চেঙ্গিস খানের দেশে
আনোয়ারুল হক
হঠাৎ করেই আমন্ত্রণ পেলাম উলানবাটরে একটা কনফারেন্সে অংশ নেয়ার। ই-মেইল পেয়ে প্রথমে চেঙ্গিস খানের নামটাই ভেসে উঠলো – কানে যেন বাজতে থাকলো ঘোড়ার পায়ের খটখট আওয়াজ। ছোটবেলা থেকে যে কতো পড়েছি চেঙ্গিস খানের কথা। ঘোড়সওয়ার সমৃদ্ধ দুধর্ষ বাহিনী কিভাবে বড় একটা সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল, এমনকি এই উপমহাদেশেও চেঙ্গিস খানের নামে কাঁপতো সব রাজারা। সেই চেঙ্গিস খানের দেশে যাওয়ার আলাদা একটা উত্তেজনা তো আছেই।
বিরাণভূমির মঙ্গোলিয়া
ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মঙ্গোলিয়ার উত্তরে রাশিয়া আর দক্ষিণে চীন। আকারে ভারতের প্রায় অর্ধেক এই দেশের জনসংখ্যা কিন্তু মাত্র ৩০ লাখ। তবে মঙ্গোলিয়ার মোট ভূমির মাত্র অল্প অংশই চাষযোগ্য। উত্তর-পশ্চিম বরফে ঢাকা পাহাড়-পর্বতে ঘেরা আর দক্ষিণ জুড়ে বিশাল গোবি মরুভূমি। সে মরুভূমি এতোটাই বিস্তৃত যে টানা ৮/১০ ঘন্টা গাড়ি ড্রাইভ করলেও তার শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। উলানবাটর মঙ্গোলিয়ার রাজধানী – এই নগরে বাস করে দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ। মঙ্গোলিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর কোনো ধর্ম নেই। প্রায় তিন শতাংশ মুসলমানও রয়েছে, যাদের সবাই কাজাখ জাতিগোষ্ঠীর।
একদিনের পরিচয়ে হাজার বছরের বন্ধুত্ব
মঙ্গোলিয়ানরা সুপরিচিত তাদের অদ্বিতীয় আতিথেয়তার জন্য। প্রতিটি পদক্ষেপেই আতিথেয়তার ছোঁয়া। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ আছে কিনা, বা উলানবাটরে ঘোরাফেরা করতে কোনো সহযোগিতা লাগবে কিনা সব কিছুরই খোঁজ-খবর রাখছে আয়োজকেরা। সবার মুখে মিষ্টি হাসি। ডিনারে দেখি খাবার-দাবারের বিশাল আয়োজন। একটার পর একটা পরিবেশন চলছে। ভরা পেটে মুখে দিয়েও মনে হল এতো সুস্বাদু মুরগি আমি আমার জীবনে কখনো খাইনি। নরম কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর গন্ধে ভরা। পাশে বসা এক মঙ্গোলিয়ান তার দেশের একটি প্রবাদ বলল ‘একদিনের পরিচয় থেকে শুরু হয় হাজার বছরের বন্ধুত্ব।’
ব্যক্তিই বড়
যতটুকু বুঝলাম মঙ্গোলিয়ানদের স্বভাব আত্ম-কেন্দ্রিক। ‘নোমাড’ বা যাযাবর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা এই জাতির কমিউনিটি হলো নিজেদের নিকটাত্মীয়রা। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে উত্থান হলেও গত ২৫ বছরে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। কনফারেন্সে অংশ নেওয়া এক মঙ্গোলিয়ানের উপস্থাপনায় মনে হল, তারা আজকাল আগের চেয়ে আরো বেশী আত্মকেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে। বড় কমিউনিটিতে যেন আর আস্থা নেই। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ১২ শতকেও চেঙ্গিস খানতো একই কথা বলেছিলেন, ‘ প্রথমে নিজের ঘর সামলাও, তারপর ভাবো দেশের কথা।’ আমরা যেমন শ্লোগান বানিয়ে ফেলেছি যে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ। যদিও বাস্তবে করি উল্টাটা। এদের কাছে ব্যক্তিই বড়। আমরা কনফারেন্সে এসেছি সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে। আরেকটা প্রবাদের কথা বলি, যা মঙ্গোলিয়ানদের লড়াকু মনোভাবের প্রতিচ্চিত্র – ‘ঘোড়ার লম্বা মাথায় থাকা দু’টি চোখ যে দিক যেতে চায় সেদিকে যাও, পিঠে চেপে থাকা ঘোড়-সওয়ারের ইচ্ছেতে নয়।’ তারা সামাজিক বিশ্বাসও ফিরিয়ে আনবে, আশা করি প্রতিষ্ঠা করবে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সামাজিক দায়বদ্ধতা।
রাজাদের রাজা, স্বর্গের সন্তান – চেঙ্গিস খান
শুরুতেই চেঙ্গিস খান নিয়ে রোমাঞ্চের কথা বলেছিলাম। এয়ারপোর্টে নেমেই বোঝা গেল মঙ্গেলিয়ানদের আসল হিরো হলো চেঙ্গিস খান। তার নামেই এয়ারপোর্ট। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে তারই মূর্তি। সারা উলানবাটর জুড়েই তার সরব উপস্থিতি – বড় হোটেলটা তার নামে, মিউজিয়ামেও তিনি। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে তার প্রতিকৃতি। ১২০৬ সালে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন মঙ্গেলিয়ান সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলা খানতো চীনের প্রাচীর পেরিয়ে চীনও দখল করে নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইয়ুয়ান শাসনের। তার মৃত্যুও পর এই শাসনের পতন ঘটে।
চেঙ্গিস খানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তিনি মঙ্গোলিয়ান সবগোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ এবং একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তার তৈরি যোদ্ধারা ছিল সাহসী ও শক্তিশালী। তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ছোট ইউনিট ছিল ১০ সদস্যের। ১০টি ছোট দল মিলে গঠিত হতো মাঝারী ইউনিট। আর ১০টি মাঝারী ইউনিট (১০,০০০ জন) নিয়ে গঠিত হতো সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ইউনিটটি। বুদ্ধি ও অমিত সাহসের কারণে তিনি হয়েছেন সবার নেতা। উলানবাটরের মঙ্গোলিয়ান আর্ট মিউজিয়ামের এক কর্ণারে থাকা একটি লাইন যেন সত্যিই বর্ণনা করে তাদের নেতাকে ‘অল কিংস কিং, হেভেন্স সন – চেঙ্গিস খান।’
উট, ঘোড়া আর ট্রাফিক জ্যাম
মঙ্গোলিয়ান ‘নোমাড’ সংস্কৃতির সঙ্গে উট আর ঘোড়ার যোগাযোগ ওতঃপ্রোত। আমরা উপমহাদেশ বা আরবে যে উট দেখি তার কুঁজ কিন্তু একটা, কিন্তু মঙ্গোলিয়ান উটের কুঁজ দুইটা। আর এই উটগুলো আরবের উটের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এগুলো শক্তি প্রায় একেকটা নাকি হাতির সমান। আবার ঘোড়া ছাড়াও মঙ্গোলিয়াকে কল্পনা করা যায় না। এদেও সাম্রাজ্য গঠনের মূল শক্তিই ছিল অশ্বারোহী যোদ্ধা। ঘোড়সওয়ার সেই বাহিনী দখল করত রাজ্য, প্রতিষ্ঠা করতো তাদের সাম্রাজ্য। মঙ্গোলিয় ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়লো উট আর ঘোড়া নিয়ে অনেক শিল্পকর্ম। হোটেল থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে ন্যাশনাল একাডেমি ফর গভার্নেন্স ভবনে যেতে সকালে সময় লাগলো ৫০ মিনিট। আর জ্যাম হবেই না বা কেন, দেশের ৩০ লাখ লোকের প্রায় অর্ধেকই থাকে এই শহরে। শহরের আকার ঢাকার চেয়েও ছোট। সবাই গাড়ি নিয়ে বের হয় এবং সবগুলো চৌরাস্তায় জ্যাম। তবে ঢাকার অধিবাসী হিসেবে উলানবাটরের জ্যাম আমার কাছে কিন্তু অসহনীয় লাগেনি, ওরা তো আর আমাদের বিখ্যাত জ্যাম দেখেনি!
চীন গেলো, সোভিয়েত এলো, এখন পুঁজিবাদ
ইয়ুয়ান রাজ্যের পতনের পর চীনা রাজা মাঞ্চুর শাসন চলে মঙ্গোলিয়ায়। পুরো ১৭ শতক ধরে চলে মাঞ্চু শাসন ব্যবস্থা। ১৬ শতকের দিকে এই দেশে তিব্বতীয়দের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুরুষ বৌদ্ধ সন্ন্যাস গ্রহণ করে। এই শাসনের পতন ঘটে ১৯১১ সালে, মঙ্গোলিয়ানরা তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২১ সালে মঙ্গোলিয়া চীন থেকে মুক্ত হয়। এর পরপরই সেখানে সোভিয়েত আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। ১৯২৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী মঙ্গোলিয়া গঠিত হয় যা ছিল আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি স্যাটেলাইট অঙ্গরাজ্য। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর মঙ্গোলিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে যে নতুন সংবিধান লেখা হয় তাতে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং বাজার অর্থনীতির স্বীকৃতি দেয়া হয়।
এখন চলছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। বাজার অর্থনীতির বদৌলতে বিদেশী কোম্পানীগুলো এসেছে মঙ্গোলিয়ার খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজে। এদেশের কপার আর সোনা দুটি মূল্যবান খনিজ। কপার উৎপাদনে এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের একটি মঙ্গোলিয়া। আশা করা হয়েছিল এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। বাস্তবে মাত্র নয় হাজার লোকের কাজ জুটেছে এইসব কোম্পানীতে। বিভিন্ন চুক্তির অধীনে সরকার যে রাজস্ব পাচ্ছে তার পরিমাণও খুবই কম। অথচ ঠিকই লাভবান হচ্ছে বিদেশী কোম্পানীগুলো – সারা পৃথিবী জুড়েই কী একই দৃশ্য?
মঙ্গোলিয়ায় বাংলাদেশী?
হ্যাঁ, মঙ্গোলিয়াতেও বাংলাদেশী আছে সবমিলে দশজনের মতো। এদের বেশির ভাগই মঙ্গোলিয়ান মেয়ে বিয়ে করে এদেশে সংসারী হয়েছেন। এরকম একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। তিনি জানালেন, তার বউয়ের সঙ্গে পরিচয় কোরিয়াতে। ওখানে তিনি কাজ করতে এসেছিলেন। এরপর প্রেম এবং বিয়ে। বন্ধুত্ব হয়ে গেল মিন্টুনাথ নামের এক বাংলাদেশীর সঙ্গে। ওনার বাড়ি চট্টগ্রামে। এখানে একটি কলেজে অ্যাকাউন্টিং পড়ান। যে কোনো বাংলাদেশীর দেখা পেলেই সময় দেন। কয়েক বছর আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন উলানবাটরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। ওখানকার সব বাংলাদেশী তখন বিপুল উৎসাহে সহযোগিতা করেছিলেন সঙ্গে আসা সরকারী কর্মকর্তাদের। হাসিমুখে একজন বললেন, প্রধানমন্ত্রী এখান থেকে বেশ কয়েকটি উলের চাদর কিনেছিলেন। টিভিতে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁকে এখনো সেগুলো পরতে দেখি। চোখে মুখে তার এক ধরনের প্রশান্তি, যেন মঙ্গোলিয়ান উলের গর্বে গর্বিত তিনি নিজেও।
নারীর সরব উপস্থিতি
উলানবাটরে ঘুরলে সব জায়গাতেই দেখা যায় নারীর সরব উপস্থিতি। মনে হয় যেন নারীরাই শহরের সব পরিচালনা করছে। কারণ জানতে চাইলে এক সরকারী কর্মকর্তা হাসতে হাসতে বলেন, ‘পুরুষরা কাজে ব্যস্ত থাকে, আর নারীরা শপিং করে’। আমি বলেই ফেললাম, ‘আপনার উত্তরটা কিন্তু খুবই জেন্ডার অসংবেদনশীল।’ আসল কারণটা পরে জানলাম, এদেশের মেয়েরা জানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের জায়গা করে নিতে হলে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক ডিগ্রিটা লাগবে। যেহেতু বেশির ভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু উলানবাটরে, তাই এখানে মেয়েদের চলাফেরাও এখানে বেশি।
মঙ্গোলিয়ান সঙ্গীতে বিষাদের সূর
মঙ্গোলিয়ায় ক্রিকেট
অবাক হলাম জেনে যে, মঙ্গোলিয়ানরাও ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে। উলানবাটরে এখন দু’টি ক্রিকেট ক্লাব। এতে প্রথমে যোগ দিয়েছে উপমহাদেশ থেকে আসা ভারতীয়, বাংলাদেশী আর পাকিস্তানী – সবাই। এখানকার অস্ট্রেলিয়ান দুতাবাস একজন কোচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার তত্ত্বাবধানে হাতে-খড়ি হচ্ছে ক্রিকেটারদের। বেশ কয়েকটি স্কুলে ক্রিকেট খেলা চালু হয়েছে। আমার বন্ধু মিন্টু নাথও একটি ক্লাবে নিয়মিত ক্রিকেট খেলেন।
ঠান্ডার দেশের হেমন্তকাল
উলানবাটরে আমার প্রথম দু’দিন ছিল উজ্জ্বল রৌদ্রালোকিত। তাপমাত্রা ১৩/১৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। মনে হচ্ছিলো সত্যিকার হেমন্তকাল। রাস্তার ধারের রঙ্গীন ফুল আর রঙ্গীন হয়ে ওঠা গাছের পাতাগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিলো বছরের সেরা সময় পার করছে উলানবাটর। তৃতীয় দিন সকালে হোটেলের জানালা দিয়ে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। বের হয়ে দেখি- একেবারে কনকনে ঠান্ডা। মোটা জ্যাকেট, মাফলার আর টুপি চাপিয়েও ঠান্ডা কমছিল না। আফসোস করছিলাম কেন যে হাতমোজাগুলো আনিনি?
জীবনও থেমে নেই। আমিও বের হলাম শহর দেখতে। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দেখি ছোটখাট একটা জটলা। কাছে গিয়ে দেখি নব বিবাহিত এক দম্পতিকে ঘিরে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের ভীড়। ঠান্ডার মধ্যে কনে হাসিমুখে ছবির পোজ দিয়ে যাচ্ছেন আর কাঁপছেন। বিয়ের পর পার্লামেন্ট ভবনের সামনে এসে ছবি তোলাটাও এদের একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।
কাশমেরি উল না কিনলে ভ্রমন অসমাপ্ত
মিন্টু নাথ আমাকে নিয়ে গেলেন গোবি কাশমের উলের শো-রুমে। অসাধারণ সব উলের কালেকশন। সূক্ষ উলের সূক্ষ কাজ। হাতে নিলে মনে হয় কোনো ওজনই নাই। আর এতো নরম স্পর্শ যে হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যায়। অথচ ঠান্ডার সময় গা গরম করতে এগুলোর জুড়ি নাই। বিস্ময় হলো, এতো পাতলা উল এতো ওম দেয় কিভাবে! এই উল তৈরি হচ্ছে কোনোটা উটের পশম দিয়ে, আবার কোনোটা ভেড়ার পশম থেকে। শো-রুমে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই মন ভালো হয়ে গেল। বুঝলাম ‘গোবি’ ব্র্যান্ড কেন এই ট্যাগলাইন করেছে – ‘ট্রিপ টু মঙ্গোলিয়া ইজ ইনকমপ্লিট উইদাউট গোবি কাশমের।”
দু’তিন দিন তাতেও যাা অভিজ্ঞতা যা হলো তা মধুর। আর মঙ্গোলিয়ানদের আতিথেয়তা সত্যি ভোলার নয় – একদিনের চেনাশেনা যেন হাজার বছরের বন্ধুত্ব।
আনোয়ারুল হক।
দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ২১ এপ্রিল, ২০১৮ সংখ্যায় ‘চেঙ্গিস খানের দেশে’ নামে এক লেখার ঈষৎ সংক্ষেপিত ভার্সন প্রকাশিত হয়েছিল।
দানিয়ুব পাড়ের দুর্গ নগরী
এলিজা বিনতে এলাহী , পর্যটক ও শিক্ষক
দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন সবে মাত্র ভ্রমণ কাহিনী পড়া শুরু করেছি। বাসার গল্পের বইয়ের তাকে ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলী। তাঁর লেখনীর মাধ্যমেই দানিয়ুব নামটার সাথে পরিচয়। সে সময় আবছা এরকম একটি ধারনা তৈরি হয়েছিল- শান্ত স্বভাবের দানিয়ুব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কৃষ্ণ সাগরে গিয়ে মিশেছে। অস্ট্রিয়া , হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়াতে দানিয়ুবের দেখা পেয়েছি , কিন্তু ঠিক কি যেন বুঝতে পারিনি। সেটাও স্পষ্ট করে এখন বলতে পারবো না কি বুঝিনি।
দানিয়ুবের মোহনীয়তা, কমনীয়তা ধরা পড়েছে আমার কাছে ডেভিন ক্যাসেল দেখতে গিয়ে। ডেভিন গ্রামের ডেভিন ক্যাসেল। হ্যাঁ স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিসলাভা থেকে ১২কিলোমিটার দূরে অবস্থান এই ঐতিহাসিক ডেভিন ক্যাসেলের।
ডেভিন ক্যাসেল শুধুমাত্র স্লোভাকিয়ার জন্যই নয়, মধ্য ইউরোপের গুরুত্বপুর্ন স্থাপনা গুলোর মধ্যে অন্যতম। নদীর তীরবর্তি হবার দরুন এখানে মানুষ বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নিওলিথিক যুগ থেকে। আর বর্তমানে এই ডেভিন গ্রাম স্লোভাকের প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে কাজ করছে। নতুন পাথরের যুগ থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ডেভিন ক্যাসেল ইউরোপের জাতীয়, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক জীবন এমনকি পর্যটনের জন্য একটি উল্লেখ্যযোগ্য স্থান বলে বিবেচিত ।
ডেভিন ক্যাসেলকে ১৯৬১ সালে স্লোভাকিয়ার জাতীয় সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ক্যাসেলটির অবস্থান সমুদ্র সমতল থেকে ৭০০ ফুট উঁচুতে টিলার উপর দানিয়ুব ও মরাভিয়া নদীর মাঝে।
ইতিহাসে ডেভিন ক্যাসেল
ডেভিন ক্যাসেল স্লোভাকিয়ার একটি জাতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সত্যি কথা বলতে, ডেভিন ক্যাসেল এবং স্লোভাক এই দুটি নাম বর্তমান স্লোভাকিয়ায় একে অপরের পরিপূরক।
ডেভিন ক্যাসেলের কথা বলতে গেলে একটু পেছনে না তাকালে আসলে গল্পটা অসম্পুর্ন থেকে যাবে। পাথুরে টিলার উপর মধ্যযুগের এই দুর্গ নির্মানের বড় কারণ দুটো কারণ হলো রাজনৈতিক। নিজের অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত রাখা আর অর্থনৈতিক বিষয়টা যুক্ত হয়েছে নদী পথে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনায়।
অষ্টম শতকে প্রথমে এখানে একটি কাঠের দুর্গ নির্মান করা হয়। তারও প্রায় একশ বছর পর এখানে দুর্গ নগরী গড়ে ওঠে রাজার বাসস্থান সহ। যুগে যুগে এই দুর্গ নগরীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজারা। তেরশ শতকে এটি হাঙ্গেরি কিংডমের অধীনস্ত হয়। একইভাবে চৌদ্দশ শতকে অস্ট্রিয়া , পরে আবারও হাঙ্গেরি কিংডমের অধিকারে যায়। ১৪৪৪ সালে জার্মানীর ফ্রেড্রিক ফোর ডেভিন ক্যাসেল দখল করেন। সময়ের পরিক্রমায় হাত বদল হতে থাকে এই দুর্গ নগরী। সর্বশেষ দুর্গটি উনিশ শতকে স্লোভাকিয়ার পাফি রাজবংশের অধিকারে ছিল। ১৮০৯ সালে নেপোলিয়ানের আর্মি ডেভিন ক্যালেসটি ধ্বংসস্তূপে পরিনত করে।
আধুনিক যুগেও ডেভিন ক্যাসেলের রাজনৈতিক গুরুত্ব এতটুকু কমেনি কারন এর অবস্থান পুর্ব সোভিয়েত আর পশ্চিমা দেশের সীমান্ত রেখায় । ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত এই সীমান্ত এলাকা “ মিলিটারি রেস্ট্রিটেড জোন” ছিল চেকোস্লোভাকিয়া তিন খন্ডে ভাগ হবার আগ পর্যন্ত।
যেমন দেখেছি ডেভিন ক্যাসেল
ব্রাতিস্লাভা শহরের প্রায় মাঝামাঝি ছিল আমার থাকবার হোস্টেল। ভ্রমণ খরচ কমাবার জন্যই হোস্টেলে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেনজেনভুক্ত দেশগুলো ভ্রমনের সময় আমি সব সময়ই বেছে নিয়েছি হোস্টেল, ডরমেটরি অথবা এয়ারবিএনবি। সেখনাকার অভ্যর্থনা কক্ষে ডেভিন ক্যাসেলের কথা বলার সাথে সাথে আমার হাতে একটি ম্যাপ ধরিয়ে দেয়া হলো। শুধু তাই নয় ম্যাপে কলম দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো যাবার উপায়। ইউরোপ ভ্রমণই মুলত আমাকে অভ্যস্ত করেছে ম্যাপ দেখে যেকোন স্থান খুঁজে বের করা। সেটা নিজের টেলিফোন সেটের গুগল ম্যাপ হোক অথবা হোটেল না হোস্টেল থেকে সরবরাহ করা কাগজের ম্যাপই হোক।
হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ৩/৪ মিনিট হেঁটে ট্রামে করে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে ডেভিন ক্যাসেল যেতে হয়। ডেভিন ক্যাসেল যাবার জন্য আলাদা বাসই নিয়োজিত আছে। সেই বাসস্ট্যান্ড থেকে ডেভিন ক্যাসেল যেতে ৩০মিনিট সময় লাগে।
বাস একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিল। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিছুদূর যাবার পরই দেখতে পাচ্ছিলাম দুর্গের চূড়া। বেশ খানিকটা মানে, ১০/১৫ মিনিট পায়ে হেঁটে যাবার পর টিকিট ঘর দেখতে পেলাম। ইউরোপের স্টুডেন্ট হবার দরুন টিকিটের দাম অর্ধেক রাখা হোল। সব না, কিছু কিছু পুর্ব এবং মধ্য ইউরোপের দেশ গুলোতে স্টুডেন্টদের জন্য মিউজিয়াম এবং ঐতিহাসিক স্থান গুলো ভ্রমনে এই সুবিধা পেয়েছি। তবে গ্রীসের কথা বেশি করে মনে আছে , কারন সেখানে স্টুডেন্টদের জন্য দর্শনীয় স্থান গুলোতে বিনা টিকিটেই যাওয়া যায় , শুধু টিকেট ঘরে শিক্ষার্থী হবার পরিচয় পত্র দেখাতে হবে।
টিকেট নিশ্চিত হবার পর আবারও হাঁটতে হবে। পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় ভাবছিলাম , সেই মধ্যযুগে এই রাস্তা দিয়ে কারা হেঁটে গেছেন। শুধু কি সৈন্য-সামন্তরা বা ঘোড়া ,হাতি এই রাস্তা দিয়ে যেত, নাকি রাজারাও যেতেন। নেপোনিয়ানের আর্মি দল যখন এই দুর্গ দখল করেছিল বা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল , তখন কি তিনি এখানে এসেছিলেন। আচ্ছা ধরে নিচ্ছি এসেছিলেন, তাহলে কোন পথ দিয়ে গেছেন? আমি কি সেই একই পথে হাঁটছি? এরকম নানা অমুলক কথা চিন্তা করতে করতে এসে পৌঁছলাম ডেভিন ক্যাসেলের সামনে। ভিতরে যাবার আগে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখতে থাকলাম মধ্যযুগের দুর্গনগরী।
বর্তমানে যেটুকু টিকে আছে, সেখানে রাজা বা সম্রাটদের বাসস্থানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে প্রতিটি স্তরে সেখানকার লিখিত ইতিহাস থেকে অনুমান করে নিতে হবে অবয়ব। টিকে থাকা দুর্গটি আমার কাছে পুরোটাই একটি প্রকান্ড পাথর খন্ড মনে হয়েছে।
দুর্গের শীর্ষে উঠবার পর আপনি উপভোগ করতে পারবেন দানিয়ুব আর মরাভিয়া নদীর আসল সৌন্দর্য। দুর্গের উপর থেকে দুই নদীর নীল জলরাশি আর সামনের ঘন জঙ্গল আপনাকে কিঞ্চিৎ হলেও মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দিবে। শীর্ষ থেকে ডেভিন গ্রামের চারপাশ এবং বহতা নদী বহুদূর দৃষ্টিগোচর হয়। সেই থেকেই বোঝা যাচ্ছে দুর্গনগরী হিসেবে কেন এই অঞ্চলকে বেছে নেয়া হয়েছে।
আমি যেহেতু গ্রীষ্মের সময় ভ্রমণ করছিলাম তাই আকাশ একদম পরিস্কার ছিল আর উপর থেকে দানিয়ুব আমাকে তার দিকে বার বার ইশারা করছিল শরীর ও মন ভেজাবার জন্য। সেটা সম্ভব ছিল না, কারন ভ্রমণ লিস্টও তাড়া দিচ্ছিল অন্য স্থানগুলো দেখবার জন্য।
পুরো চত্বরে দেখেছি দুটি মিউজিয়াম একটি সাময়িক আর একটি দুর্গের নিচে। দুর্গের নিচেরটিকে মনে করা হয় এটি ছিল দুর্গের গোপন কুঠুরি। আর সাময়িক মিউজিয়ামটি মূল দুর্গ কেন্দ্রের খোলা জায়গায়। মিউজিয়ামগুলোতে নানা তথ্যের সাথে আছে সেই সময়ের ব্যবহার্য জিনিসপত্র , অস্ত্র , পোশাক। গোটা ডেভিন ক্যাসেল ভালো করে দেখতে হলে দিনের প্রায় আধা বেলা দিতে হবে।
দানিয়ুবের পাড়ে
দুর্গের উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম নদীর ধারে একটি সাইকেলের পথ। সেখানে পর্যটকরা সাইকেলে ঘুরে দেখছেন দানিয়ুবের রূপ। প্রায় ২০কিলোমিটার দীর্ঘ সাইকেলের পথ রয়েছে দুই নদীর ধারে। ক্যাসেল থেকে বের হয়ে সেদিকে গেলাম। পায়ে হাঁটার পথও আছে। দানিয়ুবের পাড়ে ক্যাসেলের গা ঘেঁষে রয়েছে স্লোভাকিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ। দেখতে পেলাম ,সাইকেলে পর্যটকরা চলে যাচ্ছেন গ্রামের ভিতরে , স্লোভাক গ্রামীন জীবন দেখবার জন্যে।
আমি ধীর পায়ে দানিয়ুবের হাওয়া খেতে খেতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে অগ্রসর হলাম। পেছন ফিরে আরও একবার দেখে নিলাম মধ্যযুগের স্মৃতি বহনকারি ডেভিন ক্যাসেল।
বাসে অন্য গন্তব্যে যাবার পথে ভাবতে থাকলাম আমাদেরও তো রয়েছে এরকম জলদুর্গ, দুর্গনগরী। পৃথিবীর কটা পর্যটক আসলে সে কথা জানে। পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম, আমরা নিজেরা কতটুকু জানি বা হেরিটেজ ভ্রমনে বের হই নিজের দেশে।
নিশ্চয়ই আমরাও একদিন ইতিহাস সংরক্ষনে সচেতন হবো, আমাদের হেরিটেজের গল্পও ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে।
লিংকন সাইকেলওয়ালা
সাইদুর রহমান লিংকন
১৮৬১ শব্দ- ১৩৫০
সবেমাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি, আব্বা জাপান, কানাডা, জার্মান পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশে পাঠাতে গিয়ে অনেক টাকা পয়সা নষ্ট করেছেন। আব্বা বলে দিলেন তোমাকে ভালো দেশ গুলোতে পাঠাতে গিয়ে আজ আমি ক্লান্ত। পালে তুমি সৌদি আরব গিয়ে হজ্ব করে ভালো মানুষের মত জীবন যাপন শুরু করো। সত্যি সত্যি আজ আমি বুঝি আব্বা, আমার জন্য কত টাকা পয়সা, সম্পত্তি নষ্ট করেছে।
ঘোরাঘুরির শখ যখন মাথায় চেপে বসলো তখন মাত্র ৫০০ ডলার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম অজানাকে জানার জন্যে সাথে শুধু দু’চাকার একটা সাইকেল। দিল্লি থেকে পাঞ্জাবের গোল্ডেন প্যালেস হয়ে আটারি বর্ডার দিয়ে পাকিস্তান যাই। পৃথিবীর যতগুলো দেশে যাই সবচাইতে বেশী অসুবিধায় পড়তে হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তান সত্যিই এক বর্বর জাতি, তা আমি পাকিস্তানে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। পাকিস্তানের ইমিগ্রেশন কথাই শুনতে চায় না। ভিসা থাকা সত্ত্বেও আমাকে ডিপোর্ট করতে চেয়েছিল কয়েকবার। ১২ ঘণ্টা লকআপে রেখে দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার অবশেষে তাদের খানসামা বশিরের অনুরোধে আমাকে ছেড়ে দেয়।
ভারতে সন্ধ্যায় ভালুকের সামনে পড়ে ভেবেছিলাম এখানেই বিশ্ব পরিব্রাজকের বিশ্বভ্রমণ শেষ কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন। ইরানে ইংলিশ বলার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা, সেখানে ডলারের রেট পর্যন্ত কম দেয়। পাহাড় ঘেরা তেহরানে সাইকেল চালাতে গিয়ে অল্প সময়ে ক্লান্ত হয়ে ভ্রমনের প্রতি অনীহা চলে আসে, আবার পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামতে গিয়ে নিজের অজান্তে মনের ইচ্ছার পরিবর্তন হয়ে যায়। অবাক পৃথিবী।
গ্রিস
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যে ছোট্ট দেশটিতে পশ্চিমা সমাজে গড়ে উঠেছিল তার নাম গ্রিস। চেশমে থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে শিপে উঠলাম। শিপে পরিচয় হলো চেশমে সিটির মেয়র আর মার্কিন পর্যটক নিকের সাথে, তারা আমার ডায়রিতে কমেন্ট লিখে দিলো। আমি তাদের আমন্ত্রণ জানালাম লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়ার জন্য। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে শিপ এসে ভিড়ল। আবার নামার পালা। বের হওয়ার গেটের উপরে লেখা রয়েছে “ ডবষপড়সবফ ঃড় এৎববপব “ এবার ইমিগ্রেশনের পালা। তারা কিছু কুকুর নিয়ে আমাকে ওয়েলকাম জানালো! তছনছ করে খোঁজা হলো আমার ব্যাগগুলো আর পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেল ভিতরের রুমে। সাইকেলে বাংলাদেশের পতাকা, বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখে তারা যেন একটা দুর্বল হরিণের উপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। অবশেষে তারা আমাকে আটকাতে পারেনি।
শহরে এসে বোঝা যাচ্ছে গ্রীস অত্যন্ত ব্যস্ত একটা শহর। রাস্তায় হাটার সময় পথচারীকে জিজ্ঞেস করে নিলাম বন্ধু আলমগীরের বাসায় যাওয়ার নির্দেশনা। তাছাড়া সংবাদপত্রের দোকান থেকে একটা মানচিত্র কিনে নিলাম। গ্রিসে এসে লক্ষ করলাম এখানকার ছেলেমেয়েরা মেলামেশায় শিথিল। বন্ধু আলমগীর বাসায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। যেহেতু আলমগীর দিনে কাজ করে তাই রাতে ছাড়া আলমগীরকে পাওয়া মুশকিল। রাতে খাওয়ার পর শুরু হলো আলাপ।
এবার ইতালি যাবার পালা। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করে বিদায় নিলাম। আমার হরগঙ্গা কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানিক আমাকে জড়িয়ে ধরে কঁদছিলো। ইতালির এক বন্ধুর নাম আর ফোন নাম্বার দিয়ে দিল যাতে সেখানে তার সাথে দেখা করি।
ইটালি
উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দক্ষিণ ইউরোপের দেশটির নাম ইতালি। বড় বড় ইমারত আর চার্চে ভরা এই দেশ। তাদের মিউজিয়ামগুলোতে বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো সংরক্ষিত। দেশটির চারদিকে সমুদ্রসৈকত, উঁচু পাহাড়, জলপ্রপাত আর সবুজে ভরপুর মাঠঘাট।
শীপে করে গ্রিস থেকে ইতালি উদ্দেশে রওনা দিলাম। শীপে রাতে হালকা একটু খাবার খেয়ে চাদর দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে কফি আর ব্রেডের সাথে ওমলেট খেলাম। আবার গিয়ে সবার উপরের ডেকে কিছুক্ষন বসে রইলাম। কিছু ছবিও তুললাম। চারদিক কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। শুধু পানি আর পানি। এত জলরাশির মাঝে এত বড় জাহাজ তাকে একটা কীটপতঙ্গের মত মনে হলো। প্রায় তিনটার দিকে শিপটা ইটালি এসে থামলো। ইমিগ্রেশনের লোক জানতে চাইল, তুমি এখনে কতদিন থাকতে চাও? আমি বললাম তিন মাস, অবশ্য পরে তারা আমাকে ছয় মাসের অনুমতি দিয়েছিল।
তিন চারবার কল করে কাংখিত ব্যক্তিকে পেলাম। তার কাছ থেকে জমিদারপাড়ার আলম ভাইয়ের ফোন নাম্বার পেলাম। আলম ভাই আমার দূরসম্পর্কের বড় ভাই, তাছাড়া আমার বন্ধুও বটে। ভালই হলো আলম ভাইকে পেয়ে। আলম ভাই মুন্সিগঞ্জ জেলায় ব্যডমিন্টনে সবসময়ই চ্যাম্পিয়ন হতেন। আমি তো তার ফোন নাম্বার পেয়ে মহাখুশি। ফোনে পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন আমি তোমার ঠিক ৮/১০ ব্লক দূরে আছি তুমি ঠিকানা দাও আমি তোমাকে নিয়ে আসি। তাকে আসতে নিষেধ করে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইকেলসহ আমি গিয়ে পৌঁছালাম। আমাকে পেয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরলেন, আবেগঘন কণ্ঠে আমাকে বললেন, তোমাকে ৬/৭ বছর পর দেখলাম। তোমাকে এভাবে পাবো তা কোনদিনও ভাবিনি। রাত তখন প্রায় বারোটা হবে। আলম ভাইয়ের রুমমেটরা তখন সবাই ঘুমিয়ে আছেন। আমাকে পরম মমতায় নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন। তারপর শুরু হল আমাদের গল্প। কিভাবে আলম ভাই ইতালি এলেন। ইটালির অবস্থা কেমন? তিনি কোথায় কাজ করেন, কত বেতন পান, ভোর ৭টায় কাজে যান বাসায় ফিরেন রাত ৮/৯ টায় রোজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আলম ভাই সকাল বেলা চলে গেলেন কাজে। আমি বেরিয়ে পড়লাম বাংলাদেশ দূতাবাসে সেখানে দেখা হলো ফার্স্ট সেক্রেটারি আক্তারুজ্জামান এর সাথে। তিনি আজ আর বেঁচে নেই। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এফএমও ছিলেন। তিনি না থাকলে হয়তো আমার বিশ্বভ্রমণই হতো না। তিনি আমাকে দেখে অনেক কথা বললেন ইতালিতে কতদিন আছি? এরপর কোথায় যাচ্ছি? ইউরোপের পরবর্তী ভিসাগুলো তার একান্ত চেষ্টা হয়েছিল। তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তার এই ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। এজন্য তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
ফ্রান্স এম্বাসিতে ভিসার জন্য গেলাম তারা বলল যে ১০ দিন পর জানাবে। পরেরদিন টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। লুক্সেমবার্গ দূতাবাস জানিয়ে দেয় ভিসা হবে না। মনটা খুব খারাপ হলো, ফ্রান্স দূতাবাস বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির লেটার লাগবে। আক্তারুজ্জামান সেটা সমাধান করলেন। পাসপোর্ট আনতে ফ্রান্স দূতাবাসে যাই। সেখানে উজ্জ্বলের সঙ্গে দেখা। বললো, লিংকন আমি গত পরশু ইটালি এসেছি। আমি বললাম আমি আগামী পরশু সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি। আমি যখন কোন দেশে ঘুরাঘুরি করে বের হয়ে অন্য কোন দেশে যাই ঠিক তখনই এভাবে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়ে যাচ্ছে উজ্জ্বলের সঙ্গে।
আলম ভাইয়ের বাসায় সবাইকে বলে রাখলাম হয়তো যাওয়ার সময় অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। তবে এখানে পনির মামা, হাকিম মামা ওনারা এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। পরদিন রাতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভার উদ্দেশ্যে রওনা হবো।
সুইজারল্যন্ড
ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ সুইজারল্যান্ড। বরফে ঢাকা সুন্দর, স্বাধীনচেতা মানুষের বসবাসের স্থান হিসেবে পরিচিত। একে পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয়। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী হলো বার্ন। মানুষ সুন্দরের পূজারী। তাইতো মানুষ সুন্দরের সন্ধানে চলে যায় দূর থেকে দূরান্তে। সুইজারল্যন্ড এমন একটি সুন্দর দেশ যা ভ্রমণ না করলে কোন পর্যটকেরই ভ্রমন সম্পন্ন হবে না। সুইসরা বন্ধুসুলভ আচরণ করে থাকে। আমার এই পর্যন্ত দেখা ৩০টি দেশের মধ্যে সুইসদের সবচেয়ে বেশি ভদ্র, হাসিখুশি, আনন্দিত দেখেছি। তারা মারামারি-কাটাকাটি, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিশ্বাসী নয়, বরং তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন এবং অন্যের যুদ্ধবিরতিতে অবদান রেখে থাকে।
চারদিক পরিপাটি সাজানো-গোছানো সুন্দর সুইজারল্যান্ড সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ। সবকিছুর দাম খুব বেশি এবং ভাড়া ও তুলনামূলক বেশি। জেনেভায় গিয়ে মুন্সীগঞ্জের নজরুলকে পেলাম। নজরুল তার বাসার ঠিকানা দিয়ে বললেন সেখানে যেতে, সে আগেই ফোন করে বাসায় বলে রেখেছে। নজরুল জেনেভার প্রবাসী সমিতির সেক্রেটারি। বাঙালি অধিবাসীদের মাঝে অধিকাংশই সুইস মেয়েদের কন্ট্রাক্ট ম্যারিজের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডে বসবাসের বৈধ কাগজপত্রর ব্যবস্থা করে থাকে। যদিও প্রথমে প্রত্যেকেই রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। মুন্সিগঞ্জের এক বন্ধুর অপুর সাথে দেখা হলো। অপু ট্রেনে করে তার আরেক বন্ধু মুন্সীগঞ্জের ফারুক ভাইয়ের বাসায় নিয়ে গেলেন।
বার্ন ঘুরে ফিরে চলে গেলাম জুরিখ। তবে জুরিখ যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগে আব সুইজারল্যন্ডের সভাপতি এবং বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি তাজুল ইসলামের বাসায় গেলাম। সেখানে নৈশভোজের সময় তাজুল ইসলাম নানা বিষয়ে পরামর্শ দিলেন। তিনি আমাকে সুইজারল্যান্ড থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। অবশেষে আমরা রাত ১২টায় আনোয়ারের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই। আনোয়ারার আমি মুন্সীগঞ্জ ‘কে কে গভ.ইনস্ টিউশন থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমার জানা ছিল না আনোয়ার এখানে আছে, তবে বন্ধুর অপুর মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া গেলো।
প্রতিটা দেশে মিডিয়ার কল্যাণে অনেক প্রচারণা পাই। তাছাড়া ইরান বাংলা নিউজ, কুয়েত টিভি,পাকিস্তান টিভি, আরবিসি রেডিও, বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকাতে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার হয়।
নিউইয়র্ক
৩০টা দেশ ঘুরে অবশেষে আমি নিউইয়র্ক চলে আসি। আর আমি আমার স্কুল-কলেজের বন্ধু জাকিরকে পেয়ে যাই নিউইয়র্ক-এ। নিউইয়র্কে শত চেষ্টা করেও কোন স্পন্সরের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাছাড়া নিউইয়র্কে আসার পর পরই আব্বা মারা যান। আমার ইচ্ছে ছিল দেশের পশ্চিম দিক থেকে বের হয়েছিলাম আর পূর্ব দিক দিয়ে দেশে ফিরবো। তিন মাস পর্যন্ত কোনো কাজ করিনি দেশে ফিরে যাব বলে। নিয়তির একি পরিহাস ইচ্ছের বিরুদ্ধে থেকে যেতে হলো। থিতু হয়ে যাই প্রানের শহর নিউইয়র্কে।
নিউইয়র্কে আসার পরপরই ঢাকা ড্রামা থিয়েটার গ্রুপের সদস্য হয়ে সাংস্কৃতি জগতের সাথে মিশে আছি। আমার ভ্রমনের উপর প্রথম বই “দিগন্ত ছোঁয়ার গল্প” আর দ্বিতীয় বইটি “সাইকেলে বিশ্বজয়” বই দু’টি পড়লে আপনারা বিস্তারিত জানতে পারবেন আমার ভ্রমণ-কাহিনী।
প্রায় ২২ বছর যাবৎ ড্রাইভিং স্কুলের ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করছি। আমার পেশা একটি জনসেবামূলক কার্যক্রম বলা যায় কেননা এই ড্রাইভিং স্কুল থেকে অনেকে লাইসেন্স নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সাইকেল আমার জীবনের একটা ব্র্যান্ড তাই নামের শেষে সাইকেলওয়ালা লাগিয়ে দিলাম, কেউ আইসক্রিম বিক্রি করলে হয় আইসক্রীমওয়ালা, রিক্সা চালালে হয় রিক্সাওয়ালা, সাম্পান চালালে হয় সাম্পানওয়ালা, আর সাইকেল চালিয়ে আমি আজ “লিংকন সাইকেলওয়ালা”।
ঙহ ঔধহ ৯, ২০২০, ধঃ ৮:২৭ চগ, ঝধরফঁৎ খরহমশড়হ <ংৎষরহমশড়হ@মসধরষ.পড়স> ৎিড়ঃব:
মধু কবির সমাধি প্রাঙ্গনে…
-মালেকা পারভীন
১৩৬২ থেকে ১২১২ শব্দ
এবার যে কদিন কোলকাতা ছিলাম (২৮ নভেম্বর-০৪ ডিসেম্বর ২০১৮), মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানসূচির বাইরে আর কোথাও যাই বা না যাই, খ্রিস্টান কবরস্থানে যাবো এবং মধুকবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে আসবো। আমার এক ভাবীর কথা মতো, যেন অনেকটা “ঋণ শোধ করা।” স্টার্টফোর্ড-অন-আভন এ আমার শেক্সপীয়রের জন্মস্থান সফরের কথা শুনে তার বিস্মিত উচ্চারণ ছিলঃ “ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রীর এযে একেবারে ঋণ শোধ করা ! আমিও তো কতবার লন্ডন গেলাম! কই, আমার তো একবারও ওখানে যাওয়ার কথা মনে হলো না !”
