Skip to content Skip to footer

ঝরিয়া -জাঞ্জাইলের ভৌতিক স্টেশন মাস্টার

 

বাংলাদেশে খুব কম লোকই ঝরিয়া -জাঞ্জাইল নাম জানেন। যারা জানেননা তাদের জন্য বলছি , ঝরিয়া -জাঞ্জাইল নেত্রকোনা জেলা, যা আগে একটি মহকুমা ছিল ময়মনসিং জেলার অন্তর্ভুক্ত , একটি সীমান্ত এলাকার রেল স্টেশন। সেখানে যেতে বহু ঘাট পেরুতে হয় (আক্ষরিক অর্থে নয়)। ঢাকা থেকে রেলে ঝরিয়া যেতে আপনাকে প্রথম যেতে হবে ময়মনসিং, তারপর সেখান থেকে গৌরীপুর। গৌরীপুরে ট্রেন বদলে নিতে হবে ঝরিয়া-জাঞ্জাইলের ট্রেন। এই শেষ ভাগে আপনি পাবেন আরো চারটি রেল স্টেশন। ঝরিয়া শেষ স্টেশন। এই স্টেশনটি ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল যা পূর্বের আসামের সীমান্তের সঙ্গে মাল পরিবহনের সুযোগ করে দিত। খুব ছোট স্টেশন হলেও ঝরিয়া-জাঞ্জাইল সীমান্ত এলাকার লোকজনের খুব কাজে দিত। কারণ সে সময় ওদিকে মোটর যান বাহন চলার রাস্তা ছিলনা।
আমার পরিচয় ঝরিয়া -জাঞ্জাইলের সঙ্গে খুব কাকতালীয় ভাবে। সেটা হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর। আমি তখন এম,এ, পরীক্ষা দিয়ে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোয়নি। গিয়েছিলাম ময়মনসিং বেড়াতে মাকে নিয়ে। ঢাকা থেকে ট্রেনে যেতে দেখা আমার হলের একজন প্রাক্তন সিনিয়র ছাত্রের সাথে। তিনি পাস করে বেরিয়ে গেছেন তিন বছর আগে। জানালেন তিনি তার এলাকা গৌরীপুরে স্থানীয় উদ্যোগে একটি কলেজ খুলেছেন, এবং তিনি সে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। আমি কি করছি জানতে চাইলে তাকে বললাম আমি পরীক্ষার রেজাল্টের অপেক্ষায়। সে শুনে আমার সিনিয়র বন্ধু আমাকে অনুরোধ করলেন তার কলেজে যোগ দিতে অধ্যাপক হিসাবে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। একে তো আমি এখনো পাস করিনি, আর দুই আমি পাস করলেও এই ঘোর মফস্বলে কখনই কাজ করবনা। আমি যতই আপত্তি জানাই আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু কোন মতেই মানলেন না। বললেন অন্তত দু মাস হলেও আমি যেন কাজটি নেই, করেন বোর্ডে তাদের কলেজের অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য অধ্যাপক তালিকায় একজন ইংরেজি শিক্ষক দরকার। অগত্যা আমি রাজি হলাম, এই শর্তে যে আমি দু মাসের বেশি একদিন ও থাকবনা।
আমি ময়মনসিং ভ্রমণ শেষ হবার পর ঢাকা ফিরে গৌরীপুর যাই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। গৌরীপুর স্টেশন নামার পর দেখি ঝরিয়া-জাঞ্জাইল নাম প্রথম বারের মত। একটি ফলকে লেখা “ঝরিয়া-জাঞ্জাইল যেতে হলে এখানে গাড়ি পরিবর্তন করুন”। সেখানে জানলাম ঝরিয়া ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তি এলাকার জায়গা।সেখানে দিনে দুটি ট্রেন যায়, একটি সকালে আরেকটি বিকালে।ভাবলাম গৌরীপুর থাকতে সুযোগ পেলে একবার এই অদ্ভুত জায়গাটি দেখে আসব।
গৌরীপুর কলেজ স্টেশন থেকে মাইল দুয়েক দূরে, যেতে হল রিকশা করে। কলেজটি গৌরপুরের প্রাক্তন জমিদারের পরিত্যক্ত ভবনে। তার কিছু দূরে একটি অর্ধ ভগ্ন দালানে ছিল অধ্যাপকদের মেস হল বা আস্তানা। যখন আমি সেখানে পৌছাই তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, শীতের দিন তাই তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা। কোনো বিদ্যুৎ নেই, হ্যারিকেনের আলো টিম টিম করে জ্বলে স্থানটিকে আমার কাছে ভুতুড়ে মনে হচ্ছিল। ভাবলাম আমি মানুষকে সাহায্য করতে কি বিপদ ডেকে আনলাম?
