Skip to content Skip to footer

“দুনিয়ার সেরা বিমানবন্দর”

লিখেছেন: মোঃ মাহমুদুল কবীর

পঞ্চাশ মিনিট আকাশচারণের পর স্বর্গরাজ্যের ভূমি স্পর্শ করা গেল। আমরা ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পারোতে পৌঁছালাম। বিমানে উঠার আগের গল্পটা দুঃস্বপ্নের মত। আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর ১২:২০ মিনিটে। আমরা বেশ খানিকটা সময় হাতে রেখেই বাসা থেকে রওনা দেই। কালশি ফ্লাইওভারে উঠার পরেই দেখি গাড়ি আর আগায় না। ঢাকা শহরের জানজট আমাদের অপরিচিত কিছু নয়। এইসব বিবেচনায় রেখেই আমরা রাস্তায় বের হই। কিছুক্ষণ আটকে থেকে বুঝলাম এটা সাধারণ কোন জ্যাম নয়। ১০/১৫ মিনিটেও যখন গাড়ির চাকা এক চক্কর ঘুরে না গুগল ম্যাপ তখন বলে “its getting worse!” একা হলে কোন চিন্তা না করেই নেমে হাঁটা দিতাম। কিন্তু…….. তাই অপেক্ষা করতে থাকলাম ছোটখাট মিরাকলের। হয়তো হঠাৎ করে জ্যামটা ছেড়ে দিবে। তেমন কিছুই ঘটল না। এরমাঝে শুনলাম টঙ্গিতে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপ নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করছে। ব্যাগ বোঁচকা সহই রাস্তায় নেমে গেলাম। আমার কাছে বিশাল এক লাগেজ, বউয়ের কাঁধে ব্যাকপ্যাক। লাগেজটাকে কিছুটা হিঁচড়ে কিছুটা হাতে করে কিছু অংশ মাথায় করে ছুটলাম এয়ারপোর্টের দিকে। অবশ্য রাস্তায় আমরা একা না, অনেকেই আমাদের মত গাট্টি বোঁচকা নিয়ে আমাদের সাথে হাঁটছে। আমার সহযাত্রিনী হাঁটুর ব্যাথা উপেক্ষা করে আমার সাথে ভালই পাল্লা দিয়েছে। এমন করে যখন এয়ারপোর্টে ঢুকে  আমাদের বিমানের কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে এগারোটা। কাউন্টারে কেউ নেই, যদিও ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে চেক-ইন চলছে। আশেপাশে বাংলাদেশ বিমানের লোকজনকে জিজ্ঞেস করায় তারা বলে কাউন্টারতো বন্ধ হয়ে গেছে। আপনাদের ফ্লাইট কয়টায় ছিল? ১২:২০ বলার পর তারা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল যে ফ্লাইটের এক ঘন্টা আগে কাউন্টার বন্ধ হয়ে যায়, এবং তারা আমাদের কোন সাহায্যই করতে পারবে না। আমরা ফ্লাইট মিস করেছি। জীবন সঙ্গিনীর সাথে প্রথম বিদেশ যাত্রা, অফিসিয়াল ট্যুরের বাইরে আমারও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। বিমান টেকেটটাও বিয়ের গিফট। না যেতে পারলে উপহারদাতারাও কথা শুনাতে ছাড়বে না। এই ফ্লাইটটাই মিস করলাম!! উদভ্রান্তের মত কিছুক্ষণ ছুটাছুটির পর কাউন্টারের সামনে একজনকে দেখা গেল। কাছে গিয়ে দেখি তাঁর গলায় আমাদের এয়ারলাইন্সের লগোওয়ালা টাই ঝুলছে। তাকে দেখে মনে হলো ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো ধরতে পেরেছে। ভদ্রলোক বললেন চিন্তার কিছু নেই আমরাই ওই বিমানের প্রথম যাত্রী!! আর কেউ এখনো এসে পৌঁছায়নি। এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। অবশেষে দুপুর আড়াইটায় বিমান উড়ল……

