Skip to content Skip to footer

কলকাতা: সিটি অব জয়

কাজের সূত্রে কলকাতায় যাবার কারণে কলকাতার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমি নিবিঢ়ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছি। কলকাতা ভারতের তৃতীয় মেগাসিটি। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব ভালো হবার কারণে কলকাতার বাইরে থেকেও কয়েক লাখ মানুষ রোজ কাজের জন্য কলকাতায় ছুটে যায়, আবার কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। একদিকে কলকাতা সারারাত জেগে থাকে আবার কলকাতা ব্যস্ততম কলকাকলিতে জাগতে শুরু করে সকাল দশটার পর।
কলকাতায় সকাল দশটা মানে মেট্রোতে হুলস্খুল গাদাগাদি। ট্রেনে ওঠার জন্য ব্যাপক ঠ্যালাঠ্যালি। বাসে ওঠার জন্য বিশাল যুদ্ধ। অটো স্টেশনে বিশাল লম্বা লাইন। এটা সকাল এগারোটা পর্যন্ত একেবারে রীতিমত যুদ্ধ। সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত কলকাতার মেট্রো, ট্রেন, বাস মোটামুটি আরামদায়ক। বিকাল পাঁচটা থেকে আবার সেই ফিরতি চাপ। সবাই অফিস থেকে ঘরে ফিরবে। এই চাপ শেষ হয় রাত নয়টা নাগাদ। এরপর ঘণ্টাখানেক আবার একটু আরাম। রাত দশটায় মেট্রো বন্ধ হয়ে যায়। তখন আবার ট্রেন আর বাসের উপর একটু চাপ পড়ে। এমনিতে কলকাতায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর বাইরে কলকাতার বাইরে থেকে আরো প্রায় পঞ্চাশ লাখ মানুষ রোজ কলকাতায় কাজের সূত্রে আসা যাওয়া করে।

কলকাতায় থাকার সময় কাজের সূত্রে প্রায় দিনই আমাকে মেট্রো ধরে নর্থ থেকে সাউথে যেতে হয়েছে। প্রথম দিকে আমি থাকতাম বরানগর। আমার সাউন্ড স্টুডিও ছিল অজয়নগর। অজয়নগর আমি দুইভাবে যেতাম। রিকসা হাঁটা ও মেট্রো মিলিয়ে অজয়নগর স্টুডিওতে যাবার সময় লাগতো দেড় ঘণ্টা আর ফেরার সময় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।

এটা ছিল ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের সাউন্ড করার সময় আমার নিয়মিত যাতায়াত। ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রে সাউন্ড করেছেন অরিজিৎ মিত্র। অরিজিৎ দা সত্যজিৎ রায় ফিল্ম উনস্টিটিউটের সাউন্ডের টিচার।
‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের জন্য আমার মিউজিক স্টুডিও ছিল টালিগঞ্জ আর কল্যাণীতে। টালিগঞ্জ যেতে হলে আমি নোয়াপাড়া থেকে মেট্রো ধরে সোজা মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশনে নামতাম। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পনেরো মিনিটের পথ ছিল স্টুডিও। ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের মিউজিক করেছেন অংশুমান বিশ্বাস।
