুধারে কবি, শিল্পী, লেখকদের আবক্ষ মূর্তি সাজানো। গাছের সারি। কখনও ছোট ছোট বুটিক। হকার নেই ভিখারি নেই। আমরা এ দোকান ও দোকান ঘুরছি। একসারিতে দাঁড়ানো ভ্রমণ সংক্রান্ত অফিসগুলি। ম্যাজিক ট্যুও, গ্যালকাটিকা, ওট্টার ট্র্যাভেল, কানটেংগ্রি, এশিয়া ট্যুরিজম- ভেতরে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি কোথায় কোথায় যাওয়া যায় দূরে আর কম খরচে। আলমেতি শহরটা পায়ে হেঁটে দেখার শহর। আনাচকানাচে বিস্ময় অপেক্ষা করছে। পুরনো গির্জা, ছড়ানো পার্কে ফুলের কেয়ারি, বাচ্চাদের ছোটাছুটি, লেকের ধারে বৃদ্ধেও অলস বসে থাকা, পার্ক পার্কে বার্চ গাছের সারি, সাজানো ঝোপ, তারই কাছে চাটাই বিছিয়ে বিক্রি হচ্ছে আলিবাবার রত্নভান্ডার- মিলিটারি পদক, ডাকটিকিট, মুদ্রা, পাথরের কাজের গয়না আরও কত কী!
শহরে প্রাচীন নবীনে কী সুন্দর সমন্বয়। পানফিলভ শহিদ মিনারের কাছেই কী আশ্চর্য সুন্দর পুরনো গির্জা। আবার তখনই রাজপথে আইফেল টাওয়ারের মিনি সংস্করণ দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। ফরাসি পারফিউমের দোকান। ভেতরে সারি দিয়ে সাজানো ইভ সাঁ লরঁ, ক্রিস্তিয়ঁ দিয়র, কোকো শানেল- সুগন্ধে ভারি হয়ে আছে ওই ঘর। গালিয়াকে বললাম, তাড়াতাড়ি হাওয়া বাতাসে চল, বাইরে এসে দেখি মুল্যাঁ রুজের মতো দেখতে রেস্তোরো উইন্ড মিলের প্রতীক। দামি পরিবেশ। মেয়েটিকে বললাম, কাবা এ সব চড়া দামের পারফিউম কেনে, কারাই বা এই দামি রেস্তোরাঁয় খায়, ফরাসি বুটিকে পোশাক কেনে! ও ঠোট চেপে বলল, ‘সেই কালোবাজারিরা যারা দেশের টাকা নিয়ে অসাধু খেলা খেলছে। পেট্রো ডলার তো সাধারন মানুষের হাতে আসছে না, মুষ্টিমেয়দের মধ্যেই সীমিত। গালিয়া ইংরেজি ক্লাস নিয়ে পায় ঘন্টায় দু ডলার। সরকারি শিক্ষকদের মাইনে মাসে একশ ডলার। ওর কথায় মাসে পাঁচশো ডলারের কমে চালানো কঠিন। দ্রব্যমূল্য বাড়ছে দ্রুত গতিতে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাইনে তো আর বাড়ছে না! গালিয়ার স্বপ্ন সে কাজ করবে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। যেখানে মাইনে গন্ডিবাঁধা নয়। স্বামী ইকনমিস্ট। ভালো রোজগার। সে চায় বউ ছেলেপুলে মানুষ করে ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত থাকুক। কাজ করার দরকার কী? তার কোম্পানি তো যথেষ্ট পয়সা দেয়। মেয়েটির