Skip to content Skip to footer

ঋতুভিত্তিক পর্যটনের আহ্বান

অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান

অধ্যাপক ড. সৈয়দ রাশিদুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও পর্যটন বিষয়ে দেশের প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিধারী গবেষক। এথেন্সের ইকোনোমিক্স অ্যান্ড বিজনেস সায়েন্স ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ট্যুরিজম মার্কেটিংয়ে পিএইচডি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় তিনিই প্রথম ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি বিভাগ গঠনের প্রস্তাব দেন, যার ফলশ্রুতিতে ২০০৭ সালে এই বিভাগ চালু হয়। ২০০৯ সালে তিনি মার্কেটিং বিভাগ থেকে ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে যোগ দেন অধ্যাপক হিসেবে। প্রায় ৩৭ বছরের শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

শীত নয়, সব ঋতুই ভ্রমণের সময়

আমরা সাধারণত শীতকালকেই ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময় বলে ভাবি—ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, গরমের যন্ত্রণা নেই। অথচ ভুলে যাই, এ ভূখণ্ডে বছরের ছয় ঋতুতে ছড়িয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও রঙ। শীতের বাংলাদেশ যেমন নিরিবিলি সৌন্দর্যে মোড়া, তেমনি বর্ষার বাংলাদেশ যেন উদ্ভিন্না রমণীর বাঁধনহারা যৌবন; বসন্তের বাংলাদেশ আবার স্নিগ্ধতার মাদকতাময় আহ্বান। তাই ভ্রমণের আনন্দ পেতে হলে শুধু শীতে নয়, বরং প্রতিটি ঋতুতেই বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে হবে।

বর্ষার বাংলাদেশ: এক অপূর্ব আবেশ

শৈশবের রচনায় বর্ষার গ্রামের ছবি আঁকতে গিয়ে লিখতাম—চারিদিকে থৈ থৈ পানি, গ্রাম যেন ছোট ছোট দ্বীপ। রাত নামলে ব্যাঙের ডাক, নৌকার ছপছপ শব্দ আর ভুতুম পেঁচার ডাক মিলে তৈরি করত মায়াবী ভয়াল এক পরিবেশ। দূরের গ্রামে কেরোসিন বাতির টিমটিম আলো সেই দৃশ্যকে করত আরও রহস্যময়।
এমন বর্ষার রূপ সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায় হাওর এলাকায়। অথচ এখনো খুব কম ট্যুর অপারেটরই বর্ষার এই সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের সামনে তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছেন। অথচ এই সময়ের বিশেষ অভিজ্ঞতা শুধু পর্যটন মৌসুমের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তুলতে নয়, দেশের পর্যটন শিল্পেরও নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে।

বর্ষায় বান্দরবান অভিযান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম বিভাগের কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ছাত্রকে নিয়ে আমরা দুইজন শিক্ষক রওনা হলাম বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা—ঢাকা থেকে রুমা বাজার হয়ে ৩ হাজার ফুট উঁচু বিখ্যাত বগালেকে রাতযাপন, তারপর নীলগিরিতে মেঘের মাঝে আরেক রাত।

প্রথম চ্যালেঞ্জ এল নীলগিরি রিসোর্ট বুকিংয়ে—বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত হওয়ায় সেনা কর্মকর্তার মাধ্যমে বুকিং আবশ্যক। ভাগ্যক্রমে শেষ মুহূর্তে বাতিল হওয়া একটি বুকিং আমরা পেয়ে যাই।

রুমা বাজার থেকে বগালেক

বান্দরবান থেকে লোকাল বাসে রুমা বাজার যাত্রা, পথে সাঙ্গু নদীর ঘাটে পৌঁছে ট্রলারে দুই ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ—নদীর বুক চিরে যাওয়া, স্থানীয়দের নদীতে স্নান দেখা। মনে হল, এখানেই র‌্যাফটিং বা রিভার ট্রেকিং শুরু করলে কেমন হয়!

রুমা বাজারে পৌঁছেই জানা গেল—বগালেক, কেওক্রাডাং বা তাজিনডং যেতে হলে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ছাড়পত্র নিতে হবে, স্থানীয় গাইড সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। বিষয়টি আমাদের মনে করিয়ে দিল মিয়ানমারের মংডু শহরের কঠোর বিধিনিষেধের কথা।

পায়ে হেঁটে স্বপ্নের লেকে

বর্ষায় চান্দের গাড়ি পুরো পথ যায় না; ১৬ কিলোমিটার গাড়িতে, তারপর ৬ কিলোমিটার খাড়া পাহাড়ি পথে হাঁটতে হয়। ঘণ্টা দেড়েক কষ্টকর পদযাত্রার পর চোখের সামনে এল বগালেক—২৭০০ ফুট উঁচুতে, ১৫ একর আয়তনের এক স্বচ্ছ জলরাশি, যার গঠন প্রাচীন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বলে ধারণা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এখানে বাস করে ড্রাগন দেবতা।

লেকপাড়ের রেস্ট হাউজগুলোর অবস্থা অবশ্য হতাশাজনক—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাব। সেনাবাহিনী নীলগিরির মতো এখানে রিসোর্ট করতে চাইলেও স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা ছাড়া যে কোনও উন্নয়নই বাধাগ্রস্ত হবে—এটাই বাস্তবতা।

বৃষ্টির রাতের বগালেক

বিকেলে লেকের জলে স্নান শেষে রাতের বেলা চারদিকের অন্ধকার, সোলার আলো, নেটওয়ার্কহীন নিস্তব্ধতা—মাঝে মাঝে দূরে বিদ্যুতের ঝলক আর বৃষ্টির শব্দ মিলে যেন অন্য এক জগতে থাকার অনুভূতি। পাহাড়ের টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে মিশে ছিল ভয় ও মুগ্ধতা—এ অভিজ্ঞতা আজীবনের।

নীলগিরির মেঘমালা

পরদিন নেমে এলাম রুমা বাজারে, সেখান থেকে যাত্রা নীলগিরি রিসোর্টে। পাহাড়ি কটেজে বিকেলের দিকে ঘন মেঘে ঢেকে গেল চারপাশ—পাঁচ হাত দূরের মানুষকেও চেনা যায় না। আমরা যেন মেঘের ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম, মেঘের জল শরীরে মেখে।
ভোরে কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম—উপরে ঝলমলে রোদ, আর নিচে সাদা মেঘের সমুদ্র ঢেকে রেখেছে বান্দরবানকে। সত্যিই, ভ্রমণ স্লোগান—”মেঘ আর বৃষ্টির মাঝে বান্দরবানের পাহাড়ে”—শতভাগ পূর্ণতা পেল।

ঋতুভিত্তিক পর্যটনের সম্ভাবনা

এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল বর্ষার সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। অভিজ্ঞতা বলছে, সৃজনশীলতা ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে শীত, বর্ষা, বসন্ত—সব ঋতুতেই পর্যটনকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এতে যেমন ভ্রমণপিপাসুদের অভিজ্ঞতা বহুমাত্রিক হবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদানও বহুগুণে বাড়বে। প্রয়োজন কেবল কয়েকজন উদ্যমী, সৃজনশীল উদ্যোক্তা, যারা ঋতুর রঙে সাজানো ভ্রমণ প্যাকেজ উপহার দিতে পারবেন দেশের মানুষকে।