কাজ শেষে ফেরার সময় অংশুদার হাতে সময় থাকলে দু’জনে দমদম পর্যন্ত মেট্রো ধরতাম নতুবা মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত এসে অংশুদা ট্যাক্সি বা বাস ধরে শিয়ালদহ চলে যেতেন। আর আমি মেট্রো ধরে নোয়াপাড়া। আর যেদিন কল্যাণী স্টুডিওতে মিউজিকের কাজ হতো সেদিন আমাকে রওনা করতে হতো ভোর ছয়টায়। দমদম গিয়ে ট্রেনে সোজা কল্যাণী। সেখানে অংশুদা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতেন। তারপর সেখান থেকে সোজা বাবলাদার স্টুডিওতে। পনেরো মিনিটের পথ। ফেরার সময় রাত এগারোটা পর্যন্ত স্টুডিওতে কাজ করার পরেও আমি দিব্যি ট্রেন ধরে কলকাতায় আসতাম রাত একটার মধ্যে।
অবশ্য ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের কালার করার সময়টা আমি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থেকেছি। বিটি রোডের রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থাকার দিনগুলো ছিল চমৎকার। ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের কালার করেছেন আমির মণ্ডল। আমির আবার টানা কাজ করা পছন্দ করতো না। দুই দিন পরপর একদিন বা দুই দিনের বিরতি দিতো। ফলে আমি ওই সময়টায় কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় খুব ঘুরতাম।
ছুটি পেলেই সকালে চলে যেতাম দক্ষিণেশ্বর। দুপুর পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বর কাটিয়ে লঞ্চে চলে যেতাম বেলুর মঠ। সন্ধ্যায় শেষ লঞ্চে বেলুর মঠ থেকে সোজা এপারে কুটিঘাটে নামতাম। কুটিঘাটে রাত নয়টা/দশটা পর্যন্ত আড্ডা দিতাম রবীন্দ্র ভারতীর স্টুডেন্টসদের সাথে। বিশেষ করে আমাদের খুলনার ছেলে মাহমুদ আর সুনামগঞ্জের ছেলে সাদ্দাম ছিল আমার আড্ডার সাথী।
সবচেয়ে বেশি মজা হতো শনিবার। শনিবার আকাডেমিতে আড্ডা মারতে আসতো বন্ধু শিল্পী জয়ন্ত রায়। জয়ন্ত’র ব্যাচমেটরা প্রতি শনিবার আকাডেমিতে আড্ডা মারতে আসে। সিডিউল মিললে আমি চলে যেতাম আড্ডা মারতে। আমার বন্ধু ঝন্টু যোগী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে এখন মাইগ্রেট ফোক আর্টিস্টদের উপর। ঝন্টু’র সাথে বিশ্বভারতীতে পিএইচডি করছে মিনাক্ষী সেনগুপ্ত। মিনাক্ষী আর জয়ন্ত হলো হাসব্যান্ড-ওয়াইফ। ঝন্টু আমাকে নিয়ে ওদের বাসায়ও গেছে। এই শিল্পী জুটি’র সাথে আমারও বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
মনে আছে গত বছর পহেলা বৈশাখ আমরা জয়ন্ত আর মিনাক্ষী’র স্টুডিওতে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি। তখন আমি থাকতাম ঝন্টু’র বাসায়। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁয়ের ছেলে সুজন বর্মণ আর ঝন্টু এক বাসায় থাকতো। সুজন বাসা ছেড়ে দেওয়ায় এবং ঝন্টু বাংলাদেশে চলে আসার পর আমি উঠলাম মাহমুদের বাসায়। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী যত স্টুডেন্টস প্রায় সবার সাথেই আমার পরিচয় হয়েছে। আড্ডা মেরেছি। এর মধ্যে রনক হাসান রনো খুব গান শোনাতো। সাদ্দাম আর মাহমুদের অন্য বন্ধুরা বিশেষ করে মৃত্তিকা, বাপ্পা, শাপলা, তিথি, বিপ্রেশ। বিপ্রেশের বাড়ি হবিগঞ্জ। খুব ভালো গান করে বিপ্রেশ।