ঝরিয়া -জাঞ্জাইল যাওয়ার আরো অনুপ্রেরণা পেলাম আমার মেসে থাকা বাংলার অধ্যাপক অনিল বাবুর কাছ থেকে। তার সাথে পরিচয় হবার পর জানলাম তার বাড়ি ঝরিয়া। আসলে স্টেশনের নাম ঝরিয়া -জাঞ্জাইল এজন্যে রাখা হয়েছে কারণ এ স্টেশন এলাকার দুটি বাজার ঝরিয়া এবং জাঞ্জাইলের অধিবাসীদের মন তুষ্টি করার জন্য। অনিল বাবুর বাড়ি জাঞ্জাইল যা স্টেশন থেকে মাইল দুয়েক দূরে। লোকজন হয় রিকশা না হয় পায়ে হেটে স্টেশন আসে যায়। অনিল বাবু এও জানালেন যে জাঞ্জাইল বাজারের কাছে একটি প্রাচীন শিব মন্দির আছে যা দেখতে দূর দূর থেকে লোক সেখানে যায়। মন্দিরের কথা শুনে আমার ঝরিয়া -জাঞ্জাইল যাওয়ার ইচ্ছা আরো বেড়ে গেল। অনিল বাবু বললেন এক ছুটির দিনে তিনি আমাকে সাথে নিয়ে তার এলাকা দেখাবেন। আমরা পরের রবিবার যাওয়ার দিন স্থির করলাম।
দুঃখের বিষয় সে সপ্তাহের শেষে অনিল বাবু সর্দি কাশি আর জ্বরে পড়লেন , তাই আমাকে একই যেতে হল। যাওয়ার আগে অনিল বাবু একটি চিঠি দিলেন জাঞ্জাইল মন্দিরের পুরোহিতের জন্যে এই মর্মে যে আমাকে যেন মন্দিরের ভিতরে যেতে দেওয়া হয় সেখানে স্থাপিত পুরাতন শিব পার্বতী মূর্তি দেখার জন্য। আমি মহা আনন্দে সে চিঠি নিয়ে ঝরিয়ার দিকে রওয়ানা হই।
গৌরীপুর স্টেশন থেকে আমি সকাল ন’টার ট্রেন ধরলাম। ট্রেন সাদা মাটা , মাত্র চারটি বগী , তিনটি তৃতীয় শ্রেণী, আর একটি মধ্যম শ্রেণী। যাত্রীদের প্রায় সবার কাছে বস্তা ভরা বাজারে বিক্রির পণ্য। এগুলো তারা ময়মনসিং থেকে পাইকারি দরে কিনে ঝরিয়া বা জাঞ্জাইল বাজারে বিক্রির জন্যে নিয়ে যান। কিছু যাত্রী ময়মনসিং কাজে গিয়ে ফেরত আসছেন। হয়ত বা এদের মধ্যে কেউ কেউ মন্দির যাত্রী হতে পারেন। ঝরিয়া স্টেশনের আগে আরো চারটি স্টেশন ছিল। অনেক যাত্রী এ স্টেশন গুলোতে নেমে গেলেন।
শেষ স্টেশন ঝরিয়া-জাঞ্জাইল। নেমে দেখলাম স্টেশনটি টিনের ছাদ দেওয়া একটি আধ পাকা দালানে অবস্থিত। স্টেশনে মাত্রা দুজন কর্মচারী , স্টেশন মাস্টার আর একজন প্রহরী যে ঘণ্টাবাদকের কাজ ও করে। স্টেশন মাস্টার একাধারে স্টেশন অধিকারী এবং টিকেট বিক্রেতা। টিকেট বিক্রির ষ্টল তার অফিসের জানালা। লোকজন সে জানালা থেকে টিকেট কিনে।
ঝরিয়া পৌঁছে আমি প্রথম গেলাম স্টেশন মাস্টারের খোঁজে। তিনি তখন টিকেট বিক্রি করছিলেন। আমাকে দেখে একটু অপেক্ষা করতে বললেন। পরে জানতে চাইলেন আমি কি চাই। আমি তাকে বললাম আমার উদ্দেশ্যের কথা। স্টেশন মাস্টার বললেন মন্দির তো বেশ দূর , আর তা ছাড়া আপনি অন্য ধর্মের লোক মন্দিরের ভিতর তো যেতে পারবেন না। আমি তাকে জানালাম আমার কাছে অনিল বাবুর দেয়া চিঠির কথা। শুনে স্টেশন মাস্টার বললেন রিকশা নিয়ে যেতে কারন এত দূর আমি হেটে যেতে পারবনা। এও বললেন যে যেহেতু আমি জাঞ্জাইলে রাতে থাকবনা আমি যেন সময় মত ফিরে আসি বিকালের ট্রেন ধরার জন্য। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম।
