Skip to content Skip to footer

গালিবের হাভেলির খোঁজে

দিল্লির চাঁদনি চকের রাস্তায় জনসমুদ্র—যানজট, ফুটপাত ভরতি ভিড়, হট্টগোল, আর মানুষ চলাচলের এক অন্তহীন ঢল। যেন নদীর স্রোতের মতো এগোতে হচ্ছে লাইনে দাঁড়িয়ে। আমি অমিতের পেছনে হাঁটছি—সে দিল্লির ছেলে, চেহারায় মোটাসোটা হলেও দৌড়ের গতি দেখলে চোখ কপালে উঠবে।

আমাদের গন্তব্য পুরোনো দিল্লির বালিমারানের এক সরু গলি।

চাঁদনি চকে কী নেই—শাড়ি, পোশাক, চুড়ি, জুতা, খাবার, এমনকি পুরোনো ক্যামেরাও পাওয়া যায়। বিয়ের বাজার করতে এ জায়গা মানুষের প্রথম পছন্দ। গুগল ম্যাপ দেখে দেখে অমিত পথ দেখাচ্ছে। জনারণ্য পেরিয়ে অবশেষে ঢুকে পড়লাম সরু গলির ভেতর।

পুরোনো দিল্লি বা শাহজাহানাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৮ সালে, যা বাহাদুর শাহ জাফরের আমল পর্যন্ত মুঘল রাজধানী ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা জাফরকে নির্বাসনে পাঠায় এবং শহরের বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়। শুধু লালকেল্লা আর জামে মসজিদ রয়ে গেল, বাকি অনেক স্থাপনা ভেঙে মিলিটারি প্যারেড গ্রাউন্ড তৈরি হয়। তবুও কিছু প্রাচীন স্থাপনা আর আঁকাবাঁকা গলি টিকে যায় সময়ের পরীক্ষায়।

১৯১১ সালে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে ফেরানো হলেও উন্নয়ন হলো নিউ দিল্লিতে—পুরোনো দিল্লি রয়ে গেল অবহেলিত, সরু রাস্তায় রাজত্ব করছে পথচারী, ঠেলাগাড়ি, সাইকেল, মোটরসাইকেল আর গরু। অনেক বাড়ি ভগ্নদশায়, কিছু নতুন হলেও সৌন্দর্যের বদলে যেন বিশৃঙ্খলা বেড়েছে।

আমরা ঢুকে পড়লাম কুচা রহমান গলিতে। দু’পাশে ছোট ছোট দোকান—সেলাই মেশিন মেরামত, হেলমেট, বাচ্চাদের পোশাক। ওপরে জট পাকানো বৈদ্যুতিক তার, গলি এঁকেবেঁকে সাপের মতো চলেছে। পথ দেখানোর জন্য এক কিশোর এগিয়ে এলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তার পেছনে ছোটাছুটি শুরু করলাম। গন্তব্য—‘গলি কাসিমজান’।

এই অখ্যাত লেনই এখন বিখ্যাত মির্জা গালিবের হাভেলির জন্য। গালিব (১৭৯৭–১৮৬৯) ছিলেন উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আগ্রায় জন্ম, ১১ বছর বয়সেই ফারসিতে কবিতা লেখা শুরু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিল্লির অভিজাত পরিবারে বিয়ে হলেও সংসারজীবন ছিল কষ্টকর—সাত সন্তানের কেউই ১৫ মাসের বেশি বাঁচেনি, পরে পেনশনও বন্ধ হয়ে যায়। মদ, গাঁজা ও জুয়ার নেশা তাকে আরও আর্থিক সংকটে ফেলে; ঋণগ্রস্ত হয়ে দুইবার কারাগারে যেতে হয়।

তবুও কবিতায় তার প্রতিভা ম্লান হয়নি। বাহাদুর শাহ জাফরের রাজদরবারে তিনি ‘রাজকবি’ উপাধি পান এবং ফারসি-উর্দু সাহিত্যে অমর হয়ে থাকেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে গৃহবন্দি হয়ে থাকেন, পরে জীবনের শেষ দিকে রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।

ছেলেটি জানাল, হাভেলি আর দূরে নয়। সরু গলিতে রিকশাও ঢুকতে পারে না, মোটরসাইকেল আর মানুষই শুধু যাতায়াত করে। আশেপাশের বাড়িগুলোর বেশিরভাগই ভাঙাচোরা বা অযত্নে তৈরি।

গলি কাসিমজানের ওই বাড়িটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো, যেখানে গালিব জীবনের শেষ ৯ বছর কাটিয়েছিলেন। বাড়িটি ছিল এক হাকিমের, যিনি গালিবের কবিতার অনুরাগী ছিলেন। পরে দীর্ঘদিন অবহেলিত ছিল—নব্বইয়ের দশকে তো এটি কয়লার গুদাম হয়ে যায়।

১৯৮৮ সালে গুলজারের টিভি সিরিয়াল মির্জা গালিব জনপ্রিয় হওয়ার পর নতুন প্রজন্ম গালিবকে নতুন করে চিনতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে আন্দোলনের ফলে ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার বাড়ির একাংশ অধিগ্রহণ করে জাদুঘরে রূপান্তর করে।

তবে জাদুঘরটি খুব সমৃদ্ধ নয়—কিছু ছবি, চিঠি, গালিবের পছন্দের খাবারের তালিকা, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য রয়েছে। দেয়ালে লেখা আছে তার মদপ্রেম, জুয়ার আসক্তি, ঘুড়ি ওড়ানোর শখ, আমপ্রেম—সবই যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।

প্রতি বছর ২৭ ডিসেম্বর ভক্তরা এখানে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার জন্মদিন পালন করে। আর তার সমাধি আছে নিজামুদ্দিন বস্তিতে, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের পাশে—সেখানে ‘গালিব একাডেমি’তে রয়েছে তার জীবন ও কর্মের স্মৃতিচিহ্ন।