এছাড়া অনু, অমিতাভ, মৌ, সুস্মিতা, ঐশি, চঞ্চল, তমা, সৌরভ, তুষারদের সাথে আড্ডাগুলো কখনোই ভোলার মত নয়। এরা সবাই রবীন্দ্র ভারতীতে বিভিন্ন সাবজেক্টে পড়ে। ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের সাব-টাইটেল করেছি আমি আর সমৃদ্ধি। সমৃদ্ধি পাল সাদ্দামের বন্ধু। সমৃদ্ধি নিজের বাসায় খুব সুন্দর একটা স্টুডিও করেছে। সিনেমা ছাড়া ও আর কিছুই করে না। চব্বিশ ঘণ্টা ও সিনেমা নিয়েই থাকে।
কলকাতার বাইরে আমার একটা ঘাটি ছিল শান্তিনিকেতনে। বোলপুরে গেলে টানা এক সপ্তাহের আগে আর ফিরতে মন চাইতো না। পণ্ডিৎ মোহন সিং খানগুরার বড় ছেলে বিক্রম সিং খানগুরা’র রবীন্দ্র সংগীতের আমি খুব ভক্ত। বিক্রমের গান আমার সিনেমায় ব্যবহার করার ইচ্ছা থেকেই প্রথম শান্তিনিকেতনে যাওয়া। পণ্ডিৎ আবীর সিং খানগুরা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিক ডিপার্টমেন্টের অ্যাসরাজ প্রফেসর। শান্তিনিকেতনের এই ধ্রুপদী মিউজিক পরিবারের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের জন্য এক পরম পাওয়া। আবীর ‘হরিবোল’ চলচ্চিত্রের প্রথম লাইনআপ দেখেই একটা গান দেয় আমাকে। ভবা পাগলার গান। গেয়েছেন ফোকসম্রাট সনাতন দাস বাউল। ওই গানের জন্য আমি বাঁকুড়া সনাতন মন্দিরে গিয়েছিলাম।
সনাতন দাস বাউলের ছেলে বিশ্বনাথ দাস বাউলকে খুঁজে বের করতে আমাকে সহায়তা করেছেন সনাতন দাস বাউলের ছাত্রী পার্বতী দাস বাউল। পার্বতী দাস বাউলকে খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে আমার বাংলাদেশের বন্ধু সাইমন জাকারিয়া। সে এক বিশাল যজ্ঞ বিশাল ইতিহাস।
কলকাতায় থাকার সূত্রে আমি যাদের আতিথিয়তা পেয়েছি তারা হলেন কালীঘাটে আমার দাদা সত্যব্রত চক্রবর্তী, ব্গাুইআটির অমর মিত্র দাদা, গড়িয়াহাটের দীপেন ভট্টাচার্য দাদা, লর্ডসের বন্ধু দেবাশিস সরকার, দমদমের অরিজিৎ মিত্র দাদা, বাগুইআটির সমৃদ্ধি পাল, বরানগরের সুজন, মাহমুদ ও সাদ্দাম, শান্তিনিকেতনের বন্ধু আবীর ও দুর্বা। এসব মহান মানুষের সান্নিধ্য পাবার সুযোগ আমার এক জীবনে এক অপার পাওয়া।
এছাড়া কলকাতায় আমার আরেকটা ঘাটি হলো রাসবিহারী এভিনিউতে। কবি শুভংকর দাশের বাড়িতে। শুভংকর দা আমার এক পরম কবি বন্ধু। কলকাতায় আমার যে কোনো ধরনের পরামর্শ এবং আশ্রয় স্থল বলতে গেলে তিনটি। সত্যদার বাসা, শুভংকর দার বাসা আর বাপি’র বাসা। কলকাতার বাইরে আমার আরেকটা ঘাটি ছিল মোছলন্দপুর। ওখানে থাকে আমার ভাতিজা বাপি সিংহ। বাপি আমার ছোট ভাই’র বন্ধু হলেও আমার সাথে বাপি’র এক অন্যরকম বন্ধুত্ব।

কলকাতায় কর্মসূত্রে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটি থেকে বুঝেছি, ঢাকার চেয়ে কলকাতার মানুষ বেশি প্রফেশনাল। আমাদের মত খামাখা আড্ডা মেরে ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট করে না। কলকাতার সবাই ট্রেন-মেট্রো-বাস-লঞ্চের টিকিট কাটেন। আমাদের মত বাসের ভাড়া নিয়ে কন্ট্রাকটরের সাথে কোনো বচ্চা চোখে পড়েনি। ট্রেনে টিকিট চেক হয় না কিন্তু সবাই টিকিট কাটেন। কলকাতার এই সভ্যতা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
