Skip to content Skip to footer

উৎমাছড়ার পথে

 

ভোলাগঞ্জের সুখ স্মৃতি নিয়ে আমাদের ম্যাড প্ল্যাটুন যাচ্ছিলাম উৎমাছড়ার পথে। ভালোই যাচ্ছিলো আমাদের যাত্রা। তবে আজ পর্যটকের অনেক ভীড়। জুম্মার নামাজ উপলক্ষ্যে যাবার রাস্তা আটকানো। সেতুর মধ্যে অনেক ট্র্যাক আর লেগুনার ভীড় দেখলাম। এতক্ষন বসে থাকা তো দায়। তাই আমরা লেগুনা ঘুরিয়ে রওনা হলাম গোয়াইনঘাটের উদ্দ্যেশে। হ্যা ঠিক ধরতে পেরেছেন আমরা যাব রাতারগুল জলাবনে।

 

লেগুনা চলছে আবার দূরন্ত গতিতে, এর আগে একটি তথ্য দিয়ে রাখা ভাল রাতারগুল বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন নয়। আরও জলাবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। সে গুলো না হয় গোপন থাকুক। আমাদের তো আম খাওয়া নিয়েই কারবার আটি গুণে কি করবে। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের প্রায় ৩৩৮ একর জমিজুড়ে অবস্থিত এই বন কে ১৯৫২ সালে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করে আমাদের বন বিভাগ। সিলেটের স্থানীয় ভাষায় মুর্তা বা পাটিগাছ “রাতাগাছ” হিসাবে বেশ পরিচিত। সেই রাতা থেকে রাতারগুল জলাবনের নামকরণ। সিলেটের শীতলপাটি তৈরির মূল উপাদান মুর্তার বড় অংশ এই বন থেকেই আসে।

 

দেখতে দেখতে চলে এলাম গোয়াইনঘাট। আমাদের লেগুনা ঠিক নৌকা ঘাটের সাথেই রাখলো। হালকা জিরিয়ে সাথের আনা শুকনা খাবার খেয়ে নিলাম। জলাবনের ভিতরে ঢোকার এক মাত্র মাধ্যম কোষা নৌকা। কোষা নৌকা ঠিক করতে গিয়ে তালুখানা জ্বলে উঠলো। দুইটা  নৌকা মাত্র দেড় দুই ঘন্টা ঘুরাবে চেয়ে বসলো ২৬০০ টাকা, এই রকম সিন্ডিকেটের কারণেই অনেকেই আসতে চায় না পর্যটন স্থান গুলোতে। আসলাম যখন ফিরে তো যাওয়া যায় না। নাদিম ভাই, চান মিয়া যাবে না বেকে বসলো। নাদিম ভাই আগেও এসেছেন তাই বোধ হয় আগ্রহ পাচ্ছেন না। কিন্তু দলের বাকি সবাই এই প্রথম রাতারগুলে এল বলে কিছুটা তর্ক বিতর্কের পর সবাই যেতে রাজি হলাম। তবে আর একটু বাজিয়ে দেখা যাক। শেষ পর্যন্ত দুইটা নৌকা ২০০০ হাজারে রাজি হল।

 

চলছে আমাদের নৌকা জলাবনের পথে। জলে চলছে জলের জলেশ্বরী, যেন আমরা জলেই বেঁধেছি ঘর। চারদিক কত শান্ত, কোলাহল মুক্ত। উত্তরে গোয়াইন নদী তার দক্ষিণে বিশাল হাওর আর মাঝে আমাদের জলাবন। যেন জলেই শুনি জলাবনের কাব্য। শেষ ২০১৩ সালে যখন রাতারগুল এসেছিলাম তখন শুনেছিলাম পাখিদের ডাক। আজ পাখি সব কোথায় হারিয়ে গেল।

 

যতই বনের গহীনে ঢুকছি ততই প্ল্যাস্টিক আর মানুষের আনাগোনার চিহ্ন দেখতে পারছি। ভাবা যায় এই বনে এক সময় পাখিদের গান শোনা যেত। অনেকে রাতারগুল কে বাংলাদেশের আমাজন বলে তারা কি আমাজনের বিশালতা কে কোন দিন ধারন করতে পারবে, আমার কাছে তো রাতারগুলের সৌন্দর্য্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট থেকে কোন অংশে কম লাগে না। যাক সে সব কথা এ বনে কিন্তু এককালে সাপ, ব্যাঙ, গিরগিটি দেখা যেত। আশায় বুক বেঁধেও হতাশ হলাম পুরা যাত্রায় তাদের সন্ধান পেলাম না। জঙ্গলের একেবারে শুরুর দিকটায় মুতার বন।