স্টেশন থেকে বেরুতেই দেখলাম অনেক রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। জাঞ্জাইলের মন্দিরের কথা বলতেই একটি রিকশা সামনে এগিয়ে এলো। জাঞ্জাইলের রাস্তা আধা পাকা, শীত কাল বলে কাঁদামাটা নয়। দু পাশে ধান খেত আর মাঝে মাঝে কলা বাগান। মন্দির পৌঁছাতে প্রায় আধা ঘন্টা লাগলো। মন্দির টি দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম। সুন্দর একটি দীঘির পারে বড় বড় অশ্বথ গাছের ভিড়ে মন্দিরটি। বেশ উঁচু প্রায় পঞ্চাশ ফুট হবে। বাংলাদেশের আর দশটা মন্দির থেকে ভিন্ন, অনেকটা উড়িষ্যা এলাকার মন্দিরের ছাঁচে তৈরি। দেখে বেশ প্রাচীন মনে হল। মন্দিরের সামনে বেশ লোক, অনেকে ঘুরে দেখছেন আর অনেকে বাইরে দাঁড়িয়ে মস্তক অবনত করে প্রণাম করছেন। আমি বাইরে থেকে দেখি মন্দিরের পেল্লায় কাঠের দরজাটি বন্ধ। সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম দরজায় ধাক্কা দিব কি না।
এমনি অবস্থায় দেখি একজন সাদা ধুতি আর চাদর গায়ে সৌম্য চেহারার একজন লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তার কপালে চন্দন দেখে মনে হল তিনি হয়ত মন্দিরের পুরোহিত। জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন যে তিনিই সে ব্যক্তি। আমি অনিল বাবুর কথা বলে তাকে চিঠি টি দিলাম। সাথে সাথে পুরোহিত আমাকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরের ভিতরে ঢুকলেন। ভেতরে পেল্লায় কান্ড। প্রায় বিশ ফুট উঁচু শিবের মূর্তি , রক্ত চন্দনে আবৃত। চার পাশে স্তূপাকৃত গাঁদা ফুলের মালা। পুরোহিত বললেন মূর্তি টি কাল পাথরের এবং তা নির্মিত হয়েছিল ময়মেনসিংয়ের এক প্রাচীন রাজার আমলে। বয়স আনুমানিক তিন থেকে চার শ বছর। শিব মূর্তির পাশে আরো ছোট কয়েকটি মূর্তি পার্বতীসহ। অবিশাস্য এক অনুভূতি হয় মন্দিরে ঢুকলে, কিছুটা ভয় কিছুটা কৌতূহল। মন্দিরের ভেতর কিছু ঘুরে আমি বেরিয়ে আসলাম। পরে মন্দিরের আসে পাশে কিছু ঘুরলাম।
ঘুরতে ঘুরতে হটাৎ ঘড়িতে দেখি বিকেল তিনটে। সর্বনাশ! আমার ফেরার ট্রেন তো চারটায়। দৌড়ে বেরিয়ে রিকশা খুঁজতে একটু দেরি হল। হাপাই ঝাপাই করে স্টেশন পৌছালাম চারটার দশ মিনিট আগে। স্টেশন মাস্টার আমাকে দেখে বললেন, যাক এসে গেছে তা হলে। তবে খুব তাড়া নেই, কারণ গৌরীপুরের ট্রেন একটু লেইট আছে। পাশে চা দোকান আছে , সেখান থেকে চা খেতে পারেন।
চায়ের দোকান স্টেশনের পাশে একটি বাঁশের ঝুপড়ি ঘর। গিয়ে দেখি দোকানের সামনে কাঠের উনুনে এক বিরাট অ্যালুমিনিয়াম পাত্রে চা তৈরি হচ্ছে দুধ চিনি সহ। সামনে ঝুলছে কিছু মর্তমান কলা, আর একটি খাঁচায় কিছু ডিম্। তাকে রাখা আছে কয়েকটি বিস্কুটের প্যাকেট আর কয়েকটি শুকনো কেক কাগজে মোড়া। আমি এক কাপ চা চাইতে যুবক দোকানি আমাকে একটি নীল রঙের ছোট গ্লাসে দুধ-চিনি মেশান চা ঢেলে দিল। কিছু খিদে লাগার জন্য একটি কলা আর এক প্যাকেট বিস্কুট ও নিলাম। চায়ের স্বাদ ভালোই ছিল যদিও একটু বেশি মিষ্টি।