কলকাতার রাস্তায় সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলে। মেইন রাস্তায় হেলমেট ছাড়া কোনো মটরসাইকেল কেউ চালায় না। ট্রাফিক পুলিশ না থাকলেও সিগন্যালে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সবগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রাফিক আইন কঠোর ভাবে অনুসরণ করার এমন রীতি পাশের শহরে অথচ আমরা নিজেরা এটা চর্চা করতে পারলাম না।
কলকাতার সড়কগুলো ঢাকার চেয়ে বড় বড়। যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে ওরা সড়ক নির্মাণ করেছে। অনেব বেশি স্পেস নিয়ে ওরা ফুটপথ তৈরি করেছে। মানুষের চলাচলের জন্য কোনো ধরনের সমস্যা কলকাতার সড়কে নজরে পড়েনি। ট্রাফিক জ্যাম একদম হাতে গোনা। পিক-আওয়ারে ওইটুকু ট্রাফিক জ্যামকে আমি স্বাভাবিক বলতে চাই। ঢাকার মত সারাদিন লাগাতার ট্রাফিক জ্যাম এখন আর কলকাতায় নেই।
কলকাতার খাবার ঢাকার চেয়ে সস্তা। বিশেষ করে স্ট্রিট ফুড খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। তবে কলকাতার চেয়ে ঢাকার ভাতের হোটেল অনেক বেশি এবং গোছানো। কলকাতায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভাতের হোটেল না থাকাটা আমাকে খুব অবাক করেছে। এটা থেকে বোঝা যায় কলকাতার মানুষ সকালে আর দুপুরে বাসায় খায়। রাতের খাবার ওরা স্ট্রিট ফুড খেতে পছন্দ করে। রাতে রাস্তা থেকে রুটি, তরকা, আলু ভাজি, চাউমিন, ডিমরোল এসব ওরা রাস্তা থেকেই সংগ্রহ করায় অভ্যস্থ।
কলকাতার খাবারে আলু’র ব্যবহার খুব বেশি। এমন কোনো আইটেম আমার নজর এড়ায়নি যেখানে ওরা আলু ব্যবহার না করে। কলকাতার খাবার বলতে আমার কাছে সবকিছু আলুময়। আলু’র এই অতিব্যবহার জ্বিভের স্বাদ একদম নষ্ট করে দেয়। তবে কলকাতায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বার আছে। ইচ্ছা মত যে কোনো ধরনের ড্রিংকস কেনা যায়। কোনো ধরনের পুলিশি ঝামেলা নাই। ওরা যে আমাদের তুলনায় একটু সভ্য, এটা তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ।
একটা আদর্শ নগরির জন্য যে ধরনের টাউন প্লান করা দরকার, কলকাতা ঠিক সেভাবে গড়ে উঠেছে। এখনো কিছু এলাকায় ঘিঞ্জি বসতবাড়ি আছে, কিন্তু তা ঢাকার তুলনায় খুবই সামান্য। সড়ক ও ফুটপথের জন্য ওরা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে প্রয়োজন মত স্পেস ছেড়ে এগুলো নির্মাণ করেছে। আরেকটা জিনিস কলকাতার সড়কে ঢাকার মত এত খোড়াখুড়ি নেই। দিনের বেলায় তো প্রশ্নই ওঠে না। যদি কোনো সড়ক সংস্কারের প্রয়োজন হয়, সেটা রাত বারোটা থেকে সকাল ছয়টার মধ্যেই করা হয়। এটাই ওখানে আইন। এটা সবাই মেনে চলে।
আইন মেনে চলা শহর কলকাতা। তাই এত লোকসংখ্যা স্বত্ত্বেও কলকাতায় কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। কলকাতায় সড়কে কোনো মিটিং মিছিল নেই। কলতাতায় ফুটপথে কোনো হকারদের দোকান নেই। কিছু এলাকায় যা চোখে পড়েছে, ওটা আইন মেনেই করা। ঢাকার মত যেকোনো সড়কে ইচ্ছা হলেই আইন অমান্য করে কেউ সড়ক অবরোধ করছে না। এটাই কলকাতার সভ্য হয়ে ওঠার আরেকটা জ্বলন্ত উদাহরণ।
