Skip to content Skip to footer

দানিয়ুব পাড়ের দুর্গ নগরী

দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন সবে মাত্র ভ্রমণ কাহিনী পড়া শুরু করেছি। বাসার গল্পের বইয়ের তাকে ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলী। তাঁর লেখনীর মাধ্যমেই দানিয়ুব নামটার সাথে পরিচয়। সে সময় আবছা এরকম একটি ধারনা তৈরি হয়েছিল- শান্ত স্বভাবের দানিয়ুব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কৃষ্ণ সাগরে গিয়ে মিশেছে। অস্ট্রিয়া , হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়াতে দানিয়ুবের দেখা পেয়েছি , কিন্তু ঠিক কি যেন বুঝতে পারিনি। সেটাও স্পষ্ট করে এখন বলতে পারবো না কি বুঝিনি।
দানিয়ুবের মোহনীয়তা, কমনীয়তা ধরা পড়েছে আমার কাছে ডেভিন ক্যাসেল দেখতে গিয়ে। ডেভিন গ্রামের ডেভিন ক্যাসেল। হ্যাঁ স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিসলাভা থেকে ১২কিলোমিটার দূরে অবস্থান এই ঐতিহাসিক ডেভিন ক্যাসেলের।
ডেভিন ক্যাসেল শুধুমাত্র স্লোভাকিয়ার জন্যই নয়, মধ্য ইউরোপের গুরুত্বপুর্ন স্থাপনা গুলোর মধ্যে অন্যতম। নদীর তীরবর্তি হবার দরুন এখানে মানুষ বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নিওলিথিক যুগ থেকে। আর বর্তমানে এই ডেভিন গ্রাম স্লোভাকের প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে কাজ করছে। নতুন পাথরের যুগ থেকে একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ডেভিন ক্যাসেল ইউরোপের জাতীয়, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক জীবন এমনকি পর্যটনের জন্য একটি উল্লেখ্যযোগ্য স্থান বলে বিবেচিত ।
ডেভিন ক্যাসেলকে ১৯৬১ সালে স্লোভাকিয়ার জাতীয় সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ক্যাসেলটির অবস্থান সমুদ্র সমতল থেকে ৭০০ ফুট উঁচুতে টিলার উপর দানিয়ুব ও মরাভিয়া নদীর মাঝে।