চা খাওয়ার পর স্টেশন এসে লোক ভিড় করে আছে প্লাটফর্মে। ট্রেনের খবর জিজ্ঞেস করতে একজন যাত্রী বলল টেন আরো দেরি হবে। এদিকে সময় প্রায় পাঁচটা হতে চলেছে। শীতের দিন অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমি অগত্যা স্টেশন মাস্টারের কাছে আবার গেলাম। দেখলাম তিনি রেলের বার্তা যোগাযোগ কলে কথা বলছেন। তখনকার দিনে বার্তা যোগাযোগ শুধু রেলওয়ের তারের মাধ্যমে হত। স্টেশন মাস্টার তার কথা শেষ করে বললেন, খবর খারাপ। গৌরীপুর ট্রেন আগের স্টেশনে থেমে রয়েছে ইঞ্জিন বিকল হওয়ার জন্য। আরেকটি নুতন ইঞ্জিন আসলে তখন ট্রেন আসবে তবে তা কাল সকালের আগে নয়।
স্টেশন মাস্টার প্লাটফর্ম গিয়ে অপেক্ষমান যাত্রীদের জানালেন। যাত্রীরা সবাই এলাকার তাই তারা বিশেষ উচ্চবাচ্য না করে প্ল্যাফটফর্ম ছেড়ে চলে গেল। একমাত্র পড়ে রইলাম আমি। আমাকে একা দেখে স্টেশন মাস্টার এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন ঝরিয়া আমার কোন থাকার জায়গা আছে কিনা। আমি মাথা নেড়ে বললাম না। স্টেশন মাস্টার বললেন আমি তার স্টেশনের অফিসে রাতে থাকতে পারি, একটি আরাম কেদারা আছে কোন মতে শুয়ে থাকতি পারি রাট কাটাবার জন্য। পাশে একটি বাথরুম আছে, দরকারে ব্যবহার করতে পারি। তবে খাওয়ার কোন জায়গা নেই আসে পাশে। চায়ের ষ্টল অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি মহা খুশি হয়ে তাকে বললাম যে আমি তার অফিসে রাত কাটাতে পরলে খুবই আনন্দিত হবে , রাতে আমার না খেলেও চলবে। স্টেশন মাস্টার আমাকে তার অফিসে নিয়ে দেখালেন তার আরাম কেদারা আর বাথরুম। ছোট ঘর কিন্তু ছিমছাম। তিনি আরো একটি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঘরটিকে আলোকিত করলেন। আমি তাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানালাম।

কিছুক্ষন পার স্টেশন মাস্টার চলে গেলেন, বললেন সকালের ট্রেন দশটায় তবে তিনি আসবেন আটটায়। আমি ছোট্ট স্টেশন ঘরে অন্ধকারে পড়ে রইলাম একা। স্টেশন মাস্টারের অফিসে কোন বই পত্রের বালাই নেই। কয়েকটি পুরোনো ম্যাগাজিন তাও এই টিম টিম হ্যারিকেনের আলোতে কিছু পড়া যায়না। আরাম কেদারাটি ক্যানভাসের , বসলে বেশ ভালোই লাগে। দেখলাম পাশে একটি তেল চিটচিটে বালিশ ও আছে। মাথার নিচে তাই দিয়ে শোয়ার চেষ্টা করলাম।
বাইরে তখন ঘন অন্ধকার , একটি তারাও নেই, মনে হয় যেন কেউ আকাশকে কালী দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছে। পাশের ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁ র আওয়াজ, গাছ থেকে হুতুম পেঁচার ডাক, আর দূর থেকে মাঝে মাঝে শেয়ালের শব্দ, সব মিলিয়ে আমার কাছে জায়গাটিকে ভুতুড়ে মনে হতে লাগলো।