বলা বাহুল্য, ভাবীও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী কিনা। সাহিত্যের প্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টানও আছে। বই পড়েন। বইয়ের খোঁজ-খবর রাখেন। কিন্তু আমার এই সাহিত্যিক ভ্রমণের কাহিনী তাঁকে এতোটাই চমৎকৃত করলো যে, আমি আর আগ বাড়িয়ে বেশি কিছু বলিনি।
এই ভাবীর সৌজন্যে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ রচিত এবং কোলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পিতৃপুরুষ (১৮২৪-১৮৭৩) মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অসামান্য জীবনীগাঁথা ‘আশার ছলনে ভুলি’ বইটি সংগ্রহ করি ২০১২ সালে। এরপর ২০১৩ সালে আমার ব্রাসেলস এর প্রবাস জীবনে পড়ে শেষ করি। ইচ্ছা ছিল, পার্শ্ববর্তী দেশের রাজধানী শহর প্যারিস এর ভার্সেই নগরে গিয়ে কবির স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে আসবো।
। কোলকাতায় আসার পর সেই সুযোগ একদিন মিললো মাত্র ঘন্টা দেড়েকের জন্য। ৩রা ডিসেম্বর দুপুর গড়াবার আগে তাই গাড়ি নিয়ে ছুট লাগালাম। গন্তব্য পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। চালক নতুন। রাস্তাঘাট এখনও চিনে উঠতে পারেনি। শেষমেশ আমিই নির্দেশনা দিয়ে ঠিকমতো নির্দিষ্ট কবরস্থানের দ্বারে গিয়ে হাজির হলাম। লোয়ার সার্কুলার রোড বা মাদার তেরেসা সরণির ওপরেই এটি অবস্থিত। শুধু ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরে আসতে হয় বলে কিছুটা ঝামেলা।
ক্রিশ্চিয়ান সিমেটারির দ্বারে নেমে ভেতরে ঢুকে উদ্দেশ্য বলতেই একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন। তার আগে একটা খাতায় নাম, পরিচয়,ঠিকানা লিখতে হলো। “আসুন, আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।” বয়স্ক লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। আমি আর আগ-পাছ না ভেবে তাঁর পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম।
যেতে যেতে একা একাই অনেক কথা বলে যেতে থাকলেন তিনি। আমি কিছু জানতে না চাইলেও। নাম, ধাম, আরও অনেক কিছু। কোলকাতার টানে বলা তাঁর কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিল।
“আমি আপনাকে আরও কিছু সুন্দর জিনিষ দেখাবো।” কবর যে সুন্দর জিনিস হয় এই প্রথম শুনলাম।
“না, না, আমি শুধু এখন মধুসূদন দত্তের সমাধিটা দেখতে চাই। আরো কিছু বিখ্যাত মানুষের সমাধি দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাড়াহুড়াতে নাম লিখে নিয়ে আসতে পারিনি।”
“কোন অসুবিধা নেই। আমি আপনাকে সব দেখিয়ে দবো খন।”
বেশি দূর যেতে হলো না। কয়েক পা ফেলতেই চোখে পড়লো লাল-সাদার এক নির্দেশক ফলক। তাতে লেখা “মধু-বিশ্রাম পথ”। আমার বুঝতে আর বাকি থাকলো না যে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। এতো তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো ভাবতে পারিনি।
এরপর অল্প কিছু সময়। গাইড সাহেব ঠিকঠাক নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটা আর মহাকবির সমাধি দুটি পাশাপাশি। ১৮৭৩ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে দুজন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। হেনরিয়েটা ২৬ তারিখে আর কবি ২৯ তারিখে। তাঁদের দুজনের শেষ সময়ের করুণ বর্ণনাও পড়েছিলাম উল্লিখিত বইটিতে। মহাকবির জীবনালেখ্য গ্রীক ট্রাজেডির এক মহাকাব্য যেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। ।
জুতা খুলে ভেতরে ঢুকে সমাধির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। নীরবে। নিজের ‘এপিটাফ’ বা সমাধি-লিপি কবি নিজেই রচনা করে গিয়েছিলেন। অনেকবার পড়া সেই বিখ্যাত সমাধি-লিপি আরও একবার পড়লাম তাঁর সমাধি পাশে দাঁড়িয়ে। অনাদরে, অবহেলায় মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেবার পনেরো বছর পরে কবির সমাধিস্থলে সেই সমাধিলিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিলঃ
“দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে!তিষ্ঠ ক্ষণকাল!এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধু সূদন !
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ন নামে, জননী জাহ্নবী !”
বেশ কিছুটা সময় ঘুরে ফিরে দেখলাম। সাথে গাড়ির চালক ছিল। সে কিছু ছবি তুলে দিলো। ওদিকে নিজের মতো এক মনে কথা বলেই চলেছেন গাইড সাহেব।
“আপনারা অনেক বড়লোক আছেন,দিদি।” বুঝলাম, কিছু বখশিসের জন্য এই অযাচিত তোষামোদ।
“কে বলেছে আপনাকে? আমরা ছাপোষা সরকারি চাকুরে।”
“বিদ্যা, বুদ্ধি, টাকা; তার নাম ঢাকা, দিদি।”
এইবার আমাকে থমকাতে হলো। একটু হেসেও ফেললাম। তাঁর দিকে ভালো করে তাকালাম। কালো প্যান্ট, সাদা ফুল হাতা শার্টের ওপর কমলা রঙের নকশা-কাটা চটকদার কোটি। হাতে ঘড়ি, মাথায় ক্যাপ। বেশ-ভুষায় চমক আছে। কেবল পায়ের পুরনো চপ্পল জোড়া ধূলায় মলিন। সারাদিন তাঁকে কবরগুলির পরিচর্যা করতে হয়; পানি ঢালতে হয়। চাইলেও জুতা পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। সেটা জানলাম কিছু সময় পরে।
“কে বলেছে আপনাকে এসব?”
“আমি জানি। আমিও তো বাংলাদেশের। ফরিদপুরের। আমার ঠাকুরদা, বাবারা তো ওই সময় চলে এসেছেন।” বুঝলাম, দেশ বিভাগের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
আগেই জেনেছি, তাঁর নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। তিনি খুব ঠাটের সাথে বললেন, “আর এন ব্যানার্জি।” পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তাঁর বাবার নাম ঈশ্বর প্রমথনাথ ব্যানার্জি; ঠাকুর মশাই এর নাম ঈশ্বর নিত্যগোপাল ব্যানার্জি। মনে হলো, যে কোন কারণেই হোক, তিনি নিজের নাম থেকে ঈশ্বর অংশটি বাদ দিয়েছেন। আর এন ব্যানার্জি বলতে এবং শুনতে বরং আরও বেশি শ্রুতিমধুর।
হয়তো ফেলে আসা পিতৃভূমি থেকে আগত একজন মানুষকে পেয়ে তিনি এমন প্রগলভ হয়ে উঠেছেন। আমি তাঁকে বাধা দিইনা, তেমন কিছু বলিওনা। দুয়েকবার তাঁর কথা শুনে তাঁর দিকে তাকিয়ে একটু হাসি। হয়তো তাতেই তিনি কিছুটা প্রশ্রয় দেখতে পান। আর তাঁর মনে যা কিছু আছে তা প্রকাশ করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
“আইতে শাল যাইতে শাল; তার নাম বরিশাল।” “ঢেকোনা, খুলনা,পাবনা।” “পদ্মা, যমুনা, মেঘনা; কিছু আমি দবো না; আর কিছু আমি নবো না।” তাঁর ছেলে-মেয়েদের কথা। তাঁদের নিয়ে গিয়ে একবার নিজের জন্মভূমিটা দেখিয়ে আনবার ইচ্ছার কথা। ইত্যাদি। অনেক দূরের অতীত থেকে স্মরণ করে পিতৃভূমির বিখ্যাত জায়গাগুলোর নাম তিনি এভাবে ছন্দে-সুরে গেঁথে রেখেছেন। মনের সেতারের প্রতিটি তারে। সুযোগ মতো সেগুলো তিনি আওড়াতে ভালোবাসেন। তাতেও যদি কিছু মনের সুখ মেলে। নিজের দেশের নাম উচ্চারণেই যে সব সুখ। সেই নিজের দেশ যত দূরেই থাকুক, যত অধরাই থাকুক।
“চলেন, দিদি, আপনাকে আরও কিছু সুন্দর জিনিস দেখাই। ওই যে বেথুন সাহেব ছিলেন, উনারটাও দেখে যান। আরও কিছু।” এতক্ষণে বুঝে গেছি, সারাদিন এই কবরস্থানের দেখ-ভাল করতে গিয়ে ব্যানার্জি বাবুর কাছে একেকটি কবরই হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের প্রতীক। সাধারণ মানুষ এড়িয়ে চললেও তাঁর কাছে এই কবরই সব; এই কবর ঘিরেই যত আয়োজন। অথচ, প্রতিটি মানুষের অবধারিত শেষ ঠিকানা এখানে এই সত্য অনুধাবন করতে পারলে ব্যানার্জি বাবুর মতো আমাদেরও কবরকে একটি সুন্দর জিনিস হিসেবে ভাবতে খুব বেশি মানসিক পরিশ্রম করার প্রয়োজন পড়বে না।
আমি আর এন ব্যানার্জির দেখিয়ে দেওয়া পথে তাঁর পিছে পিছে হেঁটে যাচ্ছি। যেতে যেতে তিনি বললেন, “আমি খুব সৌখিন আছি, দিদি। একেক দিন একেক পোশাক পরি। চটিও আলাদা।” আগেই একবার দেখেছি। তাঁর কথা শুনে আরও একবার ধূলা-মাখানো পুরনো চটিজোড়ার দিকে তাকিয়ে চুপ মেরে গেলাম।
ব্যানার্জি বাবু আমাকে বেথুন সাহেবের সমাধিস্থলে নিয়ে গেলেন। লর্ড বেথুন এর পুরো নাম ঔড়যহ ঊষষরড়ঃ উৎরহশধিঃবৎ ইবঃযঁহব (১৮০১-১২ অগাস্ট ১৮৫১)। আমি ব্যানার্জি বাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম কবরগাত্রে উৎকলিত নামটির দিকে।
“দেখেছেন, উনার নামের মাঝখানে ড্রিঙ্কওয়াটার?”
খুব সুন্দর করে হাসলেন আমার গাইড। “খুব বুঝি জল খেতেন?”
আরও অনেক ব্রিটিশ লাটের মতো লর্ড বেথুন এর নামও আমার জানা ছিল। তবে তিনি এখানে সমাহিত আছেন ওই মুহূর্তে মাথায় ছিলনা। তিনি ছিলেন ভারত-প্রেমী এক ব্রিটিশ রাজকর্মচারী। বেথুন বালিকা বিদ্যালয় (বেথুন স্কুল) ও বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করে এ উপ-মহাদেশে বাংলার নারী জাগরণের সূচনা করেন। বেথুন কলেজ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ। বেথুন সাহেব ইংরেজিতে মহাকাব্য লিখতে আগ্রহী মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলায় লিখতে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। আজ তাঁরা একই স্থানে স্বল্প দুরত্বে চির নিদ্রায় শায়িত। স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের এ এক অপূর্ব নিদর্শন। আমি শুধু মধুকবির সমাধি দেখতেই এখানে ছুটে এসেছি। ব্যানার্জি বাবুর কল্যাণে বেথুন সাহেবের সমাধিস্থলও দেখা হয়ে গেলো যারা জীবদ্দশায় একে অপরের কাছে পরিচিত ছিলেন।
ঘড়ি তাড়া দিচ্ছিলো ফিরে যাবার। ফিরে গিয়ে নির্ধারিত অনুষ্ঠানসূচিতে যোগ দিতে হবে। আরো খানিকটা এদিক-ওদিক ঘুরে ব্যানার্জি বাবুর হাতে ৫০০ রুপি গুঁজে দিয়ে ঐতিহাসিক সমাধিস্থল থেকে বের হয়ে আসবার জন্য পা বাড়ালাম।
ব্যানার্জি বাবুকে বললাম, “ভালো থাকবেন। আর ওই বিড়ি জিনিসটা ফুঁকবেন না। ওটা শরীরের জন্য ভালো না।”
“সেঞ্চুরি না করে মরছি না, দিদি। আর একবার বাংলাদেশে আসতে চাই। বাপ-দাদার ভিটাটা একবার দেখতে চাই।”
“অবশ্যই আসবেন।” বলে বিদায় নিলাম।
***
লেখক পরিচিতিঃ
মালেকা পারভীনের কাছে আরাধনার আরেক নাম সাহিত্য। তিনি বিশ্বাস করেন বেঁচে থাকার আনন্দ পরিপূর্ণতা পায় একনিষ্ঠ সাহিত্য মগ্নতায়। সেই ব্রত নিয়ে তিনি তাঁর মতো করে নিমগ্ন আছেন একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধনায়। পড়া আর লেখাকে তিনি গ্রহণ করেছেন জীবনের যাবতীয় প্রতিকুলতা মোকাবিলায় মোক্ষম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে। অবধারিত বাড়তি পাওনা বিশুদ্ধ আনন্দ যার স্বরুপ অপার্থিব।
মালেকা পারভীন মূলত ছোটগল্প লিখে থাকেন। কবিতাও তাঁর আরেক ভালোবাসা। চাকরিসূত্রে এবং নিজের মনের ভ্রমণ পিপাসা মেটাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘোরার সুবাদে লিখেছেন ভ্রমণ গাঁথা। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন এবং অনলাইন সাহিত্য পাতায় নিয়মিতভাবে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়ে আসছে।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ সিদ্ধান্ত (গল্পগ্রন্থ, ২০১২), অনুধাবনের মতো কিছু (গল্পগ্রন্থ, ২০১৫) সব পাখি ঘরে আসে (গল্পগ্রন্থ, ২০১৮), বৈদেশ বৈরাগে (মুক্ত গদ্য ২০১৯)।
***
শান্তি, ফিরে এসো
রচনা – শ্রেয়সী লাহিড়ী
————————-
‘এদের কি সবই সুন্দর? এই পাহাড়, উপত্যকা, চিনার গাছ, টিউলিপ, জাফরান, আপেল, গোলাপ আর লাবণ্যমাখা সুন্দর মুখ – প্রকৃতি যেন এদের উজাড় করে সাজিয়েছে। কিন্তু, পৃথিবীর এই স্বর্গে এত বারুদের গন্ধ কেন? কেন এত রক্ত, এত আশান্তি?’
ভেরিনাগের বাগানে বসে এইসব এলোমেলো ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কাশ্মীর উপত্যকা কি গোলাগুলি, কার্ফু, আর্মি – এই করেই শেষ হয়ে যাবে? কিছুক্ষণ আগেই আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইড বিট্টু সিং-এর সঙ্গে ট্যুর প্ল্যান বানাচ্ছিলাম। সে তো উলার হ্রদটা তালিকা থেকে কেটে বাদ দিয়ে দিল। বলল, ওপথে পর্যটকদের জন্য সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা আছে। মন খারাপ হয়ে গেল। এ পর্বের যাত্রায় ডাল লেক, নাগিন লেক আর মানসবল লেক দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।নিজের দেশের সীমানার মধ্যে ইচ্ছেডানা মেলার অধিকারটুকুও আমাদের নেই।
গোলাগুলির ভয় কাটিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে এসেছি। ভেরিনাগের বাগানে মখমলে সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে ডিজিট্যাল ক্যামেরার স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। দুপুরেই ‘টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট’ এর দৃষ্টিনন্দন শোভা বন্দী করেছি ক্যামেরায়। দূরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। তারই পাদদেশে সুবিস্তৃত উপত্যকায় পাকা ধানের খেত আর জোতগুলোকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে আছে লম্বা লম্বা পাইন গাছ। যেন হলদে ক্যানভাসে গাঢ় সবুজ প্যাস্টেল রঙ দিয়ে কেউ ত্রিভুজ, বহুভুজ, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র প্রভৃতি জ্যামিতিক আকার তৈরি করেছে। এক অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ।
ভেরিনাগের এই উদ্যানটি কাশ্মীর উপত্যকার মোগল উদ্যানগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার মতো হবে। শুধু উদ্যান নয়, ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভেরিনাগ আসলে ঝিলাম নদীর উৎস। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তৈরি করেন এই উদ্যান। ভেরিনাগ থেকে ফেরার পথেই রাজওয়ারী তালুকে মারা যান সম্রাট। বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি এই উদ্যানে রংবাহারী ফুল, প্রজাপতি আর সবুজের সমারোহ। চারপাশ নির্জন পাহাড়ে ঘেরা। পাহাড়ের নামও ভেরিনাগ। পুর্বে এর নাম ছিল নীলনাগ। কথিত আছে-বিরাটাকার এক সাপ বাস করত এখানে।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝরনার কাছে চলে এলাম। আটকোণা চত্ত্বর থেকে জল বেরিয়ে এসে জমা হয়েছে গোলাকার এক জলাশয়ে। এই জলাশয়ের চারপাশ ঘিরে মোগল আঙ্গিকে তৈরি হয়েছে এক স্থাপত্য। গোধুলি বেলায় জলাশয়ের বুকে এই স্থাপত্যের প্রতিচ্ছবি খুবই সুন্দর লাগছে। স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ট্রাউট মাছ।
স্থানীয় মানুষের বৈকালিক আড্ডা, শিশুদের হুটোপুটি, কেউ বা তার মায়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাদের লাল টুকটুকে গাল দেখে মনে হচ্ছে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা আপেল। আর তাদের মায়েদের দেখে বেশ বোঝাই যাচ্ছে, এ মুলুকে ফেয়ারনেস ক্রিমের বাজার একেবারেই মন্দা।
নিঝুম সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চারপাশটা ঘিরে ধরেছে। আমরাও বেরিয়ে এলাম। আবার গাড়িতে উঠে চলা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনন্তনাগ শহর পেরিয়ে এবার পৌঁছতে হবে পহেলগাম।
পহেলগাম যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন প্রায় রাত ৮টা বাজে। এখনই মনে হচ্ছে সমগ্র অঞ্চলটা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দোকানপাট বেশিরভাগই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো খোলা আছে, মালিকরা ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। হাতে গোনা কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।
জমজমাট অঞ্চলটা ছেড়ে আরও প্রায় ১ কিলোমিটার এগিয়ে গাড়ি থামল লিডার নদীর ধারে একটা ছোট্ট কাঠের সেতুর কাছে। সেতুটা পেরোলেই একটা খুব সুন্দর লজ। এখানেই আজ আমাদের নিশিযাপন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব বেশিদিনের নয়। দেওয়ালের গায়ে এখনও নতুনত্বের গন্ধ লেগে আছে। এ তল্লাটে হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁ প্রায় নেই বললেই চলে। বরং স্থানীয় মানুষদের বাড়িঘরই বেশি।
জম্মু পৌঁছনোর কয়েকটা স্টেশন আগে থেকেই সমস্ত প্রি-পেইড মোবাইল পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়টা আগে থেকে জানাও ছিল না। কলকাতার সঙ্গে দুদিন ধরে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু জরুরি ফোন করা খুবই আবশ্যিক। অগত্যা পাবলিক বুথের উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।
হোটেলে রিশেপসনের ফোনটা আস্থায়ীভাবে দেহ রেখেছে। লাগেজপত্র রেখেই প্রথম ও প্রধান কাজ যেটা, সেটা হল ফোন করতে বেরোনো। ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে আটটা ছুঁই ছুঁই। হোটেল ম্যানেজার জানালেন, কাছেই একটা মুদির দোকানে পাবলিক ফোনের ব্যবস্থা আছে। সেটা একটু বেশি রাত পর্যন্তই খোলা থাকে। এখনই গেলে হয়ত খোলা পাওয়া যাবে। সুতরাং বেশি দেরি না করে আমি আর বাবা বেরিয়ে পড়লাম।
কপাল মন্দ থাকলে যা হয়, দোকান বন্ধ। সামনের এক চিলতে বারান্দাটায় দুজন অল্প বয়সী ছেলে দাবা খেলছে। আমরা এসটিডি করতে চাই শুনে একজন বলল, ‘দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে, কাল সকাল ন’টা নাগাদ খুলবে।’
কি আর করি? ফিরে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় ছেলেটি পিছন থেকে ডাকল, ‘শুনিয়ে, আরজেন্ট ফোন? আইয়ে মেরে সাথ।’
ফোন করাটা সেই মুহূর্তে এতটাই গুরুত্বপুর্ণ ছিল যে কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কী তার উদ্দেশ্য – কিছুই চিন্তা করলাম না। সরু গলি দিয়ে ছেলেটির পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে ছোটো ছোটো স্থানীয় বাড়ি, অন্ধকার সরু পথ। এবার একটু ‘ভয় ভয়’ করতে লাগল। ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকালাম। দৃঢ় দৃষ্টিতে বাবা ইশারা করে যেন বলতে চাইল, ‘দেখাই যাক না, কী হয়।’
অশান্তির রাজ্য কাশ্মীরে স্থানীয় সদ্য পরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে রাত্রে এই নির্জন গলিপথে কোথায় চলেছি কে জানে? সন্ত্রাসবাদীর আখড়ায় নিয়ে যাচ্ছে না তো? আমরা কিডন্যাপড হয়ে যাব না তো? র্ধু! যত্তোসব আজেবাজে চিন্তা। বিট্টুজী স্থানীয় লোক। ওকে সঙ্গে আনলেই ভালো হতো। তবে, সে হয়ত সারাদিন গাড়ি চালানোর পর এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, তাকেও তো বিরক্ত করা ঠিক হতো না।
প্রায় মিনিট সাতেক হাঁটার পর একটা বড় উঠোন পার হয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ছেলেটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। বেশ বুঝতে পারছি, প্রবল ঠাণ্ডাতেও আমার কপালে ঘামের ফোঁটা। দু মিনিটের মধ্যে ছেলেটি বেরিয়ে এল এবং আমাদের ভেতরে ডাকল, ‘অন্দর আইয়ে।’
একটা ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুম। সোফায় আমাদের বসতে বলে ছেলেটি আবার চলে গেল। ফিরন পরা একটা সুন্দর মুখ ঘরের পর্দা ফাঁক করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে উঁকি দিয়েই চলে গেল। একটু পরেই ছেলেটির সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন ভীষণ হ্যান্ডসাম ষাট ছুঁই ছুঁই এক ভদ্রলোক। ছেলেটি তার আব্বুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি বললেন, ‘ওটা আমারই দোকান।আপনাদের যখন আরজেন্ট কল করার আছে, আমার মোবাইল থেকেই ফোন করুন।’
খান পাঁচেক এসটিডি হল কলকাতায়। ততক্ষণে ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছে।ভয়টাও কেটে গেছে। ওর নাম রিয়াজ, অনন্তনাগ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। হস্টেলে থাকে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। রিয়াজের আব্বু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা পেমেন্ট করব বলে ওনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
উনি ঘরে ঢুকলেন, হাতে একটা ঠোঙা। ওদের বাড়ির গাছের আখরোট খাওয়ার জন্য দিলেন। শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও ফোনের জন্য একটা টাকাও নিলেন না। ওনার একই কথা, ‘আপনারা মেহমান। যদি দোকান থেকে ফোন করতেন আলাদা ব্যাপার ছিল। কিন্তু, আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন। অসুবিধায় পড়েছেন, এটুকু সাহায্য করব না?’
এর মধ্যেই চা এসে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নানান প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এর থেকে বাদ গেল না। কথা প্রসঙ্গে রিয়াজ বলল, ‘আপনারা, মানে দেশের অন্য রাজ্যের মানুষরা সবাই ভাবেন, কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসবাদী। কিন্তু, সবাই তো তা নই। আমরা সাধারণ মানুষ, শান্তিতে থাকতে চাই।’
মনে মনে খুব খারাপ লাগল। আমিও তো তাই ভাবছিলাম। লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘ছিঃ! ছি! তা ভাববো কেন? কোনো দেশের সাধারণ মানুষই রক্তারক্তি, সন্ত্রাস, অশান্তি চায় না। কিছু মানুষের অপরাধের দায় চাপে সমগ্র সম্প্রদায়ের উপর।’
কথায় কথায় রাত বেড়ে যাচ্ছে। এবার ওদের বাড়িতে ডিনার করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু হল। বাকীরা সবাই হোটেলে অপেক্ষা করছে, এই বলে শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া গেল। তবে কথা দিয়ে আসতে হল, পরদিন সকালের নাস্তা রিয়াজের বাড়িতেই করতে হবে। এই অতুলনীয় আপ্যায়ন ও আন্তরিকতায় চোখে জল এসে গেল।
অন্ধকার গলিপথটা ধরে রিয়াজ বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। চারপাশটা খুব স্নিগ্ধ লাগছে। বিকালে মনের মধ্যে যে ভাবনাগুলো জমাট বেঁধেছিল, তার অনেক উত্তরই যেন পেয়ে গেলাম। জানি, এত সহজ নয়। তবু মনে আশা জাগে। একদিন ঝড় থামবেই। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, কাশ্মীর তার শান্তির বার্তা ঘোষণা করে সত্যি সত্যিই ভূস্বর্গ হয়ে উঠবে।
ভ্রমণকাল- অক্টোবর, ২০০৯
লেখক পরিচিতিঃ
কলকাতায় ১৯৭৭ সালে জন্ম। দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখি ও ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণ-কাহিনী প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার এক্সিকিউটিভ কমিটির প্রথম মহিলা সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো।
।। আমেরিকান ড্রিম।।
ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
১১টা মানে ১১টাই। সকাল ঠিক ১১টায় ওহাইও’র রাজধানী কলম্বাস শহরের রেসিডেন্স ইন হোটেল থেকে বাস ছাড়লো। আজ ২১ জনের আন্তর্জাতিক দলটিকে দুইভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। একদল গেলো কেন্টাকি স্টেটের লুইভিলে, আর আমরা রওনা দিলাম পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গের উদ্দেশ্যে। ২৭ জানুয়ারি থেকে দৌড়ের উপর আছি। বিমানে উঠতে উঠতে ক্লান্ত। বাসে করে পিটসবার্গ যাত্রা তাই অনেকের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই আয়োজনটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, আমরা যখন যে স্টেটে যাই তখন আমরা সেই স্টেটের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অতিথি। পিটসবার্গে এর দায়িত্বে আছে ‘গ্লোবাল পিটসবার্গ’। তারাই সাতসকালে বাস পাঠিয়েছিল আমাদেরকে নেয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কলম্বাস শহরের বাইরে চলে এলো। হাইওয়ে ধরে চলতে লাগলো পিটসবার্গের দিকে। আজ বাস ফাঁকা দেখে সবাই একটা একটা করে সিটে জানালার পাশে বসেছে। আমি বসেছি একেবারে সামনের দিকে। আমার সিটের সামনে একটা টেবিলও আছে। টেবিলের ওপাশে বসেছে সার্জ ব্লাড, তিনজন সমন্বয়কারীর একজন। প্রোগ্রামের শুরু থেকেই আছেন আমাদের সাথে। ডানদিকে জানালার পাশে বসেছে জোনাথন ক্রিস্ট। সে সমন্বয়কারী দলের আরেকজন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমেরিকার এই অসহ্য ঠান্ডায় রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো তাদের রঙ হারিয়ে কেমন যেন কুকড়ে আছে। এই সময়টাতে যত রঙ সব যেন আকাশে থাকে, একেবারে নিখাদ নীল। অবশ্য নিখাদ নীল বলা যাবে না। কারণ, আকাশটাও তো একটা পথ। সে পথে বিমান ঊড়ে গিয়ে পথের চিহ্ন রেখে গেছে। বাসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষের গন্তব্যে যাওয়ার রেখা দেখি, মানুষের বাড়ি ফেরার চিহ্ন দেখি। সে পথে আবার কাটাকুটিও আছে।
অনেকদূর পর পর ঘরবসতির দেখা মেলে। মাঠের পর মাঠ ফাকা পড়ে আছে, যেন বিরানভূমি। তার মাঝে কোন এক দূরের পথে রাস্তা চলে গেছে। সে পথ থেকে মন সরাতে না সরাতেই অন্য দৃশ্য সামনে চলে আসে। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। হঠাৎ মনে হলো- আচ্ছা, আমেরিকায় ফসলের জমিগুলোতে আল (বাংলাদেশে জমিগুলোকে খন্ড খন্ড করা হয় যা দিয়ে) নেই কেন? এদের কি সন্তানদের মধ্যে জমিজমা ভাগ হয় না? এদের কি জমি নিয়ে কোন বিবাদ নেই? নিজের মতো করেই একটা উত্তর খুঁজে নিলাম। ভাবলাম, এরা তো আমাদের দেশের পরিবারগুলোর মতো একাধিক সন্তান নেয় না। তাই হয়তো উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগ করতে করতে জমিগুলো টুকরো টুকরো হয়নি। কি জানি, অন্য কোন কারণও থাকতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমেরিকার গ্রামীণ সৌন্দর্য একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। সামনের টেবিলের উপর পড়ে থাকা খবরের কাগজে নজর দেই। আমেরিকায় এখন প্রতিদিনই গরম গরম খবর। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদিনই এমন এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বা কথা বলছেন যাতে আমেরিকা তো বটেই, সারা বিশ্বের মানুষ নড়েচড়ে বসছে।
কখন যেন একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাংতেই আবারো সেই নীল আকাশ, বেশ কিছুক্ষণ পর পর সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি, উঁচু টিলার উপর কবরের সারি আর বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আরেকটা খবরের দিকে নজর গেলো। সান ফ্রান্সিসকোতে ৫৮ তলা একটা অভিজাত বিল্ডিং গত ৬ বছরে কয়েক ইঞ্চি দেবে গেছে। ঐ ভবনের বাসিন্দারা তাদের কি পরিণতি হবে তা নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। কারণ, অনেকেই সারাজীবনের সঞ্চয় বা সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে শেষ বয়সে থাকার জন্য ঐ ভবনে ফ্লাট কিনেছেন। এসব খবর পড়লে মজাই লাগে। কারণ, আমাদের ওখানেও বিল্ডিং দেবে যায়, হেলে যায়, ধ্বসে যায়।
পাহাড় বা টিলা এলাকা দিয়ে যাচ্ছে বাস। উপরের দিকে ঊঠতে থাকায় টেবিলের উপর থাকা সার্জের একটা খাতা আর কলম নিচে পড়ে গেলো। এতক্ষণ সে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিলো। এবার আমেরিকান পরিবার আর সমাজব্যবস্থা নিয়ে গল্প শুরু হলো সার্জের সাথে। সার্জ একেবারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় থেকে শুরু করলেন।
-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার লোকজন একটা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। একটা সুন্দর পরিপাটি জায়গায় নিজেদের বাড়ি হবে, সাথে একটা কৃষিখামার থাকবে, খুব পরিপাটি আর ঝামেলামুক্ত জীবন কাটবে। কারণ, যুদ্ধ তো শেষ। এবার শান্তির জীবন চাই। সেই আমেরিকান ড্রিম পূরণের পথেই হাটতে লাগলো সবাই। বিভিন্ন শহরে শহরে কলকারখানা গড়ে উঠতে লাগলো। মানুষের কর্মসংস্থান এর সুযোগ তৈরি হতে লাগলো। নিজেদের একটা বাড়ি আর খামার যাদের হলো তাদের অনেকের আবার কর্মের জায়গা শহরে যাবার জন্য পরিবহনের প্রয়োজন পড়লো। তখন অটোমোবাইল কোম্পানীগুলো করলো কি, বিভিন্ন শহরের স্থানীয় পরিবহন কোম্পানীগুলোকে কিনে নিলো এবং সেগুলোকে বন্ধ করে দিলো। তারপর সহজ কিস্তিতে নিজেদের গাড়ি বাজারে ছেড়ে দিলো। তখন আমেরিকার মানুষেরা শহর থেকে একটু দূরে থাকতেই পছন্দ করতো। এভাবে বছরের পর বছর ধরে আমেরিকান ড্রিম পূরণ হতে লাগলো।
এবার পারিবারিক সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলা যাক। আমেরিকায় প্রায় প্রত্যেক পরিবারে সন্তানেরা ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে পিতামাতার সাথে থাকতে চায় না। এখানে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে ইনডিভিজুয়ালিজম এর প্রাধান্য বেশী। ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলেই সবাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ, কেউ তার উপর নজরদারি করুক এটা চায় না। পরিবারের সাথে থাকলে তো নজরদারির মধ্যে থাকতেই হবে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্তানেরা বিভিন্ন স্টেটের বড় বড় শহরে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। কারণ, উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে আনন্দ-বিনোদন সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায় বড় বড় শহরগুলোতে। এভাবে এক এক করে সব পরিবার থেকেই সন্তানেরা আলাদা হতে থাকে। শহরগুলো আরো জমজমাট হতে থাকে আর পিতামাতারা নি:সঙ্গ হতে থাকে। এমনকি সন্তানেরা পিতামাতার সম্পদের দিকেও ফিরে তাকায় না। তাদের কাছে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকার চেয়ে নিজের ইচ্ছে মতো জীবনযাপন করাটাই বড় কথা।
জোনাথনও কখন থেকে যেন এই গল্প কান খাড়া করে শুনছে। সার্জ বলতেই থাকেন। এবার তার নিজের কথা বলেন।
– আমার নিজের কথাই বলি। আমার এক খালা ছিল এক শহরে। সেই শহরে আমি মাঝেমাঝে কাজে যেতাম। প্রথম দিকে সেই খালার বাসায় গিয়েই উঠতাম। কিন্তু সেখানে গেলে এক বিপত্তি হতো। সারাক্ষণ এই খাও, ঐ খাও করতে করতে কান ঝালাপালা করে ফেলতো। বাসা থেকে বেরোতে চাইলেও ঠিকমতো বেরোনো যেতো না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে পরে ঐ শহরে গেলেও হোটেলে থাকতাম। খালার বাসায় গিয়ে দেখা করে আসতাম বা একবেলা দু’বেলা খেয়ে আসতাম।
সার্জের গল্প শুনতে শুনতে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে সুন্দর ঘরবাড়ির দিকে তাকালে নি:সঙ্গতার স্পষ্ট ছায়া চোখে পড়ে। তবু সার্জের কাছে জানতে চাই- সন্তানেরা যখন পিতামাতাকে ছেড়ে চলে যায় তখন সেই পিতামাতার কি হয়? এ কথা শুনে আবার শুরু করলেন সার্জ।
– পিতামাতাকে ছেড়ে সন্তান যখন কাছের শহরে থাকে, তখন সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকানরা সারা জীবনে গড়ে ১১টা বাড়িতে থাকে। শিক্ষা, চাকরী, বদলী এসব বিভিন্ন কারণে এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে বাড়ি বদলাতে হয়। এভাবেই পিতামাতার কাছ থেকে দূরে বহুদূরে যেতে থাকে সন্তানেরা। পিতামাতার সাথে বা ভাইবোনের সাথে ৬ মাসে বা বছরেও দেখা হওয়া কঠিন হয়ে যায়।
গাড়ির মধ্যে আরো কয়েকজন আশপাশের দৃশ্য দেখা বাদ দিয়ে সার্জের কথা শুনতে শুরু করেছে। ইউরোপ থেকে যারা এসেছে তাদের অনেকের সাথেই হয়তো আমেরিকান পারিবারিক বন্ধনের এই রীতি মিলে যায়। কিন্তু আমাদের মেলে না। তাই কথাগুলো শুনতে শুনতে কষ্টও পেতে থাকি। ভাবি, বৃদ্ধ হয়ে গেলে মানুষগুলো একা একা ডাক্তারের কাছে যায় কিভাবে? আবার ভাবি, উন্নত দেশ বলে কথা, ডাক্তারই হয়তো এসে তাদের খোজ নিয়ে যায়। তবুও সার্জকে আবার জিজ্ঞেস করি, তাহলে বৃদ্ধ বয়সে এখানে মানুষের কি হয় তাহলে?
– বৃদ্ধ বয়সে এখানে চরম নি:সঙ্গ জীবন মানুষের। তিন-চারটা বেডরুমের বিশাল বাড়ি পড়ে থাকে। কিন্তু সেখানে থাকার কেউ থাকে না। কারো কারো অনেক সম্পদ থাকলেও সন্তানেরা সেদিকে ফিরে তাকায় না। কেউ কেউ নার্সিংহোমে চলে যায়, কেউবা বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে সেই শহরে গিয়ে একটা ছোট্ট এপার্টমেন্ট কেনে যে শহরে তাদের কোন সন্তান আছে। এভাবেই আমেরিকান ড্রিম জীবনের কোন অংশে বিস্তৃত হচ্ছে, আবার কোন অংশে সংকুচিত হচ্ছে আবার কোন অংশে ঝকমকে শহরের উঁচু অট্টালিকার মধ্যে আটকে যাচ্ছে।
তাহলে কি ইনডিভিজুয়ালিজম শেষ পর্যন্ত নি:সঙ্গতার দিকেই নিয়ে যায় মানুষকে। সার্জ বলেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি ব্যক্তি স্বাধীনতার আনন্দটাও সত্য। তার কথা মেনে নেই। কোন পরিবার, সমাজ বা সমাজব্যবস্থাকে ভিন্ন চোখে দেখার কিছু নেই। কারণ, এটা তাদের অভ্যস্ততার ব্যাপার। ভিন্ন সমাজে বসে সেটার মূল্যায়ন করা অন্যায়। আমরাও কি আসলে একই পথে হাটছি না? আমি কি আমার মায়ের পাশে সবসময় থাকতে পারি? আমি কি বাড়ি বদলিয়ে ঢাকায় চলে আসিনি? আমাকে ছেড়েও কি ভবিষ্যতে আর কেউ যাবে না?
পিটসবার্গ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বাস। কলম্বাস থেকে এখানে আসতে প্রায় ৩ ঘন্টা লাগলো। এই সময়ের মধ্যে, এখানকার জমিগুলোতে আইল থাকে না কেন, তার স্পষ্ট উত্তর পেয়েছি। বাসের জানালা দিয়ে যতটুকু দেখেছি, বুঝেছি তারও বেশী। একটা নদী পার হলো আমাদের বাস। অল্পের জন্য আকাশ ঢেকে যায়নি এমন উঁচু উঁচু ভবন আমাদের স্বাগত জানালো পিটসবার্গে। জোনাথন এবার কথা বলে উঠলো।
– আমিও আমার বাবা-মার সাথে থাকি না। আমি থাকি ওয়াশিংটন ডিসিতে আর তারা থাকে টেক্সাসে। আমি তাদের বলেছি বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে সুবিধাজনক কোথাও চলে আসতে। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি না। তারা বলে- এত স্মৃতি এই বাড়িতে, কিভাবে বিক্রি করি! আমি বলেছি, ঐ বাড়িতে কোন স্মৃতি নেই। স্মৃতি যা আছে সব তোমাদের মাথায়।
পেন এভিনিউতে ঢুকে পড়েছে বাস। থামলো কোর্টইয়ার্ড ম্যারিওটের সামনে। এটাই আমাদের পরবর্তী ৪ দিন থাকার জায়গা। একে একে সবাই নামলো বাস থেকে। আমি সার্জের পেছনেই লেগে আছি। তার বয়সটা জানতে চাই। জিজ্ঞেস করতেই সে আমাকে অনুমান করতে বললো। আমি অনুমান করলাম ৬০ এর মতো। সে বললো, ৬০ পার হয়েছে। সার্জের জন্ম নিউ ইয়র্কে। চার বছরের এক ছেলে আছে তার, থাকে এস্তোনিয়াতে।
মুনজুরুল করিম
সম্পাদক, প্রবাস কথা
উপস্থাপক, মুভ উইথ মুনজুরুল করিম
(অ ঃৎধাবষনধংবফ রহভড়ৎসধঃরড়হ ংযড়)ি
িি.িুড়ঁঃঁনব.পড়স/সঁহুঁৎঁষশধৎরসঃা
দিল্লি – স্মৃতি আর সমৃদ্ধির নগরী
পরিচিতি –
নাম : মুনতাসির রশিদ খান
জন্মতারিখ ও জন্মস্থান : ৩০ই মে,১৯৯০ এ টাংগাইল জেলা।
পেশায় ব্যাংকার হলেও মুনতাসির রশিদ খানের ঝোক রয়েছে নানাদিকে। ১৯৯০ সালে, টাংগাইলে জন্ম নেয়া এই তরুণ লেখকের ছোটবেলাটা কেটেছে টাংগাইল জেলা সদরেই। ছাত্রজীবনে জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে ব্যবসায় প্রশাসন থেকে বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে যোগ দেন বেসরকারী ব্যাংক ইস্টার্ণ ব্যাংকে। দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর মানুষের বৈচিত্র্যের টানে বারে বারে তিনি দেশে বিদেশে ছুটে বেড়ান সময় পেলেই। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত সব জেলায় প্রাচীন নিদর্শন কিংবা জমিদার বাড়ি অথবা লোকচক্ষুর গহীনে থাকা নিদারুণ প্রাকৃতিক সৌন্দ্র্যেযর অজানা টানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। দেশের বাইরে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ডে পা ফেলে তিনি স্বপ্ন দেখছেন পৃথিবীর পথে আরো অনেকটা হাটতে।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা –
অনেক প্রাচীন কাল থেকেই নানা সাম্রাজ্য আর ইতিহাসের সাক্ষী এখনকার ভারতের রাজধানী দিল্লি। সাতবার ধবংসস্তুপ থেকে মাথা উচু করে মাথা উচু করে দাড়ানো এই প্রাচীন নগরীর কথা মহাভারতে উঠে এসেছে ইন্দ্রপ্রস্থ হিসেবে আবার মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নামে নাম রেখে শাহজাহানাবাদ হয়ে ওঠা এই শহর মায়ায় জড়িয়েছে বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম ড্যালেরেম্পেল (দিল্লি – দ্য সিটি অফ জ্বিনস বইয়ের লেখক)এর মত বিদেশীকে। ওবেরয়, ম্যারিয়ট বা তাজ হোটেলের বিলাসীতার সাথে এই শহরে আছে ৭-৫শ বছরের ঘোর লাগানো পুরোনো সব ঐতিহাসিক নিদর্শন।
গত বছর আগস্টে, ঢাকা থেকে সহকর্মী তৌহিদকে সাথে করে বাৎসরিক ছুটির শুরু হল মেঘলা আকাশে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করে অনলাইনে ঠিক করা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। শাটল বাসে চেপে যাত্রার শুরুতেই পড়তে হলো রাজধানীর জ্যামে। এরই মাঝে দুপুর নাগাদ পৌছে গেলাম পাহাড়গঞ্জের হোটেলে। পৌছানোর পথে তাক লাগালো জমকালো কনৌট প্লেস, দিল্লির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র যেখানে গ্রেগোরিয়ান ধাচের সব দালান আর আধুনিক সব ব্র্যান্ডের জানান দিচ্ছিল ভারতের উন্নত দিকের কথা। হোটেলে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে গেলাম দিল্লি জামে মসজিদের পাশের খাবারের মোঘলাই স্বাদ নিতে। প্রথমবারের মত পাতালরেলে চড়ে ১০/১৫ মিনিটে পৌছে গেলাম দিল্লির বিখ্যাত জামে মদজিদের পাশে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল, দিল্লির বিখ্যাত করিম’স রেস্তোরা। সেখানে পৌছে আমরা দেখলাম এক ভিন্ন দিল্লিকে এখানকার লোকজন নতুন দিল্লির মত ঝা চকচকে নয়। বরং ঘরোয়া পরিবেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সাক্ষী মুঘল আমলের, সিপাহী বিদ্রোহের আর বৃটিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গান্ধীর ভারতের। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করিমস হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাস মুঘল রসুইখানার পাচক। মেন্যুতেই নানা আইটেমের নাম এখনও সেই সময়ের ঐতিহ্য বহন করে যেমন – মুসল্লম-ই-জাহাগীরী, মুর্গ মালাই টিক্কা, পনির টিক্কা, দিল পসন্দ কাবাব, পেশোয়ারী কাবাব ইত্যাদি। সাথে ছিল বৃটিশদের ভেজ্জিটেবল স্টু দেখে আবিষ্কার করা মাটন ইস্টু, ঝুরঝুরে রুমালী টাইপ রুটি। মন জুড়িয়ে পেট ভড়ানোর শেষ পর্যায়ে ছিল ঘন মাখন, বিভিন্ন ফল, কিসমিস আর জাফরান দিয়ে তৈরী ‘দৌলাত-কি-চাট’। এরপর আমরা সিড়ি পেরিয়ে উঠলাম কালে সাক্ষী দিল্লি জামে মসজিদ। এখানে নাকি একসাথে ২৫,০০০ লোক নামাজ পড়তে পারে, ১৩৫ ফুট উচু সাদা গম্বুজের এই মসজিদ তৈরী হয়েছিল ১৬৫০-৫৬ সালের মধ্যে। সম্রাট শাজাহানের এই অমর কীর্তি মুসলিম ঐতিহ্যের সৌক্র্যে র জলজ্ব্যান্ত নিদর্শন আর এর স্থাপত্যশৈলী অভিভূত করে করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
দিল্লির তিনটে রূপ আছে এখন। নিউ দিল্লি, পুরনো দিল্লি আর বৃটিশ দিল্লি। ১৬৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত শাহজাহানাবাদ বলে পরিচিত পুরনো মুঘল দিল্লি, ঘিঞ্জি আর দারিদ্রের সাথে মিশে গেছে দিল্লির খানদানী রূপ যাতে আছে লাল কেল্লা, ফতেপুরী মসজিদ, রাজিয়া সুলতানার কবর, এশিয়ার সবথেকে বড় মশালার বাজার – খারী বাউলি, মহাত্মা গান্ধীর দাহস্থান রাজঘাট, চাদনী চক আরো অনেক মুঘল যুগের হাভেলী। আমাদের প্রথম গন্তব্য হল, লাল কেল্লা যেটা প্রায় ১০ মিনিটের হাটা দূরত্বেই অবস্থিত। সেখান থেকে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় এক অভুতপূর্ব অসাম্প্রদায়িক দৃশ্য। এক কাতারে দাড়িয়ে থাকা দিল্লি জামে মসজিদ, শিখদের গুরু দুয়ার, বিড়লা মন্দির ও গির্জা। বিকেলের দিকে লাল কেল্লার চারপাশের পরিখা ধরে একটা চক্কর দিতে গিয়ে দুজনের জিভ বেরিয়ে যাবার দশা কারণ ২৫৪.৬৭ একর বলে কথা। সামনের তেরঙ্গা পতাকা ওড়া জায়গাটাতেই নানা সময় ভারতের জাতীয় নেতাদের বক্তৃতা দিতে দেখা যায়। লম্বা লাইন পেরিয়ে ২৫-৩০ ফুট উচু গেট দিয়ে কড়া পাহাড়ার মধ্য দিয়ে ঢুকতেই জানলাম লাহোরি গেট এর মত বাকি তিনটি শহরের নামে তিনটি গেট(যেমন -কাশ্মিরী গেট)। কখনো সৈন্য সামন্ত নিয়ে যাত্রা করার সময় যেন দিক ভুল না হয় তাই ব্যবস্থা। লাহোরি গেট পার হয়েই দেখতে পেলাম প্রাচীন কালের মসলা, সিল্ক, অলংকারের বাজার ‘ছাতি চক’। ছাতি চক পেরোলেই পাওয়া নহবতখানা যেখানে রাজদরবারে আসা অতিথিদের জন্য এলান দেয়া হত এবং সংগীত বাজত দিনের নির্দিষ্ট সময়গুলোতে। এই তিনতলা গেটের মত বিল্ডিংয়েই আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সম্রাট জাহান্দার শাহ আর ফররুখশিয়র। এরপরই আছে, দিওয়ান-ই-আম মানে কিনা আমজনতার সাথে সম্রাটের মিলনস্থান। এখানে, এখনো আছে কাচে ঘেরা সম্রাট আওরংজেবের সিংহাসন যাতে আছে স্বর্ণ আর হাতির দাঁতের ইউরোপীয়ান কারুকাজ।এতে কাজ করার জন্য ফ্লোরেন্স থেকে অস্টন দ্য বরদেয়ু নামে এক শিল্পীকে আনা হয়েছিল।এরপর একে একে ঘুরে দেখলাম রং মহল, খাস মহল, দিওয়ান-ই-খাস, তুর্কী প্যাটার্ণে করা হাম্মাম খানা, হায়াত বখশ বাগান আর মতি মসজিদ।কেল্লার ভেতরেই সিপাহী বিদ্রোহের পরে বৃটিশেরা তাদের ব্যারাক গড়ে তোলে। যার অবস্থা এখনো ভালই বলা চলে।
সিপাহী বিদ্রোহের পরে এখানেই পতন হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের। শ’খানেক রুপিতে এখন রাতে দেখা যায় লাইট আর সাউন্ড শো। চাঁদের আলোতে মার্বেলের সাদা মতি মহল, হিরা মহল, মুমতাজ মহল কেমন স্বপ্নীল দেখাবে তা ভেবে শিহরিত হতে বাধ্য ইতিহাস উপেক্ষা করা মানুষও।
পরদিন ভোরের, যাত্রা শুরু হল গরম আলু পরোটা, চাট আর টক দই দিয়ে। আমরা দিল্লি ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস এর প্যাকেজ বেছে নিয়েছিলাম নানা রকম ট্যুরিজম অফার থেকে। এসি বাস, ট্যাক্সি, মিনি বাস আর তিন/পাচ/ছয়টা স্পটের মধ্য থেকে পছন্দ করলাম সারা দিনের জন্য একটি প্যাকেজ কারণ রাতে আমাদের প্ল্যান বলিউডের সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত কোন ছবি দেখার। সকাল ৮ টাতেই চলে এল বাস আর আমাদের গাইড হাসিখুশি দক্ষিণী নায়কের মত গোঁফ আর হালকা ভুড়িওয়ালা এপি মানে কিনা অতুল পান্ডে। হালকা চটুলতার সাথে মধ্যে নতুন দিল্লি দেখা শুরু হল। সবুজে মোড়া উন্নত দেশের ধাচের নতুন দেখে বিশ্বাস করা শক্ত যে এই দিল্লিতে ধুলি ঝড় হয়, এখানকার বায়ুদূষণের কথা সবার জানা।
প্রথম আকর্ষণ হল, ভারতের প্রভাবশালী পরিবার বিড়লাদের সৃষ্টি সবার জন্য উন্মুক্ত বিড়লা মন্দির। এর উদ্বোশন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি শোভা পাচ্ছে একই মন্দিরে। এরপর, আমরা একে একে দেখলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, লোকসভা, সামরিক সদর দপ্তর, বিজেপির প্রধান কার্যালয়।একসময় আমরা পৌছে গেলাম দিল্লির প্রধানতম আকর্ষণ কুতুব মিনার আর এর আশে পাশের প্রাচীন স্থাপনাসমূহ। এখানেই আছে, হালের পদ্মাবতীর খলনায়ক আলাউদ্দিন খিলজীর কবর আর দাস সাম্রাজ্যের সময়কার দিল্লির সম্রাট ইলতুৎমিশের কবর। আছে দিল্লির প্রথম মাদ্রাসা আর সরাইখানা। এখানে আছে আরবী অসাধারণ ক্যালিগ্রাফী আর দিল্লির প্রথম সালতানাতের স্থাপনা। কুতুব মিনারের পাশে আছে এর থেকে বড় স্তম্ভ বানানোর জন্য আলাউদ্দিন খিলজীর শুরু করা আলাই মিনার। জীবনের অনিত্যতায় মাত্র এক তলা করার পরেই সাম্রাজ্যের আলাউদ্দিন খিলজীর মৃত্যুর পরে বাতিল হয় নির্মাণ কাজ। এই পুরো কুতুব কমপ্লেক্স জুড়ে আছে দ্বাদশ শতকের ঐতিহাসিক সব কবর, ধংসস্তুপ।
আমাদের পরের গন্তব্য, মুঘলদের শেষ স্থাপনা সফদর জংযের সমাধি। ১৭৫৩-৫৪ সালে নবাব সুজা উদ্দৌলার পিতা এবং অযোধ্যার প্রধান মন্ত্রী পিতার স্মরণে এই দ্বিতল মুঘল কীর্তি। চারপাশে চারটি গম্বুজ ওয়ালা পিতার প্রতি পুত্রের শ্রদ্ধার নিদর্শন দেখার পর আমাদের যাত্রা শুরু মহাত্মা গান্ধীর বাড়ি আর দাহস্থান রাজ ঘাটের পথে। মহাত্মা গান্ধীর বাড়িকে ঠিক তার শেষ দিনের মত করেই রেখে দেয়া হয়েছে। বাগানের মাঝে যে পথে গান্ধীজি গিয়েছিলেন তার পায়ের ছাপ সংরক্ষণ করা আছে। রয়েছে গান্ধীজির ব্যবহ্র্যাব চরকা, চশমা, কাপড়, চৌকি আর স্বাধীনতার সময়কার অহিংস আন্দোলনের নানা দুর্লভ চিহ্ন আর চিত্রাবলী। যেখানে গান্ধীজিকে গুলি করেছিল নাথুরাম গডসে সেখানে স্মৃতিস্মারকে খোদিত আছে গান্ধীজির শেষ শব্দ – হে রাম, হে ভগবান! এখান থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রাজঘাটের সবুজ শিখা অনির্বাণে গেলে অনুভব করা যায় শান্তির জন্য সংগ্রামে তিনি একেবারে ব্যর্থ হননি।
আমাদের শেষ গন্তব্য, দিল্লির পুরানা কেল্লা আর সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি, যার স্থাপতকলা থেকে অনেকটাই প্রভাবিত তাজ মহল। পার্থক্য হচ্ছে, তাজমহলের সামনের স্তম্ভ আর এতে লালচে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। ইতিহাসে আছে, সম্রাট হুমায়ুন পাঠাগার থেকে পড়ে মারা গেলে প্রথমে তাকে সমাহিত করা হয় তুঘলতাবাদের পুরানো কেল্লাতে। কারণ, তখন হিমুর সাথে যুদ্ধ চলছিল মুঘলদের। পরে তার স্ত্রী (সম্রাট আকবরের মা) হামিদা বানু, যুদ্ধে জেতার পরে এখানে স্বামীর স্মৃতিতে গড়ে তোলে এই সমাধি স্থল। কথিত আছে, এখানে সমাহিত আছে ভাই আওরংজেব এর হাতে নিহত সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারা শিকোহকে কবর দেয়া হয়েছে। যার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আরো শত কব্রের ভীড়ে।
দিন শেষে ফেরার পথে খেয়াল করলাম, সারাদিন খাওয়াই হয়নি তেমন।বেশ বৃষ্টির শেষে যখন ডুবন্ত স্র্যূা ফ্রান্সের ‘আর্ক অফ ট্রায়াম্ফ’ এর আদলে বানানো ইন্ডিয়া গেটে পড়লো তখন বুঝতে পারলাম সময়ের থেকে শক্তিশালী কিছুই নেই পৃথিবীতে। আমাদের যাত্ত্রার শুরুর মত শেষটাও হল স্যার এডুউইন লুটিয়েনের হাতে গড়া ব্রিটিশ দিল্লিতে। যেখানে এখন ব্রিটিশ রাজের জায়গা দখল করে নিয়েছে এডিডাস, ম্যাকডোনাল্ডস, টিফানীস, লুই ভুটোনের মত নব্য আধিপত্যবাদী ব্র্যান্ড।
রাতের দিল্লিতে আমাদের আবিষ্কার ছিল শাহী লাচ্ছি, চাট আর ঝকঝকে সব শপিং মল। বিচিত্র এই শহর একদিন ভিস্তিওয়ালা, ক্রীতদাসকেও সম্রাট হতে দেখেছে আবার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দাফনের জন্য সাড়ে তিনহাত মাটিও না জুটতে দেখেছে।
থথথথথথথথথথথথথথ
গ্রেট বৃটেনের আঙ্গিনায় কিছু অপ্রিয় সত্য কথা
ফারুক হাসান
ঢাকার একজন অতি অল্পশিক্ষিত ধনাঢ্য ব্যক্তি, যিনি পরবর্তী সময়ে টাকার জোরে রাজনৈতিক নেতাও বনে গিয়েছিলেন, তিনি এক নির্বাচনী রাজনৈতিক জনসভায় সবাইকে চমকে দেয়ার জন্য তাঁর বক্তৃতায় পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, “ইংল্যান্ডে ছবাই ছিক্ষিত; চাইর/পাচ বছরের পোলাপাইনগুলাও কি ছুন্দর গড়গড় কইরা ইংরাজিতে কতা কয়। আমগো দেশের ছবাইকেও ছিক্ষিত হইতে হইবো।” (ইংল্যান্ডে সবাই শিক্ষিত; চার/পাঁচ বছরের ছেলে-মেয়েরাও কি সুন্দর গড়গড় করে ইংরেজিতে কথা বলে। আমাদের দেশের সবাইকেও শিক্ষিত হতে হবে।)
ওই রাজনৈতিক নেতার মত করে না হলেও, আমাদের দেশের সবার ধারনা ইংরেজ মাত্রই উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র ও পরিশীলিত। আমাদের দেশে অনেকেইতো ইংরেজ বা শ্বেতায় পুরুষ দেখলে তাকে ‘সাহেব’ মনে করে থাকেন, আর শ্বেতকায় নারীকে ভাবেন মেমসাহেব। ওদেশে যাওয়ার আগে আমারও ধারনা ছিল ইংরেজ মানেই সবাই সুশিক্ষিত এবং মার্জিত। কিন্তু ইংল্যান্ডে কিছুদিন কাটানোর পর আমার ধারনাটা পাল্টে যায়।
ওদেশের যে অঞ্চলেই গিয়েছি লোকজন সব আমার সঙ্গে আঞ্চলিক ইংরেজিতে কথা বলেছে। বিদেশী বলে ‘শুদ্ধ’ ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করেনি। আবার ওদের আঞ্চলিক ইংরেজি না বুঝলে এমন ভাব দেখিয়েছে যেন “এ ভূত কোত্থেকে এসেছে?” বৃটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামে বাস কে বলে বুস, তাও একজন বিদেশীকে বুঝে নিতে হবে। আরো উত্তরে এডিনবার্গে প্লেন ল্যান্ডিং-কে বলে প্লেন লুন্ডিং, তাও বুঝে নিতে হবে। খোদ লন্ডনের আদিবাসী ককনী ইংরেজরা ধিঃবৎ-কে ওয়া-য়া, ইঁঃঃবৎ-কে বা-য়া, খধফু-কে লাইডি বলবে, না বুঝলে হে বিদেশী সে তো তোমার দোষ।
জার্মানে একজন বিদেশী ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান বললে জার্মানরা উৎসাহ দিয়ে বলে, ‘জি স্প্রেখেন হোক ডয়েস।’ অর্থাৎ ‘তুমি খুব উচুমানের জার্মান বলো।’ আর এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য ইংরেজির বাচন-বচন না জানলে তুমি ইংরেজির ‘ই’ও জানো না।
আমার এক ইংরেজ বন্ধু ভূগোলবিদ্যায় মাস্টার্স করেছে। একদিন ওর মা আমাকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো আমাদের দেশটা অনেক দেখেছো, আমাদের সম্পর্কে তোমার ধারনাটা কি?”
আমি বললাম, “দেশে থাকতে ভাবতাম সব ইংরেজই বুঝি সুশিক্ষিত, পরিশীলিত। এখানে এসে দেখলাম আসলে তা নয়।” আমার কথা শুনে মহিলার মুখের উপর যেন আষাঢ়ের কালো মেঘ নেমে এলো। মনে মনে দুঃখিত হলাম ইংরেজ জাতি সম্পর্কে ইংল্যান্ডের মাটিতে বসে একজন ইংরেজ নারীকে এমন অপ্রিয় সত্য কথাটা বলার জন্য। কিন্তু মুখ থেকে কথাটা যখন বেরিয়ে গেছে, ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
ইংল্যান্ডে বারো ক্লাস পর্যন্ত প্রতিটি ছেলে-মেয়ের স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। না গেলে ক্লাশ টিচার পুলিশ সহ বাসায় চলে আসেন। মা-বাবাকে কঠিন কৈফিয়ৎ দিতে হয়। তাই প্রতিটি ছেলে-মেয়ের স্কুলে না গিয়ে উপায় নেই। আমাদের দেশের মত ওদেশে তথাকথিত পাঁচ ক্লাশ পড়ে পিএসসি, আট ক্লাশ পড়ে জেএসসি পরীক্ষা নেই। একটা বছর কেটে গেলে সকলেই নীচের ক্লাশ ডিঙ্গিয়ে উপরের ক্লাসে উঠে যায়, কেবল ক্লাশ টিচার ছাড়া; কিছু শিখলে শিখলো, না শিখলে নেই। শিকারী সারমেয়র মত গন্ধ শুঁকে শুঁকে এ দেশটার কোথাও কোচিং সেন্টার খুঁজে পাওয়া যায় না। বারো ক্লাশ পরে প্রথমবারের মত সরকার অনুমদিত পরীক্ষা দিতে হয়। পাস করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার মেলে। তবে পাস করলেও খুব কম সংখ্যক ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়ায়। বাকীরা আনন্দ-ফূর্তিতে ডুবে যায়। চাকুরি না মিললে মাসে মাসে সরকারী ভাতা তো আছেই।
আমার বন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুনী বোন আমাকে একদিন বার্মিংহামের কাছে একটি উইন্ড মিল দেখাতে নিয়ে গেল। ইংল্যান্ডে উইন্ড মিল নেই বললেই চলে। উইন্ড মিলের জন্য জগৎজোড়া নাম হল্যান্ডের। এটি যেন ওদেশের প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; উর্বশীর মত সুন্দর এক একটি। দু’চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করে।
ইংল্যান্ডের অচল হয়ে পড়ে থাকা এই উইন্ড মিলটি একবারেই সাদমাটা, হল্যান্ডের মিলগুলোর পাশে দাঁড়ানোর মত নয়। মিলটি দেখে ফিরে আসার পথে মেয়েটা গর্বভরে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগলো তোমার উইন্ড মিলটা?”
আমি বললাম, “হল্যান্ডের উইন্ড মিলগুলোর মত একবারেই নয়। ওদেরগুলো অনেক সুন্দর।”
হাসিখুশি মেয়েটা চুপ হয়ে গেল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, অপ্রিয় সত্য কথাটা বলে আবার আষাঢ়ের মেঘ ডেকে এনেছি। আমার কথায় ওর জাত্যভিমানে আঘাত লেগেছে। ভাবলাম আর কখনোই এমন চাঁচা-ছোলা কথা নয়। পশ্চিমে সব জাতিগুলোর জাত্যভিমান টনটনে। ইংরেজ, ফরাসী, জার্মানদের এ অহংবোধটা আরো এক পরত সরেস।
আমার বন্ধু একদিন আমাকে বললো, “জানো, আমাদের এখানে একটা নদী আছে?”
নদীর প্রতি আমি এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করি, তাই নদীর কথা শুনেই ওর কাছে যাওয়া জন্য, ওকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠি। দেরী না করে বললাম, “আমাকে নিয়ে চলো।”
অনেকটা পথ গাড়ি চলিয়ে ও আমাকে একটি ক্ষীণাঙ্গী স্রোতোস্বিনীর কাছে নিয়ে এলো। স্রোতোস্বিনী বললাম, কিন্তু ওর বুকে বয়ে চলার ছিঁটে-ফোটা লক্ষণ নেই। আমি ভাবলাম, বন্ধুটি হয়তো খানিকটা বিরতি নেয়ার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছে; চা বা কফি পান করবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “নদী আর কত দূর?”
ও বললো, “এইতো নদী।”
“কোথায়?”
ও এবার ক্ষীনাঙ্গিণীর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, “এইতো।”
তৃতীয়বার আষাঢ়ের মেঘ ডেকে আনার ইচ্ছে হল না বলে আমি আর ওকে মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে বললাম, “এমন তরো ক্ষীনাঙ্গিণী জলধরা আমাদের দেশে নদী পদবাচ্যের উপযুক্ত নয়। খাল বলা যেতে পারে তাকে। বাংলাদেশের বিশাল বক্ষা, দুরন্ত বয়ে চলা নদীগুলো যদি তুমি একবার দেখতে তবে জানতে নদী কাকে বলে।” ওকে একবার আমাদের পদ্মা, মেঘনা, তেতুলিয়া, পায়রা, আগুনমুখা নদীগুলো দেখাবার খুব ইচ্ছে হলো। বুক জুড়ে উত্তাল ঢেউ নিয়ে কি দুরন্ত ছুটে চলা তাদের!
(আমি দুঃখিত এখন বুভুক্ষ নদী খেকোরা আর তার দোসররা বাংলাদেশের অনেক নদীর দু’পাড় ভরাট করে ওদের দিনে-দুপুরে গলা টিপে হত্যা করছে।)
নদী দেখতে আসা আরো অনেকের মত আমরা দু’জন ভাড়া করা একটি ফাইবার গ্লাসের নৌকা করে নদীটার নির্জীব বুকে কিছুক্ষণ ঘুর বেড়ালাম। ফিরে আসার পাথে আমার বন্ধু জিঞ্জেস করলো, “কেমন দেখলে নদী?”
কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। অপ্রিয় সত্য কথা এবার আর নাই বা বললাম।
—
ফারুক হাসান একজন পর্যটন পরামর্শক, পর্যটক, লেখক ও গবেষক।
রেজাউল হক হেলাল
বিশ হাজার গ্রাম নিয়ে সৌদি আরবের জিজান প্রদেশ। দিগন্ত জুড়ে হাজার বছরের প্রকৃতির নিরবতা। প্রায় আট হাজার বছরের প্রাচীন আরব বসতি জিজান। মানব সভ্যতার উত্থান-পতনের দীর্ঘ ইতিহাস আর কিংবদন্তি ভরা এক মরু আঞ্চল। সীমান্তের ওপারে খুব কাছে ইয়েমেন ঐতিহাসিক সানা নগরি। আমি সামতা শহরে বসে স্মৃতিচারণ লেখা শুরু করি।
২০১০ সালে প্রথমবার মক্কা থেকে সারা রাত গাড়ি চালিয়ে শিশির সিক্ত সোনালি প্রভাতে জিজান গিয়েছিলাম। ‘বছর আগেও এলাকাটি ছিল ইয়েমেনের একটি জেলা। লোহিত সাগরের কুল ঘেঁসে ইয়েমেন সীমান্তে ছোট প্রদেশ। দিগন্ত বিস্তৃত মরুর বুকে এক চিলতে সবুজের সমারোহ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ক্ষেত-খামারের সাথে জিজানের কিছুটা মিল আছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির উথান-পতনের কথা জ্ঞান পিপাসুদের অজানা থাকার কথা নয়। নূহের প্লাবনের দীর্ঘ নিরবতার পর পুনরায় মানব সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে। সেকালে আদ ,ইরাম এবং সামুদ জাতির দাপটে সারা বিশ্ব কেঁপে উঠত। তাদের সুউচ্চ স্মৃতি-সৌধ, দালান-কোঠা, অট্টালিকা তুফান আর ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। এখন নির্জন নির্বাক বালিয়াড়ি পাহাড়ি পরিবেশ। চারদিক যেনো এক মৃত্যুর বেলাভূমি। দূরে দূরে কিছু গ্রাম, কিছু সড়ক তৈরি হচ্ছে।২০১০ এবং ২০১৪ সালে সড়ক পথে আদ ও সামুদ জাতির ধ্বংস প্রাপ্ত এলাকা ভ্রমণ করেছি, ২০১৫ সালের ২২ মার্চ দামাম থেকে জেদ্দা হয়ে ফ্লাই নাস বিমানে জিজান গিয়াছি।
আরব মানচিত্রের রোবাল আল-খালী নামক বিশাল মরুভুমির বুকে এখন গড়ে উঠছে শোয়েবা নামক খনিজ সম্পদ ভিত্তিক একটি শিল্প নগরী। দুবাই ওমান ও ইয়েমেনের নিকটে শোয়েবা মরুভুমি। চারদিকে হাজার হাজার মাইল জনশূন্য। ইদানিং দুর্গম পাহাড়-বেলাভূমি কেটে কিছু রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। মরুভুমির নিচে লুকিয়ে থাকা খনিজ সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। খনন কালে পাওয়া গেছে আদ জাতীর লোকদের বিশাল বিশাল কঙ্কাল, ধ্বংস প্রাপ্ত ঘরবাড়ি। সাত রাত আট দিন সাইক্লোন চালিয়ে ইতিহাসের অন্যতম ক্ষমতাধর জাতিকে মহান আল্লাহ ধ্বংশ করেন। হুদ আঃ নামক সেকালের বিখ্যাত নবী চার হাজার অনুসারী নিয়ে একটি কৃষি খামারে নিরাপদে ছিলেন। অহংকারি নাস্তিকদের এই পতন কতো ভয়ংকর ছিল রোবাল আল খালীর সাহারা-বৈদ্যভুমি তার জ্বলন্ত সাক্ষি। আজো সেখানে গাছের শিকড় ওপরের দিকে, অজস্র বিরান কৃষি খামার, মৃত নদী, বিধ্বস্ত পাহাড় আর লাল বালুর নিচে ঢেকে আছে কতো প্রাচীন জনপদ। প্রায় আট হাজার পূর্বে ঘটে যাওয়া গজব কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। নাজরানের পশ্চিমে মরু আর সৈকতের মাঝে জিজান নগরী গড়ে উঠেছে। কাল্বি ও সুদ্দি রহঃ বলেছেনঃ সেকালে তাদের লম্বা লোকদের দৈর্ঘ্য ছিল ১০০ হাত এবং খাটো লোকদের দৈর্ঘ্য ছিল ৭০ হাত। তাদের একজনের মাথা ছিল একেকটি তাবুর মতো। আমিরাত, ওমান থেকে আভা-নাজরান-খামিস-জিজান, জিজান হয়ে লোহিত সাগরের তীর ঘেঁসে হিজাজ হয়ে ইরাকের সিমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আদ জাতির দেশ। জিজান এসেছিলাম বক্তিগত কাজে। এর ফাঁকে ফাঁকে এখানকার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন, মরুভূমি আর পাহাড়-সাগরের মিতালি, ক্ষেত-খামার, ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে, লোকাল আরবদের সাথে মিশতে চেষ্টা করি এবং একটি আর্টিকেল লেখার ইচ্ছে জাগে।
জিজানি পুরুষদের কোমরে চাকু, মাথায় ফুলের মালা দেখে জানতে চাই-এশ হাজা ? এই ফুল এই তলোয়ার-চাকু আবহমান কাল ধরে চলে আসা আরব ইয়েমেন সংস্কৃতির অঙ্গ। ভাল কাজ করলে ওরা ফুল দেবে, মন্দ করলে তলোয়ার প্রস্তুত। এমন এক মরু বেদুঈন রাজ্যে এসেছি ঠিকেদারি তেজারত করতে। মোবাইল টাওয়ার দুর্বল থাকায় সবার সাথে যোগাযোগ কষ্টকর। বিশাল ভুট্টা ক্ষেত, গাড়ি থামিয়ে কাঠে পোড়া ভুট্টা খেলাম। কিছুটা দেশীয় আমেজ। কয়েক হাজার ইয়েমেনি এখন সৌদি আরবের নাগরিক। তাদের জন্য নতুন প্রজেক্ট- হাউজিংফর মাইগ্রেশন, পাওয়ার প্লান্ট, বিমান বন্দর, নৌবন্দর হাসপাতাল,সড়ক, পার্ক, স্কুল, সেনা নিবাস ইত্যাদি। আরব, চীন, কোরিয়া ও জাপানের কয়েক ডজন কোম্পানি ওসব মেঘা প্রজেক্টের ঠিকেদারি করছে। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-নেপালিরা শ্রমিক সরবরাহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এই অঞ্চলে জিজান সিটি, সাবিয়া, সামতা, বেইশ, দরব, শাকিক, লেইচ, হাবিল, হাকু, আজুমা, আভা, খামিস,সালামা,লায়লা সহ বহু গ্রাম-শহরে ঘুরেছি। বেইশ শহরের লেডিজ মার্কেটে একটি ছোট্ট চা দোকানে মহিলা দোকানি দেখে আমার সফর সঙ্গী আবু নাসের সোহাগ এগিয়ে যান এবং বলেন, ইয়া উখতি-আতিনি সাই, আরবি মহিলাকে বোন সম্বোধন করায় তিনি চায়ের সাথে জিলাফি ফ্রি দিয়েছিলেন। মনে হয় অন্যান্য আরব প্রভিঞ্চ-এর মতো জিজানিরা এতো অহংকারী ও ক্রিটিকাল নয়। তা ছাড়া বেদুঈন এখন আর বেদুঈন নাই। বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতা আর উন্নতির হাওয়া সর্বত্র। ওবামা নামক জিজান ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রের কম্পিউটার শপে দোস্তি হল। আরবি ভাষা প্রসঙ্গে আমাদের বিস্তর তর্ক হয়, সে দাবী করলো-আরবি ভাষা এক সমৃদ্ধ জীবন্ত ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কোরআন যখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয় তখন যে সকল ভাষায় সাহিত্য রচনা হতো তা ছিল মৃত। স্পেন চীন তুর্কি আফগান ভারত ইত্যাদি দেশে আরবি ভাষা ও লিপির ব্যাবহার ছিল। সেকালে পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রের সংখ্যা তিরিশটি থাকলেও তাদের ভাষা ছিল অনেকটা হেঁয়ালির কুহেলিকা মোড়ানো। ভাব ভাষা ছন্দ এসব বজায় রেখে সাহিত্য রচনার সমৃদ্ধশালী প্রাচিন ভাষা হচ্ছে আরবি। ইসলামের প্রসার ও জনপ্রিয়তা আরবি ভাষাকে বিশ্বের আনাচে-কানাছে, দ্বীপ থেকে দীপান্তরে পৌছিয়ে দিয়েছে। পরে ছাত্রের সাথে জিজানিদের একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিটের সুযোগ পাই। আরব দেশের সেসব ভিন্ন রকম স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা আমার চিন্তার জগতে এখনো দোল খায়।
লোহিত সাগরের পূর্ব তীরে ছোট্ট শহর শাকিক। লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরে সুদান, মিশর, ইরিত্রিয়া। পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম সমুদ্র স্নানে। আভা-খামিসের পাহাড়ি আরবি সৈকত বিলাসীদের ভিড়ে যেন হারিয়ে যাই। সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেও মেয়েদের সতভাগ পর্দা এবং শালীন পোশাক মুমিনের মন কাড়ে। আজানের সাথে সাথে সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য নামাজের বিরতি, এটা সরকারী নির্দেশ। উত্তাল তরঙ্গের তীরে সাপ্তাহিক মিলন মেলা উপভোগ করার মতো।বেইশ শহর থেকে ২৫ কিঃ পশ্চিমে লোহিত সাগরের তীরে চীন-কোরিয়ান-বাংলাদেশিরা মিনা পোর্ট,পাওয়ার প্লান্ট এবং কিং আব্দুল্লাহ সিটি নির্মাণের কাজ করছে। ওই এলাকার প্রাচীন বেদুঈন বশতি গুলো ইদানিং সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
জিজানের সব শহরে লেডিজ মার্কেট , লেডিজ ব্যাংকিং এবং মহিলাদের জন্য মসজিদের ব্যবস্থা রয়েছে। জিজানের সাংস্কৃতিক ও নাগরিক জীবনে ইসলামি ভাবধারা লক্ষণীয়। মেয়েরা পর্দার সাথে কৃষি ফার্মে, স্কুল-কলেজ, বাজারে যাচ্ছে, মসজিদে যাচ্ছে, সাপ্তাহিক বাজারে ও মেলায় যাচ্ছে, উট-গাধায় চড়েও কাজে যাচ্ছে- কোন ইভতিজিং নাই। অশ্লীল বা বে-আব্রু পোশাকের মেয়ে যে দেশে যত বেশী, সে দেশে ততবেশি ইভতিজিং ও নারী নির্যাতন হয়। ক্ষুদ্র জীবনে পৃথিবীর চৌদ্দটি দেশ ভ্রমণ করে এই মন্তব্য করছি। জিজানের প্রত্যেক এলাকায় ইসলামী শরিয়া কাউন্সিল আছে, সরকারী ভাবে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র আছে। একটি সুখি জাতি বলতে জা বুঝায়, তার সবকিছু বিদ্যমান। জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রায় তিরিশ হাজার বাংলাদেশী জিজানে অবস্থান করছে। মুল শহরে সুদান, মিশর, ইরিত্রিয়া বাংলাদেশ ও ইন্দিয়ানদের হাইস্কুল রয়েছে। জিজানের ক্ষেত খামার, আম ও বিশাল কলা বাগান দেখে বাংলাদেশের সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা মনে পড়ে।
প্রয়াত বাদশাহ আব্দুল্লাহর নানাবাড়ি জিজান, তাঁর নামে প্রদেশ জুড়ে অনেক সড়ক ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, সুদান, সোমালিয়া জিজান থেকে কাছে। তাই এই পথে সৌদি আরবে কালো লোকদের অনুপ্রবেশ ঘটে। জিজানের পাহাড়, শুকনো নদী আর ধু-ধু মরুভূমি দেখে কেবল অতীতের ইতিহাস হাতড়ে বেড়াই। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সঃ এর স্মৃতিধন্য জিজান হাজার বছর ধরে ইয়েমেনের অংশ ছিল। সেকালে মুয়াজ বিন জাবাল নামক একজন সাহাবাকে ইয়েমেনের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে মদিনা থেকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি এতই জনপ্রিয় শাসক ছিলেন, আজো তার নামে ইয়েমেন জুড়ে স্কুল, সড়ক, এভিনিউ রয়েছে। অনেক সাহাবি সানা, এডেন, হাজারাল মাউত,হাবাশা ভ্রমণকালে জিজানে যাত্রা বিরতি করেছিলেন।
জিজান থেকে দামাম ফিরবো বলে কিং আব্দুল্লাহ বিমান বন্দরে যাই। পরিস্থিতি সব বদলে গেছে। চারদিকে কেবল যুদ্ধের আতংক। লোকেরা বলাবলি করছে- সৌদি সরকারের নেতৃতে ইসরাইলে হামলা না করে একটি মুসলিম দেশের নিরীহ লোকদের নির্মম ভাবে বিমান হামলা করছে, আসলে কি হচ্ছে ইয়েমেনে?
মাত্র ২% শিয়া মুসলিম ইয়েমেন দখল করতে পারে? প্রেসিডেন্ট হাদি পালাবে কেন? সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রির ইস্যু সৃষ্টি করা? ইরানকে ক্ষেপীয়ে যুদ্ধে নামিয়ে দুর্বল করে ইসরায়েলকে চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্র? পশ্চিমা মিডিয়া যেসব খবর প্রচার করছে তা কি সঠিক? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য মার্কিনদের তাড়াহুড়া না-কি ? পর্দার আড়ালে কে কার স্বার্থ নিয়ে খেলছে- হলুদ সাংবাদিকতার কারণে জনতা এখন ধুম্রজালে। বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অভিযোগ বাড়ছে ? রাষ্ট্র মানে মগ আর পিগমির উল্লাস ? মাইট ইজ রাইট বা ডিভাইটেড এন্ড রুল- এসব নষ্ট সুত্র ছেড়ে বিশ্বমোড়লগণশান্ত হতে চান ?ট্যাক্সি চালক সহ যাত্রীরা নানা মন্তব্য করেন। আরব আমিরাতে হিন্দু মন্দির স্থাপিত হল সে ব্যপারে সৌদি আরব নীরব, দুর্বল দেশ ইয়েমেনে শিয়া বিদ্রোহীদমন ইসলাম রক্ষার একশান হলে সাউদিকে সাধুবাদ জানাই। আমি প্রবাসী বা আজনবি, আমরা নিরব দর্শক মাত্র। ইয়েমেনে হামলার কারণে সাউথের আভা, নাজরান ও জিজান এই তিনটি বিমানবন্দর সাধারণ যাত্রী চলাচল বন্ধ। রিটার্ন টিকেটের রিয়াল ফেরত পাই। ট্যাক্সি নিয়ে পাহাড়ি শহর আভা আসতে হল।
আমরা যখন পাহাড়ি রাস্তা ধরে মেঘের কাছাকাছি গেলাম, সেই ভেজা ভেজা সন্ধ্যা ছিল চমৎকার। অন্য রকম এক সৌদি আরব দেখলাম। দার্জিলিং বা নেপালের কাঠমান্ডুর পাহাড়ি সড়ক থেকেও আভার পাহাড়ি সড়ক ভয়ংকর। পাহাড়ের ওপরের ব্রিজ গুলো মোহনীয় ভঙ্গিতে তৈরি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো পর্যটকদের যেন ব্যকুল করে তোলে। খামিস শহরে নেমে ভগ্নিপতি নিজাম উদ্দিনকে পাই। খামিসের মুসা নামক স্থানে একরাত আরাম করি। সাপকোবাসে আবার দুই হাজার কিঃ মিঃ ভ্রমণ শুরু করি। পথে রিয়াদে আমিন আলীর বাসায় একরাত যাত্রা বিরতি। সৌদি আরব ভূখণ্ডের পাঁচভাগও ব্যাবহারের আওতায় আসেনি। হাজারো মাইল জনমানব শুন্য নির্জনতায় পড়ে রয়েছে। তবুও তারা নাগরিকত্ব দিচ্ছেনা। কোথাও এক টুকরো জমির জন্য রক্তারক্তি, কোথাও হাজারো মাইল অনাবাদি। সুন্দর এই পৃথিবীর সৃষ্টি, ইতিহাস এবং পরিণতি যেন রহস্যে ভরপুর। অনন্তকাল স্রোতের মধ্যে বুদবুদের মতো মানুষের জীবন, অবিরত ফুটছে আর ঝরছে, দুনিয়ার খেলাঘরে কয়টি মুহূর্ত কাটিয়ে দেয়ার জন্য কি তার আয়োজন, আর নিজের শক্তির পরিচয়ে কি তার আনন্দ। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ট্যুরিজমের কথা বলেছেন-সিরু ফিল আরদ, উঞ্জুর , কাইফা কানা আকিবাতুল মুকাজ্জিবিন। অর্থাৎ পৃথিবী ভ্রমণ কর, যুগে যুগে মিথ্যুকদের কি পরিণতি হয়েছিলো দেখতে পাবে।
লেখকঃ সৌদি আরব প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট
অপরূপা প্রাগ
দেবাশিষ সরকার
মধ্য ইউরোপে বেড়ানোর একটা অসাধারণ জায়গা হচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ। বর্তমানে দেশটি ‘চেকিয়া’ নামেও পরিচিত। এদেশে প্রায় দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষের বসবাস। ভলতাভা নদীর শহর প্রাগ। ভ্রমণ-পিপাসুরা একবারের জন্য হলেও প্রাগের অসাধারণ সব গল্প শুনেছেন। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল যে প্রাগ বেড়াতে যাবো। হঠাৎ একদিন বাসের টিকেট কেটেই ফেললাম। একা একাই বেড়াতে গেলাম। বাসে যাতায়াতের জন্য অনেক লম্বা সময় লাগে ভ্রমণ করতে, কিন্তু খরচের কথা চিন্তা করে চলেই গেলাম।
ব্রাসেলসের গার্ড দু নর্ড রেল স্টেশনের পাশেই ইউরো লাইনস এর বাস স্টেশন। যাই হোক, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের পথ পেরিয়ে খুব ভোরে গিয়ে নামলাম প্রাগের বাস স্টেশনে। ওইসময় এক ধরণের শিহরণ কাজ করছিলো। সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে রঙিন প্রাগকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই ভোলার নয়।
তারপর ট্রামে করে চলে গেলাম শহরে। তখনও অনেকটাই সকাল আর প্রচণ্ড শীত। ভলতাভা নদীর পাশে বসার জায়গায় মাথার নিচে ট্রাভেল ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। ভলতাভা নদীর দুই পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আপনি প্রাগের অনেক সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারবেন। আমি হেঁটে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম।
১৪ শতকের বিখ্যাত চার্লস ব্রিজ হচ্ছে প্রাগের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। সম্রাট চতুর্থ চার্লস ১৩৫৭ সালে এই ব্রিজ উদ্বোধন করেন যা তার নাম অনুসরণ করেই আজকে চার্লস ব্রিজ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যান যার বেশিরভাগই পর্যটক। এত মানুষ ব্রিজের উপর বেড়াতে যায় যে আপনাকে একরকম ঠেলাঠেলি করেই এগিয়ে যেতে হয়। ব্রিজের উপর ভাস্কর্য্গুলোর কারুকার্য দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে। এই ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আপনি শত শত বছরের ইতিহাসের নিদর্শন দেখে যেতে পারবেন।
চার্লস ব্রিজের উপর ‘ব্রিজ ব্যান্ড’ নামে গানের দল আপন মনে গান-বাজনা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছে আবার ওদের গানের রেকর্ডারও বিক্রি করছে। তাছাড়া ব্রিজের উপর অনেক চিত্রশিল্পী কাজ করে। তারা হবুহু মানুষের ছবি এঁকে দিচ্ছে। মানুষজনকে শুধু কিছু সময় ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে হয়। ব্রিজের একপাশে উঁচু পাহাড়ে ঘরবাড়ি দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগে।
ডানসিং বিল্ডিং হচ্ছে আরেকটা দর্শনীয় স্থান। এই বিল্ডিং এর দিকে তাকালে মনে হবে যেন নাচানাচি করছে। আসলে এটা একটা রেঁস্তুরা। এখানে আসলে সবাই একটা ছবি তুলতে ভুলে না। আমিও ভুল করিনি। প্রাগে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যার ঘড়ি দেখতে ভিড় লেগে যায়। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি পুরনো টাউন হলে টাওয়ারে দেখতে পাওয়া যাবে। ১৫ শতকের স্মৃতি নিয়ে এই ঘড়ি আজ অব্দি চালু আছে। তাছাড়া আপনি প্রাগ কাসল দেখে আসতে পারেন। প্রাগ কাসল দেখতে অসাধারণ লাগে।
নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি উইশ ওয়াল বা ইচ্ছে দেয়াল। এ দেয়ালে সবাই যার যার মনের কথা লিখে আসে এই বিশ্বাসে যে সেটা সে পাবে। আমি অনেক ভেবেও বুঝতে পারলাম না কি চাইবো। তাই বাবার আদর করে দেওয়া নিজের নামই লিখে আসলাম। সাথে ছবিও তুলে আনলাম যাতে পরে কেউ বেড়াতে গেলে বলতে পারি সে কথা।
প্রাগের সুন্দর সুন্দর বিল্ডিঙের সরু গলিগুলোতে দেখলাম পর্যটকরা আনন্দে হাঁটাহাঁটি করছে। বিল্ডিং এর আশপাশে অনেক সরু রাস্তা যেন পুরান ঢাকার গলি। ওইসব পথ দিয়ে হেঁটে যেতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। বেড়ানোর দিন খোলা বাজার বসেছিল প্রাগ শহরে। ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম ওদের লোকাল কৃষি পণ্য। ফিশ বা মাছ রেস্তুরা আছে চার্লস ব্রিজের পাশেই। ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিতে পারেন।
অনেক মডার্ন আর্ট চোখে পড়ে রাস্তার পাশে। কাঠের তৈরি অথবা স্টিলের তৈরি অনেক ভাস্কর্য, আর্ট আপনার মন কেড়ে নিবে। হঠাৎ রাস্তায় দেখি রিকশা। প্রাগে রিকশার দেখা পাব ভাবিনি। দেখেই ঢাকা শহরের কথা মনে পড়ে গেল। দিনের বেলার প্রাগের কথা যত না শুনেছি, রাতের বেলার প্রাগের কথা তার চেয়ে বেশি শুনেছি। রাতে প্রাগকে নাকি অদ্ভুত সুন্দর লাগে। সত্যিই সুন্দর রাতের দেখা পেলাম প্রাগে। রাতের অন্ধকারে চার্লস ব্রিজের সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে যায়। ব্রিজের বাতিগুলোর আলো নদীর পানিতে যেন আনন্দের মূর্ছনা ফেলে। নদীর পাশে বসে এককাপ কফি না খেলে কি আর চলে?
