Skip to content Skip to footer

গ্রেট বৃটেনের আঙ্গিনায় কিছু অপ্রিয় সত্য কথা

ঢাকার এক অল্পশিক্ষিত ধনাঢ্য ব্যক্তি—যিনি পরবর্তীতে অর্থবলেই রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন—এক নির্বাচনী সভায় চমক দেখাতে গিয়ে পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, “ইংল্যান্ডে ছবাই ছিক্ষিত; চাইর/পাচ বছরের পোলাপাইনগুলাও কি ছুন্দর গড়গড় কইরা ইংরাজিতে কতা কয়। আমগো দেশের ছবাইকেও ছিক্ষিত হইতে হইবো।”
(অর্থাৎ: ইংল্যান্ডে সবাই শিক্ষিত; চার/পাঁচ বছরের শিশু পর্যন্ত গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারে। আমাদের দেশেও সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে।)

ওই নেতার মতো ভঙ্গিতে না হলেও, আমাদের অনেকের ধারণা—ইংরেজ মানেই শিক্ষিত, ভদ্র আর পরিশীলিত মানুষ। দেশে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ দেখলেই আমরা তাকে “সাহেব” ভাবি, নারী হলে “মেমসাহেব।” আমিও ভেবেছিলাম, ওদেশের সবাই সুশিক্ষিত ও মার্জিত। কিন্তু ইংল্যান্ডে কিছুদিন কাটানোর পর সেই ধারণাটা ভেঙে যায়।

যেখানেই গেছি, স্থানীয়রা তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ইংরেজিতে কথা বলেছে। আমি বিদেশি বলে শুদ্ধ উচ্চারণে বলার চেষ্টা করেনি। আবার তাদের উচ্চারণ না বুঝতে পারলেই মনে হয়েছে যেন বলছে—“এ ভিনদেশি কোথা থেকে এল?” বার্মিংহামে বাসকে বলে বুস, এডিনবার্গে প্লেন ল্যান্ডিংকে লুন্ডিং—এসবই আমাকে নিজে বুঝে নিতে হয়েছে। লন্ডনের ককনিরা তো আরও জটিল—তাদের ওয়াটার হয় ওয়া-য়া, বাটার হয় বা-য়া, আর লেডি উচ্চারণে পরিণত হয় একেবারেই ভিন্ন শব্দে। বিদেশিরা যদি না বোঝে, সেটা নাকি তাদেরই দোষ।

জার্মানিতে এক বিদেশি ভাঙা-ভাঙা জার্মান বললেও স্থানীয়রা উৎসাহ দিয়ে বলে, “জি স্প্রেখেন হোক ডয়েস”—মানে, “তুমি তো দারুণ জার্মান বলছ।” কিন্তু ব্রিটেনে আঞ্চলিক টান বোঝা না গেলে মনে হবে তুমি ইংরেজির ‘ই’ও জানো না।

আমার এক ইংরেজ বন্ধু ভূগোলবিদ্যায় মাস্টার্স করেছে। একদিন তার মা হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো আমাদের দেশটা অনেক দেখেছ, কেমন মনে হয়?” আমি সত্যি কথাই বললাম—“দেশে থাকতে ভাবতাম, সব ইংরেজই সুশিক্ষিত ও মার্জিত। এখানে এসে বুঝলাম, তা নয়।” কথাটা শোনার পর তার মুখে যেন কালো মেঘ নেমে এলো। মনে মনে খারাপ লাগল—ওদের দেশেই বসে এমন অপ্রিয় সত্যটা বলে ফেললাম। কিন্তু একবার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না।

ইংল্যান্ডে বারো ক্লাস পর্যন্ত প্রতিটি শিশুর স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। না গেলে ক্লাস টিচার পুলিশ নিয়ে সরাসরি বাড়িতে হাজির হন। আমাদের দেশের মতো ওখানে প্রাইমারি শেষে পিএসসি, বা অষ্টমের পর জেএসসি নেই। বছরে একবার ক্লাস টিচারের মূল্যায়ন অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা উপরের শ্রেণিতে ওঠে। শিখল কি না, সেটা খুব একটা দেখা হয় না। কোচিং সেন্টারেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। বারো ক্লাস শেষে প্রথমবার সরকার অনুমোদিত পরীক্ষা দিতে হয়। পাস করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলে। তবে সবাই উচ্চশিক্ষায় যায় না; অনেকেই আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে ওঠে। আর চাকরি না পেলে সরকারি ভাতা তো আছেই।

একদিন বন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বোন আমাকে বার্মিংহামের কাছে একটি উইন্ডমিল দেখাতে নিয়ে গেল। ইংল্যান্ডে উইন্ডমিল খুবই বিরল, অথচ হল্যান্ডের উইন্ডমিল সারা বিশ্বেই বিখ্যাত। সেগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশ, অপূর্ব রূপে ভরা। কিন্তু ইংল্যান্ডের ওই উইন্ডমিলটি ছিল একেবারেই সাদামাটা। ফেরার পথে মেয়েটি গর্বভরে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগল?” আমি সোজাসাপ্টা বললাম, “হল্যান্ডের মতো নয়, ওদেরগুলো অনেক সুন্দর।” হাসিখুশি মেয়েটি হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। বুঝলাম, আবারও অপ্রিয় সত্য বলায় ওর জাত্যভিমান আহত হলো। তখনই মনে করলাম—পশ্চিমা জাতিগুলোর জাত্যগৌরব সত্যিই প্রবল, বিশেষ করে ইংরেজ, ফরাসি, জার্মানদের।

আরেকদিন আমার সেই বন্ধু হঠাৎ বলল, “জানো, আমাদের এখানে একটা নদী আছে।” নদীর নাম শুনেই আমার মন ছটফট করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “চল, দেখাও।” অনেকটা পথ গাড়ি চালিয়ে সে আমাকে নিয়ে এল এক ক্ষীণ স্রোতের কাছে। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আরও কিছুটা পথ গেলে নদী পাব। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “নদী আর কত দূরে?” সে আঙুল দেখিয়ে বলল, “এই তো নদী।” আমি চুপ করে গেলাম। মনে মনে বললাম, “এটিকে নদী বলার যোগ্য নয়, খাল বলা যায়।”

আমাদের দেশের পদ্মা, মেঘনা, তেতুলিয়া, পায়রা বা আগুনমুখার মতো বিশাল, দুরন্ত স্রোতস্বিনী নদী যদি একবার তারা দেখত, তবে বুঝতে পারত নদী কাকে বলে। বুক ভরে উঠত গর্বে। কিন্তু আজ দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের অসংখ্য নদী দখলদারদের হাতে দিনে-দুপুরে হত্যা হচ্ছে। এই সত্যটুকু আর মুখে আনিনি।

আমরা দু’জন ভাড়া করা ফাইবারগ্লাসের নৌকায় কিছুক্ষণ ঘুরলাম। ফেরার পথে বন্ধু আবার জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগল নদীটা?” আমি এবার কোনো উত্তর দিলাম না। কারণ, অপ্রিয় সত্য আর বলতে চাইনি।

ফারুক হাসান
একজন পর্যটন পরামর্শক, পর্যটক, লেখক ও গবেষক।