Skip to content Skip to footer

আমাদের ছোট নদী: সবরমতী

যে কোনও শহরে প্রথমবার গেলে প্রথমেই আমি নদীর খোঁজ করি। একথা আমি আগেও লিখেছি। নদীর ধারেই অে শহরগুলি গড়ে উঠেয়ে, সুতরাং নদী থাকবেই। নদীটি না দেখলে আমার শহর-সফর সম্পূর্ণ হয় না।
আমেদাবাদ গেলে অবশ্য নদীর খোঁজ করতে হয় না, শহরটি বিস্তৃত হয়েয়ে নদীর দুপাশেই, যাঅয়াতের পথে বারবার চোখে পড়ে। পারাপার করতে হয় সেতু দিয়ে। এ নদীর নাম সবরমতী। এমনিতে নদীটির কোনও খ্যাতি নেই, তবে এই নদীর ধারে গান্ধীজির সবরমতী আশ্রম একসময় বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিল।
নদীটি সুদৃশ্য নয়, অবশ্য আমি ভরা বর্ষায় এর রূপ দেখিনি। দুবার আমেদাবাদ গেছি, দুবারই হোর গ্রীষ্মে, তখন সবরমতীতে পানি থাকে খুব কম, নেংরা নেংরা চেহারা, হাড়গোড়ের মঅে বড় পাথর ভেসে ওেঠ, ধোপারা সেখানে কাপড় কাচে। পাহাড়ি নদীগুলি গ্রীষ্মকালে একেবারে শুকিয়ে গেলেও অর একটা বিশেষ সৌন্দর্য থাকে, কিন্তু সমতলের নদীর দৈন্যদশাই বেশি ফুটে ওেঠ। আর তীরবর্তী মানুষরাও সেখানে যাবতীয় আবর্জনা ফেলতে দ্বিধা করে না।
সবরমতী আশ্রমটিও এখন প্রাণহীন মনে হয়। নায়কের মৃত্যুর পর যেন নাটক শেষ হয়ে গেয়ে! গান্ধীজি নেই, অর আদর্শেরও কিছুমাত্র অবশিষ্ট আয়ে বলে বোধ হয় না। । রাজনীতিতে অহিংসাকেই একটা অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরেছিলেন গান্ধীজি। সেজন্য পৃথিবীর বহু দেশেই সম্ভ্রম পেয়েছিলেন। এখনও অন্যান্য অনেক দেশে এই অহিংস নীতি বা গান্ধীবাদকে আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, শুধু আমাদের দেশেই এই অহিংস নীতি একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেয়ে।
গুজরাট নানান বৈপরীত্যের রাজ্য। সাধারণভাবে বাঙালিরা মনে করে গুজরাটিরা যেন শুধু ব্যবসায়ীর জাত, আধুনিক শিল্প-বাণিজ্যে ওরা খুব উন্নত। কিন্তু অন্যদিকে সাহিত্য- চিত্রকলা-সঙ্গীতেও গুজরাটিরা খুবই সমৃদ্ধ। তবে রাজনীতিতে অতি নিকৃষ্ট! গুজরাটিদের সাধারণ ভাবে অহিংস হবারই কথা। জাতিগত ভাবে অরা নিরামিষাশী। আমি আমেদাবাদে গিয়ে দুবারই কোনও হোটেলে থাকিনি, অতিথি হয়েছি গুজরাটি বন্ধুদের বাড়িতে। কোনও য়েরবারের অন্দরমহলে স্থান পেলে সেখানকার জীবনযাত্রা অনেকটা বোঝা যায়। প্রথমবার আমাকে আতিথ্য দিয়েছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক ভুলাভাই প্যাটেল। য়েরচ্ছন্ন, অনাড়ম্বর অর সংসার, এঁরা কঠোরভাবে নিরামিষ ভোজী। তিনদিন ছিলাম, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি, নিরামিষ রান্নাও যে কত বিচিত্র ও সুস্বাদু হতে পারে, অ আগে জানঅম না। নানাপ্রকার ডাল চেয়ে চেয়ে খেয়েছি। তবে, মিষ্টির ব্যবহার বেশি। শ্রীখন্ড নামে একটি মিষ্টদ্রব্য একটু মুখে দিলেই মুখ মেরে দেয়।
আমেদাবাদের পাশে, শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে এমন একটা রেস্তোরাঁ আমি দেখেছিলাম, যার তুলনা ভূ-ভারতে আর নেই। সেটি একটি ক্ষুদ্র গ্রামের সংস্করণ। একটি প্রবেশদ্বার আয়ে, সেখানে একটা টিকিট কাটতে হয়, খুব বেশি নয়, তখন ছিল পঞ্চাশ টাকা। অরপর ভেতরে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায়, তাঁতি তঁত বুনয়ে, কামারশালায় নেহাইয়ের আওয়াজ, পটুয়া গড়য়ে মূর্তি, মাঠে ধান বুনয়ে চাষী, ফলমূলের বাগান য়েরচর্যা করয়ে মালি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখা যায়, ওদের উৎপন্ন দ্রব্য কেনাও যায়। অরপর এক জায়গায় পৌঁছতেই দেখা যায় গানাই বাজয়ে, ফুল দিয়ে গাজানো সেট, যেন নেমতন্ন বাড়ি, কিছু লোক আপ্যায়ন করে বলে, আসুন, আসুন, খিদে পেয়েয়ে নিশ্চয়ই, খেতে বসে যান, কলাপাঅর ওপর প্রথমেই য়েরবেশন করবে জুই ফুলের মঅে সাদা ভাত, অর ওপর খাঁটি ঘি, এরপর আরও অনেক ডাল-তরকারি আসবে, য়েরবেশনকারীরা বলবে, আরেকটু নিন, আরেকটু নিন। যে কোনও দ্রব্য বারবার চাওয়া যেতে পারে। এখানে কিন্তু খাওয়ার জন্য পয়সা দিতে হয় না। ওই প্রবেশদ্বারের প্রথম টিকিটটাই যথেষ্ট।
বলাই বাহুল্য, সমস্ত পদই নিরামিষ। সোটা আমেদাবাদেই মাছ-মাংস নিষিদ্ধ। (স্থানীয় বাঙালি কর্মীরা এক সন্ধ্যায় অদের মেস বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে অরা লুকিয়ে মাছ খায় । আমার অবশ্য মায়ের জন্য কোনও আকুলি-বিকুলি ছিল না।) এগব অনেকদিন আগে কার কথা, এখন হয়অে বড় বড় হোটেলগুলিতে আমিষ চালু হতেও পারে। মদও চালু হয়েয়ে কি না জানি না। তখন মদ্যপানের প্রশ্নই ছিল না। শুনেছি, কোনও বহিরাগত মদ্যপায়ীকে পুলিশ ধরার আগে রাস্তার লোকই টানতে টানতে থানায় নিয়ে যায়।
আমি এদেশে ও বিদেশে যতজন গুজরাটিকে চিনি, অরা প্রত্যেকেই নিষ্ঠাবান নিরামিষাশী। মাছ-মাংসের গন্ধও অদের সহ্য হয় না। অর্থাৎ অরা যে কোনওরকম জীবহত্যার বিরোধী। অথচ এখন গুজরাটের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে কী করে?
আমেদাবাদ শহরটি হিন্দু-মুসলমান মিশ্র সংস্কৃতির নানা ঐশ্বর্যে পূর্ণ। এখানে যেমন রয়েয়ে অনেক সুদৃশ্য মসজিদ, ঝুলঅ মিনার বা ঝযধশরহম গরহধৎবঃং অে স্থাপত্যের এক বিস্ময়কর নিদর্শন, তেমনই রয়েয়ে অনেক মন্দির ও হিন্দুদের পুণ্যস্থান। আবার রয়েয়ে রানি রূপমতীর মসজিদ, এক মুগলমান সুলঅনের হিন্দু রানির স্মৃতি মসজিদ হিন্দু-মুসলিম স্থাপত্যের যৌথ নিদর্শন। এইসব স্থাপত্যগুলি একই শহরে পাশাপাশি থাকতে পারে, অথচ দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে থাকতে পারে না!
এ বছর গুজরাটে যখন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়, তখন আমি বিদেশে। ইন্টারনেটে বীভৎস ঘটনাগুলির সচিত্র বিবরণ দেখে লজ্জায় ঘৃণায় মনটা অবশ হয়ে যেত।
তখন আমি মনে করার চেষ্টা করঅম য়েরচিত গুজরাটিদের কথা। প্রথমেই মনে পড়ে উমাশঙ্কর যযাশির নাম, তিনি ছিলেন। ভারত প্রসিদ্ধ কবি, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না রেখেও তিনি কিছুদিনের জন্য আমাদের বিশ্বভারতীর উপাচার্য হয়েছিলেন। অতিশয় নম্র, ভদ্র ও মৃদুভাষী মানুষটি সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন। তিনি বাংলাও জানতেন চমৎকার। গুজরাটের শিক্ষিত মহল, বিশেষ করে সাহিত্য-শিল্প সমঝদার অনেকেই আগ্রহ করে বাংলা শিখেয়েন। আমাকে একজন গুজরাটি লেখক বলেয়েন, বাঙালিরা যেমন শখ করে ফরাসি ভাষা শেখে, ফরাসি সাহিত্য পড়ে, সেইরকম গুজরাটিরাও পড়ে বাংলা সাহিত্য। সত্তর-আশির দশক পর্যন্ত, কোনও একজন লেখক ‘দেশ’ য়েত্রকা রাখতেন, প্রতি সংখ্যা হাতে পেলে তিনি বন্ধুদের ডেকে সেই য়েত্রকার গল্প-কবিঅগুলি পড়ে শোনাতেন।
নিউ ইয়র্কে থাকে প্রীতি নামে একটি গুজরাটি মেয়ে, অর আগের পদবি ছিল শাহ। এখন বাঙালিকে বিয়ে করে সেনগুপ্ত হয়েয়ে, অনর্গল বাংলা বলতে পারে। পড়তে পারে। সে কিন্তু লেখে গুজরাটি ভাষায়, বিস্ময়কর অর চরিত্র, এমনই অর ভ্রমণ পিপাসা যে অর ঘরকুনে স্বামী চন্দন সেনগুপ্ত অর সঙ্গী হতে না চাইলেও প্রীতি একা একাই বিশ্ব পর্যটন করে, সে একাই গিয়েয়ে তিব্বতে, আফ্রিকার গহন অরণ্যে আর দক্ষিণ আমেরিকায়।
মনে পড়ে মহম্মদ বশীরের কথা। সে নিজে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পথশিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে অনলসভাবে। আর কোনওরকম প্রচারের আলো নিজের মুখে ফেলতে চায় না। সব সময় সে থাকে আড়ালে। এরকম সজ্জন আমি খুব কমই দেখেছি।
মুম্বইতে থাকে নলিনী মদগাওকর, সেও গুজরাটি মেয়ে, বিয়ে করেয়ে মারাঠি বলবন্তকে। নলিনী সুমিষ্ট উচ্চারণে বাংলা বলে, বাংলা থেকে কবিঅ অনুবাদ করেয়ে এবং অনেকদিন সে অর স্বামীর সঙ্গে মিলে মুম্বইয়ের অনেককে এমনকী বাঙালি ছেলেমেয়েদেরও, রবীন্দ্রগঙ্গীত শিখিয়েছে।
আরেকজন বিখ্যাত অধ্যাপক সমালোচকের কথা মনে পড়ে, অঁর বাড়িতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকজন বন্ধু। এঁর পদবি দেশাই, এবং সেগময় তিনি বৃদ্ধ এবং অগসস্থ ও শয্যাশায়ী। ইনি আমাকে একটি চমকপ্রদ কথা বলেছিলেন। প্রত্যেকদিন সকালবেলা ইনি রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি এরকম কয়েকজনের কথা মনে মনে চিন্তা করেন এবং কিছুক্ষণ ধ্যান করেন। তখনকার হিন্দুরা ঠাকুর- দেবের নামে ধ্যান করত এরাই তো এ যুসের দেবতা। । গুজরাটে যেমন রয়েছে হিংসায় উন্মত্ত জনতা, বিবেকহীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তেমনই এইসব সংবেদনশীল মানুষও তো আছে। সাম্প্রতিক হানাহানির সময় এঁদের মর্মপীড়ার কথাও আমি অনুভব করি। এঁদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদও জানিয়েয়েন। আমার মনে পড়ে একটি সন্ধ্যার কথা। সবরমতী নদীর ধারেই একটি বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্নে গিয়েছিলাম। দোতলায় প্রশস্ত ঢাকা বারান্দায় বসার ব্যবস্থা। এখান থেকে নদীটি যেমন দেখা যায়, তেমনই চোখে পড়ে পাশের রাস্তার যানবাহন। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ির মতো উটে টানা গাড়ি আমি আমেদবাদেই প্রথম দেখি। আমাদের কলকাতায় উট নেই, তবে অনেক আগে হাতি দেখা যেত, এখন আর পোষা হাতিও শহরে ঢোকে না। ওইসব অঞ্চলে কিন্তু এখনও দিব্যি হাতি দেখা যায় শহরের রাস্তায়। সূর্যাস্তের সময় নদীটির রূপ কিছুটা বদলে যায়। ঢাকা পড়ে যায় অর রুগ্নতা, কারা যেন স্বল্প জলে অনেক প্রদীপ ভাসিয়েছে, অনেকগুলি প্রদীপ দুলিয়ে, সেই ছবিটা মনে গেঁথে থাকে। এক সময় শুরু হয় কবিতা পাঠ। স্থানীয় কবিরা পড়ছিলেন গুজরাটি ভাষায়, সম্পূর্ণ বোঝা না সেলেও অনেকটাই হৃদয়ঙ্গম করা যায়, তা ছাড়া কবিতা ধ্বনি মাধুর্যও তো অনেকখানি আবেগ এনে দেয়। ইংরিজি অনুবাদ সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ওঁরা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বাংলাতেই কবিতা পাঠ করতে।।
স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আয়ে সেই সন্ধ্যাটি। দাঙ্গার সময় সেইসব কবি বন্ধুরা নিশ্চয়ই লজ্জায়, দুঃখে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে শুনলাম, তাদের মধ্যে একজন একটি মুসলমান পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়েয়েন। এ ঘটনাওতো লিখে রাখবার মতো!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়