আলতা মাসির কাছে প্রথম শুনেছিলাম ‘দেশের বাড়ির’ কথা। আলতা মাসি আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসে। ভোটের সময় দেশের বাড়ি যাবে বলেছিল। মায়ের কাছে আমাদের দেশের বাড়ির খোঁজ করি। জানতে পারি বাংলাদেশের যশোর জেলার ভেরচী গ্রামে আমাদের দেশের বাড়ি।
অনেকবার কথাবার্তার পরে ১৫ আগস্ট দিনটি ঠিক হলো। এই দিনটি দুই দেশের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের স্বাধীনতা দিবস। আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস। আমার বেশ দুশ্চিন্তা ছিল একটা বিষয়ে। আমরা শহরের মানুষ। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আমাদের অনেক তফাৎ। ভাবনা চিন্তায়, জীবনযাপনে। কীভাবে মিলব ওদের সঙ্গে?
এর আগে তিনবার এসেছি বাংলাদেশে, কিন্তু গ্রামে এই প্রথম। যশোর জেলাতে বাড়ি হলেও প্রবেশপথ খুলনার চুকনগর। চুকনগর ঠিক শহর নয়, আধা গ্রাম আধা শহর। শেষ বিকেলে যখন বাস থেকে নামলাম তখন আকাশ জুড়ে কালো মেঘের জটলা। ছোট মামা দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের জন্য। গাড়ি করে রওনা দিলাম। ভদ্রা নদী পার হলাম। মা আর দাদার কাছে এই নদীর কথা অনেক শুনেছি। বর্ষায় নদী ভয়ংকর চেহারা ধারণ করে। কিন্তু এখন নদীর বুকে চড়া। মাঝখানে সামান্য জল। আগস্ট মাসে নদীতে জল নেই। আমার দাদা, অর্থাৎ দাদামশাইয়ের জন্ম এই গ্রামে। তিনি নদীকে দেখে খুব দুঃখ করছিলেন।
গ্রামের মধ্যে আসতেই দাদা সবকিছু চেনাতে লাগল৷ গ্রামের হাট, কালি মন্দির সবকিছু৷ হাটে পৌঁছে মা তো অবাক৷ কত দোকান সেখানে৷ আগে এখানে সপ্তাহে দুই দিন হাট বসত৷ বুধবার আর রোববার৷ গ্রামে আগে বৈদ্যুতিক আলো ছিল না৷ কিন্তু এখন সর্বত্র আলো ঝলমলে পরিবেশ৷ আরেকটা বিরাট পরিবর্তন নিয়ে মা, দাদা আর ছোট মামা আলোচনা শুরু করল, সেটা হলো পথঘাটের উন্নতি৷ আগে বর্ষাকালে খুব কষ্ট ছিল৷ আমি বয়সে ছোট বলে শুধু বড়দের কথা শুনে যাচ্ছি৷
একটা বড় শান বাঁধানো পুকুর দেখেই দাদা ‘থামো’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ সবাই নেমে পুকুর ঘাটে গেলাম৷ দাদা ছোটবেলায় পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে এই পুকুর ঘাটে ঘুমিয়ে থাকত৷ শেষমেশ ধরা পড়ে এবং বড় দাদা মানে দাদার বাবার হাতে মার খেতে হয়৷ হায়রে, দাদাদের কত মজা ছিল৷ আমাদের স্কুল ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই৷
পুকুর ছাড়িয়ে কয়েক পা যেতেই অনেক মানুষজন ঘিরে ধরল৷ আসলে আমাদের আসার খবর পৌঁছে গিয়েছিল সবার কাছে৷ বাড়িগুলোর ইটের দেয়াল কিন্তু ছাদ টিন বা মাটির টালির৷ সব খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অনেক গাছপালা৷ কেমন যেন প্রাণবন্ত। বাড়ির দিকে যত এগোচ্ছি, আরও অনেক প্রতিবেশীরা আমাদের সঙ্গে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলেন৷ দলটা বেশ বড় হতে লাগল৷ বড়রা আমাকে আদর করতে লাগলেন৷ মনে হচ্ছিল যেন বিরাট কোনো ভালো কাজ করে বাড়ি ফিরছি৷
দূর থেকে একটা বাড়ির সামনে দেখলাম ন’দিদা দাঁড়িয়ে৷ বুঝলাম ওটাই আমার দেশের বাড়ি৷ এক দৌঁড়ে পৌঁছে গেলাম উঠানে। কয়েকটা সিঁড়ি টপকে বারান্দা৷ কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা৷ চেয়ারে ন’দাদু বসা৷ বেশি চলাফেরা করতে পারেন না৷ আমার মাথায় হাত রেখে বললেন ‘এত দিনে সময় হলো?’
দিদা হাত ধরে বড় ঘরে নিয়ে গেলেন৷ মা চিনিয়ে দিল পুরোনো আমলের সব আসবাব৷ সিন্দুক, দেরাজ, পালঙ্ক৷ বিরাট বড় উঁচু আয়না লাগানো খাটের নাম যে ‘পালঙ্ক’ সে কথা দেশের বাড়ি না এলে জানা হতো না৷ সিন্দুকে থাকে কাঁসা পিতলের বাসন৷ দেরাজে থাকে জামা কাপড়, টাকা-পয়সা৷ এই পালঙ্কতে অসুস্থ অবস্থায় আমার বড় দাদা অর্থাৎ প্রমাতামহ পরলোক গমন করেন৷ মনে মনে বড় দাদা আর বড় দিদাকে শ্রদ্ধা জানালাম৷
বাইরে এসে আমি তো অবাক৷ উঠোন ভর্তি লোক৷ সবাই আমাদের দেখতে এসেছে৷ বড়দের সঙ্গে শিশুরাও আছে৷ আমি ছোটদের সঙ্গে করে আনা চকলেট দিলাম৷ একজন বাচ্চা হাতে করে ভাঙা খেলনা গাড়ি নিয়ে এসেছিল খেলবে বলে৷ আমার খুব খারাপ লাগল৷ যদি ওদের জন্য কয়েকটা খেলনা আনতাম ভালো হতো৷
সবার সঙ্গে ছবি তোলা হলো। মা চিনিয়ে দিল ঢেঁকিঘর, গোয়ালঘর৷ এর মধ্যে ন’দিদা গরম-গরম লুচি ভেজে অনেকগুলো মিষ্টি দিয়ে কাঁসার থালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছে৷ অন্ধকার নেমে এসেছে৷ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে৷ আমাদের স্বল্পমেয়াদি সফরসূচি অনুযায়ী আজ ফিরতে হবে খুলনা শহরে৷
চলে আসার সময় দিদা আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন ইচ্ছেমতো খরচ করতে৷ উঠোনের থেকে মা নিল একটুখানি মাটি৷ স্মৃতি হিসাবে৷ গাড়িতে ওঠার সময় খুব কষ্ট হচ্ছিল৷ সবাই বলছিল ‘আবার এসো’৷ গাড়ি ছাড়তেই তুমুল বৃষ্টি৷ একটা গাছের ডালে কয়েকটা পাখি ভিজে যাচ্ছে দেখে খুব মায়া হলো৷ গাড়ির ভেতর থেকে বৃষ্টিভেজা পথের দিকে তাকিয়ে খুব মন খারাপ লাগছিল৷ মনে হচ্ছিল ‘দেশের বাড়ি’ শব্দটা প্রথম শুনে যেমন বিরক্তি লেগেছিল এখন ততটাই ভালো লাগছে৷ ব্যাপারটা যে এত সুন্দর হবে সেটা কল্পনাতে ছিল না৷ ভাগ্যিস মা আর দাদা জোর করে এনেছিল৷ কীভাবে যে সময় কেটে গেল, বুঝলাম না৷
খুলনার হোটেলে এসে এক হাজার টাকার নোটটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, এই টাকা আমি বাঁচিয়ে রাখব দেশের বাড়ির স্মৃতি হিসাবে৷
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়:
কলকাতার ‘দ্য বিএসএস’ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী৷ পড়াশোনার পাশাপাশি চিত্রাঙ্কনে আগ্রহ আছে৷ ইতিমধ্যে ১১টি দেশে ভ্রমণ করেছে৷ ভবিষ্যতে ইতিহাস নিয়ে উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা আছে৷