কি আর করা , আমাকে কাল সকাল পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। চোখ বুজে ঘুমাবার চেষ্টায় থাকলাম। কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা , হটাৎ শুনি দরজা খোলার আওয়াজ। চোখ খুলে দেখি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছেন এক সাদা দাড়ি বয়স্ক লোক, পরনে রেলওয়ে মাস্টারের ইউনিফর্ম, হাতে একটি গ্যাস ল্যান্টার্ন। গ্যাস বাতিতে তার চেহারা খুব ফর্সা দেখালো বলতে গেলে অস্বাভাবিক রং। তার মাথায় টুপী যা কান পর্যন্ত ঢাকা, আর হাতে দস্তান। আমি উঠে দাঁড়ালে সে ব্যক্তি আমাকে সালাম জানালেন। আমি তিনি কে জিজ্ঞেস করবার আগেই তিনি বলে উঠলেন তিনি এ স্টেশনের পুরোনো স্টেশন মাস্টার, রাতে ডিউটিতে আসেন। আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে ডিউটির দরকার? রাতে তো এ স্টেশনে কোন ট্রেন আসেনা? বুড়ো লোকটি কিছুটা ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বললেন, আমার রাতের ডিউটি সব দিন থাকেনা, যখন দরকার হয় আমাকে ডাকা হয়। আজকে দরকার হল শুনলাম আপনি এখানে আটকে পড়েছেন তাই।
আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। আমি এখানে আটকে আছি এটাকি এতই জরুরি সংবাদ যে তার জন্য রাতের ডিউটি স্টেশন মাস্টারকে আসতে হবে?আর তাকে খবর ই বা কে দিল ? কিন্তু আমি কিছু বলবার আগেই বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার আমাকে বললেন, আপনি ক্ষুধার্ত নিশ্চই, আপনার জন্যে কিছু খাবার আর চা নিয়ে আসি। আমি অবাক হয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলাম এত রাতে আপনি খাবার কোথায় পাবেন? চায়ের দোকান তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটি উত্তর দিলেন তার জন্য আপনি চিন্তা করবেননা ,আবার সেই ফ্যাস ফ্যাসে গলায়। বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন হ্যাজাক বাতি সহ।
আমি হলফ করে বলছি বোধ হয় দু মিনিট সময় গিয়েছে,এর মধ্যে বৃদ্ধ ব্যক্তিটি উপস্থিত হলেন হাতে একটি ট্রে নিয়ে। ট্রেতে দুখানি টোস্ট বিসকুট, দুটি সেদ্ধ ডিম , দুটি কলা , আর এক গ্লাসে ধূমায়িত চা। আমার চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। ভদ্রলোক ট্রে টি টেবিলে নামিয়ে বললেন দেরি না করে খেয়ে নিন, চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমি শুধু প্রশ্ন করলাম, আপনার চা? আমি রাতে খাই না , আবার খনখনে গলায় উত্তর।
আমার বেশ খিদে পেয়ে ছিল , তাই আপাততঃ আমার বিস্ময়কে পেছনে ফেলে খাবার যা ছিল শেষ করলাম, চা টুকু। খাবার খেতে খেতে শুধু তার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম তিনি কবে অবসরে যান, কোন গ্রামে থাকেন, আর তার পরিবার বর্গ কোথায়। অবাক হলাম তিনি আমার কোন সব কথার উত্তর দিলেননা। শুধু বললেন অবসর অনেক বছর আগে , আর গলায় হাত দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলেন তার কথা বলতে অসুবিধা আছে। আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি ট্রে হাতে নিয়ে বললেন এটা ফেরত দিতে যাচ্ছেন।