স্বপ্ন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। আঠারো বছর বয়সে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় বাড়ি থেকে ঠিক করা পাত্রে সঙ্গে। উনিশে পুত্র আর বাইশে কন্যা জন্মায়। ইসলাম ধর্ম ওদের। ধর্মবিশ্বাস জোর কদমে এখন কাজাকস্তানে। গির্জা, মসজিদ এমনকী ইসকনের সংখ্যা বেড়েই চলছে। সোভিয়েত আমলে যারা নাস্তিক ছিল তারা বেশি সংখ্যায় আস্তিকায় ফিরে আসছে। ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীদের সংখ্যা বেশি। কাজেই দেশটির সীমানা অন্যান্য দেশে হারে উগ্র রক্ষণশীলতা বাড়ছে তা এখানেও ধাক্কা না মারে এ রকম ভয়ের সম্ভাবনা নিয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায় আলোচনা করছেন। গালিয়া থাকে শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে এক বাড়িতে। দুবেলা রান্না, শিশুদের দেখাশোনা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সব কিছুই তাকে করতে হয়। স্বামী, বউ পড়াশুনা করে, চায় না। গাড়ি কওে নামিয়ে দিয়ে যায় রোজ কিন্তু বউ গাড়ি চালানো শিখবে নৈব নৈব চ। মেয়েটি স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে চায়। নিজের পয়সায় একদিন গাড়ি চালানো শিখে চালাবে। এখন শ্বশুর শ্বাশুড়ির সঙ্গে আছে ঠিক আছে। এ দেশে ওরকম আলাদা থাকা রীতি নয়। কিন্তু টাকাকড়ি রোজগার করতে পারলে আলাদা ফ্ল্যাটে সংসার বাঁধার স্বপ্ন। স্বামীর তাতে সম্মতি নেই জানাল। কিশোরী মুখের মেয়েটির বয়স মাত্র চব্বিশ। আমি মনে মনে প্রার্থনা জানালাম ওর ভালো হোক। আমরা কাছের একটি স্ট্যান্ড থেকে গরম সাসলিক অর্থাৎ শিককাবাব আর পরোটা কিনে পথে চলতে চলতে গল্প করছি। পানফিলভ পার্ক পেরিয়ে এলাম জেনকভ ক্যাথিড্রালেল সামেন। রাশিয়ান আমলে ছিল মিউজিয়াম। কাঠের কারুকাজ দেখার মতো। ভেতরে এখন প্রার্থনা বেদী, দেওয়ালের গায়ে বাইবেলের কাহিনা আঁকা। নীলে সাদায় হলুদে কী সুন্দর কাজ। ভেতরে প্রার্থনা চলছে। আমরা দুটি মোমবতি জ্বালালাম পুজোর উপচারে। একটু আগেই ফেলে এসেছি স্বাধীনতা স্মৃতির অগ্নিমশাল, সামরিক ব্যান্ডের বাদ্যধ্বনি আর সেই সুরে সৈন্যদের সমবেত মার্চ। আর এখানে কী প্রশান্তি। গির্জার বাইরে দেখি আমাদের দেশের মতোই সিঁড়ির কাছে হাত পেতে বসে থাকা ভিখারী ভিখারিনী- দু একজনকে দাক্ষিণ্য দেখানো যায় কিন্তু দশজনকে!