ইতিহাসে ডেভিন ক্যাসেল
ডেভিন ক্যাসেল স্লোভাকিয়ার একটি জাতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সত্যি কথা বলতে, ডেভিন ক্যাসেল এবং স্লোভাক এই দুটি নাম বর্তমান স্লোভাকিয়ায় একে অপরের পরিপূরক।
ডেভিন ক্যাসেলের কথা বলতে গেলে একটু পেছনে না তাকালে আসলে গল্পটা অসম্পুর্ন থেকে যাবে। পাথুরে টিলার উপর মধ্যযুগের এই দুর্গ নির্মানের বড় কারণ দুটো কারণ হলো রাজনৈতিক। নিজের অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত রাখা আর অর্থনৈতিক বিষয়টা যুক্ত হয়েছে নদী পথে ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনায়।
অষ্টম শতকে প্রথমে এখানে একটি কাঠের দুর্গ নির্মান করা হয়। তারও প্রায় একশ বছর পর এখানে দুর্গ নগরী গড়ে ওঠে রাজার বাসস্থান সহ। যুগে যুগে এই দুর্গ নগরীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজারা। তেরশ শতকে এটি হাঙ্গেরি কিংডমের অধীনস্ত হয়। একইভাবে চৌদ্দশ শতকে অস্ট্রিয়া , পরে আবারও হাঙ্গেরি কিংডমের অধিকারে যায়। ১৪৪৪ সালে জার্মানীর ফ্রেড্রিক ফোর ডেভিন ক্যাসেল দখল করেন। সময়ের পরিক্রমায় হাত বদল হতে থাকে এই দুর্গ নগরী। সর্বশেষ দুর্গটি উনিশ শতকে স্লোভাকিয়ার পাফি রাজবংশের অধিকারে ছিল। ১৮০৯ সালে নেপোলিয়ানের আর্মি ডেভিন ক্যালেসটি ধ্বংসস্তূপে পরিনত করে।
আধুনিক যুগেও ডেভিন ক্যাসেলের রাজনৈতিক গুরুত্ব এতটুকু কমেনি কারন এর অবস্থান পুর্ব সোভিয়েত আর পশ্চিমা দেশের সীমান্ত রেখায় । ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত এই সীমান্ত এলাকা “ মিলিটারি রেস্ট্রিটেড জোন” ছিল চেকোস্লোভাকিয়া তিন খন্ডে ভাগ হবার আগ পর্যন্ত।
যেমন দেখেছি ডেভিন ক্যাসেল
ব্রাতিস্লাভা শহরের প্রায় মাঝামাঝি ছিল আমার থাকবার হোস্টেল। ভ্রমণ খরচ কমাবার জন্যই হোস্টেলে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেনজেনভুক্ত দেশগুলো ভ্রমনের সময় আমি সব সময়ই বেছে নিয়েছি হোস্টেল, ডরমেটরি অথবা এয়ারবিএনবি। সেখনাকার অভ্যর্থনা কক্ষে ডেভিন ক্যাসেলের কথা বলার সাথে সাথে আমার হাতে একটি ম্যাপ ধরিয়ে দেয়া হলো। শুধু তাই নয় ম্যাপে কলম দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো যাবার উপায়। ইউরোপ ভ্রমণই মুলত আমাকে অভ্যস্ত করেছে ম্যাপ দেখে যেকোন স্থান খুঁজে বের করা। সেটা নিজের টেলিফোন সেটের গুগল ম্যাপ হোক অথবা হোটেল না হোস্টেল থেকে সরবরাহ করা কাগজের ম্যাপই হোক।
হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ৩/৪ মিনিট হেঁটে ট্রামে করে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে ডেভিন ক্যাসেল যেতে হয়। ডেভিন ক্যাসেল যাবার জন্য আলাদা বাসই নিয়োজিত আছে। সেই বাসস্ট্যান্ড থেকে ডেভিন ক্যাসেল যেতে ৩০মিনিট সময় লাগে।
বাস একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিল। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিছুদূর যাবার পরই দেখতে পাচ্ছিলাম দুর্গের চূড়া। বেশ খানিকটা মানে, ১০/১৫ মিনিট পায়ে হেঁটে যাবার পর টিকিট ঘর দেখতে পেলাম। ইউরোপের স্টুডেন্ট হবার দরুন টিকিটের দাম অর্ধেক রাখা হোল। সব না, কিছু কিছু পুর্ব এবং মধ্য ইউরোপের দেশ গুলোতে স্টুডেন্টদের জন্য মিউজিয়াম এবং ঐতিহাসিক স্থান গুলো ভ্রমনে এই সুবিধা পেয়েছি। তবে গ্রীসের কথা বেশি করে মনে আছে , কারন সেখানে স্টুডেন্টদের জন্য দর্শনীয় স্থান গুলোতে বিনা টিকিটেই যাওয়া যায় , শুধু টিকেট ঘরে শিক্ষার্থী হবার পরিচয় পত্র দেখাতে হবে।
টিকেট নিশ্চিত হবার পর আবারও হাঁটতে হবে। পাথুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় ভাবছিলাম , সেই মধ্যযুগে এই রাস্তা দিয়ে কারা হেঁটে গেছেন। শুধু কি সৈন্য-সামন্তরা বা ঘোড়া ,হাতি এই রাস্তা দিয়ে যেত, নাকি রাজারাও যেতেন। নেপোনিয়ানের আর্মি দল যখন এই দুর্গ দখল করেছিল বা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল , তখন কি তিনি এখানে এসেছিলেন। আচ্ছা ধরে নিচ্ছি এসেছিলেন, তাহলে কোন পথ দিয়ে গেছেন? আমি কি সেই একই পথে হাঁটছি? এরকম নানা অমুলক কথা চিন্তা করতে করতে এসে পৌঁছলাম ডেভিন ক্যাসেলের সামনে। ভিতরে যাবার আগে কিছুক্ষন তাকিয়ে দেখতে থাকলাম মধ্যযুগের দুর্গনগরী।
বর্তমানে যেটুকু টিকে আছে, সেখানে রাজা বা সম্রাটদের বাসস্থানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে প্রতিটি স্তরে সেখানকার লিখিত ইতিহাস থেকে অনুমান করে নিতে হবে অবয়ব। টিকে থাকা দুর্গটি আমার কাছে পুরোটাই একটি প্রকান্ড পাথর খন্ড মনে হয়েছে।
দুর্গের শীর্ষে উঠবার পর আপনি উপভোগ করতে পারবেন দানিয়ুব আর মরাভিয়া নদীর আসল সৌন্দর্য। দুর্গের উপর থেকে দুই নদীর নীল জলরাশি আর সামনের ঘন জঙ্গল আপনাকে কিঞ্চিৎ হলেও মধ্যযুগের কথা মনে করিয়ে দিবে। শীর্ষ থেকে ডেভিন গ্রামের চারপাশ এবং বহতা নদী বহুদূর দৃষ্টিগোচর হয়। সেই থেকেই বোঝা যাচ্ছে দুর্গনগরী হিসেবে কেন এই অঞ্চলকে বেছে নেয়া হয়েছে।
আমি যেহেতু গ্রীষ্মের সময় ভ্রমণ করছিলাম তাই আকাশ একদম পরিস্কার ছিল আর উপর থেকে দানিয়ুব আমাকে তার দিকে বার বার ইশারা করছিল শরীর ও মন ভেজাবার জন্য। সেটা সম্ভব ছিল না, কারন ভ্রমণ লিস্টও তাড়া দিচ্ছিল অন্য স্থানগুলো দেখবার জন্য।
পুরো চত্বরে দেখেছি দুটি মিউজিয়াম একটি সাময়িক আর একটি দুর্গের নিচে। দুর্গের নিচেরটিকে মনে করা হয় এটি ছিল দুর্গের গোপন কুঠুরি। আর সাময়িক মিউজিয়ামটি মূল দুর্গ কেন্দ্রের খোলা জায়গায়। মিউজিয়ামগুলোতে নানা তথ্যের সাথে আছে সেই সময়ের ব্যবহার্য জিনিসপত্র , অস্ত্র , পোশাক। গোটা ডেভিন ক্যাসেল ভালো করে দেখতে হলে দিনের প্রায় আধা বেলা দিতে হবে।