ফেরত আসার সময় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি তখন বাসে ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ পুলিশ এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে পাসপোর্ট নিয়ে গেলো একটু পর ফেরত দেওয়ার কথা বলে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পাশের যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদেরটাও নিয়ে নিয়েছে। এইরকম অবস্থায় মধ্যরাতে হঠাৎ অচেনা এক জায়গায় পুলিশের পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়াটা আমার জন্য ভনায়ক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ পর পুলিশ ‘দুঃখিত’ বলে হাসিমুখে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আপনি না চাইলে প্রাগ আপনাকে ছাড়বে না। আমাকেও ছাড়েনি। আবার শান্তির ঘুম দিয়ে নিলাম। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও চোখে ভাসছিলো প্রাগের উজ্জ্বলতা।
লেখক পরিচিতি:
দেবাশিস সরকার একজন লেখক ও গবেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ এবং এমবিএ করেছেন। তারপর বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোফিন্যান্স উপর মাস্টার্স করেছেন। পরবর্তীতে বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অফ মন্স থেকে গবেষণার উপর ডিগ্রী নিয়েছেন। তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণাপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে লিপ্ত আছেন। চাকরিজীবনে তিনি বাংলাদেশ ও জার্মানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তিনি দেশে বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তিনি ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। পড়াশুনা, চাকরি আর ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে তার ৫ টি মহাদেশের অনেক দেশ বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে। তার ভ্রমণ গল্পগুলো নফহবংি২৪.পড়স এ নিয়মিত প্রকাশিত হত। তিনি তার ভ্রমণগল্পের সম্মানিত পাঠকগণের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা এবং উৎসাহ পেয়েছেন।
যাই মধু আহরণে
মুস্তাফিজ মামুন
যাই মধু আহরণে
এবার সুন্দরবনে ১ এপ্রিল থেকে মধু সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে, চলবে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত
গ্রামে ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যায় বাজারে গেলাম। কড়াইয়ে গরম মিষ্টি দেখে হানা লোভ সামলাতে পারছিল না। দুজনে প্রথমে একটি করে ছানার জিলাপি খেলাম। হানা পরে আরো তিনটি খেয়েছিল। হানাও সাংবাদিক। চেক প্রজাতন্ত্রে তার বাড়ি।
বুড়িগোয়ালিনীতে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আমরা লঞ্চে ফিরলাম। এখানে অনেক মশা। সাফসুতরো হয়ে ওডোমস মেখে বসে রইলাম। রাতের খাবারও খেয়ে নিলাম আগেভাগেই। বেঙ্গল ট্যুরসের লঞ্চে করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সদর কার্যালয় বুড়িগোয়ালিনীতে এসেছি আমরা খুলনা থেকে।
লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দে ঘুম ভাঙল। জেগে দেখি, চলতে শুরু করেছে। চালকের নাম সঞ্জয়। জানাল, সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছি। নদীটার নাম চুনা। ঢাকা থেকে রাতের বাসে দলের অন্যরা ওখানে আসবে। মুন্সীগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। লঞ্চ থামল বন কার্যালয়ের সামনে। গিয়ে দেখি দল হাজির। বিটু ভাই ও সালমানকে দেখলাম আগে। সবাইকে লঞ্চে তুলে আবার চললাম বুড়িগোয়ালিনী। পৌঁছে দেখি, মৌয়ালরা আটঘাট বাঁধছে। জানাল, আরো ঘণ্টা দুই লাগবে।
বছর কয় আগে প্রথম যখন মধু সংগ্রহ দেখতে গিয়েছিলাম সুন্দরবন, চমৎকার একটি উৎসব হতো তখন- সবাই মিলে প্রার্থনায় বসত, বন কর্মকর্তা বন্দুক হাতে দাঁড়াতেন জেটিতে, নৌকাগুলো বাঁধা থাকত পর পর। আনুষ্ঠানিকতা শেষে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়তেন কর্মকর্তা আর মৌয়ালরা জোর বৈঠা চালিয়ে ছুটে যেতেন বনে।
এখন আর তেমন হয় না। বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মীরা পট গানের মধ্য দিয়ে সচেতনতামূলক তথ্য দিল মৌয়ালদের। তারপর বনে চললাম। ঢালী চাচা আমাদের লঞ্চের সঙ্গে তাঁর নৌকাটি বেঁধে নিলেন। ঢালী চাচার মধু সংগ্রহের অভিজ্ঞতা ষাট বছরের। ডিসকভারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে।
খোলপেটুয়া নদী ধরে ঘণ্টাখানেক চলার পর ঢুকলাম ছোট্ট একটি খালে। নাম বুড়ির খাল। লঞ্চ নোঙর ফেলল। ঢালী চাচার দলের সঙ্গে আমরাও নৌকায় উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ চলার পর জঙ্গল শুরু হলো। মৌয়ালরা গেল চাক খুঁজতে, আমরা রইলাম বন প্রহরীদের সঙ্গে।
মিনিট দশেক পর আওয়াজ পেলাম ‘আল্লাহ আল্লাহ বলো রে’। ঢালী চাচার ছেলে মনিরুল দৌড়ে এলো- স্যার চাক পাওয়া গ্যাছে, ম্যালা বড়, পাঁচ কেজি মুধু হইব। আমরা চললাম মনিরুলের সঙ্গে।
মৌয়ালদের একজন টাইগার ফার্ন কেটে মশালের মতো তৈরি করলেন। এর ধোঁয়া দিয়ে চাক থেকে মৌমাছি তাড়ানো হয়। আমাদেরও মশারির জাল দিয়ে তৈরি মুখোশ দেওয়া হলো। মশালে আগুন দেওয়া হয়েছে, ধোঁয়া বের হচ্ছে।
মনিরুল মশাল নিয়ে উঠে গেল গাছে। মৌমাছিরা বেশি বেগড়বাই করল না, রণে ভঙ্গ দিল অল্প সময়েই। অভিযান সফল হলো। চাক কেটে ধামায় ভরে নিলেন মৌয়ালরা। জঙ্গলেই খাওয়া হয়ে গেল পুরোটা মধু।
একটু জিরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় চাকের খোঁজে গেল মৌয়ালরা। আমরা নৌকায় অপেক্ষায় থাকলাম। এবারও কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক এলো। গেলাম চাকের গাছে। কিন্তু ঢালী চাচা চাক না কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ আগেই চোরা শিকারিরা এক দফা ছুরি চালিয়েছে। সবাইকে চাক থেকে দূরে থাকতে বললেন চাচা। জানালেন, কাটা চাকের মৌমাছিরা খুব হিংস্র হয়। কিন্তু এত বড় চাক দেখে আমি আর সালমান ছবি তোলার লোভ সামলাতে পালাম না। ভালো কয়েকটা ছবিও তুললাম। হঠাৎ ভন ভন শব্দ! তাকিয়ে দেখি, পুরো চাক হামলে পড়েছে সালমানের ওপর। আমার মুখোশ ছিল। তার পরও হাতমোজার ওপর দিয়ে সমানে কামড়াচ্ছিল। সালমানের হাতমোজা নেই, মুখোশও নেই।
চিৎকার শুনে বেঙ্গল ট্যুরসের কর্মী সোহাগ সারা গায়ে কাদা মাটি মেখে দৌড়ে এলো। জড়িয়ে ধরল সালমানকে। নিয়ে তুলল নৌকায়। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নিতে হবে। জঙ্গল ছেড়ে সবাই গিয়ে লঞ্চে উঠলাম। সোজা গেলাম বুড়িগোয়ালিনী বিজিবি হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার সালমানকে ছেড়ে দিলেন দুপুরে। খাবার খেয়ে সবাই গেলাম বিশ্রামে।
দুপুরের পর আবারও চাক কাটতে বের হলাম। সালমান নাছোড়বান্দা। বারণ সত্ত্বেও সঙ্গে চলল। এ যাত্রায় বেশ কয়েকটি চাক কাটা হলো। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম লঞ্চে। রাতে নোঙর ফেলা হলো কলাগাছিয়া অভয়ারণ্যের সামনে।
পরদিন খুব ভোরে আবারও জঙ্গলে গেলাম। তবে এবার চাক কাটতে নয়, বন দেখতে। কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে নেমে কাঠের ট্রেইল ধরে হাঁটলাম ঘণ্টাখানেক। বন মোরগ এত কাছে পেয়েও ছবি তুলতে না পেরে আফসোস করলাম! বেশ কিছু বানর, চিত্রা হরিণও দেখলাম এখানে।
সমুদ্রের আহবানে হেঁটে হেঁটে হেঁটে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার
জিল্লুর রহমান খন্দকার
ভদ্রলোকের নাম সুজাউদ্দিন এফ. সোহান পেশায় একজন দন্ত চিকিৎসক। সদ্য ইন্টার্ন শেষ করে বেরিয়েছেন, বিগত চার বছর যাবৎ উনি একটি অভিনব ট্রিপের আয়োজন করে থাকেন ভ্রমণবিলাসী অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের জন্য। আর সেটা হচ্ছে, সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার বাজার পর্যন্ত যাওয়া। ফেসবুকের মাধ্যমে তার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিগত চার বছর যাবৎ আমি এই অভিনব এবং আকর্ষণীয় ট্রিপে যাবার জন্য চেষ্টা করছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সময় সুযোগ কখনোই মেলাতে পারছিলাম না উনার পরিকল্পনার সাথে। আর উনি এটা সারাবছর করেন না বছরে শুধুমাত্র দুইবার এই আয়োজন করেন ডিসেম্বরে একবার জানুয়ারিতে একবার।
এবার অক্টোবর মাসেই উনার পরিকল্পনার কথা জানতে পারলাম এবং আমি নিজের মনস্থির করে নিলাম যে এবার আমি যাবো ইনশাআল্লাহ্। সবার আগে আমি সারা দিলাম তার প্রস্তাবনায় এবং আমার যারা কাছের বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। সবাই প্রায় আঁতকে ওঠে বলল, তুই কি পাগল? টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যাবি? এটা অসম্ভব, এটা স্বাভাবিক মানুষের কোন কাজ নয়। আমিও জানি এটা একমাত্র পাগলামি ছাড়া কিছুই না আর এজন্য পাগল হতে হবে।
যাই হোক অবশেষে একজন পাগল বন্ধুকে সঙ্গী হিসেবে পেলাম। সে আমার অত্যন্ত ছোটবেলার বাল্যবন্ধু সিলেটে বসবাসরত নুরুল মামুন মনি। দুই মাস মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেলাম পাশাপাশি একটু শারীরিক কসরত করারও সুযোগ পেলাম। যাতে হুট করে আমরা কোন প্রকার বিপদে না পড়ে যাই। কারণ প্রতিদিন গড়ে ২০ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হবে এ ধরনের পূর্বঅভিজ্ঞতা আমার কোনো কালেই ছিল না। এমনিতে আমি হাঁটাহাঁটি করি প্রায় প্রতিদিন, তবে সেটা ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার কিন্তু এরকম করে আমার কখনোই হয়ে ওঠেনি আগামীতে হবে কিনা আমার জানা নেই।
অনেক আলোচনা করে ফেললাম, এবার আসি মূল পর্বে যথারীতি দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলো এবং পারিবারিক কিছু সীমাবদ্ধতাও সামনে চলে এলো। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল আমার মনে হয় আর যাওয়া হবে না। তারপরেও আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানীতে এবং আমার সহধর্মিণীর উৎসাহে আমার যাওয়ার সুযোগটা প্রস্তুত হয় এবং আল্লাহর রহমত আমি রওনা দিতে সক্ষম হই। আমাদের গাড়িটি রিজার্ভ নেওয়া হয়েছিল তার কারণ এবারই সর্বোচ্চ সংখ্যক অংশগ্রহণকারীর অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের এই মিলন মেলাটা। সাধারণত ৩০ জনের বেশি সোহান ভাই নেন না, তার কারণ ম্যানেজ করতে সমস্যা হয় কিন্তু এবার প্রচুর আগ্রহী ভ্রমণিপাসুদের কাছে উনি হার মানতে বাধ্য হন এবং সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে সেটা ৫০ জনে উত্তীর্ণ হয়।
রওনা দিলাম রাত এগারোটায় অথচ গাড়ি নয়টায় আসার কথা ছিল। জ্যামের কারণে দেরি হয়ে গেছে আমাদের, টেকনাফে আমরা পৌঁছাই বেলা সাড়ে ১২ টায়। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে টেকনাফ শহর থেকে আমরা চলে গেলাম টেকনাফ সী বিচ পয়েন্টে। সেখানে আমাদের সবাইকে গ্রুপ ভিত্তিক ভাগ করে দেওয়া হল। আমরা তিনটা গ্রুপে বিভক্ত হলাম লাল, হলুদ, সবুজ, আমার অবস্থান ছিল হলুদ গ্রুপে এবং আমাদের গ্রুপের মাসুম ভাই সেখানে আমাদের করণীয় কি কি তা বুঝিয়ে দিলেন এবং আজকে আমাদের গন্তব্য কতদূর সেটা জানিয়ে দিলেন। এরপর শুরু হল অফিশিয়াল ফটোসেশন। ফটোসেশনের পর্ব শেষ করে আমাদেরকে বলে দেওয়া হল আজকে আমাদের যেতে হবে কচ্ছপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। প্রথমদিন এর সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা রওনা দিলাম দুপুর ২ টা ৩০ মিনিটে, আজকে নাকি ১৫ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হবে।
বিসমিল্লাহ বলে হাঁটা শুরু করলাম, একপাশে সমুদ্রের সৌন্দর্য আর আরেক পাশে পাহাড়, দারুণ লাগছিল আমাদের। নানারকম গল্প করতে করতে আমরা সকলে এগিয়ে চললাম তবে সবার হাঁটার গতি একরকম ছিল না, তাই আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়লাম। এরমধ্যে আমার বন্ধু কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লো পা নাড়াতে পারছিল না। ওর জন্য কিছুটা সময় নষ্ট হলো, তবে আল্লাহর রহমতে ও দ্রুত হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পায়। জীবনে প্রথম সমুদ্রকে অত্যন্ত কোলাহলমুক্ত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। সমুদ্র যেন তার সৌন্দর্যের পসরা আমাদের জন্য বিছিয়ে অপেক্ষায় ছিল, সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করতে থাকলাম। বিশাল বিশাল ঢেউ আর প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা হাওয়ায় মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। হাটার কোন ক্লান্তি অনুভব আমরা করছিলাম না। আমরা দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে হেঁটে আসছিলাম এবং বাতাসটা উত্তর দিক থেকে বইছিল, সে এক প্রাণ জুড়ানো অভিজ্ঞতা। বাম পাশে বিশাল সমুদ্রের হাতছানি বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তটে আর আমাদের ডান পাশে ছিল ঝাউবন এবং পাহাড় পরিবেষ্টিত টেকনাফের সৌন্দর্য।
কখন যে সন্ধ্যা হয়ে এলো টেরই পাইনি, সব আলো যেন আজকের জন্য নিভিয়ে দিল প্রকৃতি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা দুজন হেঁটে চলেছি, একটা পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম যে সবাই আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে শুধু পেছনে পড়ে রয়েছি আমি আর আমার বন্ধু মনি। নির্জন সমুদ্রের পাড়ে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। অন্ধকারে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল একটু ভয়ও কাজ করছিল, তাই আমরা বিচ সংলগ্ন মেরিন-ড্রাইভ-রোড এ উঠে পড়লাম। অন্ধকার ঘুটঘুটে পরিবেশে তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। টর্চের সাহায্যে রাতের অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছিলাম।
রাতের অন্ধকারে অনেকক্ষন হাটার পর স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তারা জানালো আমরা দুই কিলোমিটার বেশি এগিয়ে গেছি। স্থানীয় এক চায়ের স্টলের মালিকের সহযোগিতায় আমরা আমাদের গন্তব্য স্থল কচ্ছপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় উপস্থিত হলাম অটোরিক্সাতে করে। সেখানে যখন পৌছালাম, পৌঁছে আমরা দুজনে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের দলের লোকেরা এত সুন্দর আয়োজন করে রেখেছেন আমাদের জন্য, আগে থেকে আমরা ভাবতে পারিনি। পুরো স্কুলের মাঠে জুড়ে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে সারি সারি তাবুগুলো। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা তাঁবুতে প্রবেশ করলাম। এবার ফ্রেস হবার পালা, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম এবং মোবাইলগুলো চার্জে লাগালাম যেহেতু আগামীকাল বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে কিনা তা সঠিক জানা নেই। এবার রাতের খাবারের ডাক পড়লো, খাবারের আয়োজন অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে করা তবে পরিবেশনা এবং উপস্থাপনা অভিনবত্বের ছোঁয়া রয়েছে, আর সেটা হচ্ছে স্থানীয় একটি রিকশার গ্যারেজ। খুব সুন্দর করে টেবিল চেয়ার বসানো হয়েছে এবং সামুদ্রিক মাছের নামটা মনে করতে পারছিনা সামুদ্রিক মাছের ঝোল এত অমৃতের মত লাগলো। পেট ভরে খেলাম কারণ অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে টার্গেট ছিল ১৫ কিলোমিটার আমরা মনে হয় প্রায় ১৭ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে চলে এলাম আমরা স্কুল প্রাঙ্গণে সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। আড্ডা পর্ব শেষে যে যার মত ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আমার মনে পড়ে না আমি সর্বশেষ কবে এত আগে ঘুমিয়েছিলাম। আমি ঠিক সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে গেলাম, ঘুমাবো না কেন? কারন আমরা ডিজিটাল লাইফ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ইউটিউব এগুলো না থাকলে মনে হয় আমি দুনিয়ার বাইরে চলে এসেছি। আমার আর কোন কাজ নেই, ঠিক তেমনটিই হয়েছে যেহেতু এলাকাটা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশে এবং সরকারি নির্দেশে সন্ধ্যা ৬ টার পরে নেটওয়ার্ক তেমন থাকে না, সেই কারণে কোন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না শুধু কথা বলার জন্য সামান্য নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল। কথা বলার বাইরে আমাদের আর কোন কাজ না থাকার কারণেই আমরা সবাই যে যার মত সেই পুরনো দিনে চলে গেলাম, মানে আগে আগে ঘুমিয়ে পরলাম।
এত সুন্দর একটি ঘুম হল ক্লান্তির কারনে হবে হয়তো, উঠলাম সকাল সাড়ে ছটায়। সকালে উঠেই কিছুটা অবাক হওয়ার পালা তার কারণ গতকাল রাতে আমরা যখন এখানে এসেছিলাম তখন ছিল ঘোর অন্ধকার তাই এলাকাটা ভালোভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি। সকালের আলোতে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না, সামনে সমুদ্র আর পেছনে বিশাল পাহাড়ের হাতছানি এর মাঝে শান্ত পরিবেশে অবস্থিত আমাদের ক্যাম্পিং সাইট কচ্ছপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। এত সুন্দর একটা পরিবেশ হতে পারে একটি স্কুলের আমার পূর্বে ধারণা ছিল না। সাধারণ সুন্দর সকালটা আসলেই অসাধারণ হয়ে উঠলো। যাক এবার ফ্রেস হলাম, যথারীতি আবার আগের স্থানে নাস্তা করলাম। নাস্তা শেষে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে, আজকে আমাদের যেতে হবে শাপলাপুর নামার বাজার এর কাছাকাছি শাপলাপুর বাজার মসজিদ। দূরত্ব ২২ কিলোমিটার মত হবে সুতরাং আর দেরী করলাম না রওনা দিলাম আবার দ্বিতীয় দিনের মতো হাঁটা শুরু করলাম।
সমুদ্রের গর্জন একাধারে বয়ে চলছিল কানের মধ্যে শব্দটা যেন সেট হয়ে গেছে, গর্জন না শুনলে যেন ভালই লাগছিল না, অসাধারণ একটা অনুভূতি। সকালের তীব্র বাতাস আর রোদের প্রখরতা দুটোর দুটোর কম্বিনেশন ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার কাছে নেই। শীতের সকালের গা হিম করে দেওয়া বাতাস মনটাকে উদাস করে দিচ্ছিল পাশাপাশি হাঁটাহাঁটি করার যে শারীরিক ক্লান্তি সেটা সুন্দরভাবে দূর করে দিচ্ছিল। সর্বদা আমরা নিজেদের ক্লান্তিহীন অনুভব করছিলাম। আমরা দুজন আবার গতকালকের মতন গল্প করতে করতে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সুন্দর সুন্দর লোকেশন গুলোতে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। স্মৃতি ধারণ করার চেষ্টা করছিলাম কারণ জানি এই সময়টা এবং এই সুযোগটা জীবনে দ্বিতীয়বার হয়তোবা আর পাব না। এক ঘন্টা পর পর আমরা নিজেরাই পাঁচ মিনিট দশ মিনিট করে বিরতি নিয়েছিলাম যাতে কোন প্রকার ক্লান্তি আমাদের গায়ে ভর না করে। এলাকার সৌন্দর্য, জেলেদের মাছ ধরার কিছু বিষয় যেটা আসলেই আমার আগে কখনো দেখা হয়নি। এইমাত্র মাছ ধরে আনা হয়েছে সেই রকম নৌকার কাছে গিয়ে দেখলাম, তারা কিভাবে মাছ বাছাই করছেন। এখানে চলার পথে যেতে যেতে অনেক জেলে পরিবারকে কাছ থেকে দেখার নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। দেখলাম তাদের জীবনযাত্রা, দেখলাম তাদের কর্মকাণ্ড। কিভাবে তারা মাছ সমুদ্র থেকে ধরে এনে সেগুলোকে বাছাই করছে বাজারে বিক্রি করবে বলে।
সকাল গড়িয়ে কখন যে দুপুর হয়ে গেল আনন্দে আর উত্তেজনায় খাবারের বিষয়টা আমাদের মাথাতেই আসেনি। তবে পেট নাছোড়বান্দা আমাদের জানান দিচ্ছিল যে আমাদের কিছু খাওয়া দরকার, তেষ্টাও পেয়েছিল খুব। একটি গাছ তলায় বসে সামান্য হালকা কিছু বিস্কিট আর ফল খেয়ে নিলাম ডাবের পানি পান করলাম। দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে পূর্ণ উদ্যোমে আবারও হাঁটা শুরু করলাম। সমুদ্রকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা এবং সমুদ্রের বিশাল সৌন্দর্যের নির্জনতায় একাকী পথচলা পথিকের বেশে আমরা দুই বন্ধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আর হাঁটতে হাঁটতে কিভাবে যে সকাল থেকে সন্ধ্যা করে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যে নামার কিছুক্ষণ আগেই আমরা শামলাপুর বাজার এর কাছে যে মসজিদ আছে সেখানে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের গ্রুপ লিডার তার দলবল নিয়ে আগে থেকেই আমাদের জন্য ক্যাম্পিং সাইট রেডি করে রেখেছিল। এবারের ক্যাম্প সাইট একটু ব্যতিক্রম। সমুদ্রের একদম তীরবর্তী ঝাউ গাছের ফাঁকে ফাঁকে তাবুগুলো টানানো ছিলো এবং পাশেই ছিল মসজিদ, আমরা মূলত মসজিদকে কেন্দ্র করেই অবস্থান গ্রহণ করলাম। আমাদের আগে যারা পৌঁছে গেছে তারা সবাই দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠেছিল, আমরা অবশ্য খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই পৌছালাম বিধায় খেলার শেষটা দেখার সুযোগ পেলাম। সবাই বেশ আনন্দ আর উত্তেজনায় সময়টাকে উপভোগ করছিল।
আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা তাঁবুতে আমরা আমাদের ব্যাগ গুলো রেখে গোসল করার উদ্দেশ্যে সমুদ্রের দিকে গেলাম গত দুইদিন ধরে সমুদ্রের কাছাকাছি রয়েছি অথচ সমুদ্রের পানিতে গা ভেজানো হয়ে ওঠেনি। অবশেষে আমরা দুজন সান্ধ্য কালীন সময়ে গোসল করতে নামলাম। সমুদ্রের অসম্ভব তীব্র ঠান্ডা পানিতে গা হিম হয়ে যাবার পালা, কোনরকম ১৫ মিনিট থেকে দ্রুত উঠে এলাম পানি থেকে এক গাদা বালি শরীরে মাখিয়ে ক্যাম্প সাইটে ফিরলাম, মসজিদের পানির কল ছিল সেখানে গিয়ে ভালো মতো গোসল করে ফ্রেশ হলাম এবং আমরা সবাই রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে শাপলাপুর নামার বাজারে গেলাম। আমাদের জন্য আগে থেকেই ওখানে খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল। রাতের খাবারের মেনু ছিল কালো চাঁদা মাছের তরকারি আর ডাল। পেট ভরে খেলাম খাওয়া-দাওয়া শেষে ফেরার পথে পরের দিনের জন্য কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম, সামান্য ঔষধ কিছু ফলমূল কিনে সাইটে ফিরে এলাম। আমরা আমাদের তাঁবুর ভেতর বসে নিজেদেরকে পরের দিনের জন্য প্রস্তুত করার চেষ্টা শুরু করলাম।
এই এলাকাতেও ঠিক একই সমস্যা, আমাদের খুব নিকটবর্তী শাপলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প অবস্থিত ছিল তাই যথারীতি কোন ডিজিটাল নেটওয়ার্ক নেই। আমরা সেই আদি মানবের চরিত্রে ফিরে গেলাম অর্থাৎ কাজ নেই গল্প করো, আড্ডা দাও, তারপর ঘুমিয়ে পড়ো, পরিবারের সাথে খোঁজখবর দেওয়া নেওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজকে আমাদের তাবুটা ছিল সমুদ্রের একদম পাশে, সারাক্ষন শুধু গর্জন আর গর্জন এর মধ্যে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল প্রচন্ড বাতাসের শব্দে, মনে হচ্ছিল যেন আমাদের তাবু বাতাসে উড়িয়ে নেবে। এমন একটা ভাবে কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম আমি। তবে রক্ষা পেলাম সেটা সীমিত সময়ের জন্য ছিল। রাতে ওখান থেকেই আমরা খবর পেলাম যে ঢাকা বিভাগের আশেপাশে প্রচন্ড ঝড় তুফান সাথে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। অথচ এখানে তেমনটি হয়নি শুধুমাত্র প্রচন্ড বাতাস ছাড়া।
সকালে এসে ঝামেলায় পড়লাম টয়লেট করা নিয়ে, মসজিদের কাছাকাছি টয়লেট প্রায় দশটি কিন্তু তেমন একটা ব্যবহার ব্যবহার না হওয়ার কারণে প্রত্যেকটা এমন দুরবস্থা হয়ে আছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তার মধ্য থেকেই কোনরকমে জান বাঁচানো পর্ব বলা যায়, প্রাকৃতিক কাজ শেষ করলাম।
আজকে সকালে আমাদের নাস্তার কোন মেনু নেই, সাথে থাকা ফলমূল আর পানীয় পান করে তৃতীয় দিনের মতো রওনা দিলাম। আজকে আমাদের ক্যাম্পিং সাইট সোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং তার কারণ আজকে সর্বোচ্চ দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। তারচেয়ে বড় কথা গতকাল আমার পায়ে ফোসকা পড়েছে আর তা নিয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আজকে তাই ভালোমতো ব্যান্ডেজ লাগিয়ে হাঁটার জন্য নিজের মনকে তৈরি করলাম পাশাপাশি মনকে বোঝালাম যে আমরা পারবো।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমরা শুরু করে দিলাম হাঁটা তার কারণ ঘণ্টায় ৩ কিলোমিটার গতিতে যদি হাঁটতে থাকি তাহলেও ১০ ঘন্টা লেগে যাবে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে। নানান রকমের আলোচনা-সমালোচনা করতে করতেই দুই বন্ধু হাঁটতে থাকলাম সমুদ্রউপকূল ধরে। দেখতে থাকলাম সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা কিভাবে নির্ভর করছে এই সমুদ্রকে ঘিরে। এই এলাকাটায় বেশ কিছু জেলে পরিবার এর বসতি আছে বলে মনে হচ্ছে কারণ কিছুদূর পর পর আমরা জেলে পরিবারের দেখা পাচ্ছিলাম, যারা সবাই তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ছিল। কেউবা মাছ ধরছে, কেউবা নৌকা মেরামত করছে। অনেক রকম তাদের জীবন যুদ্ধ সমুদ্রকে ঘিরে। এইসব দেখতে দেখতে আমরা এগোতে থাকলাম।
সমুদ্রের সৌন্দর্য আসলে নিজের চোখে না দেখলে কখনো কাউকে বোঝানো সম্ভব না, যে কতটা সুন্দর। আর টেকনাফ থেকে যত উত্তরে কক্সবাজারের দিকে এগুচ্ছি মনে হচ্ছে, সমুদ্রের একেকটা বিচ একেক রকম সুন্দর, কারো সাথে কারো মিল নেই প্রত্যেকেই নিজ নিজ সৌন্দর্য ছড়িয়ে অপেক্ষায় আছে আমাদের আলিঙ্গন করার জন্য। যে পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি সে পথ আসলেই এখনো অপরূপ অবস্থায় আছে। যেখানে পড়েনি কোন অট্টালিকার গাঁথুনি, পড়েনি কোন প্রকার যুগের পরিবর্তনের হাওয়া। অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে বসে আছে নাম না জানা বীচগুলো। বিকাল অবধি আমরা ইনানী বিচের প্রায় কাছে চলে এলাম। এখানে এসে ব্যাপক প্রবাল পাথরের দেখা পেলাম। দেখে মনে হল প্রবাল পাথরগুলো নির্জন সমুদ্রের গর্জন এর মাঝে একাকী অপেক্ষায় আছে কোন ক্লান্ত পথিকের দেখা পাবে বলে। তাদের রুপ আমাদের তীব্রভাবে আকর্ষন করল আমরাও ছিলাম ক্লান্ত পথিক, বসে পরলাম ক্ষণিকের অবসরে। হালকা পানীয় জলপান করলাম নিজেদের চাঙ্গা করার জন্য। কিছুক্ষণ বসে সমুদ্রের গর্জন আর হাওয়ার কলতানে মুখরিত হলো হৃদয়-মন, আন্দোলিত হল প্রাণ, ভাবলাম পৃথিবীর এই মুহূর্তে শ্রেষ্ঠ মানুষ একমাত্র আমি।
কক্সবাজার আসার পর আমার তিন বন্ধু যারা কক্সবাজার বেড়াতে এসেছে তাদের সাথে যোগাযোগ হল এর মধ্যে একজন সাহাবুদ্দিন বিলাস উনি ওনার পরিবার নিয়ে ইনানীতে অবস্থান করছিল। বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল, তাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় আমরা ব্যয় করলাম। সন্ধ্যা হবার অল্প কিছু সময় বাকি ছিল তাই আমরা দেরি না করে পুনরায় আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। এবার হেঁটে হেঁটে আমরা সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমাদের টার্গেটে পৌঁছানোর চেষ্টা চালালাম এবং সোনারপাড়া প্রাইমারি স্কুলের কাছেই বাজার আছে সেখানে চলে এলাম। এলাকাটা ইনানী বিচ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে এবং আমাদের ক্যাম্পিং লোকেশনটা একটু লোকালয়ের দিকে সীবিচ থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে দিকে হবে হয়তো। বাজারে এসেই খাওয়া-দাওয়া করলাম। কারণ আমরা সারাদিন তেমন ভারী কোন খাবার খাইনি, হালকা বিস্কিট আর পানীয় জল ছাড়া। মেনু নির্ধারন করলাম আশেপাশের লোকজনদের খাওয়া-দাওয়ার ধরন দেখে। দেখলাম, সবাই বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু এগুলো খাচ্ছে তাও আবার বিষয়টা আমার কাছে একটু নতুনত্ব লাগলো তার কারণ সবাই এগুলি মজা করে খাচ্ছে এবং যে পরিবেশন করছেন সে সবকিছুকে মিলিয়ে কেমন যেন একটা বিষয় তৈরি করছেন, আসলে সেটা আমার ধারণা নেই। তবে সবার খাওয়ার আগ্রহ এর ধরন দেখে আমরাও সেটা অর্ডার করে বসলাম এবং খেলাম, বেশ লাগলো খেতে। খাওয়া শেষে এলাকার মানুষের সহযোগিতা নিয়ে যেহেতু স্থানটা আমাদের কাছে অপরিচিত, আমরা আমাদের লক্ষ্যে: সোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এ উপস্থিত হলাম।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি ৩০+ কিলোমিটারের মত পথ কিভাবে পাড়ি দিলাম আল্লাহ পাকই জানেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কিভাবে যে হেঁটে বেড়ালাম তাও ফোসকা পড়া পা নিয়ে। সোনারপাড়া বিদ্যালয় প্রাঙ্গণটা বেশ বড়, প্রথমে সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় এর মাঝখানে মাদ্রাসা আছে দেখলাম এবং এরপর প্রাথমিক বিদ্যালয় এর অবস্থান। আমরা সাইক্লোন সেন্টার নিচে তাঁবুতে অবস্থান গ্রহণ করলাম। সব মালপত্র গুছিয়ে গোসল করার প্রস্তুতি নিলাম যেহেতু ক্লান্ত ছিলাম, তবে টিউবওয়েলের পানি বাইরের ঠাণ্ডার তুলনায় গরম ছিল, গোসলটা করে বেশ শান্তি পেলাম।
সবাই যখন সবার মালামাল গোছগাছ শেষ করেছে তখন এলো রাতের খাওয়া-দাওয়ার পালা। স্থানীয় বাজারে রাতের খাওয়া-দাওয়া করে আমরা আমাদের ক্যাম্প সাইডে চলে এলাম। এসেই এবার আমরা বারবিকিউ আয়োজনে নিমগ্ন হলাম। ২০ কেজি কালো রূপচাঁদা মাছ বারবিকিউ করা হবে বলে কেনা হয়েছে বাজার থেকে। বিগত দুইদিন আমরা নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম যেখানে কোনো টু-জি নেটওয়ার্ক কাজ হচ্ছিল না। এই এলাকায় আসার পর দেখলাম এখানেই থ্রিজি ফোরজি নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে।
যেহেতু নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু আমরা আমাদের রোজকার অভ্যাসগত বা বদঅভ্যাসগত বিষয়: ডিজিটাল লাইফ, মানে মোবাইল জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যেটা আসলে আমার কাছে খুব খারাপ লাগলো তার কারণ হচ্ছে আমরা এতটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছি যে প্রকৃতির কাছাকাছি এখন আর আমরা থাকতে চাই না। আমরা চাই শুধু সারাক্ষণ নেটওয়ার্কের ভেতর থাকতে। নেটওয়ার্ক না হলে যেন আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। নেট ছাড়া যেন আমাদের একটু চলেনা। কেউবা ব্যস্ত ছবি আপলোড করায়, ব্যস্ত কেউবা ব্যস্ত লাইভে, দেখাচ্ছে আমরা কী করছি সবাই। এর বাইরে আমিও যেতে পারলাম না, আমিও তাদের সাথে তাল মেলানো শুরু করলাম। যাক এদিকে বারবিকিউ করতে করতে রাত বারোটা বেজে গেল বারোটার দিকে বারবিকিউ খেয়ে আমরা ঘুমোতে গেলাম।
সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে চতুর্থ দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। ক্যাম্প সাইট থেকে লাগেজপত্র গুছিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম, তবে ডাক পড়ে গেল গ্রুপ ছবি তোলা হবে বলে, আমরা যেখানে অপেক্ষা করছিলাম সমুদ্রের তীরবর্তী একটা খোলা জায়গায় সেখানে গ্রুপ ছবি তোলা শেষে হাঁটা শুরু করলাম। পথিমধ্যে নাস্তা করলাম, আজকের গন্তব্য কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্ট, যেখানে আমাদের ভ্রমণের ইতি টানা হবে। আজকের লক্ষ্যটাকে তেমন বেশি কোন বড় লক্ষ্য মনে হচ্ছিল না, তার কারণ আজকের গন্তব্য ছিল মাত্র ১৮ কিলোমিটার। হাঁটতে হাঁটতে ভুলক্রমে আমরা একটি খালের কাছাকাছি চলে আসলাম কিন্তু খালটি (পরে জেনেছি খালটির নাম রেজুখাল) বেজায় বড় আর গভীর ছিল যেটা হেঁটে পার হওয়া সম্ভব ছিল না সুতরাং যতদূর গিয়েছি ঠিক ততদূর আবার পেছনে ফিরে আসতে হলো মানসিকভাবে আমরা একটু দুর্বল হয়ে পড়লাম কারণ যাওয়া-আসা মিলে ৫ কিলোমিটার অহেতুক হাঁটা হয়ে গেল পাশাপাশি সময়ও নষ্ট হলো অনেক। খালটি পাড়ি দেওয়ার জন্য আমাদেরকে মেরিন-ড্রাইভ-রোড এর উপর উঠতে হল। কিছুদূর হাটার পর খাল বরাবর একটি ব্রিজ পরল, ব্রিজে উঠলাম নাম “রেজুখাল ব্রিজ” দিয়ে খাল পাড়ি দিলাম। এবার রাস্তা ধরে ধরে এগুলোতে লাগলাম, অনেকটা পথ আমরা মেরিন-ড্রাইভ-রোড ধরে এগুলাম। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমরা পুনরায় রাস্তা থেকে বিচের দিকে পৌছালাম এবং শুনলাম আর কোন প্রকার খাল কক্সবাজার পর্যন্ত পড়বে না। হেঁটে হেঁটে আমরা প্রায় হিমছড়ির কাছাকাছি চলে এলাম। দেখলাম সেখানে প্যারাগ্লাইডিং হচ্ছে বেশ ভালই লাগলো দেখতে। সবাই খুব আগ্রহ সহকারে একজনের পর একজন প্যারাগ্লাইডিং করছে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর আমরা দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে তাদের আনন্দ শেয়ার করার চেষ্টা করছিলাম। পাশাপাশি চোখে পড়লো স্পিডবোটে ঘোরাঘুরি এবং আরো নানারকম একটিভিটিস যা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, এই হিমছড়ি নামক এলাকাটা।
হিমছড়িতে এসে তেষ্টা মেটালাম ডাবের পানি পান করে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মোবাইলের চার্জ শেষ। এখানে মোবাইলের চার্জ দিলাম ৩০ মিনিট পাশাপাশি একটু বিরতি নিলাম। বিরতির পর রওনা দিলাম আবার সমুদ্রের তীর ধরে, লক্ষ্য অতি সন্নিকটে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে এবং দূর থেকে কক্সবাজারের বড় বড় হোটেলগুলোর সারি দেখা যাচ্ছিল এবং আশান্বিত হচ্ছিলাম যে, আর কিছুদূর গেলেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যাব। চলার পথে বেশকিছু কচ্ছপ চোখে পড়লো যারা বীচে মারা গেছে ডিম পারতে এসে। দেখে হঠাৎ করে মনে হয় যেন জীবন্ত বসে আছে, এইতো হয়তো দৌড় দিবে এমন। কেন মারা গেছে? তা আমার জানা নেই। তবে তাদের এই হাল দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। আমাদের মাঝে কিছু লোক কেন ধরনের কাজগুলো করে থাকে?