বৃদ্ধ স্টেশন মাস্টার সেই যে গেলেন আর আসেননা। মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা হল, তার আর দেখা নেই। লোকটি গেলো কোথায়? হাওয়া হয়ে গেল নাকি? আমি সত্যি সত্যি ভয়ে পড়ে গেলাম ? লোকটি আসলে কি মানুষ না আর কিছু? নাকি আমি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছি ? আমি সাহস করে দরজা খুলে বাইরে গেলাম। কেউ নেই। বাইরে শুধু ঝিঁঝিঁর আওয়াজ আর হুতুম পেঁচার ডাক। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি দরজার বাইরে কলার ছিলকা , ডিমের খোসা, আর খালি চায়ের গ্লাস। আরে ? এ গুলো আমার খাওয়ার উচ্ছিষ্ট ? লোকটা তা হলে উচ্ছিষ্ট এখানে ফেলে চলে গিয়েছে? ভারী দায়ীত্ত্বজ্ঞানহীন লোকটা! যাই হোক আর কিছু না ভেবে আমি ঘরে ফিরে এসে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করলাম , কিন্তু ঘুম আর হলনা ভয়ে আর চিন্তায়।
সকালে ঘুম ভাঙ্গল স্টেশন মাস্টারের ডাকে। চোখ খুলে দেখি সূর্য অনেক আগে উঠেছে। উঠেই মাস্টার সাহেব কে বললাম রাতের সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা। আমি অবাক হলাম যে স্টেশন মাস্টার আমার কথা সাথে সাথে উড়িয়ে দিলেননা আজগুবি বা দূঃস্বপ্ন বলে। বললেন যে তিনি তার পূর্ববর্তী স্টেশন মাস্টার দের কাছ থেকে শুনেছেন যে এ স্টেশনে এক অশরীরি আত্মা আছে যে অনেক সময় রাতে ঘুরে বেড়ায় এখানে। তবে তাকে কেউ কখনো দেখেনি। স্টেশন মাস্টার এও বললেন কথিত আছে যে বহু বছর আগে ব্রিটিশ আমলে এক স্টেশন মাস্টার পতাকা দেখাতে গিয়ে এক ট্রেনের নিচে পা পিছলে পড়ে মারা যান। তার কেউ ছিলনা , স্টেশনের পাশে ঝরিয়া কবরস্থানে তাকে গোর দেয়া হয়। অনেকে মনে করে অশরীরি আত্মা হয়ত তারই। আপনি কি সত্যি তাকে দেখেছেন? স্টেশন মাস্টার একটু অবিশ্বাসের সাথে আমাকে প্রশ্ন করলেন। আমি তখন তাকে দরজার পারে রাখা ডিমের খোসা আর কলার ছিলকা দেখালাম। তিনি বললেন এগুলো তো কোন প্যাসেঞ্জার তো ফেলে যেতে পারে। আমি আর কি করি , প্লাটফর্মের দিকে রওয়ানা দিলাম।
বেশি দূর যেতে হলনা, হটাৎ দেখি সে চায়ের দোকানের মালিক হন্ত দন্ত হয়ে এসে স্টেশনে মাস্টার কে বলে কাল রাতে তার দোকান ভেঙ্গে কেউ তার বিস্কুট , ডিম্ আর কলা চুরি করেছে। আর চায়ের চুলাতে আগুন দিয়ে চা তৈরি করেছে। স্টেশন মাস্টার তার দোকানের দিকে গেলেন, সাথে সাথে আমিও। গিয়ে দেখি চায়ের চুলায় কিছু জ্বলন্ত অঙ্গার, ভাঙা ডিমের খাঁচা, আর কলার ছড়া টি মাটিতে। স্টেশন মাস্টার দেখলেন আর গম্ভীর ভাবে দোকানিকে বললেন এ সম্পর্কে আর কাউকে কিছু না বলতে। তিনি বললেন দোকানিকে তার ডিম আর কলা বিস্কুটের দাম পুষিয়ে দেবেন। তার মুখ ছিল ভীত।
আমার গৌরীপুর ফেরত যাওয়ার ট্রেন সময় মতই এলো। আমি আর কখন ঝরিয়া -জাঞ্জাইল যাইনি। আমি অনিল বাবুকে আমার এই অদ্ভুত কাহিনী বলিনি, কারন তিনি হয়ত বিশ্বাস করবেননা। পরে শুনেছি, সেই স্টেশন মাস্টার চাকরী থেকে অবসর নিয়ে নিজ জেলায় ফিরে গেছেন।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী