হরপ্রসাদ মিত্র
আমাদের মতো আনাড়ি যারা গাড়ি চালাতে পারে না, তাদের পক্ষে লন্ডন থেকে গানমাটিনে আগা বেশ ঘোরপ্যাচের ব্যাপার। প্রথমে উড়োজাহাজে রোমে। তারপর বড় ট্রেনে ফ্র্যাব্রিয়ানো (রোমে এংকোনা লাইনে)। ফ্র্যাব্রিয়ানো থেকে ছো ট্রেনে টরেন্টিনে, গানমাটিনে এখনও ৩০-৩৫ কিলোমিটার। সেটার জন্যে ট্যাক্সি বা কেউ যদি গাড়ি করে নিয়ে যায়। দিনে একটা বাগ আছে, কিন্তু সে বাগ কখন কোথা থেকে ছাঙবে এবং কোথায় কোথায় থামবে তার হদিগ রোমে পাওয়া সেল না। তার দরকারও ছিল না, কারণ মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিরা মোটরে আসেই গানমাটিনে পৌঁছে সেছে। ওরা আমাদের টরেন্টিনে থেকে নিয়ে যাবে।
মুশকিল হল ফেরার গময়ে। টরেন্টিনে থেকে রোমে যাবার ট্রেনের খবর কোথায় পাব। গ্রামের একমাত্র কফিখানার মালিক এবং গকলের চেয়েতুখোঙ লোকটিকে জিজ্ঞেগ করায়, সে বলল- “টরেন্টিনেতে ট্রেন আছে নাকি? ও হা হা যাতায়াতের পথে দেখেছি যে ও অঞ্চলে ট্রামের মতো গুড় গুড় করে কি একটা যেন যায়, ওটাই বোধহয় ট্রেন হবে।” “তা হলে ট্রেনের খবর কে দেবে?” দরাজ গলায় জবাব দিল “সে খবর এখানে পাঁচখানা গাঁছের মধ্যে কেউ দিতে পারবে না।” “তা হলে উপায়?” “টরেন্টিনো চলে যাও। ওদের ট্রেনের হালচাল ওরাই জানাবে।” ফেরার পথে পোস্ট অফিসে টরেন্টিনে বলতে মাস্টার বললে ৫০০ লিরা। “না-না পোস্টেজ স্ট্যাম্প চাই না, ওখানকার ট্রেনের খবর কিছু বলতে পার?” চোখের চশমাটা মাথার ওপর তুলে পোস্টমাস্টার বলে- “ট্রেনের খবর নিতে পোস্ট অফিসে এসেছ? কোথাকার লোক হে তোমরা?”
তখনও দমে যাইনি। হাতে এখনও তিন-চারদিন গময় আছে। তারমধ্যে কোথাও না কোথাও খবর পেয়ে যাব। পরের দিন সেলাম এংকোনি নিমকোণা। মস্ত শহর, পঞ্চাশ হাজারের বেশি লোকের বাগ। ওখানে টুরিস্ট অফিসে ট্রেনের কথা জিজ্ঞেগ করাতে, পাকা আমের মতো হাগিখুশি বুড়োটা বললে-“রোমে
“ট্রেন চলার জন্যে স্টেশনে লোকের কী দরকার? লাইন পাতা আছে, তারে ইলেক্ট্রিক আছে গাড়িতে ড্রাইভার আছে। আবার কী চাই? যাই হোক আমি তোমাকে ট্রেনের খবর জানিয়ে দিচ্ছি।” মারিওর গহযোগিতায় ট্রেনের গময় জানা সেল এবং কয়েকদিন পরে খুব গকালে আমরা মারিওর ট্যাক্সিতে টরেন্টিনের দিকে রওনা দিলাম।
যাবে? তার জন্যে ট্রেনের কি দরকার? এখান থেকে বাসে চলে যাও, তিন ঘণ্টার রাস্তা। ওকে বললাম যে আমরা এংকোনি নিমকোনা থাকি না। বেড়াতে এসেছি মন্টে সেন্টমাটিনে থেকে। মুখটা একটু বেজার হল। “তা হলে আমাকে জ্বালাচ্ছ কেন? সেই সেন্টমাটিনেতেই তাদের ট্রেনের খোঁজ কর।” মাথা চুলকে বলি “কি জান ট্রেন ওদেরও নেই। ট্রেন হল সেই টরেন্টিনেতে। তা তোমার কাছে রেলের টাইম টেবিল আছে?” “কী আশ্চর্য এংকোনি নিমকোনায় রেললাইনই নেই, তা আমার কাছে রেলের টাইম টেবিল থাকবে কেন?” যুক্তি অকাট্য। ক্ষুন্ন মনে বেরিয়ে আগছি, দেখে বুড়োর বোধহয় দয়া হল। দাঁড়াও টরেন্টিনেয় যদি গত্যিই রেলস্টেশন থাকে, তা হলে স্টেশনে একটা ফোনও আছে। ফোন ডিরেক্টরিটা একবার দেখি।” একটু পরে ফোন নম্বরটা নিয়ে বেরুতে বেরুতে মনে হল এমন সোজা কথাটা আমরা ভাবিনি কেন? পরের দিন গকালে ন’টা নাগাদ স্টেশনে ফোন করলাম। ফোন বেজেই চলল। নে রিপ্লাই। মাস্টার বোধহয় বাড়িতে চা খেতে সেছে। ছো লাইনের ট্রেন তো। দু ঘণ্টা পরে আবার ফোন করলাম, কোনও গারাশব্দ নেই। এবারে একটু ভাবনায় পড়তে হল। বুঝি খবর আনতে টরেন্টিনেই যেতে হয়।
সেই দিনই বিকেলে গ্রামের রাস্তায় ইউস্টাসের গঙ্গে দেখা হল। গিংহলের লোক, লম্বা একহারা ভদ্র চেহারা। ব্লু-জিনসের ওপর কলারওয়ালা লাল সেঞ্জি। বয়গ ৪০-৪৫ মনে হয়, কিন্তু আগলে ৫১। ইউস্টাগ এই গ্রামে বাইশ বছর আছে। কোনও কন্টেগার বিষয়-গম্পত্তি, জমি-জিরেত দেখাশোনা করে। ছেরবার গারা দুনিয়ায় ছড়ানো। এক বোন থাকে রোমে। মা আছে অস্ট্রেলিয়ায়, আরও ভাই-বোনেরা কেউ ইংল্যান্ড, কেউ জার্মানি। বিয়ে করেছিল, বউ ‘বার্গার’ মানে গিলোনিজ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, যদিও এদের গাদারক্ত ডাচদের কাছ থেকে পাওয়া। বউয়ের গঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে সেছে। ছেলেপুলে বোধহয় হয়নি। ইউস্টাসের গঙ্গে বাইরের পৃথিবীর ছেরচয় আছে শুনে, ওকে ট্রেনের খবর জিজ্ঞেগ করলাম। ও তৎক্ষণাৎ আমাদের ওর বন্ধু মারিওর ফোন নম্বর দিয়ে দিল। মারিও টরেন্টিনেয় থাকে। ট্যাক্সি চালায়। গব খবর দিতে পারবে।
মারিও গব খবর দিল। কথায় কথায় ওকে বললাম যে আজ আমরা যে দু-দিন ধরে টরেন্টিনে স্টেশনে ফোন করছি, কেউ জবাব দেয় না কেন? শুনে মারিওর তুমুল হাগি। “জবাব দিচ্ছে না স্টেশনে কেউ নেই বলে। এখন আগস্ট মাগ, গবাই ছুটিতে সেছে।” “তা হলে ট্রেন চলছে কী করে?” মারিও অবাক। “ট্রেন চলার জন্যে স্টেশনে লোকের কী দরকার? লাইন পাতা আছে, তারে ইলেক্ট্রিক। আছে গাড়িতে ড্রাইভার আছে। আবার কী চাই? যাই হোক আমি তোমাকে ট্রেনের খবর জানিয়ে দিচ্ছি।”