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে আমরা কক্সবাজারের কাছাকাছি চলে এলাম, দূর থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট দেখা যাচ্ছে। দেখে মনটা আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে বরং ভারাক্রান্ত হয়ে গেল, তার কারণ আমাদের এই অসাধারণ সুন্দর একটা ভ্রমণের ইতি ঘটতে যাচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। আর বিগত তিনদিন যে নির্জনতায় একাকী প্রকৃতির কাছাকাছি ছিলাম তার যবনিকাও হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরে। দূরে দেখা যাচ্ছে শুধু মানুষ আর মানুষ, অগণিত মানুষ, মানুষের মহাসমুদ্র অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, আমরা অপেক্ষায় আছি সেই ভিড়ে মিশে যাবার। বিকেল সাড়ে চারটায় আমাদের গন্তব্য স্থল কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টে উপস্থিত হলাম, আমাদের ভ্রমণ পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করলাম। দুই বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম বিজয়ের আনন্দে। আমরা পেরেছি ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে, পেরেছি লক্ষ্য অর্জন করতে, যা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর তবে অসম্ভবপর ছিলনা।
আমার বিশ্বাস ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে বড়জোর শ’পাঁচেক লোক হবে কিনা এই ধরনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ? আমার জানা নেই। আমি হয়তো সীমিত কিছু মানুষের মধ্যে একজন হয়ে উঠলাম, এটা ভাবতেই আমার মনটা শিহরিত হয়ে উঠছিল। পাশাপাশি নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল যে, আমি এক অসাধ্যসাধন করেছি। আমি দেখেছি আমার বাংলাদেশ, আমি দেখেছি আমার বাংলার অনিন্দ্য সুন্দর রূপ। আমি দেখেছি সমুদ্র সৈকতের জীববৈচিত্র্য, সেখানকার মানুষের জীবিকার অন্বেষণে তাদের জীবনযুদ্ধ, কাছ থেকে দেখা জেলেপল্লীর জীবন চিত্র, চলার পথে মাছের বাজার ঘুরে দেখা এবং জেলেরা কত কষ্ট করে যে মাছগুলো ধরে আনে এবং সে মাছগুলো তারা বিক্রি করে দেয় খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে।
ছোটবেলা থেকে শুনেছি যে, কক্সবাজার হচ্ছে এদেশের নয়, সারা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। তার রূপ-সৌন্দর্য, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্রকৃতির কাছে আমরা যে কত ক্ষুদ্র ও নগণ্য এবং প্রকৃতি কতটা শান্ত তার কাছাকাছি না গেলে সেটা অনুভব করা দুষ্কর। তার কাছে এসে বসে থাকলে মন এমনিতেই ভাল হয়ে যায়, তাইতো নিজের মতো করে আমি যেখানে যেখানে ভাল লেগেছে বসে থেকে বা দাঁড়িয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি, নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি।
অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল আমার দৃষ্টিকোণ থেকে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পাটুয়ারটেক, ইনানী, হিমছড়ি ও মূল কক্সবাজার ছাড়া বাকিটা সমুদ্র সৈকত অতীতে যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই আছে, এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গি তার কারণ, আমার কাছে বাকিটা অংশ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বলেই মনে হয়েছে যেখানে এখনো গড়ে ওঠেনি মানব বসতি ইট পাথরের জঞ্জাল।
কথা আর বাড়াবো না এমনিতেই অনেক বেশি বলে ফেলেছি ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন কারণ আমি শুধু আমার অন্তরের কিছু কথা এখানে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু যতটুকু বলেছি তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ অভিজ্ঞতার আলো আমার অন্তরে গেঁথে রয়েছে।
পরিশেষে, আরেকটা বিষয় না বললে আমার এই ভ্রমণ বিবরণী অপূর্ণ থেকে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এটা কিন্তু আয়োজক সোহান ভাইয়ের কোনো বাণিজ্যিক ট্রিপ প্ল্যান ছিল না। উনি নিজে কিছু দাতব্য কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন এবং এখান থেকে অর্জিত টাকা উনি বিভিন্ন গরীব-দুঃস্থ মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তিনি বিতরণ করেন। বিশেষ করে যারা টাকার অভাবে ফরম ফিলাপ করতে পারছেনা, ভর্তি হতে পারছেনা, নতুন বই কিনতে পারছেনা, এই ধরনের অনেক সুন্দর সুন্দর কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। এরকম মহান মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে যদি প্রত্যেকটা মানুষ এরকম মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যেত তাহলে দেশটাই বদলে যেত।
হেঁটে হেঁটে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আমার আগের আমি আসিনি বরং আমি এসেছি ভেতরের অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ এবং বিশুদ্ধ করে। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আমিও বদলে গিয়েছি তার কারণ আমি কিছু আলোকবর্তিকা সম্পন্ন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি এবং তার আলোকছটা কিছুটা হলেও আমার ভেতরে এসেছে এবং নিয়ত করেছি আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমিও চেষ্টা করে যাবো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যদি আল্লাহপাক আমাকে সেই তৌফিক দান করেন।
*এই ট্রিপে আমার মত পাগলের সংখ্যা ছিল ৫২ জন।
*দূরত্ব অতিক্রম করছি ১০০ কি: মি: প্রায়।
🎯প্রথম দিন: টেকনাফ বীচ থেকে কচ্চপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়
🎯দ্বিতীয় দিন: কচ্চপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শাপলাপুর বাজার
🎯তৃতীয় দিন: শাপলাপুর বাজার থেকে সোনার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়
🎯চতুর্থ দিন: সোনার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্ট।
*একদিনে সর্বোচ্চ 👣হেঁটেছি ৩০কি: মি: এর বেশি, ১০ ঘণ্টায়।
*সময় লেগেছে ৪দিন (২৫ ডিসেম্বর – ২৯ ডিসেম্বর)।
*ধন্যবাদ সবাই ভাল থাকবেন।
চেঙ্গিস খানের দেশে
আনোয়ারুল হক
হঠাৎ করেই আমন্ত্রণ পেলাম উলানবাটরে একটা কনফারেন্সে অংশ নেয়ার। ই-মেইল পেয়ে প্রথমে চেঙ্গিস খানের নামটাই ভেসে উঠলো – কানে যেন বাজতে থাকলো ঘোড়ার পায়ের খটখট আওয়াজ। ছোটবেলা থেকে যে কতো পড়েছি চেঙ্গিস খানের কথা। ঘোড়সওয়ার সমৃদ্ধ দুধর্ষ বাহিনী কিভাবে বড় একটা সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল, এমনকি এই উপমহাদেশেও চেঙ্গিস খানের নামে কাঁপতো সব রাজারা। সেই চেঙ্গিস খানের দেশে যাওয়ার আলাদা একটা উত্তেজনা তো আছেই।
বিরাণভূমির মঙ্গোলিয়া
ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মঙ্গোলিয়ার উত্তরে রাশিয়া আর দক্ষিণে চীন। আকারে ভারতের প্রায় অর্ধেক এই দেশের জনসংখ্যা কিন্তু মাত্র ৩০ লাখ। তবে মঙ্গোলিয়ার মোট ভূমির মাত্র অল্প অংশই চাষযোগ্য। উত্তর-পশ্চিম বরফে ঢাকা পাহাড়-পর্বতে ঘেরা আর দক্ষিণ জুড়ে বিশাল গোবি মরুভূমি। সে মরুভূমি এতোটাই বিস্তৃত যে টানা ৮/১০ ঘন্টা গাড়ি ড্রাইভ করলেও তার শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। উলানবাটর মঙ্গোলিয়ার রাজধানী – এই নগরে বাস করে দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ। মঙ্গোলিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর কোনো ধর্ম নেই। প্রায় তিন শতাংশ মুসলমানও রয়েছে, যাদের সবাই কাজাখ জাতিগোষ্ঠীর।
একদিনের পরিচয়ে হাজার বছরের বন্ধুত্ব
মঙ্গোলিয়ানরা সুপরিচিত তাদের অদ্বিতীয় আতিথেয়তার জন্য। প্রতিটি পদক্ষেপেই আতিথেয়তার ছোঁয়া। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, এমনকি ইন্টারনেট সংযোগ আছে কিনা, বা উলানবাটরে ঘোরাফেরা করতে কোনো সহযোগিতা লাগবে কিনা সব কিছুরই খোঁজ-খবর রাখছে আয়োজকেরা। সবার মুখে মিষ্টি হাসি। ডিনারে দেখি খাবার-দাবারের বিশাল আয়োজন। একটার পর একটা পরিবেশন চলছে। ভরা পেটে মুখে দিয়েও মনে হল এতো সুস্বাদু মুরগি আমি আমার জীবনে কখনো খাইনি। নরম কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর গন্ধে ভরা। পাশে বসা এক মঙ্গোলিয়ান তার দেশের একটি প্রবাদ বলল ‘একদিনের পরিচয় থেকে শুরু হয় হাজার বছরের বন্ধুত্ব।’
ব্যক্তিই বড়
যতটুকু বুঝলাম মঙ্গোলিয়ানদের স্বভাব আত্ম-কেন্দ্রিক। ‘নোমাড’ বা যাযাবর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা এই জাতির কমিউনিটি হলো নিজেদের নিকটাত্মীয়রা। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে উত্থান হলেও গত ২৫ বছরে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। কনফারেন্সে অংশ নেওয়া এক মঙ্গোলিয়ানের উপস্থাপনায় মনে হল, তারা আজকাল আগের চেয়ে আরো বেশী আত্মকেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে। বড় কমিউনিটিতে যেন আর আস্থা নেই। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ১২ শতকেও চেঙ্গিস খানতো একই কথা বলেছিলেন, ‘ প্রথমে নিজের ঘর সামলাও, তারপর ভাবো দেশের কথা।’ আমরা যেমন শ্লোগান বানিয়ে ফেলেছি যে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ। যদিও বাস্তবে করি উল্টাটা। এদের কাছে ব্যক্তিই বড়। আমরা কনফারেন্সে এসেছি সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কথা বলতে। আরেকটা প্রবাদের কথা বলি, যা মঙ্গোলিয়ানদের লড়াকু মনোভাবের প্রতিচ্চিত্র – ‘ঘোড়ার লম্বা মাথায় থাকা দু’টি চোখ যে দিক যেতে চায় সেদিকে যাও, পিঠে চেপে থাকা ঘোড়-সওয়ারের ইচ্ছেতে নয়।’ তারা সামাজিক বিশ্বাসও ফিরিয়ে আনবে, আশা করি প্রতিষ্ঠা করবে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সামাজিক দায়বদ্ধতা।
রাজাদের রাজা, স্বর্গের সন্তান – চেঙ্গিস খান
শুরুতেই চেঙ্গিস খান নিয়ে রোমাঞ্চের কথা বলেছিলাম। এয়ারপোর্টে নেমেই বোঝা গেল মঙ্গেলিয়ানদের আসল হিরো হলো চেঙ্গিস খান। তার নামেই এয়ারপোর্ট। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে তারই মূর্তি। সারা উলানবাটর জুড়েই তার সরব উপস্থিতি – বড় হোটেলটা তার নামে, মিউজিয়ামেও তিনি। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে তার প্রতিকৃতি। ১২০৬ সালে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন মঙ্গেলিয়ান সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলা খানতো চীনের প্রাচীর পেরিয়ে চীনও দখল করে নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইয়ুয়ান শাসনের। তার মৃত্যুও পর এই শাসনের পতন ঘটে।
চেঙ্গিস খানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তিনি মঙ্গোলিয়ান সবগোত্রগুলোকে সংঘবদ্ধ এবং একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তার তৈরি যোদ্ধারা ছিল সাহসী ও শক্তিশালী। তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ছোট ইউনিট ছিল ১০ সদস্যের। ১০টি ছোট দল মিলে গঠিত হতো মাঝারী ইউনিট। আর ১০টি মাঝারী ইউনিট (১০,০০০ জন) নিয়ে গঠিত হতো সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ইউনিটটি। বুদ্ধি ও অমিত সাহসের কারণে তিনি হয়েছেন সবার নেতা। উলানবাটরের মঙ্গোলিয়ান আর্ট মিউজিয়ামের এক কর্ণারে থাকা একটি লাইন যেন সত্যিই বর্ণনা করে তাদের নেতাকে ‘অল কিংস কিং, হেভেন্স সন – চেঙ্গিস খান।’
উট, ঘোড়া আর ট্রাফিক জ্যাম
মঙ্গোলিয়ান ‘নোমাড’ সংস্কৃতির সঙ্গে উট আর ঘোড়ার যোগাযোগ ওতঃপ্রোত। আমরা উপমহাদেশ বা আরবে যে উট দেখি তার কুঁজ কিন্তু একটা, কিন্তু মঙ্গোলিয়ান উটের কুঁজ দুইটা। আর এই উটগুলো আরবের উটের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। এগুলো শক্তি প্রায় একেকটা নাকি হাতির সমান। আবার ঘোড়া ছাড়াও মঙ্গোলিয়াকে কল্পনা করা যায় না। এদেও সাম্রাজ্য গঠনের মূল শক্তিই ছিল অশ্বারোহী যোদ্ধা। ঘোড়সওয়ার সেই বাহিনী দখল করত রাজ্য, প্রতিষ্ঠা করতো তাদের সাম্রাজ্য। মঙ্গোলিয় ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়লো উট আর ঘোড়া নিয়ে অনেক শিল্পকর্ম। হোটেল থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে ন্যাশনাল একাডেমি ফর গভার্নেন্স ভবনে যেতে সকালে সময় লাগলো ৫০ মিনিট। আর জ্যাম হবেই না বা কেন, দেশের ৩০ লাখ লোকের প্রায় অর্ধেকই থাকে এই শহরে। শহরের আকার ঢাকার চেয়েও ছোট। সবাই গাড়ি নিয়ে বের হয় এবং সবগুলো চৌরাস্তায় জ্যাম। তবে ঢাকার অধিবাসী হিসেবে উলানবাটরের জ্যাম আমার কাছে কিন্তু অসহনীয় লাগেনি, ওরা তো আর আমাদের বিখ্যাত জ্যাম দেখেনি!
চীন গেলো, সোভিয়েত এলো, এখন পুঁজিবাদ
ইয়ুয়ান রাজ্যের পতনের পর চীনা রাজা মাঞ্চুর শাসন চলে মঙ্গোলিয়ায়। পুরো ১৭ শতক ধরে চলে মাঞ্চু শাসন ব্যবস্থা। ১৬ শতকের দিকে এই দেশে তিব্বতীয়দের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুরুষ বৌদ্ধ সন্ন্যাস গ্রহণ করে। এই শাসনের পতন ঘটে ১৯১১ সালে, মঙ্গোলিয়ানরা তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২১ সালে মঙ্গোলিয়া চীন থেকে মুক্ত হয়। এর পরপরই সেখানে সোভিয়েত আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। ১৯২৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী মঙ্গোলিয়া গঠিত হয় যা ছিল আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি স্যাটেলাইট অঙ্গরাজ্য। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর মঙ্গোলিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে যে নতুন সংবিধান লেখা হয় তাতে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং বাজার অর্থনীতির স্বীকৃতি দেয়া হয়।
এখন চলছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। বাজার অর্থনীতির বদৌলতে বিদেশী কোম্পানীগুলো এসেছে মঙ্গোলিয়ার খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজে। এদেশের কপার আর সোনা দুটি মূল্যবান খনিজ। কপার উৎপাদনে এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের একটি মঙ্গোলিয়া। আশা করা হয়েছিল এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। বাস্তবে মাত্র নয় হাজার লোকের কাজ জুটেছে এইসব কোম্পানীতে। বিভিন্ন চুক্তির অধীনে সরকার যে রাজস্ব পাচ্ছে তার পরিমাণও খুবই কম। অথচ ঠিকই লাভবান হচ্ছে বিদেশী কোম্পানীগুলো – সারা পৃথিবী জুড়েই কী একই দৃশ্য?
মঙ্গোলিয়ায় বাংলাদেশী?
হ্যাঁ, মঙ্গোলিয়াতেও বাংলাদেশী আছে সবমিলে দশজনের মতো। এদের বেশির ভাগই মঙ্গোলিয়ান মেয়ে বিয়ে করে এদেশে সংসারী হয়েছেন। এরকম একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। তিনি জানালেন, তার বউয়ের সঙ্গে পরিচয় কোরিয়াতে। ওখানে তিনি কাজ করতে এসেছিলেন। এরপর প্রেম এবং বিয়ে। বন্ধুত্ব হয়ে গেল মিন্টুনাথ নামের এক বাংলাদেশীর সঙ্গে। ওনার বাড়ি চট্টগ্রামে। এখানে একটি কলেজে অ্যাকাউন্টিং পড়ান। যে কোনো বাংলাদেশীর দেখা পেলেই সময় দেন। কয়েক বছর আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন উলানবাটরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। ওখানকার সব বাংলাদেশী তখন বিপুল উৎসাহে সহযোগিতা করেছিলেন সঙ্গে আসা সরকারী কর্মকর্তাদের। হাসিমুখে একজন বললেন, প্রধানমন্ত্রী এখান থেকে বেশ কয়েকটি উলের চাদর কিনেছিলেন। টিভিতে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁকে এখনো সেগুলো পরতে দেখি। চোখে মুখে তার এক ধরনের প্রশান্তি, যেন মঙ্গোলিয়ান উলের গর্বে গর্বিত তিনি নিজেও।
নারীর সরব উপস্থিতি
উলানবাটরে ঘুরলে সব জায়গাতেই দেখা যায় নারীর সরব উপস্থিতি। মনে হয় যেন নারীরাই শহরের সব পরিচালনা করছে। কারণ জানতে চাইলে এক সরকারী কর্মকর্তা হাসতে হাসতে বলেন, ‘পুরুষরা কাজে ব্যস্ত থাকে, আর নারীরা শপিং করে’। আমি বলেই ফেললাম, ‘আপনার উত্তরটা কিন্তু খুবই জেন্ডার অসংবেদনশীল।’ আসল কারণটা পরে জানলাম, এদেশের মেয়েরা জানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের জায়গা করে নিতে হলে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক ডিগ্রিটা লাগবে। যেহেতু বেশির ভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু উলানবাটরে, তাই এখানে মেয়েদের চলাফেরাও এখানে বেশি।
মঙ্গোলিয়ান সঙ্গীতে বিষাদের সূর
মঙ্গোলিয়ায় ক্রিকেট
অবাক হলাম জেনে যে, মঙ্গোলিয়ানরাও ক্রিকেট খেলা শুরু করেছে। উলানবাটরে এখন দু’টি ক্রিকেট ক্লাব। এতে প্রথমে যোগ দিয়েছে উপমহাদেশ থেকে আসা ভারতীয়, বাংলাদেশী আর পাকিস্তানী – সবাই। এখানকার অস্ট্রেলিয়ান দুতাবাস একজন কোচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তার তত্ত্বাবধানে হাতে-খড়ি হচ্ছে ক্রিকেটারদের। বেশ কয়েকটি স্কুলে ক্রিকেট খেলা চালু হয়েছে। আমার বন্ধু মিন্টু নাথও একটি ক্লাবে নিয়মিত ক্রিকেট খেলেন।
ঠান্ডার দেশের হেমন্তকাল
উলানবাটরে আমার প্রথম দু’দিন ছিল উজ্জ্বল রৌদ্রালোকিত। তাপমাত্রা ১৩/১৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। মনে হচ্ছিলো সত্যিকার হেমন্তকাল। রাস্তার ধারের রঙ্গীন ফুল আর রঙ্গীন হয়ে ওঠা গাছের পাতাগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিলো বছরের সেরা সময় পার করছে উলানবাটর। তৃতীয় দিন সকালে হোটেলের জানালা দিয়ে দেখি বৃষ্টি হচ্ছে। বের হয়ে দেখি- একেবারে কনকনে ঠান্ডা। মোটা জ্যাকেট, মাফলার আর টুপি চাপিয়েও ঠান্ডা কমছিল না। আফসোস করছিলাম কেন যে হাতমোজাগুলো আনিনি?
জীবনও থেমে নেই। আমিও বের হলাম শহর দেখতে। পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দেখি ছোটখাট একটা জটলা। কাছে গিয়ে দেখি নব বিবাহিত এক দম্পতিকে ঘিরে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের ভীড়। ঠান্ডার মধ্যে কনে হাসিমুখে ছবির পোজ দিয়ে যাচ্ছেন আর কাঁপছেন। বিয়ের পর পার্লামেন্ট ভবনের সামনে এসে ছবি তোলাটাও এদের একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।
কাশমেরি উল না কিনলে ভ্রমন অসমাপ্ত
মিন্টু নাথ আমাকে নিয়ে গেলেন গোবি কাশমের উলের শো-রুমে। অসাধারণ সব উলের কালেকশন। সূক্ষ উলের সূক্ষ কাজ। হাতে নিলে মনে হয় কোনো ওজনই নাই। আর এতো নরম স্পর্শ যে হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যায়। অথচ ঠান্ডার সময় গা গরম করতে এগুলোর জুড়ি নাই। বিস্ময় হলো, এতো পাতলা উল এতো ওম দেয় কিভাবে! এই উল তৈরি হচ্ছে কোনোটা উটের পশম দিয়ে, আবার কোনোটা ভেড়ার পশম থেকে। শো-রুমে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই মন ভালো হয়ে গেল। বুঝলাম ‘গোবি’ ব্র্যান্ড কেন এই ট্যাগলাইন করেছে – ‘ট্রিপ টু মঙ্গোলিয়া ইজ ইনকমপ্লিট উইদাউট গোবি কাশমের।”
দু’তিন দিন তাতেও যাা অভিজ্ঞতা যা হলো তা মধুর। আর মঙ্গোলিয়ানদের আতিথেয়তা সত্যি ভোলার নয় – একদিনের চেনাশেনা যেন হাজার বছরের বন্ধুত্ব।
আনোয়ারুল হক।
দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ২১ এপ্রিল, ২০১৮ সংখ্যায় ‘চেঙ্গিস খানের দেশে’ নামে এক লেখার ঈষৎ সংক্ষেপিত ভার্সন প্রকাশিত হয়েছিল।
দানিয়ুব পাড়ের দুর্গ নগরী
এলিজা বিনতে এলাহী , পর্যটক ও শিক্ষক
দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন সবে মাত্র ভ্রমণ কাহিনী পড়া শুরু করেছি। বাসার গল্পের বইয়ের তাকে ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলী। তাঁর লেখনীর মাধ্যমেই দানিয়ুব নামটার সাথে পরিচয়। সে সময় আবছা এরকম একটি ধারনা তৈরি হয়েছিল- শান্ত স্বভাবের দানিয়ুব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কৃষ্ণ সাগরে গিয়ে মিশেছে। অস্ট্রিয়া , হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়াতে দানিয়ুবের দেখা পেয়েছি , কিন্তু ঠিক কি যেন বুঝতে পারিনি। সেটাও স্পষ্ট করে এখন বলতে পারবো না কি বুঝিনি।
দানিয়ুবের মোহনীয়তা, কমনীয়তা ধরা পড়েছে আমার কাছে ডেভিন ক্যাসেল দেখতে গিয়ে। ডেভিন গ্রামের ডেভিন ক্যাসেল। হ্যাঁ স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিসলাভা থেকে ১২কিলোমিটার দূরে অবস্থান এই ঐতিহাসিক ডেভিন ক্যাসেলের।
ডেভিন ক্যাসেল শুধুমাত্র স্লোভাকিয়ার জন্যই নয়, মধ্য ইউরোপের গুরুত্বপুর্ন স্থাপনা গুলোর মধ্যে অন্যতম। নদীর তীরবর্তি হবার দরুন এখানে মানুষ বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নিওলিথিক যুগ থেকে। আর বর্তমানে এই ডেভিন গ্রাম স্লোভাকের প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে কাজ করছে। নতুন পাথরের যুগ থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ডেভিন ক্যাসেল ইউরোপের জাতীয়, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক জীবন এমনকি পর্যটনের জন্য একটি উল্লেখ্যযোগ্য স্থান বলে বিবেচিত ।
ডেভিন ক্যাসেলকে ১৯৬১ সালে স্লোভাকিয়ার জাতীয় সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ক্যাসেলটির অবস্থান সমুদ্র সমতল থেকে ৭০০ ফুট উঁচুতে টিলার উপর দানিয়ুব ও মরাভিয়া নদীর মাঝে।
ইতিহাসে ডেভিন ক্যাসেল
ডেভিন ক্যাসেল স্লোভাকিয়ার একটি জাতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সত্যি কথা বলতে, ডেভিন ক্যাসেল এবং স্লোভাক এই দুটি নাম বর্তমান স্লোভাকিয়ায় একে অপরের পরিপূরক।
ডেভিন ক্যাসেলের কথা বলতে গেলে একটু পেছনে না তাকালে আসলে গল্পটা অসম্পুর্ন থেকে যাবে। পাথুরে টিলার উপর মধ্যযুগের এই দুর্গ নির্মানের বড় কারণ দুটো কারণ হলো রাজনৈতিক। নিজের অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত রাখা আর অর্থনৈতিক বিষয়টা যুক্ত হয়েছে নদী পথে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনায়।
অষ্টম শতকে প্রথমে এখানে একটি কাঠের দুর্গ নির্মান করা হয়। তারও প্রায় একশ বছর পর এখানে দুর্গ নগরী গড়ে ওঠে রাজার বাসস্থান সহ। যুগে যুগে এই দুর্গ নগরীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজারা। তেরশ শতকে এটি হাঙ্গেরি কিংডমের অধীনস্ত হয়। একইভাবে চৌদ্দশ শতকে অস্ট্রিয়া , পরে আবারও হাঙ্গেরি কিংডমের অধিকারে যায়। ১৪৪৪ সালে জার্মানীর ফ্রেড্রিক ফোর ডেভিন ক্যাসেল দখল করেন। সময়ের পরিক্রমায় হাত বদল হতে থাকে এই দুর্গ নগরী। সর্বশেষ দুর্গটি উনিশ শতকে স্লোভাকিয়ার পাফি রাজবংশের অধিকারে ছিল। ১৮০৯ সালে নেপোলিয়ানের আর্মি ডেভিন ক্যালেসটি ধ্বংসস্তূপে পরিনত করে।
আধুনিক যুগেও ডেভিন ক্যাসেলের রাজনৈতিক গুরুত্ব এতটুকু কমেনি কারন এর অবস্থান পুর্ব সোভিয়েত আর পশ্চিমা দেশের সীমান্ত রেখায় । ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত এই সীমান্ত এলাকা “ মিলিটারি রেস্ট্রিটেড জোন” ছিল চেকোস্লোভাকিয়া তিন খন্ডে ভাগ হবার আগ পর্যন্ত।
যেমন দেখেছি ডেভিন ক্যাসেল
ব্রাতিস্লাভা শহরের প্রায় মাঝামাঝি ছিল আমার থাকবার হোস্টেল। ভ্রমণ খরচ কমাবার জন্যই হোস্টেলে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেনজেনভুক্ত দেশগুলো ভ্রমনের সময় আমি সব সময়ই বেছে নিয়েছি হোস্টেল, ডরমেটরি অথবা এয়ারবিএনবি। সেখনাকার অভ্যর্থনা কক্ষে ডেভিন ক্যাসেলের কথা বলার সাথে সাথে আমার হাতে একটি ম্যাপ ধরিয়ে দেয়া হলো। শুধু তাই নয় ম্যাপে কলম দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো যাবার উপায়। ইউরোপ ভ্রমণই মুলত আমাকে অভ্যস্ত করেছে ম্যাপ দেখে যেকোন স্থান খুঁজে বের করা। সেটা নিজের টেলিফোন সেটের গুগল ম্যাপ হোক অথবা হোটেল না হোস্টেল থেকে সরবরাহ করা কাগজের ম্যাপই হোক।
হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ৩/৪ মিনিট হেঁটে ট্রামে করে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে ডেভিন ক্যাসেল যেতে হয়। ডেভিন ক্যাসেল যাবার জন্য আলাদা বাসই নিয়োজিত আছে। সেই বাসস্ট্যান্ড থেকে ডেভিন ক্যাসেল যেতে ৩০মিনিট সময় লাগে।
বাস একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিল। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিছুদূর যাবার পরই দেখতে পাচ্ছিলাম দুর্গের চূড়া। বেশ খানিকটা মানে, ১০/১৫ মিনিট পায়ে হেঁটে যাবার পর টিকিট ঘর দেখতে পেলাম। ইউরোপের স্টুডেন্ট হবার দরুন টিকিটের দাম অর্ধেক রাখা হোল। সব না, কিছু কিছু পুর্ব এবং মধ্য ইউরোপের দেশ গুলোতে স্টুডেন্টদের জন্য মিউজিয়াম এবং ঐতিহাসিক স্থান গুলো ভ্রমনে এই সুবিধা পেয়েছি। তবে গ্রীসের কথা বেশি করে মনে আছে , কারন সেখানে স্টুডেন্টদের জন্য দর্শনীয় স্থান গুলোতে বিনা টিকিটেই যাওয়া যায় , শুধু টিকেট ঘরে শিক্ষার্থী হবার পরিচয় পত্র দেখাতে হবে।
টিকেট নিশ্চিত হবার পর আবারও হাঁটতে হবে। পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় ভাবছিলাম , সেই মধ্যযুগে এই রাস্তা দিয়ে কারা হেঁটে গেছেন। শুধু কি সৈন্য-সামন্তরা বা ঘোড়া ,হাতি এই রাস্তা দিয়ে যেত, নাকি রাজারাও যেতেন। নেপোনিয়ানের আর্মি দল যখন এই দুর্গ দখল করেছিল বা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল , তখন কি তিনি এখানে এসেছিলেন। আচ্ছা ধরে নিচ্ছি এসেছিলেন, তাহলে কোন পথ দিয়ে গেছেন? আমি কি সেই একই পথে হাঁটছি? এরকম নানা অমুলক কথা চিন্তা করতে করতে এসে পৌঁছলাম ডেভিন ক্যাসেলের সামনে। ভিতরে যাবার আগে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখতে থাকলাম মধ্যযুগের দুর্গনগরী।
বর্তমানে যেটুকু টিকে আছে, সেখানে রাজা বা সম্রাটদের বাসস্থানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে প্রতিটি স্তরে সেখানকার লিখিত ইতিহাস থেকে অনুমান করে নিতে হবে অবয়ব। টিকে থাকা দুর্গটি আমার কাছে পুরোটাই একটি প্রকান্ড পাথর খন্ড মনে হয়েছে।
দুর্গের শীর্ষে উঠবার পর আপনি উপভোগ করতে পারবেন দানিয়ুব আর মরাভিয়া নদীর আসল সৌন্দর্য। দুর্গের উপর থেকে দুই নদীর নীল জলরাশি আর সামনের ঘন জঙ্গল আপনাকে কিঞ্চিৎ হলেও মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দিবে। শীর্ষ থেকে ডেভিন গ্রামের চারপাশ এবং বহতা নদী বহুদূর দৃষ্টিগোচর হয়। সেই থেকেই বোঝা যাচ্ছে দুর্গনগরী হিসেবে কেন এই অঞ্চলকে বেছে নেয়া হয়েছে।
আমি যেহেতু গ্রীষ্মের সময় ভ্রমণ করছিলাম তাই আকাশ একদম পরিস্কার ছিল আর উপর থেকে দানিয়ুব আমাকে তার দিকে বার বার ইশারা করছিল শরীর ও মন ভেজাবার জন্য। সেটা সম্ভব ছিল না, কারন ভ্রমণ লিস্টও তাড়া দিচ্ছিল অন্য স্থানগুলো দেখবার জন্য।
পুরো চত্বরে দেখেছি দুটি মিউজিয়াম একটি সাময়িক আর একটি দুর্গের নিচে। দুর্গের নিচেরটিকে মনে করা হয় এটি ছিল দুর্গের গোপন কুঠুরি। আর সাময়িক মিউজিয়ামটি মূল দুর্গ কেন্দ্রের খোলা জায়গায়। মিউজিয়ামগুলোতে নানা তথ্যের সাথে আছে সেই সময়ের ব্যবহার্য জিনিসপত্র , অস্ত্র , পোশাক। গোটা ডেভিন ক্যাসেল ভালো করে দেখতে হলে দিনের প্রায় আধা বেলা দিতে হবে।
দানিয়ুবের পাড়ে
দুর্গের উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম নদীর ধারে একটি সাইকেলের পথ। সেখানে পর্যটকরা সাইকেলে ঘুরে দেখছেন দানিয়ুবের রূপ। প্রায় ২০কিলোমিটার দীর্ঘ সাইকেলের পথ রয়েছে দুই নদীর ধারে। ক্যাসেল থেকে বের হয়ে সেদিকে গেলাম। পায়ে হাঁটার পথও আছে। দানিয়ুবের পাড়ে ক্যাসেলের গা ঘেঁষে রয়েছে স্লোভাকিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ। দেখতে পেলাম ,সাইকেলে পর্যটকরা চলে যাচ্ছেন গ্রামের ভিতরে , স্লোভাক গ্রামীন জীবন দেখবার জন্যে।
আমি ধীর পায়ে দানিয়ুবের হাওয়া খেতে খেতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে অগ্রসর হলাম। পেছন ফিরে আরও একবার দেখে নিলাম মধ্যযুগের স্মৃতি বহনকারি ডেভিন ক্যাসেল।
বাসে অন্য গন্তব্যে যাবার পথে ভাবতে থাকলাম আমাদেরও তো রয়েছে এরকম জলদুর্গ, দুর্গনগরী। পৃথিবীর কটা পর্যটক আসলে সে কথা জানে। পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম, আমরা নিজেরা কতটুকু জানি বা হেরিটেজ ভ্রমনে বের হই নিজের দেশে।
নিশ্চয়ই আমরাও একদিন ইতিহাস সংরক্ষনে সচেতন হবো, আমাদের হেরিটেজের গল্পও ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে।
লিংকন সাইকেলওয়ালা
সাইদুর রহমান লিংকন
১৮৬১ শব্দ- ১৩৫০
সবেমাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি, আব্বা জাপান, কানাডা, জার্মান পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশে পাঠাতে গিয়ে অনেক টাকা পয়সা নষ্ট করেছেন। আব্বা বলে দিলেন তোমাকে ভালো দেশ গুলোতে পাঠাতে গিয়ে আজ আমি ক্লান্ত। পালে তুমি সৌদি আরব গিয়ে হজ্ব করে ভালো মানুষের মত জীবন যাপন শুরু করো। সত্যি সত্যি আজ আমি বুঝি আব্বা, আমার জন্য কত টাকা পয়সা, সম্পত্তি নষ্ট করেছে।
ঘোরাঘুরির শখ যখন মাথায় চেপে বসলো তখন মাত্র ৫০০ ডলার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম অজানাকে জানার জন্যে সাথে শুধু দু’চাকার একটা সাইকেল। দিল্লি থেকে পাঞ্জাবের গোল্ডেন প্যালেস হয়ে আটারি বর্ডার দিয়ে পাকিস্তান যাই। পৃথিবীর যতগুলো দেশে যাই সবচাইতে বেশী অসুবিধায় পড়তে হয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তান সত্যিই এক বর্বর জাতি, তা আমি পাকিস্তানে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। পাকিস্তানের ইমিগ্রেশন কথাই শুনতে চায় না। ভিসা থাকা সত্ত্বেও আমাকে ডিপোর্ট করতে চেয়েছিল কয়েকবার। ১২ ঘণ্টা লকআপে রেখে দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার অবশেষে তাদের খানসামা বশিরের অনুরোধে আমাকে ছেড়ে দেয়।
ভারতে সন্ধ্যায় ভালুকের সামনে পড়ে ভেবেছিলাম এখানেই বিশ্ব পরিব্রাজকের বিশ্বভ্রমণ শেষ কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন। ইরানে ইংলিশ বলার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা, সেখানে ডলারের রেট পর্যন্ত কম দেয়। পাহাড় ঘেরা তেহরানে সাইকেল চালাতে গিয়ে অল্প সময়ে ক্লান্ত হয়ে ভ্রমনের প্রতি অনীহা চলে আসে, আবার পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামতে গিয়ে নিজের অজান্তে মনের ইচ্ছার পরিবর্তন হয়ে যায়। অবাক পৃথিবী।
গ্রিস
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যে ছোট্ট দেশটিতে পশ্চিমা সমাজে গড়ে উঠেছিল তার নাম গ্রিস। চেশমে থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে শিপে উঠলাম। শিপে পরিচয় হলো চেশমে সিটির মেয়র আর মার্কিন পর্যটক নিকের সাথে, তারা আমার ডায়রিতে কমেন্ট লিখে দিলো। আমি তাদের আমন্ত্রণ জানালাম লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়ার জন্য। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে শিপ এসে ভিড়ল। আবার নামার পালা। বের হওয়ার গেটের উপরে লেখা রয়েছে “ ডবষপড়সবফ ঃড় এৎববপব “ এবার ইমিগ্রেশনের পালা। তারা কিছু কুকুর নিয়ে আমাকে ওয়েলকাম জানালো! তছনছ করে খোঁজা হলো আমার ব্যাগগুলো আর পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেল ভিতরের রুমে। সাইকেলে বাংলাদেশের পতাকা, বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখে তারা যেন একটা দুর্বল হরিণের উপর বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। অবশেষে তারা আমাকে আটকাতে পারেনি।
শহরে এসে বোঝা যাচ্ছে গ্রীস অত্যন্ত ব্যস্ত একটা শহর। রাস্তায় হাটার সময় পথচারীকে জিজ্ঞেস করে নিলাম বন্ধু আলমগীরের বাসায় যাওয়ার নির্দেশনা। তাছাড়া সংবাদপত্রের দোকান থেকে একটা মানচিত্র কিনে নিলাম। গ্রিসে এসে লক্ষ করলাম এখানকার ছেলেমেয়েরা মেলামেশায় শিথিল। বন্ধু আলমগীর বাসায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। যেহেতু আলমগীর দিনে কাজ করে তাই রাতে ছাড়া আলমগীরকে পাওয়া মুশকিল। রাতে খাওয়ার পর শুরু হলো আলাপ।
এবার ইতালি যাবার পালা। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করে বিদায় নিলাম। আমার হরগঙ্গা কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানিক আমাকে জড়িয়ে ধরে কঁদছিলো। ইতালির এক বন্ধুর নাম আর ফোন নাম্বার দিয়ে দিল যাতে সেখানে তার সাথে দেখা করি।
ইটালি
উন্নত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দক্ষিণ ইউরোপের দেশটির নাম ইতালি। বড় বড় ইমারত আর চার্চে ভরা এই দেশ। তাদের মিউজিয়ামগুলোতে বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো সংরক্ষিত। দেশটির চারদিকে সমুদ্রসৈকত, উঁচু পাহাড়, জলপ্রপাত আর সবুজে ভরপুর মাঠঘাট।
শীপে করে গ্রিস থেকে ইতালি উদ্দেশে রওনা দিলাম। শীপে রাতে হালকা একটু খাবার খেয়ে চাদর দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে কফি আর ব্রেডের সাথে ওমলেট খেলাম। আবার গিয়ে সবার উপরের ডেকে কিছুক্ষন বসে রইলাম। কিছু ছবিও তুললাম। চারদিক কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। শুধু পানি আর পানি। এত জলরাশির মাঝে এত বড় জাহাজ তাকে একটা কীটপতঙ্গের মত মনে হলো। প্রায় তিনটার দিকে শিপটা ইটালি এসে থামলো। ইমিগ্রেশনের লোক জানতে চাইল, তুমি এখনে কতদিন থাকতে চাও? আমি বললাম তিন মাস, অবশ্য পরে তারা আমাকে ছয় মাসের অনুমতি দিয়েছিল।
তিন চারবার কল করে কাংখিত ব্যক্তিকে পেলাম। তার কাছ থেকে জমিদারপাড়ার আলম ভাইয়ের ফোন নাম্বার পেলাম। আলম ভাই আমার দূরসম্পর্কের বড় ভাই, তাছাড়া আমার বন্ধুও বটে। ভালই হলো আলম ভাইকে পেয়ে। আলম ভাই মুন্সিগঞ্জ জেলায় ব্যডমিন্টনে সবসময়ই চ্যাম্পিয়ন হতেন। আমি তো তার ফোন নাম্বার পেয়ে মহাখুশি। ফোনে পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন আমি তোমার ঠিক ৮/১০ ব্লক দূরে আছি তুমি ঠিকানা দাও আমি তোমাকে নিয়ে আসি। তাকে আসতে নিষেধ করে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইকেলসহ আমি গিয়ে পৌঁছালাম। আমাকে পেয়ে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরলেন, আবেগঘন কণ্ঠে আমাকে বললেন, তোমাকে ৬/৭ বছর পর দেখলাম। তোমাকে এভাবে পাবো তা কোনদিনও ভাবিনি। রাত তখন প্রায় বারোটা হবে। আলম ভাইয়ের রুমমেটরা তখন সবাই ঘুমিয়ে আছেন। আমাকে পরম মমতায় নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলেন। তারপর শুরু হল আমাদের গল্প। কিভাবে আলম ভাই ইতালি এলেন। ইটালির অবস্থা কেমন? তিনি কোথায় কাজ করেন, কত বেতন পান, ভোর ৭টায় কাজে যান বাসায় ফিরেন রাত ৮/৯ টায় রোজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আলম ভাই সকাল বেলা চলে গেলেন কাজে। আমি বেরিয়ে পড়লাম বাংলাদেশ দূতাবাসে সেখানে দেখা হলো ফার্স্ট সেক্রেটারি আক্তারুজ্জামান এর সাথে। তিনি আজ আর বেঁচে নেই। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এফএমও ছিলেন। তিনি না থাকলে হয়তো আমার বিশ্বভ্রমণই হতো না। তিনি আমাকে দেখে অনেক কথা বললেন ইতালিতে কতদিন আছি? এরপর কোথায় যাচ্ছি? ইউরোপের পরবর্তী ভিসাগুলো তার একান্ত চেষ্টা হয়েছিল। তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তার এই ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়। এজন্য তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। আমি তার রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
ফ্রান্স এম্বাসিতে ভিসার জন্য গেলাম তারা বলল যে ১০ দিন পর জানাবে। পরেরদিন টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। লুক্সেমবার্গ দূতাবাস জানিয়ে দেয় ভিসা হবে না। মনটা খুব খারাপ হলো, ফ্রান্স দূতাবাস বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির লেটার লাগবে। আক্তারুজ্জামান সেটা সমাধান করলেন। পাসপোর্ট আনতে ফ্রান্স দূতাবাসে যাই। সেখানে উজ্জ্বলের সঙ্গে দেখা। বললো, লিংকন আমি গত পরশু ইটালি এসেছি। আমি বললাম আমি আগামী পরশু সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি। আমি যখন কোন দেশে ঘুরাঘুরি করে বের হয়ে অন্য কোন দেশে যাই ঠিক তখনই এভাবে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়ে যাচ্ছে উজ্জ্বলের সঙ্গে।
আলম ভাইয়ের বাসায় সবাইকে বলে রাখলাম হয়তো যাওয়ার সময় অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। তবে এখানে পনির মামা, হাকিম মামা ওনারা এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। পরদিন রাতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভার উদ্দেশ্যে রওনা হবো।
সুইজারল্যন্ড
ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ সুইজারল্যান্ড। বরফে ঢাকা সুন্দর, স্বাধীনচেতা মানুষের বসবাসের স্থান হিসেবে পরিচিত। একে পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয়। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী হলো বার্ন। মানুষ সুন্দরের পূজারী। তাইতো মানুষ সুন্দরের সন্ধানে চলে যায় দূর থেকে দূরান্তে। সুইজারল্যন্ড এমন একটি সুন্দর দেশ যা ভ্রমণ না করলে কোন পর্যটকেরই ভ্রমন সম্পন্ন হবে না। সুইসরা বন্ধুসুলভ আচরণ করে থাকে। আমার এই পর্যন্ত দেখা ৩০টি দেশের মধ্যে সুইসদের সবচেয়ে বেশি ভদ্র, হাসিখুশি, আনন্দিত দেখেছি। তারা মারামারি-কাটাকাটি, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিশ্বাসী নয়, বরং তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন এবং অন্যের যুদ্ধবিরতিতে অবদান রেখে থাকে।
চারদিক পরিপাটি সাজানো-গোছানো সুন্দর সুইজারল্যান্ড সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ। সবকিছুর দাম খুব বেশি এবং ভাড়া ও তুলনামূলক বেশি। জেনেভায় গিয়ে মুন্সীগঞ্জের নজরুলকে পেলাম। নজরুল তার বাসার ঠিকানা দিয়ে বললেন সেখানে যেতে, সে আগেই ফোন করে বাসায় বলে রেখেছে। নজরুল জেনেভার প্রবাসী সমিতির সেক্রেটারি। বাঙালি অধিবাসীদের মাঝে অধিকাংশই সুইস মেয়েদের কন্ট্রাক্ট ম্যারিজের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডে বসবাসের বৈধ কাগজপত্রর ব্যবস্থা করে থাকে। যদিও প্রথমে প্রত্যেকেই রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। মুন্সিগঞ্জের এক বন্ধুর অপুর সাথে দেখা হলো। অপু ট্রেনে করে তার আরেক বন্ধু মুন্সীগঞ্জের ফারুক ভাইয়ের বাসায় নিয়ে গেলেন।
বার্ন ঘুরে ফিরে চলে গেলাম জুরিখ। তবে জুরিখ যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগে আব সুইজারল্যন্ডের সভাপতি এবং বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি তাজুল ইসলামের বাসায় গেলাম। সেখানে নৈশভোজের সময় তাজুল ইসলাম নানা বিষয়ে পরামর্শ দিলেন। তিনি আমাকে সুইজারল্যান্ড থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। অবশেষে আমরা রাত ১২টায় আনোয়ারের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই। আনোয়ারার আমি মুন্সীগঞ্জ ‘কে কে গভ.ইনস্ টিউশন থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমার জানা ছিল না আনোয়ার এখানে আছে, তবে বন্ধুর অপুর মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া গেলো।
প্রতিটা দেশে মিডিয়ার কল্যাণে অনেক প্রচারণা পাই। তাছাড়া ইরান বাংলা নিউজ, কুয়েত টিভি,পাকিস্তান টিভি, আরবিসি রেডিও, বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকাতে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার হয়।
নিউইয়র্ক
৩০টা দেশ ঘুরে অবশেষে আমি নিউইয়র্ক চলে আসি। আর আমি আমার স্কুল-কলেজের বন্ধু জাকিরকে পেয়ে যাই নিউইয়র্ক-এ। নিউইয়র্কে শত চেষ্টা করেও কোন স্পন্সরের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাছাড়া নিউইয়র্কে আসার পর পরই আব্বা মারা যান। আমার ইচ্ছে ছিল দেশের পশ্চিম দিক থেকে বের হয়েছিলাম আর পূর্ব দিক দিয়ে দেশে ফিরবো। তিন মাস পর্যন্ত কোনো কাজ করিনি দেশে ফিরে যাব বলে। নিয়তির একি পরিহাস ইচ্ছের বিরুদ্ধে থেকে যেতে হলো। থিতু হয়ে যাই প্রানের শহর নিউইয়র্কে।
নিউইয়র্কে আসার পরপরই ঢাকা ড্রামা থিয়েটার গ্রুপের সদস্য হয়ে সাংস্কৃতি জগতের সাথে মিশে আছি। আমার ভ্রমনের উপর প্রথম বই “দিগন্ত ছোঁয়ার গল্প” আর দ্বিতীয় বইটি “সাইকেলে বিশ্বজয়” বই দু’টি পড়লে আপনারা বিস্তারিত জানতে পারবেন আমার ভ্রমণ-কাহিনী।
প্রায় ২২ বছর যাবৎ ড্রাইভিং স্কুলের ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করছি। আমার পেশা একটি জনসেবামূলক কার্যক্রম বলা যায় কেননা এই ড্রাইভিং স্কুল থেকে অনেকে লাইসেন্স নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সাইকেল আমার জীবনের একটা ব্র্যান্ড তাই নামের শেষে সাইকেলওয়ালা লাগিয়ে দিলাম, কেউ আইসক্রিম বিক্রি করলে হয় আইসক্রীমওয়ালা, রিক্সা চালালে হয় রিক্সাওয়ালা, সাম্পান চালালে হয় সাম্পানওয়ালা, আর সাইকেল চালিয়ে আমি আজ “লিংকন সাইকেলওয়ালা”।
ঙহ ঔধহ ৯, ২০২০, ধঃ ৮:২৭ চগ, ঝধরফঁৎ খরহমশড়হ <ংৎষরহমশড়হ@মসধরষ.পড়স> ৎিড়ঃব:
মধু কবির সমাধি প্রাঙ্গনে…
-মালেকা পারভীন
১৩৬২ থেকে ১২১২ শব্দ
এবার যে কদিন কোলকাতা ছিলাম (২৮ নভেম্বর-০৪ ডিসেম্বর ২০১৮), মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানসূচির বাইরে আর কোথাও যাই বা না যাই, খ্রিস্টান কবরস্থানে যাবো এবং মধুকবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে আসবো। আমার এক ভাবীর কথা মতো, যেন অনেকটা “ঋণ শোধ করা।” স্টার্টফোর্ড-অন-আভন এ আমার শেক্সপীয়রের জন্মস্থান সফরের কথা শুনে তার বিস্মিত উচ্চারণ ছিলঃ “ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রীর এযে একেবারে ঋণ শোধ করা ! আমিও তো কতবার লন্ডন গেলাম! কই, আমার তো একবারও ওখানে যাওয়ার কথা মনে হলো না !”
বলা বাহুল্য, ভাবীও ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী কিনা। সাহিত্যের প্রতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টানও আছে। বই পড়েন। বইয়ের খোঁজ-খবর রাখেন। কিন্তু আমার এই সাহিত্যিক ভ্রমণের কাহিনী তাঁকে এতোটাই চমৎকৃত করলো যে, আমি আর আগ বাড়িয়ে বেশি কিছু বলিনি।
এই ভাবীর সৌজন্যে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ রচিত এবং কোলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পিতৃপুরুষ (১৮২৪-১৮৭৩) মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অসামান্য জীবনীগাঁথা ‘আশার ছলনে ভুলি’ বইটি সংগ্রহ করি ২০১২ সালে। এরপর ২০১৩ সালে আমার ব্রাসেলস এর প্রবাস জীবনে পড়ে শেষ করি। ইচ্ছা ছিল, পার্শ্ববর্তী দেশের রাজধানী শহর প্যারিস এর ভার্সেই নগরে গিয়ে কবির স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো ঘুরে আসবো।
। কোলকাতায় আসার পর সেই সুযোগ একদিন মিললো মাত্র ঘন্টা দেড়েকের জন্য। ৩রা ডিসেম্বর দুপুর গড়াবার আগে তাই গাড়ি নিয়ে ছুট লাগালাম। গন্তব্য পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। চালক নতুন। রাস্তাঘাট এখনও চিনে উঠতে পারেনি। শেষমেশ আমিই নির্দেশনা দিয়ে ঠিকমতো নির্দিষ্ট কবরস্থানের দ্বারে গিয়ে হাজির হলাম। লোয়ার সার্কুলার রোড বা মাদার তেরেসা সরণির ওপরেই এটি অবস্থিত। শুধু ইউ টার্ন নিয়ে ঘুরে আসতে হয় বলে কিছুটা ঝামেলা।
ক্রিশ্চিয়ান সিমেটারির দ্বারে নেমে ভেতরে ঢুকে উদ্দেশ্য বলতেই একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন। তার আগে একটা খাতায় নাম, পরিচয়,ঠিকানা লিখতে হলো। “আসুন, আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।” বয়স্ক লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন। আমি আর আগ-পাছ না ভেবে তাঁর পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলাম।
যেতে যেতে একা একাই অনেক কথা বলে যেতে থাকলেন তিনি। আমি কিছু জানতে না চাইলেও। নাম, ধাম, আরও অনেক কিছু। কোলকাতার টানে বলা তাঁর কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছিল।
“আমি আপনাকে আরও কিছু সুন্দর জিনিষ দেখাবো।” কবর যে সুন্দর জিনিস হয় এই প্রথম শুনলাম।
“না, না, আমি শুধু এখন মধুসূদন দত্তের সমাধিটা দেখতে চাই। আরো কিছু বিখ্যাত মানুষের সমাধি দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাড়াহুড়াতে নাম লিখে নিয়ে আসতে পারিনি।”
“কোন অসুবিধা নেই। আমি আপনাকে সব দেখিয়ে দবো খন।”
বেশি দূর যেতে হলো না। কয়েক পা ফেলতেই চোখে পড়লো লাল-সাদার এক নির্দেশক ফলক। তাতে লেখা “মধু-বিশ্রাম পথ”। আমার বুঝতে আর বাকি থাকলো না যে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছি। এতো তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো ভাবতে পারিনি।
এরপর অল্প কিছু সময়। গাইড সাহেব ঠিকঠাক নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটা আর মহাকবির সমাধি দুটি পাশাপাশি। ১৮৭৩ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে দুজন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। হেনরিয়েটা ২৬ তারিখে আর কবি ২৯ তারিখে। তাঁদের দুজনের শেষ সময়ের করুণ বর্ণনাও পড়েছিলাম উল্লিখিত বইটিতে। মহাকবির জীবনালেখ্য গ্রীক ট্রাজেডির এক মহাকাব্য যেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। ।
জুতা খুলে ভেতরে ঢুকে সমাধির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। নীরবে। নিজের ‘এপিটাফ’ বা সমাধি-লিপি কবি নিজেই রচনা করে গিয়েছিলেন। অনেকবার পড়া সেই বিখ্যাত সমাধি-লিপি আরও একবার পড়লাম তাঁর সমাধি পাশে দাঁড়িয়ে। অনাদরে, অবহেলায় মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেবার পনেরো বছর পরে কবির সমাধিস্থলে সেই সমাধিলিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিলঃ
“দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে!তিষ্ঠ ক্ষণকাল!এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধু সূদন !
যশোরে সাগরদাঁড়ী কবতক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ন নামে, জননী জাহ্নবী !”
বেশ কিছুটা সময় ঘুরে ফিরে দেখলাম। সাথে গাড়ির চালক ছিল। সে কিছু ছবি তুলে দিলো। ওদিকে নিজের মতো এক মনে কথা বলেই চলেছেন গাইড সাহেব।
“আপনারা অনেক বড়লোক আছেন,দিদি।” বুঝলাম, কিছু বখশিসের জন্য এই অযাচিত তোষামোদ।
“কে বলেছে আপনাকে? আমরা ছাপোষা সরকারি চাকুরে।”
“বিদ্যা, বুদ্ধি, টাকা; তার নাম ঢাকা, দিদি।”
এইবার আমাকে থমকাতে হলো। একটু হেসেও ফেললাম। তাঁর দিকে ভালো করে তাকালাম। কালো প্যান্ট, সাদা ফুল হাতা শার্টের ওপর কমলা রঙের নকশা-কাটা চটকদার কোটি। হাতে ঘড়ি, মাথায় ক্যাপ। বেশ-ভুষায় চমক আছে। কেবল পায়ের পুরনো চপ্পল জোড়া ধূলায় মলিন। সারাদিন তাঁকে কবরগুলির পরিচর্যা করতে হয়; পানি ঢালতে হয়। চাইলেও জুতা পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। সেটা জানলাম কিছু সময় পরে।
“কে বলেছে আপনাকে এসব?”
“আমি জানি। আমিও তো বাংলাদেশের। ফরিদপুরের। আমার ঠাকুরদা, বাবারা তো ওই সময় চলে এসেছেন।” বুঝলাম, দেশ বিভাগের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
আগেই জেনেছি, তাঁর নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। তিনি খুব ঠাটের সাথে বললেন, “আর এন ব্যানার্জি।” পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তাঁর বাবার নাম ঈশ্বর প্রমথনাথ ব্যানার্জি; ঠাকুর মশাই এর নাম ঈশ্বর নিত্যগোপাল ব্যানার্জি। মনে হলো, যে কোন কারণেই হোক, তিনি নিজের নাম থেকে ঈশ্বর অংশটি বাদ দিয়েছেন। আর এন ব্যানার্জি বলতে এবং শুনতে বরং আরও বেশি শ্রুতিমধুর।
হয়তো ফেলে আসা পিতৃভূমি থেকে আগত একজন মানুষকে পেয়ে তিনি এমন প্রগলভ হয়ে উঠেছেন। আমি তাঁকে বাধা দিইনা, তেমন কিছু বলিওনা। দুয়েকবার তাঁর কথা শুনে তাঁর দিকে তাকিয়ে একটু হাসি। হয়তো তাতেই তিনি কিছুটা প্রশ্রয় দেখতে পান। আর তাঁর মনে যা কিছু আছে তা প্রকাশ করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
“আইতে শাল যাইতে শাল; তার নাম বরিশাল।” “ঢেকোনা, খুলনা,পাবনা।” “পদ্মা, যমুনা, মেঘনা; কিছু আমি দবো না; আর কিছু আমি নবো না।” তাঁর ছেলে-মেয়েদের কথা। তাঁদের নিয়ে গিয়ে একবার নিজের জন্মভূমিটা দেখিয়ে আনবার ইচ্ছার কথা। ইত্যাদি। অনেক দূরের অতীত থেকে স্মরণ করে পিতৃভূমির বিখ্যাত জায়গাগুলোর নাম তিনি এভাবে ছন্দে-সুরে গেঁথে রেখেছেন। মনের সেতারের প্রতিটি তারে। সুযোগ মতো সেগুলো তিনি আওড়াতে ভালোবাসেন। তাতেও যদি কিছু মনের সুখ মেলে। নিজের দেশের নাম উচ্চারণেই যে সব সুখ। সেই নিজের দেশ যত দূরেই থাকুক, যত অধরাই থাকুক।
“চলেন, দিদি, আপনাকে আরও কিছু সুন্দর জিনিস দেখাই। ওই যে বেথুন সাহেব ছিলেন, উনারটাও দেখে যান। আরও কিছু।” এতক্ষণে বুঝে গেছি, সারাদিন এই কবরস্থানের দেখ-ভাল করতে গিয়ে ব্যানার্জি বাবুর কাছে একেকটি কবরই হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের প্রতীক। সাধারণ মানুষ এড়িয়ে চললেও তাঁর কাছে এই কবরই সব; এই কবর ঘিরেই যত আয়োজন। অথচ, প্রতিটি মানুষের অবধারিত শেষ ঠিকানা এখানে এই সত্য অনুধাবন করতে পারলে ব্যানার্জি বাবুর মতো আমাদেরও কবরকে একটি সুন্দর জিনিস হিসেবে ভাবতে খুব বেশি মানসিক পরিশ্রম করার প্রয়োজন পড়বে না।
আমি আর এন ব্যানার্জির দেখিয়ে দেওয়া পথে তাঁর পিছে পিছে হেঁটে যাচ্ছি। যেতে যেতে তিনি বললেন, “আমি খুব সৌখিন আছি, দিদি। একেক দিন একেক পোশাক পরি। চটিও আলাদা।” আগেই একবার দেখেছি। তাঁর কথা শুনে আরও একবার ধূলা-মাখানো পুরনো চটিজোড়ার দিকে তাকিয়ে চুপ মেরে গেলাম।
ব্যানার্জি বাবু আমাকে বেথুন সাহেবের সমাধিস্থলে নিয়ে গেলেন। লর্ড বেথুন এর পুরো নাম ঔড়যহ ঊষষরড়ঃ উৎরহশধিঃবৎ ইবঃযঁহব (১৮০১-১২ অগাস্ট ১৮৫১)। আমি ব্যানার্জি বাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম কবরগাত্রে উৎকলিত নামটির দিকে।
“দেখেছেন, উনার নামের মাঝখানে ড্রিঙ্কওয়াটার?”
খুব সুন্দর করে হাসলেন আমার গাইড। “খুব বুঝি জল খেতেন?”
আরও অনেক ব্রিটিশ লাটের মতো লর্ড বেথুন এর নামও আমার জানা ছিল। তবে তিনি এখানে সমাহিত আছেন ওই মুহূর্তে মাথায় ছিলনা। তিনি ছিলেন ভারত-প্রেমী এক ব্রিটিশ রাজকর্মচারী। বেথুন বালিকা বিদ্যালয় (বেথুন স্কুল) ও বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠা করে এ উপ-মহাদেশে বাংলার নারী জাগরণের সূচনা করেন। বেথুন কলেজ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ। বেথুন সাহেব ইংরেজিতে মহাকাব্য লিখতে আগ্রহী মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলায় লিখতে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। আজ তাঁরা একই স্থানে স্বল্প দুরত্বে চির নিদ্রায় শায়িত। স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যের এ এক অপূর্ব নিদর্শন। আমি শুধু মধুকবির সমাধি দেখতেই এখানে ছুটে এসেছি। ব্যানার্জি বাবুর কল্যাণে বেথুন সাহেবের সমাধিস্থলও দেখা হয়ে গেলো যারা জীবদ্দশায় একে অপরের কাছে পরিচিত ছিলেন।
ঘড়ি তাড়া দিচ্ছিলো ফিরে যাবার। ফিরে গিয়ে নির্ধারিত অনুষ্ঠানসূচিতে যোগ দিতে হবে। আরো খানিকটা এদিক-ওদিক ঘুরে ব্যানার্জি বাবুর হাতে ৫০০ রুপি গুঁজে দিয়ে ঐতিহাসিক সমাধিস্থল থেকে বের হয়ে আসবার জন্য পা বাড়ালাম।
ব্যানার্জি বাবুকে বললাম, “ভালো থাকবেন। আর ওই বিড়ি জিনিসটা ফুঁকবেন না। ওটা শরীরের জন্য ভালো না।”
“সেঞ্চুরি না করে মরছি না, দিদি। আর একবার বাংলাদেশে আসতে চাই। বাপ-দাদার ভিটাটা একবার দেখতে চাই।”
“অবশ্যই আসবেন।” বলে বিদায় নিলাম।
***
লেখক পরিচিতিঃ
মালেকা পারভীনের কাছে আরাধনার আরেক নাম সাহিত্য। তিনি বিশ্বাস করেন বেঁচে থাকার আনন্দ পরিপূর্ণতা পায় একনিষ্ঠ সাহিত্য মগ্নতায়। সেই ব্রত নিয়ে তিনি তাঁর মতো করে নিমগ্ন আছেন একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধনায়। পড়া আর লেখাকে তিনি গ্রহণ করেছেন জীবনের যাবতীয় প্রতিকুলতা মোকাবিলায় মোক্ষম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে। অবধারিত বাড়তি পাওনা বিশুদ্ধ আনন্দ যার স্বরুপ অপার্থিব।
মালেকা পারভীন মূলত ছোটগল্প লিখে থাকেন। কবিতাও তাঁর আরেক ভালোবাসা। চাকরিসূত্রে এবং নিজের মনের ভ্রমণ পিপাসা মেটাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘোরার সুবাদে লিখেছেন ভ্রমণ গাঁথা। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন এবং অনলাইন সাহিত্য পাতায় নিয়মিতভাবে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়ে আসছে।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ সিদ্ধান্ত (গল্পগ্রন্থ, ২০১২), অনুধাবনের মতো কিছু (গল্পগ্রন্থ, ২০১৫) সব পাখি ঘরে আসে (গল্পগ্রন্থ, ২০১৮), বৈদেশ বৈরাগে (মুক্ত গদ্য ২০১৯)।
***
শান্তি, ফিরে এসো
রচনা – শ্রেয়সী লাহিড়ী
————————-
‘এদের কি সবই সুন্দর? এই পাহাড়, উপত্যকা, চিনার গাছ, টিউলিপ, জাফরান, আপেল, গোলাপ আর লাবণ্যমাখা সুন্দর মুখ – প্রকৃতি যেন এদের উজাড় করে সাজিয়েছে। কিন্তু, পৃথিবীর এই স্বর্গে এত বারুদের গন্ধ কেন? কেন এত রক্ত, এত আশান্তি?’
ভেরিনাগের বাগানে বসে এইসব এলোমেলো ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কাশ্মীর উপত্যকা কি গোলাগুলি, কার্ফু, আর্মি – এই করেই শেষ হয়ে যাবে? কিছুক্ষণ আগেই আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইড বিট্টু সিং-এর সঙ্গে ট্যুর প্ল্যান বানাচ্ছিলাম। সে তো উলার হ্রদটা তালিকা থেকে কেটে বাদ দিয়ে দিল। বলল, ওপথে পর্যটকদের জন্য সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা আছে। মন খারাপ হয়ে গেল। এ পর্বের যাত্রায় ডাল লেক, নাগিন লেক আর মানসবল লেক দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।নিজের দেশের সীমানার মধ্যে ইচ্ছেডানা মেলার অধিকারটুকুও আমাদের নেই।
গোলাগুলির ভয় কাটিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে এসেছি। ভেরিনাগের বাগানে মখমলে সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে ডিজিট্যাল ক্যামেরার স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। দুপুরেই ‘টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট’ এর দৃষ্টিনন্দন শোভা বন্দী করেছি ক্যামেরায়। দূরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। তারই পাদদেশে সুবিস্তৃত উপত্যকায় পাকা ধানের খেত আর জোতগুলোকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে আছে লম্বা লম্বা পাইন গাছ। যেন হলদে ক্যানভাসে গাঢ় সবুজ প্যাস্টেল রঙ দিয়ে কেউ ত্রিভুজ, বহুভুজ, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র প্রভৃতি জ্যামিতিক আকার তৈরি করেছে। এক অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ।
ভেরিনাগের এই উদ্যানটি কাশ্মীর উপত্যকার মোগল উদ্যানগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার মতো হবে। শুধু উদ্যান নয়, ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভেরিনাগ আসলে ঝিলাম নদীর উৎস। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তৈরি করেন এই উদ্যান। ভেরিনাগ থেকে ফেরার পথেই রাজওয়ারী তালুকে মারা যান সম্রাট। বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি এই উদ্যানে রংবাহারী ফুল, প্রজাপতি আর সবুজের সমারোহ। চারপাশ নির্জন পাহাড়ে ঘেরা। পাহাড়ের নামও ভেরিনাগ। পুর্বে এর নাম ছিল নীলনাগ। কথিত আছে-বিরাটাকার এক সাপ বাস করত এখানে।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝরনার কাছে চলে এলাম। আটকোণা চত্ত্বর থেকে জল বেরিয়ে এসে জমা হয়েছে গোলাকার এক জলাশয়ে। এই জলাশয়ের চারপাশ ঘিরে মোগল আঙ্গিকে তৈরি হয়েছে এক স্থাপত্য। গোধুলি বেলায় জলাশয়ের বুকে এই স্থাপত্যের প্রতিচ্ছবি খুবই সুন্দর লাগছে। স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ট্রাউট মাছ।
স্থানীয় মানুষের বৈকালিক আড্ডা, শিশুদের হুটোপুটি, কেউ বা তার মায়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাদের লাল টুকটুকে গাল দেখে মনে হচ্ছে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা আপেল। আর তাদের মায়েদের দেখে বেশ বোঝাই যাচ্ছে, এ মুলুকে ফেয়ারনেস ক্রিমের বাজার একেবারেই মন্দা।
নিঝুম সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চারপাশটা ঘিরে ধরেছে। আমরাও বেরিয়ে এলাম। আবার গাড়িতে উঠে চলা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনন্তনাগ শহর পেরিয়ে এবার পৌঁছতে হবে পহেলগাম।
পহেলগাম যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন প্রায় রাত ৮টা বাজে। এখনই মনে হচ্ছে সমগ্র অঞ্চলটা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দোকানপাট বেশিরভাগই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো খোলা আছে, মালিকরা ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। হাতে গোনা কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।
জমজমাট অঞ্চলটা ছেড়ে আরও প্রায় ১ কিলোমিটার এগিয়ে গাড়ি থামল লিডার নদীর ধারে একটা ছোট্ট কাঠের সেতুর কাছে। সেতুটা পেরোলেই একটা খুব সুন্দর লজ। এখানেই আজ আমাদের নিশিযাপন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব বেশিদিনের নয়। দেওয়ালের গায়ে এখনও নতুনত্বের গন্ধ লেগে আছে। এ তল্লাটে হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁ প্রায় নেই বললেই চলে। বরং স্থানীয় মানুষদের বাড়িঘরই বেশি।
জম্মু পৌঁছনোর কয়েকটা স্টেশন আগে থেকেই সমস্ত প্রি-পেইড মোবাইল পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়টা আগে থেকে জানাও ছিল না। কলকাতার সঙ্গে দুদিন ধরে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু জরুরি ফোন করা খুবই আবশ্যিক। অগত্যা পাবলিক বুথের উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।
হোটেলে রিশেপসনের ফোনটা আস্থায়ীভাবে দেহ রেখেছে। লাগেজপত্র রেখেই প্রথম ও প্রধান কাজ যেটা, সেটা হল ফোন করতে বেরোনো। ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে আটটা ছুঁই ছুঁই। হোটেল ম্যানেজার জানালেন, কাছেই একটা মুদির দোকানে পাবলিক ফোনের ব্যবস্থা আছে। সেটা একটু বেশি রাত পর্যন্তই খোলা থাকে। এখনই গেলে হয়ত খোলা পাওয়া যাবে। সুতরাং বেশি দেরি না করে আমি আর বাবা বেরিয়ে পড়লাম।
কপাল মন্দ থাকলে যা হয়, দোকান বন্ধ। সামনের এক চিলতে বারান্দাটায় দুজন অল্প বয়সী ছেলে দাবা খেলছে। আমরা এসটিডি করতে চাই শুনে একজন বলল, ‘দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে, কাল সকাল ন’টা নাগাদ খুলবে।’
কি আর করি? ফিরে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় ছেলেটি পিছন থেকে ডাকল, ‘শুনিয়ে, আরজেন্ট ফোন? আইয়ে মেরে সাথ।’
ফোন করাটা সেই মুহূর্তে এতটাই গুরুত্বপুর্ণ ছিল যে কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কী তার উদ্দেশ্য – কিছুই চিন্তা করলাম না। সরু গলি দিয়ে ছেলেটির পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে ছোটো ছোটো স্থানীয় বাড়ি, অন্ধকার সরু পথ। এবার একটু ‘ভয় ভয়’ করতে লাগল। ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকালাম। দৃঢ় দৃষ্টিতে বাবা ইশারা করে যেন বলতে চাইল, ‘দেখাই যাক না, কী হয়।’
অশান্তির রাজ্য কাশ্মীরে স্থানীয় সদ্য পরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে রাত্রে এই নির্জন গলিপথে কোথায় চলেছি কে জানে? সন্ত্রাসবাদীর আখড়ায় নিয়ে যাচ্ছে না তো? আমরা কিডন্যাপড হয়ে যাব না তো? র্ধু! যত্তোসব আজেবাজে চিন্তা। বিট্টুজী স্থানীয় লোক। ওকে সঙ্গে আনলেই ভালো হতো। তবে, সে হয়ত সারাদিন গাড়ি চালানোর পর এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, তাকেও তো বিরক্ত করা ঠিক হতো না।
প্রায় মিনিট সাতেক হাঁটার পর একটা বড় উঠোন পার হয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ছেলেটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। বেশ বুঝতে পারছি, প্রবল ঠাণ্ডাতেও আমার কপালে ঘামের ফোঁটা। দু মিনিটের মধ্যে ছেলেটি বেরিয়ে এল এবং আমাদের ভেতরে ডাকল, ‘অন্দর আইয়ে।’
একটা ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুম। সোফায় আমাদের বসতে বলে ছেলেটি আবার চলে গেল। ফিরন পরা একটা সুন্দর মুখ ঘরের পর্দা ফাঁক করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে উঁকি দিয়েই চলে গেল। একটু পরেই ছেলেটির সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন ভীষণ হ্যান্ডসাম ষাট ছুঁই ছুঁই এক ভদ্রলোক। ছেলেটি তার আব্বুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি বললেন, ‘ওটা আমারই দোকান।আপনাদের যখন আরজেন্ট কল করার আছে, আমার মোবাইল থেকেই ফোন করুন।’
খান পাঁচেক এসটিডি হল কলকাতায়। ততক্ষণে ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছে।ভয়টাও কেটে গেছে। ওর নাম রিয়াজ, অনন্তনাগ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। হস্টেলে থাকে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। রিয়াজের আব্বু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা পেমেন্ট করব বলে ওনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
উনি ঘরে ঢুকলেন, হাতে একটা ঠোঙা। ওদের বাড়ির গাছের আখরোট খাওয়ার জন্য দিলেন। শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও ফোনের জন্য একটা টাকাও নিলেন না। ওনার একই কথা, ‘আপনারা মেহমান। যদি দোকান থেকে ফোন করতেন আলাদা ব্যাপার ছিল। কিন্তু, আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন। অসুবিধায় পড়েছেন, এটুকু সাহায্য করব না?’
এর মধ্যেই চা এসে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নানান প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এর থেকে বাদ গেল না। কথা প্রসঙ্গে রিয়াজ বলল, ‘আপনারা, মানে দেশের অন্য রাজ্যের মানুষরা সবাই ভাবেন, কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসবাদী। কিন্তু, সবাই তো তা নই। আমরা সাধারণ মানুষ, শান্তিতে থাকতে চাই।’
মনে মনে খুব খারাপ লাগল। আমিও তো তাই ভাবছিলাম। লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘ছিঃ! ছি! তা ভাববো কেন? কোনো দেশের সাধারণ মানুষই রক্তারক্তি, সন্ত্রাস, অশান্তি চায় না। কিছু মানুষের অপরাধের দায় চাপে সমগ্র সম্প্রদায়ের উপর।’
কথায় কথায় রাত বেড়ে যাচ্ছে। এবার ওদের বাড়িতে ডিনার করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু হল। বাকীরা সবাই হোটেলে অপেক্ষা করছে, এই বলে শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া গেল। তবে কথা দিয়ে আসতে হল, পরদিন সকালের নাস্তা রিয়াজের বাড়িতেই করতে হবে। এই অতুলনীয় আপ্যায়ন ও আন্তরিকতায় চোখে জল এসে গেল।
অন্ধকার গলিপথটা ধরে রিয়াজ বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। চারপাশটা খুব স্নিগ্ধ লাগছে। বিকালে মনের মধ্যে যে ভাবনাগুলো জমাট বেঁধেছিল, তার অনেক উত্তরই যেন পেয়ে গেলাম। জানি, এত সহজ নয়। তবু মনে আশা জাগে। একদিন ঝড় থামবেই। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, কাশ্মীর তার শান্তির বার্তা ঘোষণা করে সত্যি সত্যিই ভূস্বর্গ হয়ে উঠবে।
ভ্রমণকাল- অক্টোবর, ২০০৯
লেখক পরিচিতিঃ
কলকাতায় ১৯৭৭ সালে জন্ম। দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখি ও ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণ-কাহিনী প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার এক্সিকিউটিভ কমিটির প্রথম মহিলা সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো।
।। আমেরিকান ড্রিম।।
ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
১১টা মানে ১১টাই। সকাল ঠিক ১১টায় ওহাইও’র রাজধানী কলম্বাস শহরের রেসিডেন্স ইন হোটেল থেকে বাস ছাড়লো। আজ ২১ জনের আন্তর্জাতিক দলটিকে দুইভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। একদল গেলো কেন্টাকি স্টেটের লুইভিলে, আর আমরা রওনা দিলাম পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গের উদ্দেশ্যে। ২৭ জানুয়ারি থেকে দৌড়ের উপর আছি। বিমানে উঠতে উঠতে ক্লান্ত। বাসে করে পিটসবার্গ যাত্রা তাই অনেকের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই আয়োজনটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, আমরা যখন যে স্টেটে যাই তখন আমরা সেই স্টেটের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অতিথি। পিটসবার্গে এর দায়িত্বে আছে ‘গ্লোবাল পিটসবার্গ’। তারাই সাতসকালে বাস পাঠিয়েছিল আমাদেরকে নেয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কলম্বাস শহরের বাইরে চলে এলো। হাইওয়ে ধরে চলতে লাগলো পিটসবার্গের দিকে। আজ বাস ফাঁকা দেখে সবাই একটা একটা করে সিটে জানালার পাশে বসেছে। আমি বসেছি একেবারে সামনের দিকে। আমার সিটের সামনে একটা টেবিলও আছে। টেবিলের ওপাশে বসেছে সার্জ ব্লাড, তিনজন সমন্বয়কারীর একজন। প্রোগ্রামের শুরু থেকেই আছেন আমাদের সাথে। ডানদিকে জানালার পাশে বসেছে জোনাথন ক্রিস্ট। সে সমন্বয়কারী দলের আরেকজন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমেরিকার এই অসহ্য ঠান্ডায় রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো তাদের রঙ হারিয়ে কেমন যেন কুকড়ে আছে। এই সময়টাতে যত রঙ সব যেন আকাশে থাকে, একেবারে নিখাদ নীল। অবশ্য নিখাদ নীল বলা যাবে না। কারণ, আকাশটাও তো একটা পথ। সে পথে বিমান ঊড়ে গিয়ে পথের চিহ্ন রেখে গেছে। বাসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষের গন্তব্যে যাওয়ার রেখা দেখি, মানুষের বাড়ি ফেরার চিহ্ন দেখি। সে পথে আবার কাটাকুটিও আছে।
অনেকদূর পর পর ঘরবসতির দেখা মেলে। মাঠের পর মাঠ ফাকা পড়ে আছে, যেন বিরানভূমি। তার মাঝে কোন এক দূরের পথে রাস্তা চলে গেছে। সে পথ থেকে মন সরাতে না সরাতেই অন্য দৃশ্য সামনে চলে আসে। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। হঠাৎ মনে হলো- আচ্ছা, আমেরিকায় ফসলের জমিগুলোতে আল (বাংলাদেশে জমিগুলোকে খন্ড খন্ড করা হয় যা দিয়ে) নেই কেন? এদের কি সন্তানদের মধ্যে জমিজমা ভাগ হয় না? এদের কি জমি নিয়ে কোন বিবাদ নেই? নিজের মতো করেই একটা উত্তর খুঁজে নিলাম। ভাবলাম, এরা তো আমাদের দেশের পরিবারগুলোর মতো একাধিক সন্তান নেয় না। তাই হয়তো উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগ করতে করতে জমিগুলো টুকরো টুকরো হয়নি। কি জানি, অন্য কোন কারণও থাকতে পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমেরিকার গ্রামীণ সৌন্দর্য একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। সামনের টেবিলের উপর পড়ে থাকা খবরের কাগজে নজর দেই। আমেরিকায় এখন প্রতিদিনই গরম গরম খবর। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদিনই এমন এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বা কথা বলছেন যাতে আমেরিকা তো বটেই, সারা বিশ্বের মানুষ নড়েচড়ে বসছে।
কখন যেন একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাংতেই আবারো সেই নীল আকাশ, বেশ কিছুক্ষণ পর পর সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি, উঁচু টিলার উপর কবরের সারি আর বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আরেকটা খবরের দিকে নজর গেলো। সান ফ্রান্সিসকোতে ৫৮ তলা একটা অভিজাত বিল্ডিং গত ৬ বছরে কয়েক ইঞ্চি দেবে গেছে। ঐ ভবনের বাসিন্দারা তাদের কি পরিণতি হবে তা নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন। কারণ, অনেকেই সারাজীবনের সঞ্চয় বা সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে শেষ বয়সে থাকার জন্য ঐ ভবনে ফ্লাট কিনেছেন। এসব খবর পড়লে মজাই লাগে। কারণ, আমাদের ওখানেও বিল্ডিং দেবে যায়, হেলে যায়, ধ্বসে যায়।
পাহাড় বা টিলা এলাকা দিয়ে যাচ্ছে বাস। উপরের দিকে ঊঠতে থাকায় টেবিলের উপর থাকা সার্জের একটা খাতা আর কলম নিচে পড়ে গেলো। এতক্ষণ সে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিলো। এবার আমেরিকান পরিবার আর সমাজব্যবস্থা নিয়ে গল্প শুরু হলো সার্জের সাথে। সার্জ একেবারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় থেকে শুরু করলেন।
-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার লোকজন একটা নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো। একটা সুন্দর পরিপাটি জায়গায় নিজেদের বাড়ি হবে, সাথে একটা কৃষিখামার থাকবে, খুব পরিপাটি আর ঝামেলামুক্ত জীবন কাটবে। কারণ, যুদ্ধ তো শেষ। এবার শান্তির জীবন চাই। সেই আমেরিকান ড্রিম পূরণের পথেই হাটতে লাগলো সবাই। বিভিন্ন শহরে শহরে কলকারখানা গড়ে উঠতে লাগলো। মানুষের কর্মসংস্থান এর সুযোগ তৈরি হতে লাগলো। নিজেদের একটা বাড়ি আর খামার যাদের হলো তাদের অনেকের আবার কর্মের জায়গা শহরে যাবার জন্য পরিবহনের প্রয়োজন পড়লো। তখন অটোমোবাইল কোম্পানীগুলো করলো কি, বিভিন্ন শহরের স্থানীয় পরিবহন কোম্পানীগুলোকে কিনে নিলো এবং সেগুলোকে বন্ধ করে দিলো। তারপর সহজ কিস্তিতে নিজেদের গাড়ি বাজারে ছেড়ে দিলো। তখন আমেরিকার মানুষেরা শহর থেকে একটু দূরে থাকতেই পছন্দ করতো। এভাবে বছরের পর বছর ধরে আমেরিকান ড্রিম পূরণ হতে লাগলো।
এবার পারিবারিক সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলা যাক। আমেরিকায় প্রায় প্রত্যেক পরিবারে সন্তানেরা ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলে পিতামাতার সাথে থাকতে চায় না। এখানে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে ইনডিভিজুয়ালিজম এর প্রাধান্য বেশী। ১৮ বছর বয়স হয়ে গেলেই সবাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ, কেউ তার উপর নজরদারি করুক এটা চায় না। পরিবারের সাথে থাকলে তো নজরদারির মধ্যে থাকতেই হবে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্তানেরা বিভিন্ন স্টেটের বড় বড় শহরে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। কারণ, উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে আনন্দ-বিনোদন সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যায় বড় বড় শহরগুলোতে। এভাবে এক এক করে সব পরিবার থেকেই সন্তানেরা আলাদা হতে থাকে। শহরগুলো আরো জমজমাট হতে থাকে আর পিতামাতারা নি:সঙ্গ হতে থাকে। এমনকি সন্তানেরা পিতামাতার সম্পদের দিকেও ফিরে তাকায় না। তাদের কাছে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকার চেয়ে নিজের ইচ্ছে মতো জীবনযাপন করাটাই বড় কথা।
জোনাথনও কখন থেকে যেন এই গল্প কান খাড়া করে শুনছে। সার্জ বলতেই থাকেন। এবার তার নিজের কথা বলেন।
– আমার নিজের কথাই বলি। আমার এক খালা ছিল এক শহরে। সেই শহরে আমি মাঝেমাঝে কাজে যেতাম। প্রথম দিকে সেই খালার বাসায় গিয়েই উঠতাম। কিন্তু সেখানে গেলে এক বিপত্তি হতো। সারাক্ষণ এই খাও, ঐ খাও করতে করতে কান ঝালাপালা করে ফেলতো। বাসা থেকে বেরোতে চাইলেও ঠিকমতো বেরোনো যেতো না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে পরে ঐ শহরে গেলেও হোটেলে থাকতাম। খালার বাসায় গিয়ে দেখা করে আসতাম বা একবেলা দু’বেলা খেয়ে আসতাম।
সার্জের গল্প শুনতে শুনতে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে সুন্দর ঘরবাড়ির দিকে তাকালে নি:সঙ্গতার স্পষ্ট ছায়া চোখে পড়ে। তবু সার্জের কাছে জানতে চাই- সন্তানেরা যখন পিতামাতাকে ছেড়ে চলে যায় তখন সেই পিতামাতার কি হয়? এ কথা শুনে আবার শুরু করলেন সার্জ।
– পিতামাতাকে ছেড়ে সন্তান যখন কাছের শহরে থাকে, তখন সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকানরা সারা জীবনে গড়ে ১১টা বাড়িতে থাকে। শিক্ষা, চাকরী, বদলী এসব বিভিন্ন কারণে এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক স্টেট থেকে আরেক স্টেটে বাড়ি বদলাতে হয়। এভাবেই পিতামাতার কাছ থেকে দূরে বহুদূরে যেতে থাকে সন্তানেরা। পিতামাতার সাথে বা ভাইবোনের সাথে ৬ মাসে বা বছরেও দেখা হওয়া কঠিন হয়ে যায়।
গাড়ির মধ্যে আরো কয়েকজন আশপাশের দৃশ্য দেখা বাদ দিয়ে সার্জের কথা শুনতে শুরু করেছে। ইউরোপ থেকে যারা এসেছে তাদের অনেকের সাথেই হয়তো আমেরিকান পারিবারিক বন্ধনের এই রীতি মিলে যায়। কিন্তু আমাদের মেলে না। তাই কথাগুলো শুনতে শুনতে কষ্টও পেতে থাকি। ভাবি, বৃদ্ধ হয়ে গেলে মানুষগুলো একা একা ডাক্তারের কাছে যায় কিভাবে? আবার ভাবি, উন্নত দেশ বলে কথা, ডাক্তারই হয়তো এসে তাদের খোজ নিয়ে যায়। তবুও সার্জকে আবার জিজ্ঞেস করি, তাহলে বৃদ্ধ বয়সে এখানে মানুষের কি হয় তাহলে?
– বৃদ্ধ বয়সে এখানে চরম নি:সঙ্গ জীবন মানুষের। তিন-চারটা বেডরুমের বিশাল বাড়ি পড়ে থাকে। কিন্তু সেখানে থাকার কেউ থাকে না। কারো কারো অনেক সম্পদ থাকলেও সন্তানেরা সেদিকে ফিরে তাকায় না। কেউ কেউ নার্সিংহোমে চলে যায়, কেউবা বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে সেই শহরে গিয়ে একটা ছোট্ট এপার্টমেন্ট কেনে যে শহরে তাদের কোন সন্তান আছে। এভাবেই আমেরিকান ড্রিম জীবনের কোন অংশে বিস্তৃত হচ্ছে, আবার কোন অংশে সংকুচিত হচ্ছে আবার কোন অংশে ঝকমকে শহরের উঁচু অট্টালিকার মধ্যে আটকে যাচ্ছে।
তাহলে কি ইনডিভিজুয়ালিজম শেষ পর্যন্ত নি:সঙ্গতার দিকেই নিয়ে যায় মানুষকে। সার্জ বলেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি ব্যক্তি স্বাধীনতার আনন্দটাও সত্য। তার কথা মেনে নেই। কোন পরিবার, সমাজ বা সমাজব্যবস্থাকে ভিন্ন চোখে দেখার কিছু নেই। কারণ, এটা তাদের অভ্যস্ততার ব্যাপার। ভিন্ন সমাজে বসে সেটার মূল্যায়ন করা অন্যায়। আমরাও কি আসলে একই পথে হাটছি না? আমি কি আমার মায়ের পাশে সবসময় থাকতে পারি? আমি কি বাড়ি বদলিয়ে ঢাকায় চলে আসিনি? আমাকে ছেড়েও কি ভবিষ্যতে আর কেউ যাবে না?
পিটসবার্গ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বাস। কলম্বাস থেকে এখানে আসতে প্রায় ৩ ঘন্টা লাগলো। এই সময়ের মধ্যে, এখানকার জমিগুলোতে আইল থাকে না কেন, তার স্পষ্ট উত্তর পেয়েছি। বাসের জানালা দিয়ে যতটুকু দেখেছি, বুঝেছি তারও বেশী। একটা নদী পার হলো আমাদের বাস। অল্পের জন্য আকাশ ঢেকে যায়নি এমন উঁচু উঁচু ভবন আমাদের স্বাগত জানালো পিটসবার্গে। জোনাথন এবার কথা বলে উঠলো।
– আমিও আমার বাবা-মার সাথে থাকি না। আমি থাকি ওয়াশিংটন ডিসিতে আর তারা থাকে টেক্সাসে। আমি তাদের বলেছি বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে সুবিধাজনক কোথাও চলে আসতে। কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি না। তারা বলে- এত স্মৃতি এই বাড়িতে, কিভাবে বিক্রি করি! আমি বলেছি, ঐ বাড়িতে কোন স্মৃতি নেই। স্মৃতি যা আছে সব তোমাদের মাথায়।
পেন এভিনিউতে ঢুকে পড়েছে বাস। থামলো কোর্টইয়ার্ড ম্যারিওটের সামনে। এটাই আমাদের পরবর্তী ৪ দিন থাকার জায়গা। একে একে সবাই নামলো বাস থেকে। আমি সার্জের পেছনেই লেগে আছি। তার বয়সটা জানতে চাই। জিজ্ঞেস করতেই সে আমাকে অনুমান করতে বললো। আমি অনুমান করলাম ৬০ এর মতো। সে বললো, ৬০ পার হয়েছে। সার্জের জন্ম নিউ ইয়র্কে। চার বছরের এক ছেলে আছে তার, থাকে এস্তোনিয়াতে।
মুনজুরুল করিম
সম্পাদক, প্রবাস কথা
উপস্থাপক, মুভ উইথ মুনজুরুল করিম
(অ ঃৎধাবষনধংবফ রহভড়ৎসধঃরড়হ ংযড়)ি
িি.িুড়ঁঃঁনব.পড়স/সঁহুঁৎঁষশধৎরসঃা
দিল্লি – স্মৃতি আর সমৃদ্ধির নগরী
পরিচিতি –
নাম : মুনতাসির রশিদ খান
জন্মতারিখ ও জন্মস্থান : ৩০ই মে,১৯৯০ এ টাংগাইল জেলা।
পেশায় ব্যাংকার হলেও মুনতাসির রশিদ খানের ঝোক রয়েছে নানাদিকে। ১৯৯০ সালে, টাংগাইলে জন্ম নেয়া এই তরুণ লেখকের ছোটবেলাটা কেটেছে টাংগাইল জেলা সদরেই। ছাত্রজীবনে জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে ব্যবসায় প্রশাসন থেকে বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে যোগ দেন বেসরকারী ব্যাংক ইস্টার্ণ ব্যাংকে। দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর মানুষের বৈচিত্র্যের টানে বারে বারে তিনি দেশে বিদেশে ছুটে বেড়ান সময় পেলেই। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত সব জেলায় প্রাচীন নিদর্শন কিংবা জমিদার বাড়ি অথবা লোকচক্ষুর গহীনে থাকা নিদারুণ প্রাকৃতিক সৌন্দ্র্যেযর অজানা টানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। দেশের বাইরে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ডে পা ফেলে তিনি স্বপ্ন দেখছেন পৃথিবীর পথে আরো অনেকটা হাটতে।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা –
অনেক প্রাচীন কাল থেকেই নানা সাম্রাজ্য আর ইতিহাসের সাক্ষী এখনকার ভারতের রাজধানী দিল্লি। সাতবার ধবংসস্তুপ থেকে মাথা উচু করে মাথা উচু করে দাড়ানো এই প্রাচীন নগরীর কথা মহাভারতে উঠে এসেছে ইন্দ্রপ্রস্থ হিসেবে আবার মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নামে নাম রেখে শাহজাহানাবাদ হয়ে ওঠা এই শহর মায়ায় জড়িয়েছে বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম ড্যালেরেম্পেল (দিল্লি – দ্য সিটি অফ জ্বিনস বইয়ের লেখক)এর মত বিদেশীকে। ওবেরয়, ম্যারিয়ট বা তাজ হোটেলের বিলাসীতার সাথে এই শহরে আছে ৭-৫শ বছরের ঘোর লাগানো পুরোনো সব ঐতিহাসিক নিদর্শন।
গত বছর আগস্টে, ঢাকা থেকে সহকর্মী তৌহিদকে সাথে করে বাৎসরিক ছুটির শুরু হল মেঘলা আকাশে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করে অনলাইনে ঠিক করা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। শাটল বাসে চেপে যাত্রার শুরুতেই পড়তে হলো রাজধানীর জ্যামে। এরই মাঝে দুপুর নাগাদ পৌছে গেলাম পাহাড়গঞ্জের হোটেলে। পৌছানোর পথে তাক লাগালো জমকালো কনৌট প্লেস, দিল্লির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র যেখানে গ্রেগোরিয়ান ধাচের সব দালান আর আধুনিক সব ব্র্যান্ডের জানান দিচ্ছিল ভারতের উন্নত দিকের কথা। হোটেলে ব্যাগ রেখেই বেরিয়ে গেলাম দিল্লি জামে মসজিদের পাশের খাবারের মোঘলাই স্বাদ নিতে। প্রথমবারের মত পাতালরেলে চড়ে ১০/১৫ মিনিটে পৌছে গেলাম দিল্লির বিখ্যাত জামে মদজিদের পাশে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল, দিল্লির বিখ্যাত করিম’স রেস্তোরা। সেখানে পৌছে আমরা দেখলাম এক ভিন্ন দিল্লিকে এখানকার লোকজন নতুন দিল্লির মত ঝা চকচকে নয়। বরং ঘরোয়া পরিবেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সাক্ষী মুঘল আমলের, সিপাহী বিদ্রোহের আর বৃটিশের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গান্ধীর ভারতের। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত করিমস হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাস মুঘল রসুইখানার পাচক। মেন্যুতেই নানা আইটেমের নাম এখনও সেই সময়ের ঐতিহ্য বহন করে যেমন – মুসল্লম-ই-জাহাগীরী, মুর্গ মালাই টিক্কা, পনির টিক্কা, দিল পসন্দ কাবাব, পেশোয়ারী কাবাব ইত্যাদি। সাথে ছিল বৃটিশদের ভেজ্জিটেবল স্টু দেখে আবিষ্কার করা মাটন ইস্টু, ঝুরঝুরে রুমালী টাইপ রুটি। মন জুড়িয়ে পেট ভড়ানোর শেষ পর্যায়ে ছিল ঘন মাখন, বিভিন্ন ফল, কিসমিস আর জাফরান দিয়ে তৈরী ‘দৌলাত-কি-চাট’। এরপর আমরা সিড়ি পেরিয়ে উঠলাম কালে সাক্ষী দিল্লি জামে মসজিদ। এখানে নাকি একসাথে ২৫,০০০ লোক নামাজ পড়তে পারে, ১৩৫ ফুট উচু সাদা গম্বুজের এই মসজিদ তৈরী হয়েছিল ১৬৫০-৫৬ সালের মধ্যে। সম্রাট শাজাহানের এই অমর কীর্তি মুসলিম ঐতিহ্যের সৌক্র্যে র জলজ্ব্যান্ত নিদর্শন আর এর স্থাপত্যশৈলী অভিভূত করে করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
দিল্লির তিনটে রূপ আছে এখন। নিউ দিল্লি, পুরনো দিল্লি আর বৃটিশ দিল্লি। ১৬৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত শাহজাহানাবাদ বলে পরিচিত পুরনো মুঘল দিল্লি, ঘিঞ্জি আর দারিদ্রের সাথে মিশে গেছে দিল্লির খানদানী রূপ যাতে আছে লাল কেল্লা, ফতেপুরী মসজিদ, রাজিয়া সুলতানার কবর, এশিয়ার সবথেকে বড় মশালার বাজার – খারী বাউলি, মহাত্মা গান্ধীর দাহস্থান রাজঘাট, চাদনী চক আরো অনেক মুঘল যুগের হাভেলী। আমাদের প্রথম গন্তব্য হল, লাল কেল্লা যেটা প্রায় ১০ মিনিটের হাটা দূরত্বেই অবস্থিত। সেখান থেকে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় এক অভুতপূর্ব অসাম্প্রদায়িক দৃশ্য। এক কাতারে দাড়িয়ে থাকা দিল্লি জামে মসজিদ, শিখদের গুরু দুয়ার, বিড়লা মন্দির ও গির্জা। বিকেলের দিকে লাল কেল্লার চারপাশের পরিখা ধরে একটা চক্কর দিতে গিয়ে দুজনের জিভ বেরিয়ে যাবার দশা কারণ ২৫৪.৬৭ একর বলে কথা। সামনের তেরঙ্গা পতাকা ওড়া জায়গাটাতেই নানা সময় ভারতের জাতীয় নেতাদের বক্তৃতা দিতে দেখা যায়। লম্বা লাইন পেরিয়ে ২৫-৩০ ফুট উচু গেট দিয়ে কড়া পাহাড়ার মধ্য দিয়ে ঢুকতেই জানলাম লাহোরি গেট এর মত বাকি তিনটি শহরের নামে তিনটি গেট(যেমন -কাশ্মিরী গেট)। কখনো সৈন্য সামন্ত নিয়ে যাত্রা করার সময় যেন দিক ভুল না হয় তাই ব্যবস্থা। লাহোরি গেট পার হয়েই দেখতে পেলাম প্রাচীন কালের মসলা, সিল্ক, অলংকারের বাজার ‘ছাতি চক’। ছাতি চক পেরোলেই পাওয়া নহবতখানা যেখানে রাজদরবারে আসা অতিথিদের জন্য এলান দেয়া হত এবং সংগীত বাজত দিনের নির্দিষ্ট সময়গুলোতে। এই তিনতলা গেটের মত বিল্ডিংয়েই আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সম্রাট জাহান্দার শাহ আর ফররুখশিয়র। এরপরই আছে, দিওয়ান-ই-আম মানে কিনা আমজনতার সাথে সম্রাটের মিলনস্থান। এখানে, এখনো আছে কাচে ঘেরা সম্রাট আওরংজেবের সিংহাসন যাতে আছে স্বর্ণ আর হাতির দাঁতের ইউরোপীয়ান কারুকাজ।এতে কাজ করার জন্য ফ্লোরেন্স থেকে অস্টন দ্য বরদেয়ু নামে এক শিল্পীকে আনা হয়েছিল।এরপর একে একে ঘুরে দেখলাম রং মহল, খাস মহল, দিওয়ান-ই-খাস, তুর্কী প্যাটার্ণে করা হাম্মাম খানা, হায়াত বখশ বাগান আর মতি মসজিদ।কেল্লার ভেতরেই সিপাহী বিদ্রোহের পরে বৃটিশেরা তাদের ব্যারাক গড়ে তোলে। যার অবস্থা এখনো ভালই বলা চলে।
সিপাহী বিদ্রোহের পরে এখানেই পতন হয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্যের। শ’খানেক রুপিতে এখন রাতে দেখা যায় লাইট আর সাউন্ড শো। চাঁদের আলোতে মার্বেলের সাদা মতি মহল, হিরা মহল, মুমতাজ মহল কেমন স্বপ্নীল দেখাবে তা ভেবে শিহরিত হতে বাধ্য ইতিহাস উপেক্ষা করা মানুষও।
পরদিন ভোরের, যাত্রা শুরু হল গরম আলু পরোটা, চাট আর টক দই দিয়ে। আমরা দিল্লি ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস এর প্যাকেজ বেছে নিয়েছিলাম নানা রকম ট্যুরিজম অফার থেকে। এসি বাস, ট্যাক্সি, মিনি বাস আর তিন/পাচ/ছয়টা স্পটের মধ্য থেকে পছন্দ করলাম সারা দিনের জন্য একটি প্যাকেজ কারণ রাতে আমাদের প্ল্যান বলিউডের সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত কোন ছবি দেখার। সকাল ৮ টাতেই চলে এল বাস আর আমাদের গাইড হাসিখুশি দক্ষিণী নায়কের মত গোঁফ আর হালকা ভুড়িওয়ালা এপি মানে কিনা অতুল পান্ডে। হালকা চটুলতার সাথে মধ্যে নতুন দিল্লি দেখা শুরু হল। সবুজে মোড়া উন্নত দেশের ধাচের নতুন দেখে বিশ্বাস করা শক্ত যে এই দিল্লিতে ধুলি ঝড় হয়, এখানকার বায়ুদূষণের কথা সবার জানা।
প্রথম আকর্ষণ হল, ভারতের প্রভাবশালী পরিবার বিড়লাদের সৃষ্টি সবার জন্য উন্মুক্ত বিড়লা মন্দির। এর উদ্বোশন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি শোভা পাচ্ছে একই মন্দিরে। এরপর, আমরা একে একে দেখলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, লোকসভা, সামরিক সদর দপ্তর, বিজেপির প্রধান কার্যালয়।একসময় আমরা পৌছে গেলাম দিল্লির প্রধানতম আকর্ষণ কুতুব মিনার আর এর আশে পাশের প্রাচীন স্থাপনাসমূহ। এখানেই আছে, হালের পদ্মাবতীর খলনায়ক আলাউদ্দিন খিলজীর কবর আর দাস সাম্রাজ্যের সময়কার দিল্লির সম্রাট ইলতুৎমিশের কবর। আছে দিল্লির প্রথম মাদ্রাসা আর সরাইখানা। এখানে আছে আরবী অসাধারণ ক্যালিগ্রাফী আর দিল্লির প্রথম সালতানাতের স্থাপনা। কুতুব মিনারের পাশে আছে এর থেকে বড় স্তম্ভ বানানোর জন্য আলাউদ্দিন খিলজীর শুরু করা আলাই মিনার। জীবনের অনিত্যতায় মাত্র এক তলা করার পরেই সাম্রাজ্যের আলাউদ্দিন খিলজীর মৃত্যুর পরে বাতিল হয় নির্মাণ কাজ। এই পুরো কুতুব কমপ্লেক্স জুড়ে আছে দ্বাদশ শতকের ঐতিহাসিক সব কবর, ধংসস্তুপ।
আমাদের পরের গন্তব্য, মুঘলদের শেষ স্থাপনা সফদর জংযের সমাধি। ১৭৫৩-৫৪ সালে নবাব সুজা উদ্দৌলার পিতা এবং অযোধ্যার প্রধান মন্ত্রী পিতার স্মরণে এই দ্বিতল মুঘল কীর্তি। চারপাশে চারটি গম্বুজ ওয়ালা পিতার প্রতি পুত্রের শ্রদ্ধার নিদর্শন দেখার পর আমাদের যাত্রা শুরু মহাত্মা গান্ধীর বাড়ি আর দাহস্থান রাজ ঘাটের পথে। মহাত্মা গান্ধীর বাড়িকে ঠিক তার শেষ দিনের মত করেই রেখে দেয়া হয়েছে। বাগানের মাঝে যে পথে গান্ধীজি গিয়েছিলেন তার পায়ের ছাপ সংরক্ষণ করা আছে। রয়েছে গান্ধীজির ব্যবহ্র্যাব চরকা, চশমা, কাপড়, চৌকি আর স্বাধীনতার সময়কার অহিংস আন্দোলনের নানা দুর্লভ চিহ্ন আর চিত্রাবলী। যেখানে গান্ধীজিকে গুলি করেছিল নাথুরাম গডসে সেখানে স্মৃতিস্মারকে খোদিত আছে গান্ধীজির শেষ শব্দ – হে রাম, হে ভগবান! এখান থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রাজঘাটের সবুজ শিখা অনির্বাণে গেলে অনুভব করা যায় শান্তির জন্য সংগ্রামে তিনি একেবারে ব্যর্থ হননি।
আমাদের শেষ গন্তব্য, দিল্লির পুরানা কেল্লা আর সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি, যার স্থাপতকলা থেকে অনেকটাই প্রভাবিত তাজ মহল। পার্থক্য হচ্ছে, তাজমহলের সামনের স্তম্ভ আর এতে লালচে পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। ইতিহাসে আছে, সম্রাট হুমায়ুন পাঠাগার থেকে পড়ে মারা গেলে প্রথমে তাকে সমাহিত করা হয় তুঘলতাবাদের পুরানো কেল্লাতে। কারণ, তখন হিমুর সাথে যুদ্ধ চলছিল মুঘলদের। পরে তার স্ত্রী (সম্রাট আকবরের মা) হামিদা বানু, যুদ্ধে জেতার পরে এখানে স্বামীর স্মৃতিতে গড়ে তোলে এই সমাধি স্থল। কথিত আছে, এখানে সমাহিত আছে ভাই আওরংজেব এর হাতে নিহত সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারা শিকোহকে কবর দেয়া হয়েছে। যার কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আরো শত কব্রের ভীড়ে।
দিন শেষে ফেরার পথে খেয়াল করলাম, সারাদিন খাওয়াই হয়নি তেমন।বেশ বৃষ্টির শেষে যখন ডুবন্ত স্র্যূা ফ্রান্সের ‘আর্ক অফ ট্রায়াম্ফ’ এর আদলে বানানো ইন্ডিয়া গেটে পড়লো তখন বুঝতে পারলাম সময়ের থেকে শক্তিশালী কিছুই নেই পৃথিবীতে। আমাদের যাত্ত্রার শুরুর মত শেষটাও হল স্যার এডুউইন লুটিয়েনের হাতে গড়া ব্রিটিশ দিল্লিতে। যেখানে এখন ব্রিটিশ রাজের জায়গা দখল করে নিয়েছে এডিডাস, ম্যাকডোনাল্ডস, টিফানীস, লুই ভুটোনের মত নব্য আধিপত্যবাদী ব্র্যান্ড।
রাতের দিল্লিতে আমাদের আবিষ্কার ছিল শাহী লাচ্ছি, চাট আর ঝকঝকে সব শপিং মল। বিচিত্র এই শহর একদিন ভিস্তিওয়ালা, ক্রীতদাসকেও সম্রাট হতে দেখেছে আবার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দাফনের জন্য সাড়ে তিনহাত মাটিও না জুটতে দেখেছে।
থথথথথথথথথথথথথথ
গ্রেট বৃটেনের আঙ্গিনায় কিছু অপ্রিয় সত্য কথা
ফারুক হাসান
ঢাকার একজন অতি অল্পশিক্ষিত ধনাঢ্য ব্যক্তি, যিনি পরবর্তী সময়ে টাকার জোরে রাজনৈতিক নেতাও বনে গিয়েছিলেন, তিনি এক নির্বাচনী রাজনৈতিক জনসভায় সবাইকে চমকে দেয়ার জন্য তাঁর বক্তৃতায় পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, “ইংল্যান্ডে ছবাই ছিক্ষিত; চাইর/পাচ বছরের পোলাপাইনগুলাও কি ছুন্দর গড়গড় কইরা ইংরাজিতে কতা কয়। আমগো দেশের ছবাইকেও ছিক্ষিত হইতে হইবো।” (ইংল্যান্ডে সবাই শিক্ষিত; চার/পাঁচ বছরের ছেলে-মেয়েরাও কি সুন্দর গড়গড় করে ইংরেজিতে কথা বলে। আমাদের দেশের সবাইকেও শিক্ষিত হতে হবে।)
ওই রাজনৈতিক নেতার মত করে না হলেও, আমাদের দেশের সবার ধারনা ইংরেজ মাত্রই উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র ও পরিশীলিত। আমাদের দেশে অনেকেইতো ইংরেজ বা শ্বেতায় পুরুষ দেখলে তাকে ‘সাহেব’ মনে করে থাকেন, আর শ্বেতকায় নারীকে ভাবেন মেমসাহেব। ওদেশে যাওয়ার আগে আমারও ধারনা ছিল ইংরেজ মানেই সবাই সুশিক্ষিত এবং মার্জিত। কিন্তু ইংল্যান্ডে কিছুদিন কাটানোর পর আমার ধারনাটা পাল্টে যায়।
ওদেশের যে অঞ্চলেই গিয়েছি লোকজন সব আমার সঙ্গে আঞ্চলিক ইংরেজিতে কথা বলেছে। বিদেশী বলে ‘শুদ্ধ’ ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করেনি। আবার ওদের আঞ্চলিক ইংরেজি না বুঝলে এমন ভাব দেখিয়েছে যেন “এ ভূত কোত্থেকে এসেছে?” বৃটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামে বাস কে বলে বুস, তাও একজন বিদেশীকে বুঝে নিতে হবে। আরো উত্তরে এডিনবার্গে প্লেন ল্যান্ডিং-কে বলে প্লেন লুন্ডিং, তাও বুঝে নিতে হবে। খোদ লন্ডনের আদিবাসী ককনী ইংরেজরা ধিঃবৎ-কে ওয়া-য়া, ইঁঃঃবৎ-কে বা-য়া, খধফু-কে লাইডি বলবে, না বুঝলে হে বিদেশী সে তো তোমার দোষ।
জার্মানে একজন বিদেশী ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান বললে জার্মানরা উৎসাহ দিয়ে বলে, ‘জি স্প্রেখেন হোক ডয়েস।’ অর্থাৎ ‘তুমি খুব উচুমানের জার্মান বলো।’ আর এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য ইংরেজির বাচন-বচন না জানলে তুমি ইংরেজির ‘ই’ও জানো না।
আমার এক ইংরেজ বন্ধু ভূগোলবিদ্যায় মাস্টার্স করেছে। একদিন ওর মা আমাকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো আমাদের দেশটা অনেক দেখেছো, আমাদের সম্পর্কে তোমার ধারনাটা কি?”
আমি বললাম, “দেশে থাকতে ভাবতাম সব ইংরেজই বুঝি সুশিক্ষিত, পরিশীলিত। এখানে এসে দেখলাম আসলে তা নয়।” আমার কথা শুনে মহিলার মুখের উপর যেন আষাঢ়ের কালো মেঘ নেমে এলো। মনে মনে দুঃখিত হলাম ইংরেজ জাতি সম্পর্কে ইংল্যান্ডের মাটিতে বসে একজন ইংরেজ নারীকে এমন অপ্রিয় সত্য কথাটা বলার জন্য। কিন্তু মুখ থেকে কথাটা যখন বেরিয়ে গেছে, ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই।
ইংল্যান্ডে বারো ক্লাস পর্যন্ত প্রতিটি ছেলে-মেয়ের স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। না গেলে ক্লাশ টিচার পুলিশ সহ বাসায় চলে আসেন। মা-বাবাকে কঠিন কৈফিয়ৎ দিতে হয়। তাই প্রতিটি ছেলে-মেয়ের স্কুলে না গিয়ে উপায় নেই। আমাদের দেশের মত ওদেশে তথাকথিত পাঁচ ক্লাশ পড়ে পিএসসি, আট ক্লাশ পড়ে জেএসসি পরীক্ষা নেই। একটা বছর কেটে গেলে সকলেই নীচের ক্লাশ ডিঙ্গিয়ে উপরের ক্লাসে উঠে যায়, কেবল ক্লাশ টিচার ছাড়া; কিছু শিখলে শিখলো, না শিখলে নেই। শিকারী সারমেয়র মত গন্ধ শুঁকে শুঁকে এ দেশটার কোথাও কোচিং সেন্টার খুঁজে পাওয়া যায় না। বারো ক্লাশ পরে প্রথমবারের মত সরকার অনুমদিত পরীক্ষা দিতে হয়। পাস করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার মেলে। তবে পাস করলেও খুব কম সংখ্যক ছেলে-মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়ায়। বাকীরা আনন্দ-ফূর্তিতে ডুবে যায়। চাকুরি না মিললে মাসে মাসে সরকারী ভাতা তো আছেই।
আমার বন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুনী বোন আমাকে একদিন বার্মিংহামের কাছে একটি উইন্ড মিল দেখাতে নিয়ে গেল। ইংল্যান্ডে উইন্ড মিল নেই বললেই চলে। উইন্ড মিলের জন্য জগৎজোড়া নাম হল্যান্ডের। এটি যেন ওদেশের প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; উর্বশীর মত সুন্দর এক একটি। দু’চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করে।
ইংল্যান্ডের অচল হয়ে পড়ে থাকা এই উইন্ড মিলটি একবারেই সাদমাটা, হল্যান্ডের মিলগুলোর পাশে দাঁড়ানোর মত নয়। মিলটি দেখে ফিরে আসার পথে মেয়েটা গর্বভরে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন লাগলো তোমার উইন্ড মিলটা?”
আমি বললাম, “হল্যান্ডের উইন্ড মিলগুলোর মত একবারেই নয়। ওদেরগুলো অনেক সুন্দর।”
হাসিখুশি মেয়েটা চুপ হয়ে গেল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, অপ্রিয় সত্য কথাটা বলে আবার আষাঢ়ের মেঘ ডেকে এনেছি। আমার কথায় ওর জাত্যভিমানে আঘাত লেগেছে। ভাবলাম আর কখনোই এমন চাঁচা-ছোলা কথা নয়। পশ্চিমে সব জাতিগুলোর জাত্যভিমান টনটনে। ইংরেজ, ফরাসী, জার্মানদের এ অহংবোধটা আরো এক পরত সরেস।
আমার বন্ধু একদিন আমাকে বললো, “জানো, আমাদের এখানে একটা নদী আছে?”
নদীর প্রতি আমি এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করি, তাই নদীর কথা শুনেই ওর কাছে যাওয়া জন্য, ওকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠি। দেরী না করে বললাম, “আমাকে নিয়ে চলো।”
অনেকটা পথ গাড়ি চলিয়ে ও আমাকে একটি ক্ষীণাঙ্গী স্রোতোস্বিনীর কাছে নিয়ে এলো। স্রোতোস্বিনী বললাম, কিন্তু ওর বুকে বয়ে চলার ছিঁটে-ফোটা লক্ষণ নেই। আমি ভাবলাম, বন্ধুটি হয়তো খানিকটা বিরতি নেয়ার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছে; চা বা কফি পান করবে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “নদী আর কত দূর?”
ও বললো, “এইতো নদী।”
“কোথায়?”
ও এবার ক্ষীনাঙ্গিণীর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, “এইতো।”
তৃতীয়বার আষাঢ়ের মেঘ ডেকে আনার ইচ্ছে হল না বলে আমি আর ওকে মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে বললাম, “এমন তরো ক্ষীনাঙ্গিণী জলধরা আমাদের দেশে নদী পদবাচ্যের উপযুক্ত নয়। খাল বলা যেতে পারে তাকে। বাংলাদেশের বিশাল বক্ষা, দুরন্ত বয়ে চলা নদীগুলো যদি তুমি একবার দেখতে তবে জানতে নদী কাকে বলে।” ওকে একবার আমাদের পদ্মা, মেঘনা, তেতুলিয়া, পায়রা, আগুনমুখা নদীগুলো দেখাবার খুব ইচ্ছে হলো। বুক জুড়ে উত্তাল ঢেউ নিয়ে কি দুরন্ত ছুটে চলা তাদের!
(আমি দুঃখিত এখন বুভুক্ষ নদী খেকোরা আর তার দোসররা বাংলাদেশের অনেক নদীর দু’পাড় ভরাট করে ওদের দিনে-দুপুরে গলা টিপে হত্যা করছে।)
নদী দেখতে আসা আরো অনেকের মত আমরা দু’জন ভাড়া করা একটি ফাইবার গ্লাসের নৌকা করে নদীটার নির্জীব বুকে কিছুক্ষণ ঘুর বেড়ালাম। ফিরে আসার পাথে আমার বন্ধু জিঞ্জেস করলো, “কেমন দেখলে নদী?”
কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। অপ্রিয় সত্য কথা এবার আর নাই বা বললাম।
—
ফারুক হাসান একজন পর্যটন পরামর্শক, পর্যটক, লেখক ও গবেষক।
রেজাউল হক হেলাল
বিশ হাজার গ্রাম নিয়ে সৌদি আরবের জিজান প্রদেশ। দিগন্ত জুড়ে হাজার বছরের প্রকৃতির নিরবতা। প্রায় আট হাজার বছরের প্রাচীন আরব বসতি জিজান। মানব সভ্যতার উত্থান-পতনের দীর্ঘ ইতিহাস আর কিংবদন্তি ভরা এক মরু আঞ্চল। সীমান্তের ওপারে খুব কাছে ইয়েমেন ঐতিহাসিক সানা নগরি। আমি সামতা শহরে বসে স্মৃতিচারণ লেখা শুরু করি।
২০১০ সালে প্রথমবার মক্কা থেকে সারা রাত গাড়ি চালিয়ে শিশির সিক্ত সোনালি প্রভাতে জিজান গিয়েছিলাম। ‘বছর আগেও এলাকাটি ছিল ইয়েমেনের একটি জেলা। লোহিত সাগরের কুল ঘেঁসে ইয়েমেন সীমান্তে ছোট প্রদেশ। দিগন্ত বিস্তৃত মরুর বুকে এক চিলতে সবুজের সমারোহ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ক্ষেত-খামারের সাথে জিজানের কিছুটা মিল আছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির উথান-পতনের কথা জ্ঞান পিপাসুদের অজানা থাকার কথা নয়। নূহের প্লাবনের দীর্ঘ নিরবতার পর পুনরায় মানব সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে। সেকালে আদ ,ইরাম এবং সামুদ জাতির দাপটে সারা বিশ্ব কেঁপে উঠত। তাদের সুউচ্চ স্মৃতি-সৌধ, দালান-কোঠা, অট্টালিকা তুফান আর ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। এখন নির্জন নির্বাক বালিয়াড়ি পাহাড়ি পরিবেশ। চারদিক যেনো এক মৃত্যুর বেলাভূমি। দূরে দূরে কিছু গ্রাম, কিছু সড়ক তৈরি হচ্ছে।২০১০ এবং ২০১৪ সালে সড়ক পথে আদ ও সামুদ জাতির ধ্বংস প্রাপ্ত এলাকা ভ্রমণ করেছি, ২০১৫ সালের ২২ মার্চ দামাম থেকে জেদ্দা হয়ে ফ্লাই নাস বিমানে জিজান গিয়াছি।
আরব মানচিত্রের রোবাল আল-খালী নামক বিশাল মরুভুমির বুকে এখন গড়ে উঠছে শোয়েবা নামক খনিজ সম্পদ ভিত্তিক একটি শিল্প নগরী। দুবাই ওমান ও ইয়েমেনের নিকটে শোয়েবা মরুভুমি। চারদিকে হাজার হাজার মাইল জনশূন্য। ইদানিং দুর্গম পাহাড়-বেলাভূমি কেটে কিছু রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। মরুভুমির নিচে লুকিয়ে থাকা খনিজ সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। খনন কালে পাওয়া গেছে আদ জাতীর লোকদের বিশাল বিশাল কঙ্কাল, ধ্বংস প্রাপ্ত ঘরবাড়ি। সাত রাত আট দিন সাইক্লোন চালিয়ে ইতিহাসের অন্যতম ক্ষমতাধর জাতিকে মহান আল্লাহ ধ্বংশ করেন। হুদ আঃ নামক সেকালের বিখ্যাত নবী চার হাজার অনুসারী নিয়ে একটি কৃষি খামারে নিরাপদে ছিলেন। অহংকারি নাস্তিকদের এই পতন কতো ভয়ংকর ছিল রোবাল আল খালীর সাহারা-বৈদ্যভুমি তার জ্বলন্ত সাক্ষি। আজো সেখানে গাছের শিকড় ওপরের দিকে, অজস্র বিরান কৃষি খামার, মৃত নদী, বিধ্বস্ত পাহাড় আর লাল বালুর নিচে ঢেকে আছে কতো প্রাচীন জনপদ। প্রায় আট হাজার পূর্বে ঘটে যাওয়া গজব কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। নাজরানের পশ্চিমে মরু আর সৈকতের মাঝে জিজান নগরী গড়ে উঠেছে। কাল্বি ও সুদ্দি রহঃ বলেছেনঃ সেকালে তাদের লম্বা লোকদের দৈর্ঘ্য ছিল ১০০ হাত এবং খাটো লোকদের দৈর্ঘ্য ছিল ৭০ হাত। তাদের একজনের মাথা ছিল একেকটি তাবুর মতো। আমিরাত, ওমান থেকে আভা-নাজরান-খামিস-জিজান, জিজান হয়ে লোহিত সাগরের তীর ঘেঁসে হিজাজ হয়ে ইরাকের সিমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আদ জাতির দেশ। জিজান এসেছিলাম বক্তিগত কাজে। এর ফাঁকে ফাঁকে এখানকার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন, মরুভূমি আর পাহাড়-সাগরের মিতালি, ক্ষেত-খামার, ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করে, লোকাল আরবদের সাথে মিশতে চেষ্টা করি এবং একটি আর্টিকেল লেখার ইচ্ছে জাগে।
জিজানি পুরুষদের কোমরে চাকু, মাথায় ফুলের মালা দেখে জানতে চাই-এশ হাজা ? এই ফুল এই তলোয়ার-চাকু আবহমান কাল ধরে চলে আসা আরব ইয়েমেন সংস্কৃতির অঙ্গ। ভাল কাজ করলে ওরা ফুল দেবে, মন্দ করলে তলোয়ার প্রস্তুত। এমন এক মরু বেদুঈন রাজ্যে এসেছি ঠিকেদারি তেজারত করতে। মোবাইল টাওয়ার দুর্বল থাকায় সবার সাথে যোগাযোগ কষ্টকর। বিশাল ভুট্টা ক্ষেত, গাড়ি থামিয়ে কাঠে পোড়া ভুট্টা খেলাম। কিছুটা দেশীয় আমেজ। কয়েক হাজার ইয়েমেনি এখন সৌদি আরবের নাগরিক। তাদের জন্য নতুন প্রজেক্ট- হাউজিংফর মাইগ্রেশন, পাওয়ার প্লান্ট, বিমান বন্দর, নৌবন্দর হাসপাতাল,সড়ক, পার্ক, স্কুল, সেনা নিবাস ইত্যাদি। আরব, চীন, কোরিয়া ও জাপানের কয়েক ডজন কোম্পানি ওসব মেঘা প্রজেক্টের ঠিকেদারি করছে। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-নেপালিরা শ্রমিক সরবরাহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এই অঞ্চলে জিজান সিটি, সাবিয়া, সামতা, বেইশ, দরব, শাকিক, লেইচ, হাবিল, হাকু, আজুমা, আভা, খামিস,সালামা,লায়লা সহ বহু গ্রাম-শহরে ঘুরেছি। বেইশ শহরের লেডিজ মার্কেটে একটি ছোট্ট চা দোকানে মহিলা দোকানি দেখে আমার সফর সঙ্গী আবু নাসের সোহাগ এগিয়ে যান এবং বলেন, ইয়া উখতি-আতিনি সাই, আরবি মহিলাকে বোন সম্বোধন করায় তিনি চায়ের সাথে জিলাফি ফ্রি দিয়েছিলেন। মনে হয় অন্যান্য আরব প্রভিঞ্চ-এর মতো জিজানিরা এতো অহংকারী ও ক্রিটিকাল নয়। তা ছাড়া বেদুঈন এখন আর বেদুঈন নাই। বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতা আর উন্নতির হাওয়া সর্বত্র। ওবামা নামক জিজান ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রের কম্পিউটার শপে দোস্তি হল। আরবি ভাষা প্রসঙ্গে আমাদের বিস্তর তর্ক হয়, সে দাবী করলো-আরবি ভাষা এক সমৃদ্ধ জীবন্ত ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কোরআন যখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয় তখন যে সকল ভাষায় সাহিত্য রচনা হতো তা ছিল মৃত। স্পেন চীন তুর্কি আফগান ভারত ইত্যাদি দেশে আরবি ভাষা ও লিপির ব্যাবহার ছিল। সেকালে পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্রের সংখ্যা তিরিশটি থাকলেও তাদের ভাষা ছিল অনেকটা হেঁয়ালির কুহেলিকা মোড়ানো। ভাব ভাষা ছন্দ এসব বজায় রেখে সাহিত্য রচনার সমৃদ্ধশালী প্রাচিন ভাষা হচ্ছে আরবি। ইসলামের প্রসার ও জনপ্রিয়তা আরবি ভাষাকে বিশ্বের আনাচে-কানাছে, দ্বীপ থেকে দীপান্তরে পৌছিয়ে দিয়েছে। পরে ছাত্রের সাথে জিজানিদের একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিটের সুযোগ পাই। আরব দেশের সেসব ভিন্ন রকম স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা আমার চিন্তার জগতে এখনো দোল খায়।
লোহিত সাগরের পূর্ব তীরে ছোট্ট শহর শাকিক। লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরে সুদান, মিশর, ইরিত্রিয়া। পড়ন্ত বিকেলে গিয়েছিলাম সমুদ্র স্নানে। আভা-খামিসের পাহাড়ি আরবি সৈকত বিলাসীদের ভিড়ে যেন হারিয়ে যাই। সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেও মেয়েদের সতভাগ পর্দা এবং শালীন পোশাক মুমিনের মন কাড়ে। আজানের সাথে সাথে সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য নামাজের বিরতি, এটা সরকারী নির্দেশ। উত্তাল তরঙ্গের তীরে সাপ্তাহিক মিলন মেলা উপভোগ করার মতো।বেইশ শহর থেকে ২৫ কিঃ পশ্চিমে লোহিত সাগরের তীরে চীন-কোরিয়ান-বাংলাদেশিরা মিনা পোর্ট,পাওয়ার প্লান্ট এবং কিং আব্দুল্লাহ সিটি নির্মাণের কাজ করছে। ওই এলাকার প্রাচীন বেদুঈন বশতি গুলো ইদানিং সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
জিজানের সব শহরে লেডিজ মার্কেট , লেডিজ ব্যাংকিং এবং মহিলাদের জন্য মসজিদের ব্যবস্থা রয়েছে। জিজানের সাংস্কৃতিক ও নাগরিক জীবনে ইসলামি ভাবধারা লক্ষণীয়। মেয়েরা পর্দার সাথে কৃষি ফার্মে, স্কুল-কলেজ, বাজারে যাচ্ছে, মসজিদে যাচ্ছে, সাপ্তাহিক বাজারে ও মেলায় যাচ্ছে, উট-গাধায় চড়েও কাজে যাচ্ছে- কোন ইভতিজিং নাই। অশ্লীল বা বে-আব্রু পোশাকের মেয়ে যে দেশে যত বেশী, সে দেশে ততবেশি ইভতিজিং ও নারী নির্যাতন হয়। ক্ষুদ্র জীবনে পৃথিবীর চৌদ্দটি দেশ ভ্রমণ করে এই মন্তব্য করছি। জিজানের প্রত্যেক এলাকায় ইসলামী শরিয়া কাউন্সিল আছে, সরকারী ভাবে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র আছে। একটি সুখি জাতি বলতে জা বুঝায়, তার সবকিছু বিদ্যমান। জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রায় তিরিশ হাজার বাংলাদেশী জিজানে অবস্থান করছে। মুল শহরে সুদান, মিশর, ইরিত্রিয়া বাংলাদেশ ও ইন্দিয়ানদের হাইস্কুল রয়েছে। জিজানের ক্ষেত খামার, আম ও বিশাল কলা বাগান দেখে বাংলাদেশের সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা মনে পড়ে।
প্রয়াত বাদশাহ আব্দুল্লাহর নানাবাড়ি জিজান, তাঁর নামে প্রদেশ জুড়ে অনেক সড়ক ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, সুদান, সোমালিয়া জিজান থেকে কাছে। তাই এই পথে সৌদি আরবে কালো লোকদের অনুপ্রবেশ ঘটে। জিজানের পাহাড়, শুকনো নদী আর ধু-ধু মরুভূমি দেখে কেবল অতীতের ইতিহাস হাতড়ে বেড়াই। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সঃ এর স্মৃতিধন্য জিজান হাজার বছর ধরে ইয়েমেনের অংশ ছিল। সেকালে মুয়াজ বিন জাবাল নামক একজন সাহাবাকে ইয়েমেনের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে মদিনা থেকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি এতই জনপ্রিয় শাসক ছিলেন, আজো তার নামে ইয়েমেন জুড়ে স্কুল, সড়ক, এভিনিউ রয়েছে। অনেক সাহাবি সানা, এডেন, হাজারাল মাউত,হাবাশা ভ্রমণকালে জিজানে যাত্রা বিরতি করেছিলেন।
জিজান থেকে দামাম ফিরবো বলে কিং আব্দুল্লাহ বিমান বন্দরে যাই। পরিস্থিতি সব বদলে গেছে। চারদিকে কেবল যুদ্ধের আতংক। লোকেরা বলাবলি করছে- সৌদি সরকারের নেতৃতে ইসরাইলে হামলা না করে একটি মুসলিম দেশের নিরীহ লোকদের নির্মম ভাবে বিমান হামলা করছে, আসলে কি হচ্ছে ইয়েমেনে?
মাত্র ২% শিয়া মুসলিম ইয়েমেন দখল করতে পারে? প্রেসিডেন্ট হাদি পালাবে কেন? সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রির ইস্যু সৃষ্টি করা? ইরানকে ক্ষেপীয়ে যুদ্ধে নামিয়ে দুর্বল করে ইসরায়েলকে চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্র? পশ্চিমা মিডিয়া যেসব খবর প্রচার করছে তা কি সঠিক? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য মার্কিনদের তাড়াহুড়া না-কি ? পর্দার আড়ালে কে কার স্বার্থ নিয়ে খেলছে- হলুদ সাংবাদিকতার কারণে জনতা এখন ধুম্রজালে। বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অভিযোগ বাড়ছে ? রাষ্ট্র মানে মগ আর পিগমির উল্লাস ? মাইট ইজ রাইট বা ডিভাইটেড এন্ড রুল- এসব নষ্ট সুত্র ছেড়ে বিশ্বমোড়লগণশান্ত হতে চান ?ট্যাক্সি চালক সহ যাত্রীরা নানা মন্তব্য করেন। আরব আমিরাতে হিন্দু মন্দির স্থাপিত হল সে ব্যপারে সৌদি আরব নীরব, দুর্বল দেশ ইয়েমেনে শিয়া বিদ্রোহীদমন ইসলাম রক্ষার একশান হলে সাউদিকে সাধুবাদ জানাই। আমি প্রবাসী বা আজনবি, আমরা নিরব দর্শক মাত্র। ইয়েমেনে হামলার কারণে সাউথের আভা, নাজরান ও জিজান এই তিনটি বিমানবন্দর সাধারণ যাত্রী চলাচল বন্ধ। রিটার্ন টিকেটের রিয়াল ফেরত পাই। ট্যাক্সি নিয়ে পাহাড়ি শহর আভা আসতে হল।
আমরা যখন পাহাড়ি রাস্তা ধরে মেঘের কাছাকাছি গেলাম, সেই ভেজা ভেজা সন্ধ্যা ছিল চমৎকার। অন্য রকম এক সৌদি আরব দেখলাম। দার্জিলিং বা নেপালের কাঠমান্ডুর পাহাড়ি সড়ক থেকেও আভার পাহাড়ি সড়ক ভয়ংকর। পাহাড়ের ওপরের ব্রিজ গুলো মোহনীয় ভঙ্গিতে তৈরি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো পর্যটকদের যেন ব্যকুল করে তোলে। খামিস শহরে নেমে ভগ্নিপতি নিজাম উদ্দিনকে পাই। খামিসের মুসা নামক স্থানে একরাত আরাম করি। সাপকোবাসে আবার দুই হাজার কিঃ মিঃ ভ্রমণ শুরু করি। পথে রিয়াদে আমিন আলীর বাসায় একরাত যাত্রা বিরতি। সৌদি আরব ভূখণ্ডের পাঁচভাগও ব্যাবহারের আওতায় আসেনি। হাজারো মাইল জনমানব শুন্য নির্জনতায় পড়ে রয়েছে। তবুও তারা নাগরিকত্ব দিচ্ছেনা। কোথাও এক টুকরো জমির জন্য রক্তারক্তি, কোথাও হাজারো মাইল অনাবাদি। সুন্দর এই পৃথিবীর সৃষ্টি, ইতিহাস এবং পরিণতি যেন রহস্যে ভরপুর। অনন্তকাল স্রোতের মধ্যে বুদবুদের মতো মানুষের জীবন, অবিরত ফুটছে আর ঝরছে, দুনিয়ার খেলাঘরে কয়টি মুহূর্ত কাটিয়ে দেয়ার জন্য কি তার আয়োজন, আর নিজের শক্তির পরিচয়ে কি তার আনন্দ। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ট্যুরিজমের কথা বলেছেন-সিরু ফিল আরদ, উঞ্জুর , কাইফা কানা আকিবাতুল মুকাজ্জিবিন। অর্থাৎ পৃথিবী ভ্রমণ কর, যুগে যুগে মিথ্যুকদের কি পরিণতি হয়েছিলো দেখতে পাবে।
লেখকঃ সৌদি আরব প্রবাসী সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট
অপরূপা প্রাগ
দেবাশিষ সরকার
মধ্য ইউরোপে বেড়ানোর একটা অসাধারণ জায়গা হচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ। বর্তমানে দেশটি ‘চেকিয়া’ নামেও পরিচিত। এদেশে প্রায় দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষের বসবাস। ভলতাভা নদীর শহর প্রাগ। ভ্রমণ-পিপাসুরা একবারের জন্য হলেও প্রাগের অসাধারণ সব গল্প শুনেছেন। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল যে প্রাগ বেড়াতে যাবো। হঠাৎ একদিন বাসের টিকেট কেটেই ফেললাম। একা একাই বেড়াতে গেলাম। বাসে যাতায়াতের জন্য অনেক লম্বা সময় লাগে ভ্রমণ করতে, কিন্তু খরচের কথা চিন্তা করে চলেই গেলাম।
ব্রাসেলসের গার্ড দু নর্ড রেল স্টেশনের পাশেই ইউরো লাইনস এর বাস স্টেশন। যাই হোক, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের পথ পেরিয়ে খুব ভোরে গিয়ে নামলাম প্রাগের বাস স্টেশনে। ওইসময় এক ধরণের শিহরণ কাজ করছিলো। সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে রঙিন প্রাগকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা সত্যিই ভোলার নয়।
তারপর ট্রামে করে চলে গেলাম শহরে। তখনও অনেকটাই সকাল আর প্রচণ্ড শীত। ভলতাভা নদীর পাশে বসার জায়গায় মাথার নিচে ট্রাভেল ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম। ভলতাভা নদীর দুই পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আপনি প্রাগের অনেক সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারবেন। আমি হেঁটে হেঁটে বেড়াতে লাগলাম।
১৪ শতকের বিখ্যাত চার্লস ব্রিজ হচ্ছে প্রাগের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। সম্রাট চতুর্থ চার্লস ১৩৫৭ সালে এই ব্রিজ উদ্বোধন করেন যা তার নাম অনুসরণ করেই আজকে চার্লস ব্রিজ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যান যার বেশিরভাগই পর্যটক। এত মানুষ ব্রিজের উপর বেড়াতে যায় যে আপনাকে একরকম ঠেলাঠেলি করেই এগিয়ে যেতে হয়। ব্রিজের উপর ভাস্কর্য্গুলোর কারুকার্য দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে। এই ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আপনি শত শত বছরের ইতিহাসের নিদর্শন দেখে যেতে পারবেন।
চার্লস ব্রিজের উপর ‘ব্রিজ ব্যান্ড’ নামে গানের দল আপন মনে গান-বাজনা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছে আবার ওদের গানের রেকর্ডারও বিক্রি করছে। তাছাড়া ব্রিজের উপর অনেক চিত্রশিল্পী কাজ করে। তারা হবুহু মানুষের ছবি এঁকে দিচ্ছে। মানুষজনকে শুধু কিছু সময় ওদের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে হয়। ব্রিজের একপাশে উঁচু পাহাড়ে ঘরবাড়ি দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগে।
ডানসিং বিল্ডিং হচ্ছে আরেকটা দর্শনীয় স্থান। এই বিল্ডিং এর দিকে তাকালে মনে হবে যেন নাচানাচি করছে। আসলে এটা একটা রেঁস্তুরা। এখানে আসলে সবাই একটা ছবি তুলতে ভুলে না। আমিও ভুল করিনি। প্রাগে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল বা জ্যোতির্বিদ্যার ঘড়ি দেখতে ভিড় লেগে যায়। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি পুরনো টাউন হলে টাওয়ারে দেখতে পাওয়া যাবে। ১৫ শতকের স্মৃতি নিয়ে এই ঘড়ি আজ অব্দি চালু আছে। তাছাড়া আপনি প্রাগ কাসল দেখে আসতে পারেন। প্রাগ কাসল দেখতে অসাধারণ লাগে।
নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি উইশ ওয়াল বা ইচ্ছে দেয়াল। এ দেয়ালে সবাই যার যার মনের কথা লিখে আসে এই বিশ্বাসে যে সেটা সে পাবে। আমি অনেক ভেবেও বুঝতে পারলাম না কি চাইবো। তাই বাবার আদর করে দেওয়া নিজের নামই লিখে আসলাম। সাথে ছবিও তুলে আনলাম যাতে পরে কেউ বেড়াতে গেলে বলতে পারি সে কথা।
প্রাগের সুন্দর সুন্দর বিল্ডিঙের সরু গলিগুলোতে দেখলাম পর্যটকরা আনন্দে হাঁটাহাঁটি করছে। বিল্ডিং এর আশপাশে অনেক সরু রাস্তা যেন পুরান ঢাকার গলি। ওইসব পথ দিয়ে হেঁটে যেতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। বেড়ানোর দিন খোলা বাজার বসেছিল প্রাগ শহরে। ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম ওদের লোকাল কৃষি পণ্য। ফিশ বা মাছ রেস্তুরা আছে চার্লস ব্রিজের পাশেই। ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিতে পারেন।
অনেক মডার্ন আর্ট চোখে পড়ে রাস্তার পাশে। কাঠের তৈরি অথবা স্টিলের তৈরি অনেক ভাস্কর্য, আর্ট আপনার মন কেড়ে নিবে। হঠাৎ রাস্তায় দেখি রিকশা। প্রাগে রিকশার দেখা পাব ভাবিনি। দেখেই ঢাকা শহরের কথা মনে পড়ে গেল। দিনের বেলার প্রাগের কথা যত না শুনেছি, রাতের বেলার প্রাগের কথা তার চেয়ে বেশি শুনেছি। রাতে প্রাগকে নাকি অদ্ভুত সুন্দর লাগে। সত্যিই সুন্দর রাতের দেখা পেলাম প্রাগে। রাতের অন্ধকারে চার্লস ব্রিজের সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে যায়। ব্রিজের বাতিগুলোর আলো নদীর পানিতে যেন আনন্দের মূর্ছনা ফেলে। নদীর পাশে বসে এককাপ কফি না খেলে কি আর চলে?