এবার যাব মসজিদে। আগেই বলেছি এখানে ইসলামধর্মী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাশিয়ান ক্রিশ্চানরা অনেকে ফিরে গেছে আপন দেশে, ইহুদিরা ইজরায়েলে। কাজেই প্রধান ধর্ম এখন ইসলাম। পার্ক থেকে বেরিয়ে হাঁটছি। কোথায় গেল এতক্ষণের সাজানো শহর! মলিন বাড়িঘর, ড্রেনের পাশ দিয়ে, প্রায় ঝুপড়ির মতো বাড়ির পাশ দিয়ে গলিপথে হাঁটছি। বেঞ্চে বসেছিল তিনজন কাজাকসন্দুরী। সাজপোশাক পুরনো দিনের মতো। ফুলছাপ স্কার্ট, কালো ব্লাউজ মাথায় রঙিন চাদর। তারা শিশুদের বুকের দুধ দিচ্চে সহজ সাবলীলতায়। ইঙ্গিতে গালিয়াকে আমার পরিচয় জানতে চাইল। তার এক রমণী ঝলমলে গলায় বলে উঠল, ‘ইন্দিয়া ইন্দিয়া! মিঠুন চক্রবর্তীকে চেনো! আমার কী প্রিয় নায়ক! আমি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালাম, কী হবে হতাশ করে যে ওদের প্রিয় চিত্রতারকাদেও সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। মসজিদের দিকে চলেছি। দূর থেকে নীল চুড়াটি দেখা যাচ্ছে। গেটে কিনতে হল সাদা স্কার্ফ। না, গালিয়া তার মিনি স্কার্ট এবং আবরণহীন মস্তক নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারবে বয়স কম বলে। আমার বেলায় তা চলবে না। গালিয়া যখন আমার মাথায় স্কার্ফ বাঁধছে আমি ভাবছিলাম ঈশ্বও রক্ষা করুন, এই মস্তক বন্ধনী যেন চাদও না হয়ে ওঠে ইসলামী শরিয়তি বিধানে। কাজাক সুন্দরীদের এখনকার ঘোমটাহীন চলাফেরা যেন রুদ্ধ না হয়ে যায়। ভেতরে ঢুকে দেখি ইমাম চেয়ারে বসে আছেন। আমাদের ডাকলেন। গালিয়া কদমবুসি করল, আমি হাত জোড় করে নমস্কার জানালাম। গালিয়াকে বলে দিলেন, আমাকে ভালো করে ঘুরিয়ে নতুন গড়া মসজিদ দেখাতে ও আমার মতামত লিখে যেতে। খুব ভালো লাগল এই সহজ ব্যবহার। বাইরে জিপসি ট্যাক্সিও জন্য হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছি। অনেকক্ষণ পর একটা সবজি ভর্তি ভ্যান পাওয়া গেল। গাড়ির ছাদে ডাই করা তরমুজ। সামনে বসেছি। দেখি উইন্ড শিল্ডটা ভেঙে চৌচির। বুলেটের ছ্যাঁদা মনে হল। গালিয়া এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে চালক বললেন, তাঁর বন্ধুর মাথা ঠুকে গিয়ে এই অবস্থা। আজব ব্যাপার। কেমন মাথা তার? রেডিওতে গান চলছে অনস্টি দ্যাট সুইট ওয়ার্ড- বিশ্বাস করতেই হল। গালিয়া জানাল, এদেশে ক্রাইমের সংখ্যা বেশ উঁচুর দিকে।