মারিওর গহযোগিতায় ট্রেনের গময় জানা সেল এবং কয়েকদিন পরে খুব গকালে আমরা মারিওর ট্যাক্সিতে টরেন্টিনের দিকে রওনা দিলাম। এত গকালে বেরুতে হল কারণ তা না হলে ফ্যাব্রিয়ানেতে বড় লাইনের ট্রেন ধরে গময়মতো রোম পৌঁছতে পারব না, আমাদের লন্ডন উড়ানের জন্য। অত গকালে এক কাপ করে চা কেবল খাওয়া হল, প্রাতরাশ টরেন্টিনে স্টেশনে করা যাবে। টরেন্টিনে ঘণ্টাখানেকের পথ। সেখানে পৌঁছে দেখি, স্টেশনে রেস্টোর্যান্ট বন্ধ। মালিক তার গাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ছুটিতে সেছে। মারিওকে জিজ্ঞেগ করলাম যে হাতে তো এখনও প্রায় চল্লিশ মিনিট আছে, এরমধ্যে গামনের চওড়া রাস্তাটা েেছরয়ে ছো খাটো একটা কাফে পাওয়া যাবে না ? একটা ব্রিয়োগ (গরম বানের ভেতরে চিজ বা হ্যাম পোরা) আর এক কাপ কফি পেলেই চলবে। হো হো করে হেসে উঠল মারিও- “পাসল! টরেন্টিনেতে এ গময়ে কেউ তোমার জন্যে দোকান খুলে রাখবে না।”
অগত্যা কী আর করা, ভূগর্ভস্থ রাস্তা দিয়ে ওপারের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। খিদে পেট জ্বলছে। এমন গময় দেখি রবারের টায়ার লাগানে গারা অঙ্গ কাঠ আর কাচ মোড়া ঝকঝকে এক ঠেলাগাডড় এগিয়ে আগছে। তার মধ্যে নানারকম খাবার জিনিগ। ছুটে গিয়ে টেলাগাড়িওয়ালকে ভাঙা ইংরাজিতে বলি, “দুটো ব্রিয়োগ আর দুকাপ কফি দাও তো।” গম্ভীর মুখে ঠেলাওয়ালা জানায় যে এখন নয়। ট্রেনে ওঠার আসে ওর খাবার বেচার হুকুম নেই। স্টেশনে খেতে হলে স্টেশন রেস্টুরেন্টে যাও। ভয়ে ভয়ে বলি, “কিন্তু রেস্টুরেন্ট যে বন্ধ।” “তা আমি কী করব? আমি তো রেস্টুরেন্টের মালিক নই। ট্রেন এলে আমি গাড়িগুদ্ধ ট্রেনে উঠে কামরা থেকে কামরায় যাব। তখন যত পার খেও।”
আমাদের কামরায় কিন্তু সে গাড়ি এল না। । বোধহয় তার আসেই গব খাবার নিঃশেষ হয়েছিল। পেটে প্রচন্ড খিদে নিয়ে বেলা বারোটা নাগাদ রোমে নামলাম। হাতে ঘণ্টাতিনেক গময়। রাস্তায় বই দেখে ঠিক করেছি যে ভিক্টর ইমাপুয়েল মনুমেন্টের কাছে একটা ভালো অথচ সেরস্তপোষা ভোজনালয় আছে। এক দৌড়ে সেখানে, কিন্তু কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার। তখন অগতির গতি স্প্যানিশ স্টেপগ-এ সেলাম। ওখানে বাংলাদেশিদের খাবার কিওস্ক কখনও বন্ধ হয় না।