ফেরত আসার সময় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি তখন বাসে ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ পুলিশ এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে পাসপোর্ট নিয়ে গেলো একটু পর ফেরত দেওয়ার কথা বলে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পাশের যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদেরটাও নিয়ে নিয়েছে। এইরকম অবস্থায় মধ্যরাতে হঠাৎ অচেনা এক জায়গায় পুলিশের পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়াটা আমার জন্য ভনায়ক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ পর পুলিশ ‘দুঃখিত’ বলে হাসিমুখে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আপনি না চাইলে প্রাগ আপনাকে ছাড়বে না। আমাকেও ছাড়েনি। আবার শান্তির ঘুম দিয়ে নিলাম। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও চোখে ভাসছিলো প্রাগের উজ্জ্বলতা।
লেখক পরিচিতি:
দেবাশিস সরকার একজন লেখক ও গবেষক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ এবং এমবিএ করেছেন। তারপর বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোফিন্যান্স উপর মাস্টার্স করেছেন। পরবর্তীতে বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অফ মন্স থেকে গবেষণার উপর ডিগ্রী নিয়েছেন। তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয় সহ আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণাপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে লিপ্ত আছেন। চাকরিজীবনে তিনি বাংলাদেশ ও জার্মানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। তিনি দেশে বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন পত্রিকায় লেখালেখি করেন। তিনি ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। পড়াশুনা, চাকরি আর ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণে তার ৫ টি মহাদেশের অনেক দেশ বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে। তার ভ্রমণ গল্পগুলো নফহবংি২৪.পড়স এ নিয়মিত প্রকাশিত হত। তিনি তার ভ্রমণগল্পের সম্মানিত পাঠকগণের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা এবং উৎসাহ পেয়েছেন।
যাই মধু আহরণে
মুস্তাফিজ মামুন
যাই মধু আহরণে
এবার সুন্দরবনে ১ এপ্রিল থেকে মধু সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে, চলবে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত
গ্রামে ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যায় বাজারে গেলাম। কড়াইয়ে গরম মিষ্টি দেখে হানা লোভ সামলাতে পারছিল না। দুজনে প্রথমে একটি করে ছানার জিলাপি খেলাম। হানা পরে আরো তিনটি খেয়েছিল। হানাও সাংবাদিক। চেক প্রজাতন্ত্রে তার বাড়ি।
বুড়িগোয়ালিনীতে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আমরা লঞ্চে ফিরলাম। এখানে অনেক মশা। সাফসুতরো হয়ে ওডোমস মেখে বসে রইলাম। রাতের খাবারও খেয়ে নিলাম আগেভাগেই। বেঙ্গল ট্যুরসের লঞ্চে করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সদর কার্যালয় বুড়িগোয়ালিনীতে এসেছি আমরা খুলনা থেকে।
লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দে ঘুম ভাঙল। জেগে দেখি, চলতে শুরু করেছে। চালকের নাম সঞ্জয়। জানাল, সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছি। নদীটার নাম চুনা। ঢাকা থেকে রাতের বাসে দলের অন্যরা ওখানে আসবে। মুন্সীগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। লঞ্চ থামল বন কার্যালয়ের সামনে। গিয়ে দেখি দল হাজির। বিটু ভাই ও সালমানকে দেখলাম আগে। সবাইকে লঞ্চে তুলে আবার চললাম বুড়িগোয়ালিনী। পৌঁছে দেখি, মৌয়ালরা আটঘাট বাঁধছে। জানাল, আরো ঘণ্টা দুই লাগবে।
বছর কয় আগে প্রথম যখন মধু সংগ্রহ দেখতে গিয়েছিলাম সুন্দরবন, চমৎকার একটি উৎসব হতো তখন- সবাই মিলে প্রার্থনায় বসত, বন কর্মকর্তা বন্দুক হাতে দাঁড়াতেন জেটিতে, নৌকাগুলো বাঁধা থাকত পর পর। আনুষ্ঠানিকতা শেষে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়তেন কর্মকর্তা আর মৌয়ালরা জোর বৈঠা চালিয়ে ছুটে যেতেন বনে।
এখন আর তেমন হয় না। বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মীরা পট গানের মধ্য দিয়ে সচেতনতামূলক তথ্য দিল মৌয়ালদের। তারপর বনে চললাম। ঢালী চাচা আমাদের লঞ্চের সঙ্গে তাঁর নৌকাটি বেঁধে নিলেন। ঢালী চাচার মধু সংগ্রহের অভিজ্ঞতা ষাট বছরের। ডিসকভারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে।
খোলপেটুয়া নদী ধরে ঘণ্টাখানেক চলার পর ঢুকলাম ছোট্ট একটি খালে। নাম বুড়ির খাল। লঞ্চ নোঙর ফেলল। ঢালী চাচার দলের সঙ্গে আমরাও নৌকায় উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ চলার পর জঙ্গল শুরু হলো। মৌয়ালরা গেল চাক খুঁজতে, আমরা রইলাম বন প্রহরীদের সঙ্গে।
মিনিট দশেক পর আওয়াজ পেলাম ‘আল্লাহ আল্লাহ বলো রে’। ঢালী চাচার ছেলে মনিরুল দৌড়ে এলো- স্যার চাক পাওয়া গ্যাছে, ম্যালা বড়, পাঁচ কেজি মুধু হইব। আমরা চললাম মনিরুলের সঙ্গে।
মৌয়ালদের একজন টাইগার ফার্ন কেটে মশালের মতো তৈরি করলেন। এর ধোঁয়া দিয়ে চাক থেকে মৌমাছি তাড়ানো হয়। আমাদেরও মশারির জাল দিয়ে তৈরি মুখোশ দেওয়া হলো। মশালে আগুন দেওয়া হয়েছে, ধোঁয়া বের হচ্ছে।
মনিরুল মশাল নিয়ে উঠে গেল গাছে। মৌমাছিরা বেশি বেগড়বাই করল না, রণে ভঙ্গ দিল অল্প সময়েই। অভিযান সফল হলো। চাক কেটে ধামায় ভরে নিলেন মৌয়ালরা। জঙ্গলেই খাওয়া হয়ে গেল পুরোটা মধু।
একটু জিরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় চাকের খোঁজে গেল মৌয়ালরা। আমরা নৌকায় অপেক্ষায় থাকলাম। এবারও কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক এলো। গেলাম চাকের গাছে। কিন্তু ঢালী চাচা চাক না কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ আগেই চোরা শিকারিরা এক দফা ছুরি চালিয়েছে। সবাইকে চাক থেকে দূরে থাকতে বললেন চাচা। জানালেন, কাটা চাকের মৌমাছিরা খুব হিংস্র হয়। কিন্তু এত বড় চাক দেখে আমি আর সালমান ছবি তোলার লোভ সামলাতে পালাম না। ভালো কয়েকটা ছবিও তুললাম। হঠাৎ ভন ভন শব্দ! তাকিয়ে দেখি, পুরো চাক হামলে পড়েছে সালমানের ওপর। আমার মুখোশ ছিল। তার পরও হাতমোজার ওপর দিয়ে সমানে কামড়াচ্ছিল। সালমানের হাতমোজা নেই, মুখোশও নেই।
চিৎকার শুনে বেঙ্গল ট্যুরসের কর্মী সোহাগ সারা গায়ে কাদা মাটি মেখে দৌড়ে এলো। জড়িয়ে ধরল সালমানকে। নিয়ে তুলল নৌকায়। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নিতে হবে। জঙ্গল ছেড়ে সবাই গিয়ে লঞ্চে উঠলাম। সোজা গেলাম বুড়িগোয়ালিনী বিজিবি হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার সালমানকে ছেড়ে দিলেন দুপুরে। খাবার খেয়ে সবাই গেলাম বিশ্রামে।
দুপুরের পর আবারও চাক কাটতে বের হলাম। সালমান নাছোড়বান্দা। বারণ সত্ত্বেও সঙ্গে চলল। এ যাত্রায় বেশ কয়েকটি চাক কাটা হলো। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম লঞ্চে। রাতে নোঙর ফেলা হলো কলাগাছিয়া অভয়ারণ্যের সামনে।
পরদিন খুব ভোরে আবারও জঙ্গলে গেলাম। তবে এবার চাক কাটতে নয়, বন দেখতে। কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে নেমে কাঠের ট্রেইল ধরে হাঁটলাম ঘণ্টাখানেক। বন মোরগ এত কাছে পেয়েও ছবি তুলতে না পেরে আফসোস করলাম! বেশ কিছু বানর, চিত্রা হরিণও দেখলাম এখানে।
সমুদ্রের আহবানে হেঁটে হেঁটে হেঁটে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার
জিল্লুর রহমান খন্দকার
ভদ্রলোকের নাম সুজাউদ্দিন এফ. সোহান পেশায় একজন দন্ত চিকিৎসক। সদ্য ইন্টার্ন শেষ করে বেরিয়েছেন, বিগত চার বছর যাবৎ উনি একটি অভিনব ট্রিপের আয়োজন করে থাকেন ভ্রমণবিলাসী অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের জন্য। আর সেটা হচ্ছে, সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার বাজার পর্যন্ত যাওয়া। ফেসবুকের মাধ্যমে তার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিগত চার বছর যাবৎ আমি এই অভিনব এবং আকর্ষণীয় ট্রিপে যাবার জন্য চেষ্টা করছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সময় সুযোগ কখনোই মেলাতে পারছিলাম না উনার পরিকল্পনার সাথে। আর উনি এটা সারাবছর করেন না বছরে শুধুমাত্র দুইবার এই আয়োজন করেন ডিসেম্বরে একবার জানুয়ারিতে একবার।
এবার অক্টোবর মাসেই উনার পরিকল্পনার কথা জানতে পারলাম এবং আমি নিজের মনস্থির করে নিলাম যে এবার আমি যাবো ইনশাআল্লাহ্। সবার আগে আমি সারা দিলাম তার প্রস্তাবনায় এবং আমার যারা কাছের বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। সবাই প্রায় আঁতকে ওঠে বলল, তুই কি পাগল? টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যাবি? এটা অসম্ভব, এটা স্বাভাবিক মানুষের কোন কাজ নয়। আমিও জানি এটা একমাত্র পাগলামি ছাড়া কিছুই না আর এজন্য পাগল হতে হবে।
যাই হোক অবশেষে একজন পাগল বন্ধুকে সঙ্গী হিসেবে পেলাম। সে আমার অত্যন্ত ছোটবেলার বাল্যবন্ধু সিলেটে বসবাসরত নুরুল মামুন মনি। দুই মাস মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেলাম পাশাপাশি একটু শারীরিক কসরত করারও সুযোগ পেলাম। যাতে হুট করে আমরা কোন প্রকার বিপদে না পড়ে যাই। কারণ প্রতিদিন গড়ে ২০ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হবে এ ধরনের পূর্বঅভিজ্ঞতা আমার কোনো কালেই ছিল না। এমনিতে আমি হাঁটাহাঁটি করি প্রায় প্রতিদিন, তবে সেটা ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার কিন্তু এরকম করে আমার কখনোই হয়ে ওঠেনি আগামীতে হবে কিনা আমার জানা নেই।
অনেক আলোচনা করে ফেললাম, এবার আসি মূল পর্বে যথারীতি দিনক্ষণ ঘনিয়ে এলো এবং পারিবারিক কিছু সীমাবদ্ধতাও সামনে চলে এলো। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল আমার মনে হয় আর যাওয়া হবে না। তারপরেও আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানীতে এবং আমার সহধর্মিণীর উৎসাহে আমার যাওয়ার সুযোগটা প্রস্তুত হয় এবং আল্লাহর রহমত আমি রওনা দিতে সক্ষম হই। আমাদের গাড়িটি রিজার্ভ নেওয়া হয়েছিল তার কারণ এবারই সর্বোচ্চ সংখ্যক অংশগ্রহণকারীর অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল আমাদের এই মিলন মেলাটা। সাধারণত ৩০ জনের বেশি সোহান ভাই নেন না, তার কারণ ম্যানেজ করতে সমস্যা হয় কিন্তু এবার প্রচুর আগ্রহী ভ্রমণিপাসুদের কাছে উনি হার মানতে বাধ্য হন এবং সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে সেটা ৫০ জনে উত্তীর্ণ হয়।
রওনা দিলাম রাত এগারোটায় অথচ গাড়ি নয়টায় আসার কথা ছিল। জ্যামের কারণে দেরি হয়ে গেছে আমাদের, টেকনাফে আমরা পৌঁছাই বেলা সাড়ে ১২ টায়। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে টেকনাফ শহর থেকে আমরা চলে গেলাম টেকনাফ সী বিচ পয়েন্টে। সেখানে আমাদের সবাইকে গ্রুপ ভিত্তিক ভাগ করে দেওয়া হল। আমরা তিনটা গ্রুপে বিভক্ত হলাম লাল, হলুদ, সবুজ, আমার অবস্থান ছিল হলুদ গ্রুপে এবং আমাদের গ্রুপের মাসুম ভাই সেখানে আমাদের করণীয় কি কি তা বুঝিয়ে দিলেন এবং আজকে আমাদের গন্তব্য কতদূর সেটা জানিয়ে দিলেন। এরপর শুরু হল অফিশিয়াল ফটোসেশন। ফটোসেশনের পর্ব শেষ করে আমাদেরকে বলে দেওয়া হল আজকে আমাদের যেতে হবে কচ্ছপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। প্রথমদিন এর সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমরা রওনা দিলাম দুপুর ২ টা ৩০ মিনিটে, আজকে নাকি ১৫ কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হবে।
বিসমিল্লাহ বলে হাঁটা শুরু করলাম, একপাশে সমুদ্রের সৌন্দর্য আর আরেক পাশে পাহাড়, দারুণ লাগছিল আমাদের। নানারকম গল্প করতে করতে আমরা সকলে এগিয়ে চললাম তবে সবার হাঁটার গতি একরকম ছিল না, তাই আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়লাম। এরমধ্যে আমার বন্ধু কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লো পা নাড়াতে পারছিল না। ওর জন্য কিছুটা সময় নষ্ট হলো, তবে আল্লাহর রহমতে ও দ্রুত হাঁটার ক্ষমতা ফিরে পায়। জীবনে প্রথম সমুদ্রকে অত্যন্ত কোলাহলমুক্ত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। সমুদ্র যেন তার সৌন্দর্যের পসরা আমাদের জন্য বিছিয়ে অপেক্ষায় ছিল, সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করতে থাকলাম। বিশাল বিশাল ঢেউ আর প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা হাওয়ায় মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। হাটার কোন ক্লান্তি অনুভব আমরা করছিলাম না। আমরা দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে হেঁটে আসছিলাম এবং বাতাসটা উত্তর দিক থেকে বইছিল, সে এক প্রাণ জুড়ানো অভিজ্ঞতা। বাম পাশে বিশাল সমুদ্রের হাতছানি বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্র তটে আর আমাদের ডান পাশে ছিল ঝাউবন এবং পাহাড় পরিবেষ্টিত টেকনাফের সৌন্দর্য।
কখন যে সন্ধ্যা হয়ে এলো টেরই পাইনি, সব আলো যেন আজকের জন্য নিভিয়ে দিল প্রকৃতি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা দুজন হেঁটে চলেছি, একটা পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম যে সবাই আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে শুধু পেছনে পড়ে রয়েছি আমি আর আমার বন্ধু মনি। নির্জন সমুদ্রের পাড়ে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। অন্ধকারে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল একটু ভয়ও কাজ করছিল, তাই আমরা বিচ সংলগ্ন মেরিন-ড্রাইভ-রোড এ উঠে পড়লাম। অন্ধকার ঘুটঘুটে পরিবেশে তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। টর্চের সাহায্যে রাতের অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছিলাম।
রাতের অন্ধকারে অনেকক্ষন হাটার পর স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তারা জানালো আমরা দুই কিলোমিটার বেশি এগিয়ে গেছি। স্থানীয় এক চায়ের স্টলের মালিকের সহযোগিতায় আমরা আমাদের গন্তব্য স্থল কচ্ছপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় উপস্থিত হলাম অটোরিক্সাতে করে। সেখানে যখন পৌছালাম, পৌঁছে আমরা দুজনে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের দলের লোকেরা এত সুন্দর আয়োজন করে রেখেছেন আমাদের জন্য, আগে থেকে আমরা ভাবতে পারিনি। পুরো স্কুলের মাঠে জুড়ে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে সারি সারি তাবুগুলো। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা তাঁবুতে প্রবেশ করলাম। এবার ফ্রেস হবার পালা, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম এবং মোবাইলগুলো চার্জে লাগালাম যেহেতু আগামীকাল বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে কিনা তা সঠিক জানা নেই। এবার রাতের খাবারের ডাক পড়লো, খাবারের আয়োজন অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে করা তবে পরিবেশনা এবং উপস্থাপনা অভিনবত্বের ছোঁয়া রয়েছে, আর সেটা হচ্ছে স্থানীয় একটি রিকশার গ্যারেজ। খুব সুন্দর করে টেবিল চেয়ার বসানো হয়েছে এবং সামুদ্রিক মাছের নামটা মনে করতে পারছিনা সামুদ্রিক মাছের ঝোল এত অমৃতের মত লাগলো। পেট ভরে খেলাম কারণ অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে টার্গেট ছিল ১৫ কিলোমিটার আমরা মনে হয় প্রায় ১৭ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে চলে এলাম আমরা স্কুল প্রাঙ্গণে সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। আড্ডা পর্ব শেষে যে যার মত ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আমার মনে পড়ে না আমি সর্বশেষ কবে এত আগে ঘুমিয়েছিলাম। আমি ঠিক সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে গেলাম, ঘুমাবো না কেন? কারন আমরা ডিজিটাল লাইফ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ইউটিউব এগুলো না থাকলে মনে হয় আমি দুনিয়ার বাইরে চলে এসেছি। আমার আর কোন কাজ নেই, ঠিক তেমনটিই হয়েছে যেহেতু এলাকাটা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশে এবং সরকারি নির্দেশে সন্ধ্যা ৬ টার পরে নেটওয়ার্ক তেমন থাকে না, সেই কারণে কোন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না শুধু কথা বলার জন্য সামান্য নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল। কথা বলার বাইরে আমাদের আর কোন কাজ না থাকার কারণেই আমরা সবাই যে যার মত সেই পুরনো দিনে চলে গেলাম, মানে আগে আগে ঘুমিয়ে পরলাম।
এত সুন্দর একটি ঘুম হল ক্লান্তির কারনে হবে হয়তো, উঠলাম সকাল সাড়ে ছটায়। সকালে উঠেই কিছুটা অবাক হওয়ার পালা তার কারণ গতকাল রাতে আমরা যখন এখানে এসেছিলাম তখন ছিল ঘোর অন্ধকার তাই এলাকাটা ভালোভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি। সকালের আলোতে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না, সামনে সমুদ্র আর পেছনে বিশাল পাহাড়ের হাতছানি এর মাঝে শান্ত পরিবেশে অবস্থিত আমাদের ক্যাম্পিং সাইট কচ্ছপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। এত সুন্দর একটা পরিবেশ হতে পারে একটি স্কুলের আমার পূর্বে ধারণা ছিল না। সাধারণ সুন্দর সকালটা আসলেই অসাধারণ হয়ে উঠলো। যাক এবার ফ্রেস হলাম, যথারীতি আবার আগের স্থানে নাস্তা করলাম। নাস্তা শেষে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে, আজকে আমাদের যেতে হবে শাপলাপুর নামার বাজার এর কাছাকাছি শাপলাপুর বাজার মসজিদ। দূরত্ব ২২ কিলোমিটার মত হবে সুতরাং আর দেরী করলাম না রওনা দিলাম আবার দ্বিতীয় দিনের মতো হাঁটা শুরু করলাম।
সমুদ্রের গর্জন একাধারে বয়ে চলছিল কানের মধ্যে শব্দটা যেন সেট হয়ে গেছে, গর্জন না শুনলে যেন ভালই লাগছিল না, অসাধারণ একটা অনুভূতি। সকালের তীব্র বাতাস আর রোদের প্রখরতা দুটোর দুটোর কম্বিনেশন ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার কাছে নেই। শীতের সকালের গা হিম করে দেওয়া বাতাস মনটাকে উদাস করে দিচ্ছিল পাশাপাশি হাঁটাহাঁটি করার যে শারীরিক ক্লান্তি সেটা সুন্দরভাবে দূর করে দিচ্ছিল। সর্বদা আমরা নিজেদের ক্লান্তিহীন অনুভব করছিলাম। আমরা দুজন আবার গতকালকের মতন গল্প করতে করতে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সুন্দর সুন্দর লোকেশন গুলোতে ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম। স্মৃতি ধারণ করার চেষ্টা করছিলাম কারণ জানি এই সময়টা এবং এই সুযোগটা জীবনে দ্বিতীয়বার হয়তোবা আর পাব না। এক ঘন্টা পর পর আমরা নিজেরাই পাঁচ মিনিট দশ মিনিট করে বিরতি নিয়েছিলাম যাতে কোন প্রকার ক্লান্তি আমাদের গায়ে ভর না করে। এলাকার সৌন্দর্য, জেলেদের মাছ ধরার কিছু বিষয় যেটা আসলেই আমার আগে কখনো দেখা হয়নি। এইমাত্র মাছ ধরে আনা হয়েছে সেই রকম নৌকার কাছে গিয়ে দেখলাম, তারা কিভাবে মাছ বাছাই করছেন। এখানে চলার পথে যেতে যেতে অনেক জেলে পরিবারকে কাছ থেকে দেখার নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। দেখলাম তাদের জীবনযাত্রা, দেখলাম তাদের কর্মকাণ্ড। কিভাবে তারা মাছ সমুদ্র থেকে ধরে এনে সেগুলোকে বাছাই করছে বাজারে বিক্রি করবে বলে।
সকাল গড়িয়ে কখন যে দুপুর হয়ে গেল আনন্দে আর উত্তেজনায় খাবারের বিষয়টা আমাদের মাথাতেই আসেনি। তবে পেট নাছোড়বান্দা আমাদের জানান দিচ্ছিল যে আমাদের কিছু খাওয়া দরকার, তেষ্টাও পেয়েছিল খুব। একটি গাছ তলায় বসে সামান্য হালকা কিছু বিস্কিট আর ফল খেয়ে নিলাম ডাবের পানি পান করলাম। দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করে পূর্ণ উদ্যোমে আবারও হাঁটা শুরু করলাম। সমুদ্রকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা এবং সমুদ্রের বিশাল সৌন্দর্যের নির্জনতায় একাকী পথচলা পথিকের বেশে আমরা দুই বন্ধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আর হাঁটতে হাঁটতে কিভাবে যে সকাল থেকে সন্ধ্যা করে ফেললাম বুঝতেই পারিনি। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যে নামার কিছুক্ষণ আগেই আমরা শামলাপুর বাজার এর কাছে যে মসজিদ আছে সেখানে পৌঁছে গেলাম।
আমাদের গ্রুপ লিডার তার দলবল নিয়ে আগে থেকেই আমাদের জন্য ক্যাম্পিং সাইট রেডি করে রেখেছিল। এবারের ক্যাম্প সাইট একটু ব্যতিক্রম। সমুদ্রের একদম তীরবর্তী ঝাউ গাছের ফাঁকে ফাঁকে তাবুগুলো টানানো ছিলো এবং পাশেই ছিল মসজিদ, আমরা মূলত মসজিদকে কেন্দ্র করেই অবস্থান গ্রহণ করলাম। আমাদের আগে যারা পৌঁছে গেছে তারা সবাই দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠেছিল, আমরা অবশ্য খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই পৌছালাম বিধায় খেলার শেষটা দেখার সুযোগ পেলাম। সবাই বেশ আনন্দ আর উত্তেজনায় সময়টাকে উপভোগ করছিল।
আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা তাঁবুতে আমরা আমাদের ব্যাগ গুলো রেখে গোসল করার উদ্দেশ্যে সমুদ্রের দিকে গেলাম গত দুইদিন ধরে সমুদ্রের কাছাকাছি রয়েছি অথচ সমুদ্রের পানিতে গা ভেজানো হয়ে ওঠেনি। অবশেষে আমরা দুজন সান্ধ্য কালীন সময়ে গোসল করতে নামলাম। সমুদ্রের অসম্ভব তীব্র ঠান্ডা পানিতে গা হিম হয়ে যাবার পালা, কোনরকম ১৫ মিনিট থেকে দ্রুত উঠে এলাম পানি থেকে এক গাদা বালি শরীরে মাখিয়ে ক্যাম্প সাইটে ফিরলাম, মসজিদের পানির কল ছিল সেখানে গিয়ে ভালো মতো গোসল করে ফ্রেশ হলাম এবং আমরা সবাই রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে শাপলাপুর নামার বাজারে গেলাম। আমাদের জন্য আগে থেকেই ওখানে খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল। রাতের খাবারের মেনু ছিল কালো চাঁদা মাছের তরকারি আর ডাল। পেট ভরে খেলাম খাওয়া-দাওয়া শেষে ফেরার পথে পরের দিনের জন্য কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম, সামান্য ঔষধ কিছু ফলমূল কিনে সাইটে ফিরে এলাম। আমরা আমাদের তাঁবুর ভেতর বসে নিজেদেরকে পরের দিনের জন্য প্রস্তুত করার চেষ্টা শুরু করলাম।
এই এলাকাতেও ঠিক একই সমস্যা, আমাদের খুব নিকটবর্তী শাপলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প অবস্থিত ছিল তাই যথারীতি কোন ডিজিটাল নেটওয়ার্ক নেই। আমরা সেই আদি মানবের চরিত্রে ফিরে গেলাম অর্থাৎ কাজ নেই গল্প করো, আড্ডা দাও, তারপর ঘুমিয়ে পড়ো, পরিবারের সাথে খোঁজখবর দেওয়া নেওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজকে আমাদের তাবুটা ছিল সমুদ্রের একদম পাশে, সারাক্ষন শুধু গর্জন আর গর্জন এর মধ্যে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল প্রচন্ড বাতাসের শব্দে, মনে হচ্ছিল যেন আমাদের তাবু বাতাসে উড়িয়ে নেবে। এমন একটা ভাবে কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম আমি। তবে রক্ষা পেলাম সেটা সীমিত সময়ের জন্য ছিল। রাতে ওখান থেকেই আমরা খবর পেলাম যে ঢাকা বিভাগের আশেপাশে প্রচন্ড ঝড় তুফান সাথে বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। অথচ এখানে তেমনটি হয়নি শুধুমাত্র প্রচন্ড বাতাস ছাড়া।
সকালে এসে ঝামেলায় পড়লাম টয়লেট করা নিয়ে, মসজিদের কাছাকাছি টয়লেট প্রায় দশটি কিন্তু তেমন একটা ব্যবহার ব্যবহার না হওয়ার কারণে প্রত্যেকটা এমন দুরবস্থা হয়ে আছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তার মধ্য থেকেই কোনরকমে জান বাঁচানো পর্ব বলা যায়, প্রাকৃতিক কাজ শেষ করলাম।
আজকে সকালে আমাদের নাস্তার কোন মেনু নেই, সাথে থাকা ফলমূল আর পানীয় পান করে তৃতীয় দিনের মতো রওনা দিলাম। আজকে আমাদের ক্যাম্পিং সাইট সোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আজকের দিনটা আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং তার কারণ আজকে সর্বোচ্চ দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। তারচেয়ে বড় কথা গতকাল আমার পায়ে ফোসকা পড়েছে আর তা নিয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আজকে তাই ভালোমতো ব্যান্ডেজ লাগিয়ে হাঁটার জন্য নিজের মনকে তৈরি করলাম পাশাপাশি মনকে বোঝালাম যে আমরা পারবো।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমরা শুরু করে দিলাম হাঁটা তার কারণ ঘণ্টায় ৩ কিলোমিটার গতিতে যদি হাঁটতে থাকি তাহলেও ১০ ঘন্টা লেগে যাবে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে। নানান রকমের আলোচনা-সমালোচনা করতে করতেই দুই বন্ধু হাঁটতে থাকলাম সমুদ্রউপকূল ধরে। দেখতে থাকলাম সমুদ্রতীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা কিভাবে নির্ভর করছে এই সমুদ্রকে ঘিরে। এই এলাকাটায় বেশ কিছু জেলে পরিবার এর বসতি আছে বলে মনে হচ্ছে কারণ কিছুদূর পর পর আমরা জেলে পরিবারের দেখা পাচ্ছিলাম, যারা সবাই তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত ছিল। কেউবা মাছ ধরছে, কেউবা নৌকা মেরামত করছে। অনেক রকম তাদের জীবন যুদ্ধ সমুদ্রকে ঘিরে। এইসব দেখতে দেখতে আমরা এগোতে থাকলাম।
সমুদ্রের সৌন্দর্য আসলে নিজের চোখে না দেখলে কখনো কাউকে বোঝানো সম্ভব না, যে কতটা সুন্দর। আর টেকনাফ থেকে যত উত্তরে কক্সবাজারের দিকে এগুচ্ছি মনে হচ্ছে, সমুদ্রের একেকটা বিচ একেক রকম সুন্দর, কারো সাথে কারো মিল নেই প্রত্যেকেই নিজ নিজ সৌন্দর্য ছড়িয়ে অপেক্ষায় আছে আমাদের আলিঙ্গন করার জন্য। যে পথ আমরা পাড়ি দিয়েছি সে পথ আসলেই এখনো অপরূপ অবস্থায় আছে। যেখানে পড়েনি কোন অট্টালিকার গাঁথুনি, পড়েনি কোন প্রকার যুগের পরিবর্তনের হাওয়া। অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে বসে আছে নাম না জানা বীচগুলো। বিকাল অবধি আমরা ইনানী বিচের প্রায় কাছে চলে এলাম। এখানে এসে ব্যাপক প্রবাল পাথরের দেখা পেলাম। দেখে মনে হল প্রবাল পাথরগুলো নির্জন সমুদ্রের গর্জন এর মাঝে একাকী অপেক্ষায় আছে কোন ক্লান্ত পথিকের দেখা পাবে বলে। তাদের রুপ আমাদের তীব্রভাবে আকর্ষন করল আমরাও ছিলাম ক্লান্ত পথিক, বসে পরলাম ক্ষণিকের অবসরে। হালকা পানীয় জলপান করলাম নিজেদের চাঙ্গা করার জন্য। কিছুক্ষণ বসে সমুদ্রের গর্জন আর হাওয়ার কলতানে মুখরিত হলো হৃদয়-মন, আন্দোলিত হল প্রাণ, ভাবলাম পৃথিবীর এই মুহূর্তে শ্রেষ্ঠ মানুষ একমাত্র আমি।
কক্সবাজার আসার পর আমার তিন বন্ধু যারা কক্সবাজার বেড়াতে এসেছে তাদের সাথে যোগাযোগ হল এর মধ্যে একজন সাহাবুদ্দিন বিলাস উনি ওনার পরিবার নিয়ে ইনানীতে অবস্থান করছিল। বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল, তাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় আমরা ব্যয় করলাম। সন্ধ্যা হবার অল্প কিছু সময় বাকি ছিল তাই আমরা দেরি না করে পুনরায় আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। এবার হেঁটে হেঁটে আমরা সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমাদের টার্গেটে পৌঁছানোর চেষ্টা চালালাম এবং সোনারপাড়া প্রাইমারি স্কুলের কাছেই বাজার আছে সেখানে চলে এলাম। এলাকাটা ইনানী বিচ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে এবং আমাদের ক্যাম্পিং লোকেশনটা একটু লোকালয়ের দিকে সীবিচ থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে দিকে হবে হয়তো। বাজারে এসেই খাওয়া-দাওয়া করলাম। কারণ আমরা সারাদিন তেমন ভারী কোন খাবার খাইনি, হালকা বিস্কিট আর পানীয় জল ছাড়া। মেনু নির্ধারন করলাম আশেপাশের লোকজনদের খাওয়া-দাওয়ার ধরন দেখে। দেখলাম, সবাই বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু এগুলো খাচ্ছে তাও আবার বিষয়টা আমার কাছে একটু নতুনত্ব লাগলো তার কারণ সবাই এগুলি মজা করে খাচ্ছে এবং যে পরিবেশন করছেন সে সবকিছুকে মিলিয়ে কেমন যেন একটা বিষয় তৈরি করছেন, আসলে সেটা আমার ধারণা নেই। তবে সবার খাওয়ার আগ্রহ এর ধরন দেখে আমরাও সেটা অর্ডার করে বসলাম এবং খেলাম, বেশ লাগলো খেতে। খাওয়া শেষে এলাকার মানুষের সহযোগিতা নিয়ে যেহেতু স্থানটা আমাদের কাছে অপরিচিত, আমরা আমাদের লক্ষ্যে: সোনারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এ উপস্থিত হলাম।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি ৩০+ কিলোমিটারের মত পথ কিভাবে পাড়ি দিলাম আল্লাহ পাকই জানেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কিভাবে যে হেঁটে বেড়ালাম তাও ফোসকা পড়া পা নিয়ে। সোনারপাড়া বিদ্যালয় প্রাঙ্গণটা বেশ বড়, প্রথমে সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় এর মাঝখানে মাদ্রাসা আছে দেখলাম এবং এরপর প্রাথমিক বিদ্যালয় এর অবস্থান। আমরা সাইক্লোন সেন্টার নিচে তাঁবুতে অবস্থান গ্রহণ করলাম। সব মালপত্র গুছিয়ে গোসল করার প্রস্তুতি নিলাম যেহেতু ক্লান্ত ছিলাম, তবে টিউবওয়েলের পানি বাইরের ঠাণ্ডার তুলনায় গরম ছিল, গোসলটা করে বেশ শান্তি পেলাম।
সবাই যখন সবার মালামাল গোছগাছ শেষ করেছে তখন এলো রাতের খাওয়া-দাওয়ার পালা। স্থানীয় বাজারে রাতের খাওয়া-দাওয়া করে আমরা আমাদের ক্যাম্প সাইডে চলে এলাম। এসেই এবার আমরা বারবিকিউ আয়োজনে নিমগ্ন হলাম। ২০ কেজি কালো রূপচাঁদা মাছ বারবিকিউ করা হবে বলে কেনা হয়েছে বাজার থেকে। বিগত দুইদিন আমরা নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম যেখানে কোনো টু-জি নেটওয়ার্ক কাজ হচ্ছিল না। এই এলাকায় আসার পর দেখলাম এখানেই থ্রিজি ফোরজি নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে।
যেহেতু নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু আমরা আমাদের রোজকার অভ্যাসগত বা বদঅভ্যাসগত বিষয়: ডিজিটাল লাইফ, মানে মোবাইল জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যেটা আসলে আমার কাছে খুব খারাপ লাগলো তার কারণ হচ্ছে আমরা এতটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছি যে প্রকৃতির কাছাকাছি এখন আর আমরা থাকতে চাই না। আমরা চাই শুধু সারাক্ষণ নেটওয়ার্কের ভেতর থাকতে। নেটওয়ার্ক না হলে যেন আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। নেট ছাড়া যেন আমাদের একটু চলেনা। কেউবা ব্যস্ত ছবি আপলোড করায়, ব্যস্ত কেউবা ব্যস্ত লাইভে, দেখাচ্ছে আমরা কী করছি সবাই। এর বাইরে আমিও যেতে পারলাম না, আমিও তাদের সাথে তাল মেলানো শুরু করলাম। যাক এদিকে বারবিকিউ করতে করতে রাত বারোটা বেজে গেল বারোটার দিকে বারবিকিউ খেয়ে আমরা ঘুমোতে গেলাম।
সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে চতুর্থ দিনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। ক্যাম্প সাইট থেকে লাগেজপত্র গুছিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম, তবে ডাক পড়ে গেল গ্রুপ ছবি তোলা হবে বলে, আমরা যেখানে অপেক্ষা করছিলাম সমুদ্রের তীরবর্তী একটা খোলা জায়গায় সেখানে গ্রুপ ছবি তোলা শেষে হাঁটা শুরু করলাম। পথিমধ্যে নাস্তা করলাম, আজকের গন্তব্য কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্ট, যেখানে আমাদের ভ্রমণের ইতি টানা হবে। আজকের লক্ষ্যটাকে তেমন বেশি কোন বড় লক্ষ্য মনে হচ্ছিল না, তার কারণ আজকের গন্তব্য ছিল মাত্র ১৮ কিলোমিটার। হাঁটতে হাঁটতে ভুলক্রমে আমরা একটি খালের কাছাকাছি চলে আসলাম কিন্তু খালটি (পরে জেনেছি খালটির নাম রেজুখাল) বেজায় বড় আর গভীর ছিল যেটা হেঁটে পার হওয়া সম্ভব ছিল না সুতরাং যতদূর গিয়েছি ঠিক ততদূর আবার পেছনে ফিরে আসতে হলো মানসিকভাবে আমরা একটু দুর্বল হয়ে পড়লাম কারণ যাওয়া-আসা মিলে ৫ কিলোমিটার অহেতুক হাঁটা হয়ে গেল পাশাপাশি সময়ও নষ্ট হলো অনেক। খালটি পাড়ি দেওয়ার জন্য আমাদেরকে মেরিন-ড্রাইভ-রোড এর উপর উঠতে হল। কিছুদূর হাটার পর খাল বরাবর একটি ব্রিজ পরল, ব্রিজে উঠলাম নাম “রেজুখাল ব্রিজ” দিয়ে খাল পাড়ি দিলাম। এবার রাস্তা ধরে ধরে এগুলোতে লাগলাম, অনেকটা পথ আমরা মেরিন-ড্রাইভ-রোড ধরে এগুলাম। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমরা পুনরায় রাস্তা থেকে বিচের দিকে পৌছালাম এবং শুনলাম আর কোন প্রকার খাল কক্সবাজার পর্যন্ত পড়বে না। হেঁটে হেঁটে আমরা প্রায় হিমছড়ির কাছাকাছি চলে এলাম। দেখলাম সেখানে প্যারাগ্লাইডিং হচ্ছে বেশ ভালই লাগলো দেখতে। সবাই খুব আগ্রহ সহকারে একজনের পর একজন প্যারাগ্লাইডিং করছে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর আমরা দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে তাদের আনন্দ শেয়ার করার চেষ্টা করছিলাম। পাশাপাশি চোখে পড়লো স্পিডবোটে ঘোরাঘুরি এবং আরো নানারকম একটিভিটিস যা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, এই হিমছড়ি নামক এলাকাটা।
হিমছড়িতে এসে তেষ্টা মেটালাম ডাবের পানি পান করে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মোবাইলের চার্জ শেষ। এখানে মোবাইলের চার্জ দিলাম ৩০ মিনিট পাশাপাশি একটু বিরতি নিলাম। বিরতির পর রওনা দিলাম আবার সমুদ্রের তীর ধরে, লক্ষ্য অতি সন্নিকটে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে এবং দূর থেকে কক্সবাজারের বড় বড় হোটেলগুলোর সারি দেখা যাচ্ছিল এবং আশান্বিত হচ্ছিলাম যে, আর কিছুদূর গেলেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যাব। চলার পথে বেশকিছু কচ্ছপ চোখে পড়লো যারা বীচে মারা গেছে ডিম পারতে এসে। দেখে হঠাৎ করে মনে হয় যেন জীবন্ত বসে আছে, এইতো হয়তো দৌড় দিবে এমন। কেন মারা গেছে? তা আমার জানা নেই। তবে তাদের এই হাল দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। আমাদের মাঝে কিছু লোক কেন ধরনের কাজগুলো করে থাকে?
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে আমরা কক্সবাজারের কাছাকাছি চলে এলাম, দূর থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট দেখা যাচ্ছে। দেখে মনটা আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে বরং ভারাক্রান্ত হয়ে গেল, তার কারণ আমাদের এই অসাধারণ সুন্দর একটা ভ্রমণের ইতি ঘটতে যাচ্ছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে। আর বিগত তিনদিন যে নির্জনতায় একাকী প্রকৃতির কাছাকাছি ছিলাম তার যবনিকাও হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরে। দূরে দেখা যাচ্ছে শুধু মানুষ আর মানুষ, অগণিত মানুষ, মানুষের মহাসমুদ্র অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, আমরা অপেক্ষায় আছি সেই ভিড়ে মিশে যাবার। বিকেল সাড়ে চারটায় আমাদের গন্তব্য স্থল কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টে উপস্থিত হলাম, আমাদের ভ্রমণ পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করলাম। দুই বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম বিজয়ের আনন্দে। আমরা পেরেছি ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে, পেরেছি লক্ষ্য অর্জন করতে, যা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর তবে অসম্ভবপর ছিলনা।
আমার বিশ্বাস ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে বড়জোর শ’পাঁচেক লোক হবে কিনা এই ধরনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ? আমার জানা নেই। আমি হয়তো সীমিত কিছু মানুষের মধ্যে একজন হয়ে উঠলাম, এটা ভাবতেই আমার মনটা শিহরিত হয়ে উঠছিল। পাশাপাশি নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল যে, আমি এক অসাধ্যসাধন করেছি। আমি দেখেছি আমার বাংলাদেশ, আমি দেখেছি আমার বাংলার অনিন্দ্য সুন্দর রূপ। আমি দেখেছি সমুদ্র সৈকতের জীববৈচিত্র্য, সেখানকার মানুষের জীবিকার অন্বেষণে তাদের জীবনযুদ্ধ, কাছ থেকে দেখা জেলেপল্লীর জীবন চিত্র, চলার পথে মাছের বাজার ঘুরে দেখা এবং জেলেরা কত কষ্ট করে যে মাছগুলো ধরে আনে এবং সে মাছগুলো তারা বিক্রি করে দেয় খুব সামান্য টাকার বিনিময়ে।
ছোটবেলা থেকে শুনেছি যে, কক্সবাজার হচ্ছে এদেশের নয়, সারা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। তার রূপ-সৌন্দর্য, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। প্রকৃতির কাছে আমরা যে কত ক্ষুদ্র ও নগণ্য এবং প্রকৃতি কতটা শান্ত তার কাছাকাছি না গেলে সেটা অনুভব করা দুষ্কর। তার কাছে এসে বসে থাকলে মন এমনিতেই ভাল হয়ে যায়, তাইতো নিজের মতো করে আমি যেখানে যেখানে ভাল লেগেছে বসে থেকে বা দাঁড়িয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি, নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি।
অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল আমার দৃষ্টিকোণ থেকে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পাটুয়ারটেক, ইনানী, হিমছড়ি ও মূল কক্সবাজার ছাড়া বাকিটা সমুদ্র সৈকত অতীতে যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটিই আছে, এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গি তার কারণ, আমার কাছে বাকিটা অংশ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বলেই মনে হয়েছে যেখানে এখনো গড়ে ওঠেনি মানব বসতি ইট পাথরের জঞ্জাল।
কথা আর বাড়াবো না এমনিতেই অনেক বেশি বলে ফেলেছি ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন কারণ আমি শুধু আমার অন্তরের কিছু কথা এখানে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু যতটুকু বলেছি তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ অভিজ্ঞতার আলো আমার অন্তরে গেঁথে রয়েছে।
পরিশেষে, আরেকটা বিষয় না বললে আমার এই ভ্রমণ বিবরণী অপূর্ণ থেকে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। এটা কিন্তু আয়োজক সোহান ভাইয়ের কোনো বাণিজ্যিক ট্রিপ প্ল্যান ছিল না। উনি নিজে কিছু দাতব্য কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন এবং এখান থেকে অর্জিত টাকা উনি বিভিন্ন গরীব-দুঃস্থ মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তিনি বিতরণ করেন। বিশেষ করে যারা টাকার অভাবে ফরম ফিলাপ করতে পারছেনা, ভর্তি হতে পারছেনা, নতুন বই কিনতে পারছেনা, এই ধরনের অনেক সুন্দর সুন্দর কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। এরকম মহান মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে যদি প্রত্যেকটা মানুষ এরকম মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যেত তাহলে দেশটাই বদলে যেত।
হেঁটে হেঁটে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আমার আগের আমি আসিনি বরং আমি এসেছি ভেতরের অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ এবং বিশুদ্ধ করে। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আমিও বদলে গিয়েছি তার কারণ আমি কিছু আলোকবর্তিকা সম্পন্ন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি এবং তার আলোকছটা কিছুটা হলেও আমার ভেতরে এসেছে এবং নিয়ত করেছি আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী আমিও চেষ্টা করে যাবো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যদি আল্লাহপাক আমাকে সেই তৌফিক দান করেন।
*এই ট্রিপে আমার মত পাগলের সংখ্যা ছিল ৫২ জন।
*দূরত্ব অতিক্রম করছি ১০০ কি: মি: প্রায়।
🎯প্রথম দিন: টেকনাফ বীচ থেকে কচ্চপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়
🎯দ্বিতীয় দিন: কচ্চপিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শাপলাপুর বাজার
🎯তৃতীয় দিন: শাপলাপুর বাজার থেকে সোনার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়
🎯চতুর্থ দিন: সোনার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্ট।
*একদিনে সর্বোচ্চ 👣হেঁটেছি ৩০কি: মি: এর বেশি, ১০ ঘণ্টায়।
*সময় লেগেছে ৪দিন (২৫ ডিসেম্বর – ২৯ ডিসেম্বর)।
*ধন্যবাদ সবাই ভাল থাকবেন।