কলকাতা ঢাকার চেয়েও পুরাতন শহর। কলকাতায় শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের জন্য ওরা যে কী পরিমাণ জায়গা ছেড়েছে তা একটি আদর্শ শহরের জন্য খুব প্রয়োজন। এছাড়া ইডেন গার্ডেনস, সেন্ট পল ক্যাথেড্রারাল, রবীন্দ্রসদন, রবীন্দ্র সরোবর, ময়দান, ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন, শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন, সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি, নাখোদা মসজিদ, দক্ষিণেশ্বর, বেলুর মঠ, সায়েন্স সিটি, ফোর্ট উইলিয়াম, বিরলা প্লানেটারিয়াম, মার্বেল প্যালেস ম্যানসন, বিরলা মন্দির, জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি, বোটানিকাল গার্ডেন, আলিপুর চিড়িয়াখানা, হুগলী রিভারফ্রন্ট বিশেষ করে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত যত জায়গায় আমি ঘুরেছি, সর্বত্র খুবই পরিচ্ছন্ন শহর। কোথাও ভিখারির উৎপাত নেই।
ঢাকাকে যদি আমরা মসজিদের শহর ধরি, তাহলে কলকাতা হলো মন্দিরের শহর। ঢাকায় যেমন মাইকের শব্দে তেমনি কলকাতায় ঢাকের শব্দে কান ঝালাপালা হয় মাঝেমাঝে। হুগলী নদীকে ওরা খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছে। কলকাতাবাসীর কাছে গঙ্গা খুব পবিত্র নদী। তাই ওরা নদী নোংরা করে না। কেবলমাত্র প্রতিমা বিসর্জনের সময় কিছুটা নদী নোংরা করার দৃশ্য চোখে পড়েছে। কিন্তু হুগলী নদীকে ওরা আমাদের বুড়িগঙ্গার মত এতটা নষ্ট করেনি।
১৯৮৫ সালে ‘সিটি অব জয়’ নামে ফরাসি লেখক ডোমিনিক ল্যাপিয়ারের বইটি প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই কলকাতা বহির্বিশ্বে ‘সিটি অব জয়’ নামে নতুন করে পরিচিতি পেয়েছে।
কলকাতার মানুষ তাদের শহরকে ভালোবাসে। রাস্তায় মোড়ে মোড়ে পাবলিক টয়লেট আছে। রাস্তাঘাট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, প্রসস্থ। আইন মেনে সবাই ওখানে কলকাতাকে ভালোবাসে। কলকাতার পুলিশের সাথে পাবলিকের কোনো বচ্চা আমার চোখে পড়েনি, যা ঢাকার মোড়ে মোড়ে চোখে পড়ে। কলকাতার মানুষগুলো একটু কিপটে। এটা তাদের জীবন বাস্তবতা। ঢাকার মানুষের মত ওদের ওত টাকা নাই কিন্তু ওদের কাজ করার হিম্বত আছে। ওরা আইন মেনে মহানগরে চলে। তাই কলকাতাকে একজন পর্যটকের ভালো না বেসে কোনো উপায় নাই।
ঢাকা আর কলকাতা নিউ মার্কেটের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। আর ওখানে বাংলাদেশী মানুষ বেশি নজরে পড়েছে। যে কথাটি আমি বলতে চাই সেটি হয়তো অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে, তাই বলব না। কিন্তু ওরা আমাদের চেয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, গোছানো, নগর সভ্যতায় ওরা আমাদের থেকে কয়েকশো বছর এগিয়ে আছে। লাভ ইউ কলকাতা। লাভ ইউ সিটি অব জয়।

লেখক
রেজা ঘটক
কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা