Skip to content Skip to footer

দ্বিচক্রযানে মুজিবনগর

 

দলে আমরা চারজন। কম লোক মানে ঝামেলাও কম। সবাই বাইসাইকেল চালনায় সিদ্ধহস্ত, যদিও সাইকেলটা চালাতে হয় পা দিয়েই। যাব লালনের দেশ কুষ্টিয়ায়। দেখব মুজিবনগরও। সাইকেলে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় এর আগেও গিয়েছি। তাই বলে এতটা পথ এক দিনে পাড়ি দেওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়! সাগর ভাই আমাদের পথপ্রদর্শক, সাহসের ভাণ্ডার। তিনি বললেন, আরে, এটাই তো চ্যালেঞ্জ আর অ্যাডভেঞ্চারের মজা। আর তাই তো আমাদের এ দলে তারাই সুযোগ পেয়েছে, যাদের পা দুখানি জব্বর শক্তপোক্ত। আরিফ ভাই পাহাড়-পর্বতে সাইকেল চালান আর বাঁশিওয়ালা মফিজও বেশ শক্তসমর্থ। এ ধরনের ভ্রমণে আগে থেকে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়। এই যেমন সাইকেলগুলো এতটা দূরত্বের পথ অতিক্রম করতে পারবে কি না তা আগে থেকে নিশ্চিত হওয়া। টিউব, পামপারসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখা। সাইকেলের পেছনের চাকার ওপর ক্যারিয়ারের দুই পাশে প্যানিয়ার (প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার ব্যাগ) থাকাটা জরুরি। লং রাইডে পিঠে ব্যাগ রাখাটা বেশ কষ্টকর।
যথাযথ প্রস্তুতির পর ভোরের অন্ধকারে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। যত ভোরে শুরু করা যায় ততই ভালো। কারণ রোদের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করে। আগেই ঠিক করা ছিল পথে অতি জরুরি কিছু ছাড়া কোনো যাত্রাবিরতি হবে না। তারই ফলাফল পাঁচ ঘণ্টায় পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। পেছনে ফেলে এসেছি ৮৭ কিলোমিটার।
নাশতা সেরে ফেরিতে উঠে পড়লাম। ফেরি পার হয়ে ফরিদপুরের রাজবাড়ীর পথ ধরলাম। রাস্তা একদম পরিপাটি। কিন্তু মনে হচ্ছিল এ পথের যেন কোনো শেষ নেই। বড় বাসগুলোর দিকে লক্ষ রেখে চালাচ্ছিলাম। পথে মানুষজনের বিচিত্র কৌতূহলে বেশ মজাই পেলাম। ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি—শুনে একেকজনের চোখ তো চড়কগাছ।
বেলা গড়ালে রোদের তাপটাও বাড়ে আর আমাদের গতিও একটু মন্থর হয়ে আসে। পথের ধারের এক নিরিবিলি গ্রামে হয় চা বিরতি।
একটানা চলতে চলতে মাথা আর পা অবশ হতে শুরু করে। কিন্তু গন্তব্যের টানে শুধুই ছুটে চলা। তার পরও অবস্থা এমন হলো যে একবার তো সাইকেল থামিয়ে রাস্তার ধারে শুয়েই পড়লাম। সঙ্গীরা এসে সাহস জোগাল। এভাবে একসময় পৌঁছে গেলাম কুষ্টিয়ায়। তখন প্রায় রাত ৮টা। সাইকেলের মিটারে দেখাচ্ছে ১৭০ কিলোমিটার। রাতে মাথা গোঁজার জায়গা হিসেবে ঠিক হলো সরকারি রেস্ট হাউস। আর সেটা সম্ভব হলো এক বন্ধুর বদৌলতে। শুতে যাওয়ার আগে পরদিনের পরিকল্পনাটা হয়ে গেল। শরীর আর চলছে না। এক দিনে কুষ্টিয়া আসার আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
ভোরে সাইকেল পরিষ্কার করে রওনা হলাম মেহেরপুরের পথে। রাস্তাগুলো সত্যিই অসাধারণ। শীতের সকাল। কুয়াশার হালকা চাদর ভেদ করে এগিয়ে চলা। আজ আমাদের তেমন একটা তাড়া নেই। একটু রয়ে-সয়েই যেতে পারব। মাত্র ৮০ কিলোমিটারের পথ। এ অঞ্চলে আমের ফলন ভালো হয়, তাই পথে পথে আমের অনেক বাগান পেলাম। এখানকার কলার স্বাদও বেশ। এক বটের ছায়ায় বসে আমরা বেহিসাবে কলা সাবাড় করে দিলাম। আরিফ ভাই হঠাৎ আবিষ্কার করল, একটা বাঁশের মাচা পাতা আছে আমবাগানের ভেতরে। জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর আর নিরিবিলি। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লাম তাতে। এই অবসরে মফিজ ভাইও দিলেন বাঁশিতে টান। এমন পরিবেশে বাঁশির সুর মিলেমিশে এক কল্পলোকের সৃষ্টি করে। খেজুর আর পানি দিয়ে চলল শরীরে শক্তি সঞ্চয়ের কাজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার শুরু হলো যাত্রা। মেহেরপুরে দুপুরের খাবারটা সেরে মুজিবনগরের পথ ধরলাম।
মেহেরপুর থেকে মুজিবনগরের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। মুজিবনগর জিরো পয়েন্টে যখন পৌঁছালাম, তখনো দিনের আলো নেভেনি। আমাদের গর্বের এক জায়গা এই মুজিবনগর। কারণ এখানেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথগ্রহণ করে। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছেও। শ্রদ্ধা নিয়ে ঘুরে দেখি স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানটি। আম বাগান পার হয়ে একটু এগিয়ে গেলে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। বিশাল জায়গাজুড়ে মানচিত্রে পুরো বাংলাদেশকে দেখা যাবে। ছবি তুলে আবার ফিরতি পথ ধরি। ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে। যেতে হবে অনেকটা পথ। ওখানে চা খাওয়ার ফাঁকে পরিচয় হলো রুবেল আর তার বন্ধুদের সঙ্গে। এক-দুই কথায় আমাদের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে। সেই সূত্র ধরে তারা প্রস্তাব দেয়, অন্ধকারে সাইকেল নিয়ে এভাবে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমরা না হয় মোটরবাইকের আলোতে আপনাদের এগিয়ে দেব।’ ওদের সাহায্যে রাতেই ফিরে এলাম মেহেরপুর। রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে মেহেরপুর জেলা তথ্য অফিসের রেস্ট হাউসে। আমার স্কুলের বন্ধু চঞ্চলের সৌজন্যে। পরদিনের যাত্রা শুরু হলো সোনালি আভা গায়ে মেখে। আবহাওয়াটাও ছিল বেশ চমৎকার। আমঝুপির নীলকুঠিতে চলে এলাম। মেহেরপুরে নীলকুঠিগুলোর মধ্যে আমঝুপি নীলকুঠি অন্যতম। এখানে নাকি একসময় পলাশীযুদ্ধে বিজয়ী ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ বসবাস করতেন। নীলকুঠি থেকে হাতের বাঁ দিকে রয়েছে বিশাল মাঠ আর তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কাজলা নদী। কুঠিবাড়িটা ঘুরেফিরে দেখে আবার প্যাডেল মারা শুরু করি। পরবর্তী গন্তব্য শিলাইদহ, রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি। কুষ্টিয়ার গড়াই নদ পার হয়ে কুমারখালীর এক বিকল্প পথ ধরলাম। রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছিল, তাই যা-তা অবস্থা। বালুপথ, মেঠোপথ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে। রবিবাবুর কুঠিবাড়ি ঘুরেফিরে বেশ তেষ্টা পেয়েছে। কুলফিওয়ালা কিভাবে জানি আমাদের দেখে সেটা বুঝে ফেলল। এগিয়ে এলো কুলফি নিয়ে।
কুষ্টিয়া শহরে যাওয়ার পথে গড়াই নদ পার হতে হলো। মানুষভর্তি নৌকার মধ্যে মানুষসহ চারটি সাইকেল। রেলঘাট দিয়ে নৌকা থেকে নেমে গোধূলিবেলায় মীর মোশাররফ হোসেন সেতুতে এসে নামি। ওখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। শহরে একটি এনজিওয়ের রেস্ট হাউসে শেষ রাতের থাকার ব্যবস্থা হয়। ব্যাগ রেখে দ্বিচক্রযানে এবার লালনের বাড়ি ছেউড়িয়াতে। কুষ্টিয়া রেলস্টেশন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূর। ঘুরেফিরে আর গান শুনে লালন ফকিরের ‘সত্য বল সুপথে চল’ মনে গেঁথে ফিরে এলাম। ঢাকায় ফিরে সাইকেলের মিটার থেকে জানলাম চার দিনের এই ভ্রমণে পাড়ি দিয়েছি ৫৪৯.৭১ কিলোমিটার পথ।

হোমায়েদ ইসহাক মুন