Skip to content Skip to footer

দাভোস: আল্পসের আলো-ছায়ার দিনলিপি

ইসমাইল হোসেন

বিদেশের প্রকৃতিকে বর্ণনা করা আসলেই এক বিদেশীর পক্ষে কঠিন কাজ। আমি তো কর্কটক্রান্তির অঞ্চলের মানুষ, বেড়ে উঠেছি বর্ষামুখর বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর ভাটিপ্রবাহে। আমার মানসপটে চিরকাল ঘুরে বেড়িয়েছে জসীমউদ্দিন, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ কিংবা বিভূতিভূষণের শব্দচিত্র। তাই যখন আলপ্স পর্বতের উপত্যকা, বরফে ঢাকা বন বা ঝলমলে শৃঙ্গের সামনে দাঁড়ালাম, তখন বুঝলাম—এই অপরিচিত সৌন্দর্য আমি যতই দেখি না কেন, তার গভীরে পৌঁছানো আমার পক্ষে সহজ নয়।

গাড়ির জানালা দিয়ে শীতঘেরা দৃশ্যাবলি চোখে আসছিল দ্রুততার সঙ্গে। প্রতিটি ফ্রেম ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করছিলাম, আর মনে হচ্ছিল—যে-যে অঞ্চলের মানুষ, তাদের কাছে তাদের নিজস্ব ভূপ্রকৃতিই সবচেয়ে প্রিয় ও সুন্দর। হঠাৎ মনে পড়ল, ২০০৫ সালে গ্রীষ্মে গিয়েছিলাম কাশ্মীরে। শ্রীনগর, পেহেলগাঁও, সোনমার্গ—সবখানেই অবিশ্বাস্য রূপ। স্থানীয়রা বলত, কাশ্মীর নাকি ‘প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’। কিন্তু আলপ্সের পথে গাড়ি ছুটতে ছুটতে মনে হলো, প্রতিটি পাহাড়-উপত্যকার সৌন্দর্য আসলে একান্ত নিজস্ব; দীর্ঘদিন সেখানে বাস না করলে তার আসল রূপ ধরা দেয় না।

দাভোসের পথে হঠাৎ গাড়ি থামাতে হলো। জানুয়ারি মাস, পাহাড়ের গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে পাতা ঝরানো বৃক্ষরাজি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিটি ডালপালায় জমে আছে তুলোর মতো বরফ—সেই বরফের স্তর সূর্যালোকে ঝলমল করছে। মনে হচ্ছিল, পুরো বনে কেউ যেনো সাদা আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়েছে।

উচ্চতা বাড়তে থাকলেই প্রকৃতির রূপও বদলায়। এটা আমি প্রথম বুঝেছিলাম বহু আগে গঙ্গোত্রীর পথে। এখানেও তাই—দাভোসের দিকে এগোতে এগোতে বদলে যাচ্ছিল গাছের ধরন। হঠাৎ চোখে পড়ল বরফাচ্ছাদিত উপত্যকার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা এক ক্ষীণ স্রোতধারা। আশেপাশে হিমশীতল পরিবেশ, অথচ সেই জল টলটল করে বইছে। নদীর তীরে দেখা গেলো কয়েকটি মোহনা হাঁস। নির্বিকার ভঙ্গিতে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেনো আমাদের এ শীত-শীত খেলা তাদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ।

দাভোস তখন প্রস্তুত হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জন্য। স্থানীয়রা নিজেদের কটেজ ও অ্যাপার্টমেন্ট অতি উচ্চমূল্যে অতিথিদের কাছে ভাড়া দিয়ে চলে যায় দক্ষিণ ইউরোপের উষ্ণ এলাকায়।

প্রথম সকালের অভিজ্ঞতা আজও ভুলতে পারিনি। ভোর সাতটা পর্যন্ত সূর্যের দেখা নেই। তারপর ধীরে ধীরে পাহাড়ের চূড়ায় পড়তে শুরু করল সূর্যের মোলায়েম আভা। একেক মুহূর্তে একেক গাছের শরীরে আলো এসে পড়ছে, যেন স্বর্গীয় রশ্মি ধীরে ধীরে বনকে জাগিয়ে তুলছে। এরকম দ্রুত দৃশ্যপটের রূপান্তর আমি আগেও দেখেছি—নেপালের অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয়ের সময়। সেই সৌন্দর্য বর্ণনার ভাষা কখনো যথেষ্ট হয় না।

শীতের তীব্রতা সহ্য করা সত্যিই কঠিন ছিল। কয়েক মিনিট বাইরে দাঁড়ালেই বুটের ভেতর পা জমে যেত। কিন্তু দাভোসের নীরবতা, সাদা বরফে ঢাকা বাড়িঘরগুলো যেন আহ্বান জানাত অতিথিদের—“এসো, আমাদের ভেতরে আশ্রয় নাও।”

একদিন শহরের বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বিস্তীর্ণ জমাট বাঁধা এক হ্রদ চোখে পড়ল। উপরে এতোটাই বরফ জমে গেছে যে মানুষ দিব্যি তার উপর স্কি করছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল কোনো ফুটবল মাঠ। আমিও নামতে পারতাম, কিন্তু পলিমাটির দেশে বড় হওয়া শরীর সাহস পেল না বিনা সরঞ্জামে সেই বরফের মসৃণ পথে হাঁটার।

সেই শুভ্র নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম—কোনটা বেশি আপন? ভিড়ে ভরা দক্ষিণ এশিয়া, নাকি ধূলিকণাহীন নির্মল এই দিগন্ত?

হিমালয় আর আল্পস—দুটোই ভিন্ন ভিন্ন মহিমায় উজ্জ্বল। হিমালয়ে চিরহরিৎ বনানীর আধিক্য, আল্পসে পত্রঝরা বৃক্ষরাজি। শরতে আল্পসের বন যেনো রঙের উল্লাসে জ্বলে ওঠে, আর শীতে পুরো প্রকৃতি সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকে।

দাভোসের আরেকটি সকালে হোটেলের কাঁচের দেয়াল ঘেরা ঘর থেকে সূর্যোদয় দেখছিলাম। বাইরে এক সারি সাইকেল রাখা, যা আহ্বান করছিল সাহসী অভিযাত্রীদের। একটু দূরে এক দম্পতি বরফে ঢাকা রাস্তায় ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল স্কি করার প্রস্তুতি নিয়ে। আরেক কোণে দেখলাম এক কিশোর একা বসে আছে বেঞ্চে, হাতে স্কি-জ্যাকেট আর মুখে বিস্কুট—সম্ভবত বন্ধুর অপেক্ষায়। সেই মুহূর্তে মনে হলো, এই নিঃশব্দ শুভ্রতার মাঝেই হয়তো তার ছোট্ট আনন্দ।

রাস্তার গলিতে দুলছিল লাল পটভূমিতে সাদা ক্রসখচিত সুইস পতাকা। ইউরোপের আর দশটা শহরের মতো নয়, দাভোসের পতাকা যেন ইতিহাস আর গৌরবেরই প্রতীক।

দিনশেষে অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার পথে লক্ষ্য করলাম—একটি ল্যাম্পপোস্টে জমে থাকা বরফ নকশা কেটে তৈরি করেছে অপূর্ব নান্দনিকতা। চারপাশে সোডিয়াম বাতির প্রতিফলনে বরফ যেনো আলোয় ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি নিজ হাতে তৈরি করেছে স্বর্গীয় এক আভা।