 

ধীরে ধীরে বনের গহীনে ঢুকতে লাগলো আমাদের নৌকা, যত গহীনে ঢুকছি ততই জলে ডুবে থাকা মহীরুহের আচ্ছাদনে হারিয়ে যাচ্ছি। কি অদ্ভূত জলের রাজ্য। কোন বৃক্ষ হাটু পানিতে ভেসে আছে আবার কোন বৃক্ষ অর্ধেক জলে ডুবে গেছে। শামসুল হকের জলেশ্বরী রাজ্য ছিল কল্পনার জগৎ তবে এখানে বনের ভিতর আর এক বন দেখে লেখক নিশ্চয়ই জলেশ্বরী রাজ্যের কথা দ্বিতীয় বার ভাববেন। যতই এই জলেশ্বরীর গহীনে যাওয়া যাবে ততই গাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। সূর্যের আলোও অনেক জায়গায় এই বৃক্ষ ভেদ করে আসতে পারে না। আর বর্ষার সময় তো পানি এত পরিষ্কার থাকে সবুজাভ পানিতে গাছের প্রতিবিম্ব কে মনে হয় বনের নিচে আর একটি বন।

 

আহা এইতো আমার জলেশ্বরী। এর সৌন্দর্য্য যে ভাষায় বন্দী করা যায় না। তোমার সুধা পান করতে হলে আসতে হবে তোমার পানে। জলের রাজ্যে এতটাই মগ্ন ছিলাম ভুলে গিয়েছিলাম নাগরিক জীবনের যন্ত্রনা। ঘন হয়ে আসা বৃক্ষের কারণে কেমন অন্ধকারচ্ছন্ন সবুজাভ আভা দেখা যায় পুরো জলাবনে। গাছের ডালাপালায় মাঝে মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের কোষা নৌকা। তবে দুই পিচ্চি মাঝির সুনিপুন দক্ষতায় নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মন পবনের নাও।

 

দুই পিচ্চির মধ্যে একজন আবার পরীমনি কে বিয়ে করতে চায়। আহারে কচি মনের সরল ক্রাশ। কোন কালে তো আমাদের ও ছিল। ধীরে ধীরে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নৌকা। আর ইতিমধ্যে মাঝি আর মনা ভাই হেড়ে গলায় গান ধরলো। এই সুন্দর পরিবেশে খানিকটা যন্ত্রনা লাগলেও মানিয়ে যে নিতে হয় গ্রুপ ট্যুরে আসলে। আর গান তো সংক্রমণ। ভাইরাসের মত ছড়িয়ে পড়লো পাশাপাশি চলা দুই নৌকায়।

জলেশ্বরীর রাজ্যে যেহেতু এসেছি কিছুটা ধারনা নেয়া যাক তার ব্যাপারে। সিলেট বন বিভাগের উত্তর সিলেট রেঞ্জ ২ এর অধীনে প্রায় ৩০ হাজার ৩শ ২৫ একর জায়গা জুড়ে এ জলাবন, এর মধ্যে ৫শ’ ৪ একর জায়গার মধ্যে বন, বাকি জায়গা জলাশয় আর সামান্য কিছু উঁচু জায়গা। বর্ষাকালে পুরো ডুবে থাকলেও শীত আসলে শুকিয়ে যায় আমাদের জলেশ্বরী। তখন বনের ভেতরে খনন করা ক্যানেল গুলোতে পানির অস্তিত্ত্ব দেখা যায়। ক্যানেল ছাড়াও এই জলাবনের ভিতরে পাখির আবাসস্থল গড়ে তোলার জন্য ৩.৬ বর্গকিলোমিটার একটি লেক খনন করা হয়। তো বলা যায় শীত আসলে হাওড়ের মত এখানেও বসে পাখির মেলা। তবে এই পাখির মেলা আগে সারা বছরই থাকতো। মানুষের পদচারণে তারা আরও নিবিড়ে অন্য কোথাও বাস গড়েছে, পরজায়ি পাখিদের কি আর কোন ঘর আছে। তারা তো সত্যিকারের যাযাবর পাখি।