ছোট্ট বিমান, তবুও প্রায় পুরোটাই ফাঁকা। আমরা দুজন ছাড়া দুটি বাংলাদেশি পরিবার আর ছয় জনের এক চাইনীজ গ্রুপ। যাত্রী সাকুল্যে ১৫ জন। বিমান থেকে নামার পালা। বিমান থেকে নামার দুইটি পদ্ধতি আছে। একটি বন্ধ টানেলের মধ্য দিয়ে একেবারে টার্মিনালের ভিতরে মানে বিল্ডিং এর ভিতরে ঢুকে যাওয়া। আরেকটি সিড়ি দিয়ে খোলা জায়গায় নামা। আমরা সিড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ের সাড়ি নিয়ে ভিউকার্ডের ছবির মত উপত্যকাটি আমাদের অপেক্ষায়। বিমানবন্দরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমরা বুঝি পথ ভুল করে কোন এক রাজবাড়িতে এসে নেমেছি। রাজপোষাক পরা কর্মচারীরা আমাদের স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছে।

বিমানবন্দরের মাটিতে নামলে সেখানে থাকা কর্মচারীরা যাত্রীদের কড়া নজরদারিতে রাখে। যাত্রীদের সাধারণত বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বাস এসে তাদের টার্মিনালে নিয়ে যায়। এদিক সেদিক যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এখানে তেমন কিছু দেখলাম না। যাত্রীরা হাসিমুখে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে, ছবি তুলছে। বিমান কর্মীরাও হাসিমুখে তাদের দেখছে। বেশ একটা হাসিখুশি পরিবেশ।

এই ফাঁকে পারো বিমানবন্দর সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। এটি পৃথিবীর অতি ঝুকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর একটি। হাতেগোনা কয়েকজন সুদক্ষ পাইলট এই বিমান বন্দরে উঠানামা করার অধিকার রাখে। কারণটা চারদিকে তাকালেই বুঝা যায়। বিমানবন্দরটি উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। পাহাড়ের ফাঁকা দিয়ে হঠাৎ করেই রানওয়েটা দৃশ্যমান হয়, খুব বেশি আগে থেকে দেখার সুযোগ নেই। মাত্র দুটি এয়ারলাইন্স এখানে অপারেট করে, দুটিই ভুটানের।

আমরা ঝুঁকিপূর্ণ, ছোট্ট ছিমছাম বিমান বন্দরের এরাইভাল টার্মিনালে প্রবেশ করি। ইমিগ্রেশন অফিসাররা হাসিমুখে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। ইমিগ্রেশন ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি আমার পিছনে মানি এক্সচেঞ্জ। আমার ডলার ভাঙানো দরকার। কিন্তু ইমিগ্রেশন পার হলেতো উল্টো ঘুরার সুযোগ নেই। এর আগে দুনিয়ার যত এয়ারপোর্টে গিয়েছি সবখানেই দেখেছি ইমিগ্রেশন কাউন্টার জিনিসটা রেক্টিফায়ারের মত, কেবল একদিকে যাওয়া যায়। ইমিগ্রেশন পার হয়ে সোজা সামনে হাঁটতে হয়, পিছন ফিরে তাকানোটাও যেন কবিরা গোনাহ!! আমি ইমিগ্রেশন অফিসারকে বললাম আমার ডলার ভাঙাতে হবে তাই আমি একটু পরে ইমিগ্রেশন ক্রস করতে চাই। সে বললো কোন সমস্যা নেই, তুমি আগে ইমিগ্রেশনের ফরমালিটি সেরে ফেল, পরে গিয়ে ডলার ভাঙিয়ে আনতে পারবে!! সত্যি তার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এর মাঝেই দেখা গেল লাগেজ বেল্টে আমাদের মালপত্র চলে এসেছে। ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার স্ত্রীকে বলল তুমি চাইলে আগে লাগেজ নিয়ে আসতে পারো পরে তোমার পাসপোর্টে সিল দিচ্ছি। আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একজন বিদেশি নাগরিক পাসপোর্ট না দেখিয়েই ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ নিয়ে ফিরে আসল। এও কি সম্ভব!! এই বর্ণনা পড়ে মনে হতে পারে সেখানে চরম অব্যবস্থাপনা চলছে। আসলে মোটেই তা নয়। বরং তারা যাত্রীদের সুবিধা অসুবিধাকে সবার আগে স্থান দেয় আর সবাইকে খুব বেশি বিশ্বাস করে।

আমার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা খুব অল্প। তারপরেও বিভিন্ন দেশে ইমিগ্রেশন পুলিশের আছে বিভিন্ন রকম আতিথেয়তা পেয়েছি। জীবনে প্রথমবার যখন বিদেশী পুলিশের মুখোমুখি হই তখন সে আমার পাসপোর্টে সিল মারার সময় খুব বিরস বদনে বলেছিল “Welcome to Italy!” সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে প্রতিবেশী দেশে। ভাগ্য ভাল কথোপকথনটা বাংলায় ছিল। আর সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার ভ্রমণ করা একমাত্র মুসলিম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। কৃষ্ণকায় চেহারা আর বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখে চোখ ধাঁধানো আরব সুন্দরী আমার দিকে এমন অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল যে নিজের মানব পরিচয় নিয়েই সন্দেহ জেগেছিল। সেইসব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ভুটানিজ সেই ইমিগ্রেশন অফিসারকে মনে হয়েছে দেবদূত! অন এরাইভাল ভিসার সিল দিতে গিয়ে যখন দেখে আমার এই পাসপোর্টটা একেবারে নতুন তখন বলল “I am very lucky to stamp on this passport for the first time!” আমি জংখা ভাষায় বললাম “কাদিনচে”। সে উত্তরে বলল “ধন্যবাদ!!”

বের হওয়ার সময় এক্সিট গেটের আগে দেখি একজন টুরিস্টদের জন্য সিমকার্ড বিক্রি করছে । দুটা কিনে ফেললাম। পরবর্তিতে টের পেয়েছিলাম আমার সঙ্গিনী তার সিমে ইন্টারনেট এক্টিভ করিয়ে নিলেও আমি সেই কাজটি করিনি। পরদিন এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলাম সিম বিক্রেতা সেই মেয়েকে সমস্যাটা দেখাই। মুশকিল হচ্ছে সে বসে এক্সিট গেটের ঠিক আগে। স্বয়ংক্রিয় গেটটি একমুখী, ভিতর থেকে বের হওয়া গেলেও বাইরে থেকে ঢুকা যায় না। তাই আমরা Staff Only এন্ট্রি গেটে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডকে আমাদের প্রয়োজন বলার পর সে নিজে পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে গেছে। অন্য কোন দেশে এমন আবদার করলে তাকে ঘাড় ধাক্কা দেওয়াও অসম্ভব না।

বিমান বন্দরের ভিতরে সবকিছুর দাম সাধারণত অস্বাভাবিক থাকে। সেদিক থেকেও পারোকে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। বাইরের সাথে এয়ারপোর্টের ভিতরের দামের পার্থক্য সহনীয় মাত্রার। তাই ফেরার সময় ভিতরের একমাত্র বইয়ের দোকান থেকে একটা বই আর কিছু ভিউকার্ড কিনে ফেলি। পারো এয়ারপোর্টের সবকিছুতেই আমি মুগ্ধ হয়েছি। এয়ারপোর্টটি ছোট, খুব একটা ব্যস্তও না। তাই বোধয় নিয়ম কানুনে এমন শিথিলতা আর স্টাফরাও এতটা বন্ধুবৎসল। খুব বড় বিমান বন্দরে এমন পরিবেশ আশা করাটা নিশ্চই বোকামি। শুনেছি অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে ইমিগ্রেশন পুলিশের চেহারাও দেখতে হয় না। ভিসা থাকলে পাসপোর্ট স্ক্যান করেই সোজা ঢুকে পড়া যায়। সেখানে যাওয়া হয়নি। বিভিন্ন জরিপে গত বেশকিছু বছর ধরে পৃথিবীর সেরা এয়ারপোর্টের তালিকায় এক নম্বরে থাকা সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট দেখার সুযোগ হয় ২০২০ সালে। এয়ারপোর্ট হিসেবে সেটা অসাধারণ! পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ইনডোর ওয়াটারফল সহ আরো অত্যাধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ চাঙ্গির সার্ভিসও দারুণ। তারপরেও পারোতে কীযেন একটা আছে যা অন্য কোথাও পাইনি। আমার এই অতি অল্প অভিজ্ঞতায় যেকোন এয়ারপোর্টকে পৃথিবীর সেরা রায় দিয়ে দেওয়াটা অবশ্যই বাড়াবাড়ি। তবুও এইটুকু বলতে পারি পারো আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বিমানবন্দর। আশা করব এই বিমান বন্দরের ব্যস্ততা কখনো বাড়বে না, তার চেহারা আর আচরণও বদলাবে না।