দানিয়ুবের পাড়ে
দুর্গের উপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম নদীর ধারে একটি সাইকেলের পথ। সেখানে পর্যটকরা সাইকেলে ঘুরে দেখছেন দানিয়ুবের রূপ। প্রায় ২০কিলোমিটার দীর্ঘ সাইকেলের পথ রয়েছে দুই নদীর ধারে। ক্যাসেল থেকে বের হয়ে সেদিকে গেলাম। পায়ে হাঁটার পথও আছে। দানিয়ুবের পাড়ে ক্যাসেলের গা ঘেঁষে রয়েছে স্লোভাকিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ। দেখতে পেলাম ,সাইকেলে পর্যটকরা চলে যাচ্ছেন গ্রামের ভিতরে , স্লোভাক গ্রামীন জীবন দেখবার জন্যে।
আমি ধীর পায়ে দানিয়ুবের হাওয়া খেতে খেতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে অগ্রসর হলাম। পেছন ফিরে আরও একবার দেখে নিলাম মধ্যযুগের স্মৃতি বহনকারি ডেভিন ক্যাসেল।
বাসে অন্য গন্তব্যে যাবার পথে ভাবতে থাকলাম আমাদেরও তো রয়েছে এরকম জলদুর্গ, দুর্গনগরী। পৃথিবীর কটা পর্যটক আসলে সে কথা জানে। পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম, আমরা নিজেরা কতটুকু জানি বা হেরিটেজ ভ্রমনে বের হই নিজের দেশে।
নিশ্চয়ই আমরাও একদিন ইতিহাস সংরক্ষনে সচেতন হবো, আমাদের হেরিটেজের গল্পও ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে।

এলিজা বিনতে এলাহী , পর্যটক ও শিক্ষক