এ বনে প্রাকৃতিক ভাবে অনেক গাছ বেড়ে উঠলেও বন বিভাগ হিজল, বরুণ, করচ আর মুতা-সহ কিছু জলবান্ধবজাতের গাছ রোপন করে দেয় এ বনে। এ বনে গাছপালার ভিতর আরও উল্ল্যেখযোগ্য হল কদম, জালিবেত, অর্জুনসহ জলসহিষ্ণু। এছাড়াও আরও প্রায় ২৫ প্রজাতির গাছপালার সন্ধ্যান পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ বন বিভাগের সৌজন্যে সেই ১৯৭৩ সালেই রাতারগুল কে বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে যেমন আছে নানান প্রজাতির পাখি তেমনেই আছে নানান প্রজাতির বন্য প্রাণী। যদিও মানুষের ভীড়ে তাদের কে ইদানিং আর তেমন দেখা যায় না। মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, ফিঙে, বালিহাঁস, পানকৌড়ি থেকে শুরু করে বানর, উদবিড়াল, কাঠবেড়ালি, মেছোবাঘ ইত্যাদি এক সময় এই বনে অহরহ দেখা যেত।

এতক্ষন বক বক করতে করতে কখন যে ওয়াচ টাওয়ার এসে পড়লাম টেরই পেলাম না। ওয়াচ টাওয়ারে নৌকা ভিড়িয়ে আমরা সবাই উপরে উঠলাম। ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো বন কে যেন দেখতে পেলাম পাখির চোখ। আহা কি মায়া তোমার জলেশ্বরী। এখান থেকে নিচে তাকালে নৌকা গুলো ছোট হয়ে আসে, দূরের ওই নৌকার চলাফেরা দেখা যায়। আর পুরো বনটা যেন জেগে উঠে নতুন রুপে। যেদিকে তাকাই চারদিকে সবুজ আর সবুজ। আমরা সবাই ছবি তুললাম নিজেদের। আর গোটা কয়েক সেলফি স্মৃতি হিসাবে না নিয়ে গেলে তো পাপ হয়ে যাবে। দুপুরের শুকনা খাবার ছাড়া কোন দানা পানি পেটে পড়েনি তাই ক্ষুধাটাও বেশ চাগিয়ে উঠলো। নিচে নেমে ফারুক, ইরফান, নাদিম, ফয়সাল ভাই গং গোসল সেরে নিল।

 

এবার জলেশ্বরীর রাজ্য থেকে ফেরার পালা। আর না হয় গল্প না শুনাই। দেখা হবে আবার নতুন কোন জলের রাজ্যে। ততদিন স্মৃতিতে থাকুক আমার জলেশ্বরীর।  এবার কাব্যের ছন্দে বিদায় জানাই তোমায় রাতারগুল।

চেঙ্গি খালের বুকে হিজলের সারি
গোয়াইন নদী জুড়েছে সাথে জল হল ভারি;
আহা জলাবন রাতারগুল
তুমি যে লাল গোলাপি হিজল গাছের ফুল
এ যে বনের ভিতর আর এক বন
বর্ষার শান্ত জল কেড়েছে পথিকের মন।

হিজল গাছের প্রতিবিম্ব পড়ে জলে
এক সাথে যেন দুইটি গাছ, জেলে খুঁজে তাজা মাছ
পানি যায় আবার পানি আসে, সাক্ষী হয়ে-
হিজল গাছ গুলো দাঁড়িয়ে যে ভাসে।

ও হিজল গাছ
তুমি যে রবে এ বনে বার মাস
তোমার ছড়ানো ডালপালায় বাসা বাঁধে যে পাখি
তাই দেখে পথিকের জুড়ায় তব আঁখি
গভীর রাতে ফুল ফুটে, ঝরে যায় ভোরে
মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধে –
পথিক আসে কোষা নৌকায় চড়ে।

ধু ধু জলের উচ্ছ্বাসে প্রাণবন্ত হিজল
ঋতুচক্রে বর্ষা আবর্তে, নদী খাল বিল হাওড় হল সজল
বেলা গেল পথিকের হিজলের মায়ায়, রাত হল বনে
বাতাসের গর্জন – জ্যোৎস্নার গল্প শোনায় প্রতিক্ষনে।

সুনসান নির্জন এই জ্যোৎস্না রাতে
রুপালি চাঁদের আলো গলে গলে পড়ে-
ওই সারিবদ্ধ হিজল গাছের ফাঁকে
জল যে চিকচিক করে প্রতি বাঁকে বাঁকে।

ঘুমবিহীন জ্যোৎস্না রাতে দেখি
কুল কুল বয়ে যাওয়া গোয়াইন নদীর জল
ছোট ছোট ঢেউ তীরে তুলে ফেনা,পাই না খুঁজে হিজল গাছের তল
আহা মনরে- ঘর বাঁধ ওই জলাবনের দ্বীপে
জল-জ্যোৎস্নার কাব্য শোনাবে, জোনাকি আজ মেপে৷