সন্ধেয় কাজাকস্তানি রেস্তোরা দস্তারখানে লায়লার নিমন্ত্রণে আমরা জড়ো হলাম। একেবাওে দেশি খাবার খাব অতিথিদের এই বায়না। এরা তো আদতে যাযাবর ছিল। খাবাওে তার ছাপ থেকে গেছে। শূল্যপক্ক মাংস ছাড়া আর সব খাবারই বেশ চর্বি চপচপে’। ঘোড়া আর ভেড়া-’ হেসে বলল লায়লার স্বামী- ‘ঘোড়া নিয়ে সারা জীবনের ছোটাছুটি ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। তাই চটজলদি খাবার তো ওগুলো হতেই হবে। তাই বলে ভেড়ার মাথা! সেটা এখন রেস্তোরার কোণে বিরাট হাঁড়িতে রাখা। প্রথমে তো পান করতে দিল ঘোলের স্বাদে ঘোটকি দুধ। সাসলিক, লাঘমান, একরকমের নুড়লস, ম্যানটি- পেসট্রির মতো খেতে। ক্যাজি, নারিন, কার্তা চুচ্চুক, কুরদাক কত রকমের ঘোড়ার মাংসের সসেজ আর দুম্বো পরটা- নৈশ ভোজনের প্রথম পর্ব। জাতীয় খাবারের নাম বেসবারমাক- ফালিফালি কাটা বিফ আর ভেড়ার সেদ্ধ মাংস পেঁয়াজে ভাজা বড় একটা কাঠের ট্রেতে নুড়লসের ওপর সাজানো। ঝোল আলাদা রাখা বাটিতে চুমুক দিয়ে খাবার জন্য। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। তারপর স্পেশ্যাল ডিশটি এল, তার ওপর ভেড়ার মাথাটি বসানো। সান্যাল আজ বিশেষ অতিথি বলে তাঁকেই কাটতে হবে ওই মাথা এবং একটি মেষনয়ন তাঁকেই খেতে হবে। মেয়েরা এ সৌভাগ্র থেকে বঞ্চিত জেনে কী যে আনন্দ পেলাম। লায়লার স্বামী কাটাকুটির ব্যাপারটা করলেন এবং টেবিলে পদমর্যাদা বুঝে একে তাকে কান চোখ এ সব পরিবেশন করতে থাকলেন। এ ডিনারটা মনে থাকবে অনেকদিন। নানারকম পানীয় যে ছিল তা বলাই বাহুল্য। মৃদু স্বওে বাজদে দোমব্রা- দোতারার মতো যন্ত্র। হোটেলে ফিরলাম সাড়ে দশটায়। ঘুমে সারারাত ভেড়ার স্বপ্ন দেখেছি।
আজ সকালে দারুণ রোদ। পাহাড়ের ওপর থেকে মেঘ উধাও। দেখা যাচ্ছে বরফের চুড়া। দশটায় গালিয়া এল। আমরা ট্যাক্সি নিয়ে চলেছি স্টেপি, আদিগন্ত বিছানো নিষ্পাদপ প্রান্তর ভূমির পাশ দিয়ে। উটরং বিছানো ঘাসের গালিচা যেন কেউ বিছিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে উরতি- উলে বোনা তাঁবু, ঘোড়া ছুটিয়ে চাষ করছে কাজাক চাষী। রাশিয়ান আমলে তৈরি নীলে সাদা বাড়িগুলির সারি অনেক দূরে ফেলে এসেছি। চলেছি এদেশের জাতীয় কবি জাম্বিল জাভের গ্রাম ও মিউজিয়াম দেখতে। স্টেপির এই চরণকবি বেঁচে থাককতেই ইতিহাস হয়ে ওঠেন। ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৫ সাল। জাম্বিল পাহাড়েরর কোলে জন্ম তাই নাম জাম্বিল। মেষপালকের পরিবারে জন্ম তাঁর। বাড়ি তো ইউরতা, তৃণভূমির তাঁবু। সাধারন জীবন, অসাধারন প্রতিভা। দোমব্রা একতারার মতো যন্ত্র বাজিয়ে গাইতেন গান যা নিজেরই লেখা সংবেদনশীলতায় রচিত সেই গান সাধারন কাজাক মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, চোখের জল, যুদ্ধ, রক্তপাতের অহেতুকতা এ সব নিয়ে। তিনি ছিলেন আকিন, যার অর্থ হল কবিয়াল। মুখে মুখে রচনা করা সেই গান প্রাণ ছুঁত- ক্রুদ্ধ প্রাণ, কালো শমন, সময় ছুটছে, লেনিনগ্রাডের সন্তান, স্বাধীনতা- এ সব গান এখনও গায় অনেকে। বেঁচে থাকতেই জনপ্রিয়তা পান। পান জাতীয় কবির আখ্যা। ১৯৪২ সালে প্রাভদায় লেখা হয়েছিল, ‘কবি তোমার গান আমাদের নতুন শক্তি দেয়, দেয় প্রেরণা, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। তোমার গান আমাদের সঙ্গের সাথী। যুদ্ধক্ষেত্রে, বন্দুকের ধোঁয়ায়, কামানের গর্জনে তোমার গান যেন বিজয়ের গান হয়ে বুকে বাজে- নুরপাইশভা নামের প্রৌঢ়া রমণী এ মিউজিয়াম দেখাশোনা করেন। আমাদের পায়ে কাপড়ের জুতো। ঘুরে ঘুরে ঘর দেখছি। তারপর বাইরে এসে দেখালেন আকিনের প্রার্থনার মসজিদ। বাইরে কবির মূর্তির নিচে বসে তিনি কাজাক রমণী অ্যাপ্রিকট বাছাই করছিলেন। কী সুন্দর গ্রামীন মুখ। ছবি নিলাম। তারপর সেই স্টেপির পাশ দিয়ে আশি কিলোমিটার দূরে ফেলে আসা শহর আলমেতির দিকে চলেছি।
বিকেলটা পাহাড় দেখে কাটাব ঠিক হল। চল জিপসি ট্যাক্সি ধরি। শরীর থেকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ঝুঁকে হাত টান করে দাঁড়াতেই গাড়ি থামল। চালাচ্ছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। গালিয়া আপন ভাষায় কী সব বলতে লাগল, তিনি শুধু প্রশ্ন করলেন আমি কি ইন্দি! গালিয়া হ্যাঁ বলতেই দরজা খুলে গেল। যত্ন করে পাশে বসিয়ে সে কী গল্প। গাড়ি চলছে শহর কেটে পাহাড়ের দিকে। দুধারে ঝাউ, সাইপ্রাস, জুনিপারের সারি। অ্যাপ্রিকেট সবে গুটি ধরেছে, আপেল গাছ নুয়ে আছে লাল টুকটুকে ফলের ভারে। রাজকাপুর, সে কি বেঁচে আছে? হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠলাম। তুমি কি জানো সেই গান- মুড়মুড়কি- গাইতে শুরু করেছেন নিজেই। তাঁর নাম বখতিয়ার। পদবি খিলাজি নয় নিশ্চয়। যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে ছিলেন সামরিক আইনজীবি পেশায়। মুখের রেখায় সব কিছুতেই একটা মজা পাচ্ছেন এরকম একটা ভাব। আমাদের বিয়ের প্রতীক কি কপালের টিপ! ইন্দিরা গান্ধীর মতো সুন্দরী কখনও দেখেননি, ভারতবর্ষের ফিল্মি গানের তুলনা নেই- কথা বলেই চলেছেন। আমি চোখ ভরে দেখছিলাম আলাতো পাহাড়, মেডিও স্কেটি রিং, আরও উঁচুতে তিয়েন শান পাহাড়ের চূড়ার বরফ আর স্কি এরিয়া। ১১৩০ মিটার উচুতে মেডিও। নামটি এসেছে এক প্রাচীন বেদুইন দলপতির প্রামের নাম থেকে। সাপের মতো পথে ঘুরে ঘুরে গাড়ি উঠছে। বখতিয়ার গান ধরেছেন- ম্যায় আওয়ারা হু। আমাকে বললেন ওই উঁ উঁ ধুয়োটা ধরুন তো! হাসিটি সুন্দও, গোটা কতক সোনার দাঁত ঝিকমিকিয়ে ওঠে। আমরা মেডিং স্কেটিং রিংয়ের সামনে এসে পৌঁছেছি। পাশে পাহাড়ি ঝরনা গর্জন করে বয়ে চলেছে, এখানে ঢুকতে লাগে একশো তেনগে। পরিবেশ রক্ষা তহবিল। ১৯২১ সালের বিভীষিকা-স্মৃতি স্মরণ রেখে এই প্রচেষ্টা। ওই দিন পঁচিশ থেকে তিরিশ টন ওজনের কাদা, বালি পাথরের স্রোত আলমেতির এই পূর্বাঞ্চল ধ্বংস করে দেয়। সংগৃহীত তহবিলের টাকাটা খরচ হয় আরক্ষ প্রচেষ্টায়। ওপরে মার্বেল ফলকে খোদাই করা স্কেটিংরত পুরুষ ও রমণীর মুখ। ধাপে ধাপে আটশো সিঁড়ি উঠে গেছে। রিংয়ে এই জুনে বরফ নেই। প্রতিবছরের মতো এবারেও বরফহীন স্টেডিয়ামে এক বিরাট কনসার্ট হল। এখানে আগামীকাল থেকে শুরু হবে আদিয়া দয়সি, ভয়েস অব এশিয়া উৎসব। জনপ্রিয় গানগুলির প্রতিযোগিতা। আজ রিহার্সাল চলছে। কাজাক গায়কদের সঙ্গে মেশে বিভিন্ন দেশের তরুণ গায়কেরা। আমরা ঢুকতেই দেখি মঞ্চে শ্যামলা রঙের তিন তরুণ পপ গান গাইছে নেচে নেচে। শুনলাম ওরা শ্রীলঙ্কার গ্রুপ। তারপর কাজাকস্তানের দলটি গলা ফাটিয়ে পাসিভা পাসিভা গান গেয়ে সারা স্টেজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যখণ, সে সময়ে আমরা বাইরে এলাম। একঝাঁক কিশোরী মেয়ের অুনরোধ ছবি তুলবে। আমিও তুললাম। গোধূলির আলো পড়েছে পাহাড়চূড়ার বরফে। বখতিয়ার গাড়ি চালাচ্ছেন চুপ করে। যেন এক অপার্থিব জগতের ছবি নড়ে যেতে পারে একটি শব্দের উচ্চারণে।
আজ সকালে গালিয়াকে ছুটি দিয়েছি। যাব ইউরি আর তিমুরের সঙ্গে পূর্ব প্রদেশে ইসিক নদীর ধারে প্রাচীন কবরভূমি আর রেশম পথের দেখা পেতে। তিমুরের মুখটি তাতার জাতির মতো। উুঁচু চোয়াল, চেরা চোখ, ইউরির মখে আবার রাশিয়ান ছাপ। সে প্রত্নতাত্ত্বিক। ইউনেস্কোর অনেক পরিকল্পনায় কাজ করে। অনেকটা পথ পেরিয়ে আমরা আবার স্টেপির পাশে। লালচে বালি এবার যতদূর চোখ যায় ততদূরই। কয়েকটি উর তবা তাঁবু। তার একটির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অধ্যাপক আমাদের জন্য। ইনি এখানে দু বছওে খননকাজ চালিয়ে খুঁজে পান সেই সোনার রাজপুত্রের স্বর্ণপোশাক ১৯৭০ সালে। আলমেতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ইউরির মাস্টারমশাই। প্রাচীন সভ্যতার লুকনো রত্নভান্ডার খুঁজে খুঁজে বার করার মায়া-অঞ্জন ছাত্রের চোখে লাগিয়েছিলেন এই বৃদ্ধ। অধ্যাপনার কাজ কতদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁবুর আশ পাশে বা ওই অঞ্চলের প্রাচীন সমাধিভূমির নিচে আরও ইতিহাসের সম্পদ লুকিয়ে আছে জানালেন তিনি। ভোর থেকেই কাজ শুরু। সরকারি সাহায্য আসে না। তুব বিরাম নেই। খেপার মতো পরশপাথর খুঁজে চলেছেন। রোদে পোড়া মুখ ঝলমল করে উঠছিল যখন বালিতে হাতের লাঠি দিয়ে দাগ কেটে দেখাচ্ছিলেন তাঁর স্বপ্নে সংগ্রহশালার ছবি। মিউজিয়াম গড়ে উঠুক এখানে এই সাধ তা৭কে বাঁচিয়ে রেখেছে। সাদা ধপধপে দাড়িতে মাথার সাদা টুপিে যেন এক ঋষি দাঁড়িয়ে অথবা এদেশের আকিন। সেই কবি যে স্বপ্ন রাখে বুকে আর সারাদিন কাগজে, পাথরে, বালিতে আঁচড়ে তোলে আাকঙিক্ষত নকশার প্রতিলিপি। আলমেতি আমার স্মৃতিতে তাঁর ছবিতেই উজ্জ্বল হয়ে আছে এখনও।

প্রীতি সান্যাল