Skip to content Skip to footer

কাঞ্চনজঙ্ঘা

শান্তরলাল ভট্টাচার্য

প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগে সমুদ্রতল ভেঙে উঠে দাঁড়ায় হিমালয়। ঝড়-তুষারের হাজারো আঘাতে কোটি কোটি বছরের খোদাইকর্মে গড়ে ওঠে বিশ্বের অনন্য সৃষ্টি— কাঞ্চনজঙ্ঘা। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম এই শৃঙ্গ (২৮,১৭০ ফুট) কেবল একটি পর্বত নয়, সে এক অপরূপা নারী, যাঁর সৌন্দর্যের তুলনা নেই। সূর্যোদয়ের মুহূর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে সোনালি, রুপালি, কমলা আলো যেন রঙের খেলা করে। সেই রূপে মোহাবিষ্ট হয়ে মানুষ প্রায়ই হারিয়ে ফেলে শিখরের পূর্ণ অবয়ব।

বাঙালির কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক আবেগের নাম। তবে এবার যে দৃশ্যটি আমি দেখেছি, তা শুধু বাংলার নয়, সমগ্র পৃথিবীর কাছে অজানা। টাইগার হিল থেকে বহুবার সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সান্ডি পাহাড়ে হঠাৎ চোখে পড়ল এক আশ্চর্য আলোচ্ছটা— কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে যেন উদ্ভাসিত দেবনাগরীর “ওঁ” চিহ্ন। দেবপ্রতীক এই আলোকলিপির বয়স কত, তা কেউ বলতে পারবে না। তবে এমন এক ঈশ্বরদর্শনের অভিজ্ঞতা, মনে হয় জন্মে একবারই ঘটে।

সান্ডি পাহাড়ের অভিজ্ঞতা

সেই দিন ভোরে আমরা বিশজন সাথী ছিলাম সান্ডি পাহাড়ের ইকো হাট হোমস্টেতে। ৬২০৬ ফুট উচ্চতার এই পাহাড়ে দাঁড়িয়ে এক ঘন্টা ধরে আমরা সবাই দেখেছিলাম সেই অপূর্ব দৃশ্য। ইকো হাটের প্রতিষ্ঠাতা রাজেন প্রধান— সমাজসেবী মানুষ, যিনি প্রায় এক যুগের পরিশ্রমে পাহাড়-জঙ্গলের কোলে এই ভ্রমণনীড় গড়ে তুলেছেন। এখানকার আয়ের বড় অংশ যায় স্থানীয় শিশুদের শিক্ষার খাতে।

সান্ডি গ্রামে মাত্র ষোলোটি পরিবার। প্রকৃতির কোলে তারা গড়ে তুলেছে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপন। ঘন পাইনের বন, পাশে ঝিল— সব মিলিয়ে জায়গাটা যেন বাংলার মাটি আর ইউরোপের প্রকৃতির মেলবন্ধন। লেকে নৌকা ভ্রমণে ঠান্ডার তীব্রতা টের পাওয়া গেলেও দৃশ্যের মোহে তা যেন ভুলে গিয়েছিলাম।

তাকদায় কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্রেষ্ঠ রূপ

২ ডিসেম্বর আমরা পৌঁছালাম তাকদায়। দার্জিলিং জেলার এই পাহাড়ি গ্রাম কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের জন্য অন্যতম সেরা জায়গা। সান্ডি থেকে তাকদার পথে ভাঙাচোরা রাস্তার কষ্ট সত্ত্বেও পৌঁছানোর পর মনে হয়েছিল— এই সৌন্দর্যের জন্য সবটুকু পরিশ্রমই সার্থক।

তাকদার এক হোমস্টেতে রাত কাটালাম। রাজেন প্রধানের আরেক উদ্যোগ এটি। পাহাড়ি রান্না, দার্জিলিং চা আর অপরিসীম আতিথেয়তায় ভ্রমণ আরও উপভোগ্য হয়ে উঠল। কিন্তু পরদিন ভোরে যে বিস্ময়ের মুখোমুখি হব, তা কেউ জানত না।

ভোরের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন জীবন্ত ভাস্কর্য। দূর থেকে মনে হচ্ছিল— শায়িতা এক ক্লিওপাত্রা, যার প্রতিটি অবয়ব সূর্যের আলোয় ফুটে উঠছে। মুহূর্তেই প্রেমে পড়ে যেতে হয় এই শিখরের। দিনের পর দিন তাকিয়ে থাকলেও তৃষ্ণা মেটে না। আলো-ছায়ার খেলায় প্রতিটি মুহূর্তে নতুন ছবি, নতুন গল্প তৈরি হয়।

বিদায়ের বেদনা

তাকদায় কাটানো সময়টা ছিল এক অপূর্ব উপাসনা। খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা— সবকিছুর মাঝেই চোখ লেগে থাকত কাঞ্চনজঙ্ঘায়। যেন পাহাড় আমাদের অবচেতন মনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সাহায্য করছিল।

কিন্তু ভ্রমণের শেষদিকে তাকদা ছাড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল, শৈশবের সেই দার্জিলিং ফেরার সময়ের মন খারাপ আবার ফিরে এল। পাহাড়ের প্রতিটি বাঁকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ যেন বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছিল।

কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু এক শিখর নয়, সে এক স্বপ্ন, এক সাধনা— যে স্বপ্ন একবার চোখে ভেসে উঠলে চিরকাল হৃদয়ে থেকে যায়।