Skip to content Skip to footer

পাবলো নেরুদা’র বাড়িঃ কালো দ্বীপের আলো

– মাহফুজুর রহমান

শৈশবে ইংরেজি শেখানোর জন্য শিক্ষকরা যখন ইংরেজি শব্দ মুখস্থ শুরু করালেন তখন জেনেছিলাম ‘চিলি’ মানে মরিচ। আর ক’ বছর পর ভূগোল পড়তে এসে আবিস্কার করলাম চিলি নামে একটা দেশও আছে আর তা দেখতে আবার মরিচেরই মত। সরু আর লম্বা।

দেশ হতে গেলে নির্দিষ্ট কোন আকার নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। ফলে একেক দেশের আকার একেক রকম। কিন্তু এমন সরু আর লম্বা কোন দেশ আর নেই। দক্ষিন আমেরিকার পশ্চিম পাড় জুড়ে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ধরে, আন্দেজ পর্বতমালার পাদদেশে উত্তর-দক্ষিনে ৪,৩৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশ চিলি। অথচ পূর্ব-পশ্চিমে দেশটি দু’-তিনশ কিলোমিটারের মত। সর্বোচ্চ প্রস্থ ৩৫০ কিলোমিটার। যদিও কোথাও কোথাও তা ১০০ কিলোমিটারেরও কম।

আকারের কারনে দেশটির নাম সেই শৈশব থেকেই মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু নাম মুখস্থ হলে কি হবে, দক্ষিন আমেরিকা তো বহু দূরে। ব্রাজিল বা উরুগুয়ে তখন ফুটবলের কল্যানে কিঞ্চিৎ পরিচিত। চিলি তেমন একটা না। কিন্তু হঠাৎ করেই চিলি চলে এলো খবরের শিরোনামে, ১৯৭৩ সনে। রেডিয়োর বিশ্ব সংবাদ টিউন করায় শুনলাম চিলির প্রেসিডেন্ট এয়ায়েন্দে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত। এই সংবাদটাও দাগ কাটতো না কিন্তু পরে শুনলাম এয়ায়েন্দের হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিল হচ্ছে। আরো শুনলাম চিলির কবি পাবলো নেরুদার নাম। স্কুলে কলেজে পাবলো নেরুদার কবিতা পড়া দারুন একটা আধুনিক ব্যাপার ছিলো। পাবলো নেরুদা কবিতা লিখেন স্প্যানিশ ভাষায়। ঢাকা থেকে পাবলো নেরুদার কবিতার বাংলা অনুবাদ বই আকাওে বের হয়েছে। সংগ্রাম, আন্দোলন, ভালোবাসা, প্রেমের জৈবিক সমীকরন – পাবলো নেরুদা ছাত্র জীবনের এইসব অবশ্য অনুসঙ্গের সঙ্গী।

কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সে এক অদ্ভুত সুযোগ এলো। চিলি যাওয়ার সুযোগ। ঢাকায় চিলির কোন দূতাবাস নেই। কুরিয়ারে করে পাসপোর্ট পাঠালাম নয়া দিল্লি। চিলিয়ান দূতাবাস। সঙ্গে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা চিলিয়ান ভিসা ফর্ম, তিন কপি ছবি। ঢাকাস্থ চিলিয়ান অনারারি কনসাল খুশিমনে এগিয়ে এলেন। আমার সফর সরকারি হওয়ায় ভিসা পেতে ঝামেলা হলো না। ভিসা ফি-ও লাগলোনা। দশ ডলার বেঁচে গেলো। টিকিট কাটলাম এমিরেট্স-এ। বহু দূরের পথ। দুবাইয়ে এক রাত কাটিয়ে সাও পাওলো পৌঁছলাম। ঢাকা-দুবাই সাড়ে পাঁচ ঘন্টা আর দুবাই-সাও পায়োলো চোদ্দ ঘন্টা। প্লেনে বসে থেকে থেকে শরীর প্রায় কুঁকড়ে গেছে। সাও পায়োলোতে এক রাত কাটিয়ে লান এয়ারলাইন্সে সান্তিয়াগোপৌঁছলাম। এবার আরো সাত ঘন্টা আকাশে। শরীর আর ধকল নিতে পারছেনা। এয়ারপোর্ট থেকে তিরিশ মিনিটে পৌঁছলাম হোটেল প্লাজা সানফ্রান্সিসকো। অনলাইনে আগেই বুকিং দেওয়া ছিলো। সান্তিয়াগো

ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সান্টিয়াগোর আবহাওয়া বাংলাদেশের মতই। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নিয়ে এসেছে। চোখে ঘুম। শরীরে অবশ অবশ ভাব। বোম্বে প্যালেস নামে এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট থেকে গাড়ি এসেছে হোটেলে। এও অনলাইনে আগে থেকে ঠিক করা। হোস্ট ঢাকাস্থ চিলিয়ান আনারারি কনসাল আসিফ চৌধুরী। সজ্জন ব্যক্তি। কোনভাবে এড়িয়ে যাবো সে উপায় নেই। শফার এসে আধা ইংরেজি আধা স্প্যানিশ বলে অভিভূত করার চেষ্টা করছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার গাড়িতে উঠলাম। বোম্বে প্যালেসের বাবুর্চি এক বাঙালি, বাবুল তাঁর নাম। এদ্দিন পর বাঙালি কাউকে পেয়ে তাঁর মুখ থেকে কথার ফোয়ারা ছুটছে। কিন্তু আমার চোখ মানছে না। অগত্যা বাবুলের কাছে ক্ষমা চেয়ে দ্রুত হোটেলে ফিরলাম। রুমে ঢুকে সোজা বিছানায়।

সকালে সূর্যের আলো জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রতিসরিত হয়ে বিছানার অর্ধেকটা দখল করেছে। দক্ষিন গোলার্ধের সূর্য। আমি ঘুমে কাতর হলেও সূর্যের কোন ঘুম নেই। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে যেন ডাকছে। এসময় তাই বিছানায় শুয়ে অলস সময় নষ্ট করার মানে হয়না।

ইন্টারনেটে ‘লোনলি প্লানেট’ আর ‘ট্রিপ অ্যাডভাইজার’ ব্রাউজ করে চিলিতে কি কি করনীয় হতে পাওে তার একটা তালিকা করেছিলাম। সোজা চলে গেলাম হোটেল রিসেপশনে। মোটামুটি ইংরেজি জানা একজন শফার বা গাইড চাই। এয়ায়েন্দের বাড়ি, মিউজিয়াম, সমাধিস্থল, পাবলো নেরুদার বাড়ি, প্লাজা আরমাস, কাফে কন পির্য়েনেস, মনেদা প্যালেস, পুরোনো কংগ্রেস ভবন, সান ক্রিস্টোবাল পাহাড়, ফাইন আর্ট মিউজিয়াম, বারিও বিয়াভিস্তা, মিউনিসিপ্যাল থিয়েটার, সান্তা লুসিয়া টিলা, কাসা ওরুগা, ভিনিয়ার্ড, ওয়াইনারি – আমার তালিকা বেশ বড়।

গাইডও যোগাড় করে রেখেছেন আসিফ চৌধুরী। একসময় দিল্লিস্থ চিলিয়ান দূতাবাসে কাজ করা ভারতীয় যে এখন চিলির এক তামার খনিতে কর্মরত। এক এক করে তালিকা পড়ে শুনাচ্ছি। গাইড মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বেশ অনেকগুলো সাইট হোটেলের কাছেই। পাবলো নেরুদার বাড়ি। গাইড কপাল ভাঁজ করে বললো, দূরে হবে। আমি বললাম, কি কথা। সান্তিয়াগোতে নিশ্চই নেরুদার বাড়ি আছে। শুনেছি তা এখন মিউজিয়াম। কতই বা দূর হবে।

জানলাম যে নেরুদার তিনটি বাড়ি আছে। একটা সান্তিয়াগোতে, বাকি দু’টো একশো দেড়শো কিলোমিটার দূরে। তিনটিই পর্যটন কেন্দ্র। তিনটিই মিউজিয়াম এখন। পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশন মিউজিয়ামগুলো চালায়। তবে সান্টিয়াগো’র বাড়িটা এখন বন্ধ। সংস্কার কাজ চলছে। ইসলা নেগ্রার বাড়িটা বড়। একশো কিলোমিটার দূরে। আরেকটা ভ্যালপারাইসো-তে, দেড়শো কিলোমিটার। সুতরাং ইসলা নেগ্রা যাওয়া যেতে পারে।

হোটেলের বাইরে সুন্দর আলো। গাইডের সঙ্গে কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ এসইউভি। জিএল ৪৫০। ২০১৩ মডেল। গাড়িটা দেখে মন ভরে গেলো। গাড়িচালক অ্যান্টনিও। ‘ওলা, বুয়েনাস্ দিয়াস্’ বলে তার পাশের সিটে বসে পড়লাম। স্প্যানিশ ভাষায় সুপ্রভাত বলা শিখেছিলাম বলে তা জায়গামত ছেড়ে দিলাম। এক বুক প্রশস্তি তখন। অ্যান্টনিও হাসলো, ‘বিয়েন, তু আবলা স্পানিওল’। মানে, ‘ভালো হলো, তুমি তো স্প্যানিশ বলতে পারো।’ মনে হয় স্প্যানিশ বলে ভুল করলাম। অ্যান্টনিও আর থামছেনা, অনর্গল স্প্যানিশ বলে যাচ্ছে যার আগা-মাথা কিছু আর বুঝতে পারছিনা। ‘কাসা দে পাবলো নেরুদা, ইসলা নেগ্রা, বালে’, এইটুকু বলতে পারলাম। অ্যান্টনিও এইবার কিছুটা বন্ধুসুলভ আচরন করলো। বললো, ‘সি, সি’ মানে হ্যাঁ, হ্যাঁ।

গাইড বসেছে পেছনে। তাঁকে বললাম কাছাকাছি ভিনিয়ার্ড বা ওয়াইনারি আছে কি না। কাসা ওরুগাই বা কত দূরে। ভ্যালপ্যারাইসো’র বিশেষ করে ভিনিয়া দেল মার-এর সমুদ্র সৈকতের খ্যাতি অনেক। সালভাদর এয়ায়েন্দের জন্ম ভ্যালপারাইসো। প্লাজা মেয়র, আর্কো ব্রেটানিকো, পাবলো নেরুদার বাড়ি সেবাসটিয়ানো – এমনকি ভ্যালপারাইসো পোতাশ্রয় দেখার মতো। ভ্যালপাারাইসো পৌঁছতে আর কতক্ষন। গাইডকে একের পর এক প্রশ্ন করে গেলাম। অ্যান্টনিও মিনিট দশেকের ভেতরেই সান্তিয়াগো শহর অতিক্রম করে হাইওয়েতে উঠেছে। জিপিএস টিপে টুপে সে আমাদের জানালো যে ইসলা নেগ্রা ঠিক ১১৫ কিলোমিটার ড্রাইভ। দেড় ঘন্টার মত লেগে যাবে। সেইদিন রোববার তাই ফেরার পথে দ্বিগুন সময় লাগতে পারে বলে তার ধারনা। আমি রাস্তার দু’পাশে তাকাচ্ছি। রোড সাইনগুলো সব স্প্যানিশ ভাষায়।

আমরা সান্তিয়াগো থেকে পশ্চিমে রওনা দিয়েছি। ৫ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে হতে কস্টানেরা’র এক্সিট নিয়েছি। ১৫-১৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর ভ্যালপ্যারাইসো আর ভিনিয়া দেল মার-এর দিকে এক্সিট নিলাম। আমরা সান্তিয়াগো থেকে পশ্চিমে রওনা দিয়েছি। ন্যাশনাল হাইওয়ের ৬৮ নম্বর রুট। স্প্যানিশ ভাষায় বলে রুটা। দু’পাশে দেখার মত তেমন কিছু নেই। গমের জমি, হলুদ বাদামি রং। কখনো কখনো আঙ্গুরের বাগান চোখে পড়ছে। কোথাও কিছুটা ঢেউ খেলানো মাঠ। জিজ্ঞেস করে জানলাম গম ছাড়াও যব, ভুট্টার চাষ হয়। আর কোথাও কোথাও সবজি। চিলি পেঁয়াজ, অলিভ, আঁখ রপ্তানি করে। ফলমূল বিশেষ করে আপেল, মাল্টা, স্ট্রবেরি, অ্যাভোকাডো রপ্তানি করে। ওয়াইন রপ্তানি করে। আর ওপরে আতাকামা মরুভূমিতে রয়েছে পর্যাপ্ত তামার মজুদ। তামা রপ্তানি করেই চিলি এখন দক্ষিন আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ হিশেবে নাম লিখিয়েছে।

কোথাও কোথাও হলুদ বুনো ফুল। জানি কোন লাভ হবেনা তবু অ্যান্টনিওকে ফুলের নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো ‘মিরাফ্লোরেস’। মানে, বনফুল। কুয়েতের মরুভূমিতে ডায়ানথাসের চেয়েও ছোট হলুদ রংয়ের একটা ফুল হয়। ‘আবরাজ’ নাম। রোদে যখন মরুভূমির বালু সোনার মত চিকচিক করে আবরাজ তখন আরো প্রস্ফুটিত হয়। যেন সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দেয়।

রুটা ৬৮ দিয়ে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার চলে এসেছি। সামনে ক্যাসাব্লাঙ্কা নামে একটা শহর পড়বে। মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কা শহরের কথা মনে পড়লো। ২০০৮ সনে সেখানে গিয়েছিলাম। প্রাচ্য, পাশ্চত্য আর আরব ঐতিহ্য নিয়ে মধুময় এক শহর। পাঁচ কিলোমিটার বাকি কিন্তু অ্যান্টনিও ইতোমধ্যে বাঁয়ে যাওয়ার সংকেত দিয়েছে। এল কিসকো লিখা একটা রাস্তায় এক্সিট নিলো। এফ-৯০ এইটা। এবার কিছুটা পাহাড় চোখে পড়ছে। সঙ্গী প্রায় সবাই ঘুমে। আমি অ্যান্টনিও’র সঙ্গে ভাঙ্গা স্প্যানিশে কথা বলার চেষ্টা করছি। এই হাইওয়েতে ২০-২৫ কিলোমিটার ড্রাইভ করার পর পুনরায় বাঁয়ে এক্সিট নিলাম। ডাবল লেন। মার্সিডিজ এখন ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার বেগে চলছে। হাইওয়েতে ১২০ ছিলো।

পাহাড়ের পথে গাড়ির গতি আরো কমে এসেছে। দু’পাশে এখন মাঝে মধ্যে ঘন গাছ-পালা দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশই পাইন বা অ্যাকাশিয়া গোত্রের। এক জায়গায় কিছু হরিন দেখলাম। একবার দু’বার সমুদ্র দেখতে পেলাম। প্রশান্ত মহাসাগর। দুষ্ট মেয়ের মত উকি দিচ্ছে। যেন আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। বুঝলাম, কাছাকাছি চলে এসেছি। ক্যামেরা রেডি রাখলাম। ছোট একটা শহরতলিতে ঢুকছি। পাহাড়ের উঁচুতে থাকার কারনে নিচের শহরতলির প্যানোরমিক দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের ঘন নীল জলরাশির সঙ্গে লাগোয়া শহরতলি। এখন দু’পাশে একটা-দ’ুটো ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। একতলা-দোতলা, লাল টালির ছাদ। রোড সাইন খেয়াল করলাম, অ্যাভেনিদা ইসিডোরো ডুবোমাইস। রাস্তায় এখন গাড়ির ঘনত্ব বাড়ছে। কেউ কেউ বিচওয়্যার বা সানগ্লাস পরে কিংবা ছাতা বা টাওয়েল নিয়ে হাঁটছে। বাঁ পাশে পর পর অনেকগুলো হস্তশিল্পের দোকান। স্ট্রবো লাইট দিয়ে ফুটপাতের এক পাশে একটা মাছের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। মনে হয় কোন সী ফুড রেস্টুরেন্টের বিজ্ঞাপন। কাছাকাছি আরো একটা। ধাতব কোন পদার্থে তৈরি। মাছের পাশে সাঁতারের পোশাক পরা এক রমনীর প্রতিকৃতি। আমি ক্যামেরা সচল করলাম। গাড়ির গতিও কমতে শুরু করলো। এবং অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যান্টনিও গাড়ি পার্ক করে ফেললো। হাসি দিয়ে যা বললো আর হাতের ইশারায় যা বুঝালো তার মানে হলো আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি এবং বাকি যেটুকু পথ সেটুকু হাঁটতে হবে।

মূল অ্যাভিনিউ থেকে গলিতে ঢুকলাম। গলির মাথায় এর নাম ঝুলানো আছে। ‘পোয়েটা নেরুদা’। রোদ তখনো উজ্জ্বল। রাস্তার দু’পাশের গাছপালার বর্ম ভেদ করে কখনো কখনো গায়ে এসে পড়ছে। রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্ট। একাধিক। প্রায় সবগুলোর নামের সঙ্গে নেরুদার নাম যুক্ত। ‘লে কাভা দে পাবলো রেস্তোরা’ – যার মানে হতে পারে, পাবলোর ভাঁড়ার রেস্তোরা। ‘লা লোকুরা দেল পোয়েটা’ অর্থাৎ কবির পাগলামো। বটেই। পাগল তো বটেই। নইলে কবি কি না লিখতে পারেন, ‘ইজ দা রোজ নেকেড/ অর ইজ দ্যাট হার অনলি ড্রেস।’ কই, আমাদের সুস্থ মাথায় এমন প্রশ্ন তো কখনো এলো না।

চার পাঁচটা বাড়ি পরেই একটা বাড়ি সাত-আট ফুট উঁচু কাঠের সরু সরু তক্তা দিয়ে ঘেরা। মানুষের চোখ উচ্চতায় দেওয়ালে দু’ একটা ফোকরও রাখা হয়েছে। আমি একটা ফোকরে চোখ রেখে দেখলাম একতলা-দেড়তলা ধরনের একটা বাড়ি, সামনে পরিত্যক্ত এক রেল ইঞ্জিন। লোকোমোটিভ। পুরোনো। ধোঁওয়া উড়িয়ে ঝির ঝির শব্দ করে চলা ইঞ্জিন। এইটিই তাহলে কবি পাবলো নেরুদার বাড়ি।

পরে জেনেছি কাঠের তক্তা দিয়ে বাড়িটা ঘিরে দিয়েছিলো সামরিক শাসক আউগুস্তো পিনোচে। চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদর এয়ায়েন্দের নিকট বন্ধু হওয়ায় এয়ায়েন্দের মৃত্যু এবং সামরিক শাসন জারির পর সামরিক বাহিনী কবি পাবলো নেরুদাকেও নজরে রাখা শুরু করে এবং তাঁকে অনেকটা গৃহবন্দি করে রাখার জন্য ইসলা নেগ্রায় তাঁর বাড়ির সমগ্র প্রাঙ্গন কাঠের তক্তা দিয়ে ঘিরে ফেলে। কবির ভক্তরা কবির বাড়িতে ঢুকতে না পেরে বা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না পেরে সেই কাঠের তক্তাগুলোতেই তাঁদের ভালোবাসা বা সমর্থনের কথা লিখে রেখে গেছে। সেই লিখাগুলোর অধিকাংশই এখনো অক্ষত। রোদ, ঝড় বা বৃষ্টিতে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্রতিবাদ জানানোর কি অদ্ভুত সুন্দর প্রয়াস। অধিকাংশই স্প্যানিশে লিখা। আমি একটা দু’টো পড়লাম। ইংরেজি একটা লেখা পেলাম। কোন এক নেপালি পর্যটকের লিখা। মনে হলো আমিও আমার অনুভূতি লিখে রেখে যাই। কিন্তু নামের জায়গায় আমি ‘বাংলাদেশের এক পর্যটক’ লিখলাম।

সেসময় সামরিক জান্তা ইসলা নেগ্রার বাড়ির ভেতরেও অনুসন্ধান চালায়। হোক্ না ৭০ বছরের এক বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ কবির বাড়ি। কবিরাই তো যত নষ্টের মূল। স্পেনে লোরকা যেমন। তার উপর পার কম্যুনিস্ট। যদি কোন লিফলেট বা সামরিক শাসন বিরোধী কিছু পাওয়া যায়। নেরুদা নাকি তাদেরকে অভ্যর্থনা করে বলেছিলেন, ‘কবিতা ছাড়া ভয়ংকর কিছু এখানে নেই।’ কিন্তু কবিতা তো আদতেই অনেক ভয়ংকর হতে পারে। কারন ‘কবিরা যে সত্যবাদী’ হয়। নেরুদার এক কবিতার লাইন স্মরন করি, ‘ইউ ক্যান কাট অল দ্য ফ্লাওর্য়াস, বাট ইউ ক্যানোট কিপ স্প্রিং ফ্রম কামিং।’ তুমি সব ফুল ধ্বংস করতে পারো, তবু বসন্তের আগমন রোধ করতে পারবে না।

প্রাঙ্গনে ঢুকলাম। একতলা একটা ভবন। কাঠের পিলারের উপর নির্মিত। মাঝখানে ছোট একটা উঠোনের তিন পাশে কতগুলো রুম। কোনটা স্যুভেনির শপ, কোনটা অফিস, রেস্টরুম, কফি শপ। একটা দিক উন্মুক্ত। মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত কাঁচ। জনা চল্লিশেক পর্যটক হবে। দেওয়ালে দেওয়ালে নেরুদা’র ছবি আর পোস্টার। একদিকে প্রোজেক্টরে নেরুদার উপর একটা ডকুমেন্টারি চলছে। এটি আসলে নেরুদা ফাউন্ডেশন। বাইরে অবশ্য সাইন বোর্ডে লিখা, ‘মুসেও পাবলো নেরুদা’ – মানে পাবলো নেরুদা মিউজিয়াম। তাঁর বাড়ি, যেইটি কিনা এখন মিউজিয়াম, সেইটি আসলে পাশে। কাঁচের দেওয়ালের ভেতর দিয়ে বাড়িটি দেখা যায়। দেখা যায় প্রশান্ত মহাসাগর। আমি কাঁচের দরোজা ঠেলে বাইরে এলাম। ছোট একটা বাগান। এরপরই কবির বাড়ি। সেই বাড়ির প্রাঙ্গন সম্পূর্ণ আলাদা। কাঠের দেওয়ালে ঘেরা। ডান দিকে এবড়ো ধেবড়ো ছোট বড় পাথর আর শিলায় ক্রমান্বয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ ফুট নিচে নেমে গেলে প্রশান্ত মহাসাগর। নীল জলরাশির মাথায় মুকুটের মত শাদা শুভ্র চূড়া, যেন কেকের উপরকার শাদা আইসিং। বড় বড় ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে এসে পাথরে আঘাত করে ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিশাল তার গর্জন। পাথরের গায়ে যখন ধাক্কা দিচ্ছে তখনও বিশাল শব্দ হচ্ছে। যেন কাঁচের কোন ঘর ভেঙ্গে পড়ছে।

এদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শ’খানেক পর্যটক। কেউ কেউ পাথরের উপর দিয়ে সতর্ক পা ফেলে ফেলে সমুদ্রের দিকে এগুচ্ছে – যেন নর্তকী কোন মুদ্রা অনুসরন করে নাচছে। সমুদ্র কত বিশাল। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখার চেষ্টা করি। বাঁ দিকে কবি পাবলো নেরুদার ঐতিহাসিক বাড়ি, সামনে প্রশান্ত মহাসাগর, ডানে পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশনের রিসেপশন ও অ্যান্টে হল। অ্যান্টে হলের পশ্চিমে একটা কাফে। কাঠের পাটাতনের উপর ওপেন স্কাই কাফে। ‘কাফে রেস্তুরান্তে রিঙ্কন দে পোয়েটা’ – মানে পোয়েট’স্ কর্নার কাফে রেস্টুরেন্ট।

এইখানে এক মাগ কফি না খেলে চলবেনা। কাঠের পাটাতনটা ঝুলন্ত। নীচে কঠিন শিলা। পাথর, ঝোপ ঝাড়। পাটাতনের উপর ছ’ সাতটা টেবিল। দু’জন বা চারজন করে বসার ব্যাবস্থা। পাটাতনের শেষ প্রান্তে চার পাঁচ ফুট উঁচু কাঁচের দেওয়াল। একেবারে শেষ টেবিল ঘিরে বসলাম। সমুদ্রের গর্জন শুনে আর স্রোত প্রবল জলরাশির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাফে সলো পান করলাম। ‘সলো’ মানে সিঙ্গেল। কফির মাগ না, কাফে সলো দেওয়া হয় ছোট একটা কাপে। কাপের মধ্যে কফির পরিমান প্রায় এক চতুর্থাংশ, কালো চিলিয়ান কফি। কাপের ধার ঘেঁষে বৃত্তাকারে বাদামি রঙের খানিক ফেনা।

ফাউন্ডেশন থেকে ১৬ ডলার করে টিকিট কাটা হয়েছে। মিউজিয়ামে ঢোকার টিকিট। কিন্তু ভেতরে ছবি তোলা একদম নিষেধ। কফি খেতে খেতে জানলাম আমাদের মিউজিয়ামে ঢোকার সময় হয়ে গেছে। একবারে দশজন করে ঢোকার ব্যবস্থা। প্রত্যেককে একটা করে অডিও ডিভাইস দেওয়া হলো। ইলেকট্রনিক অডিয়ো গাইড। অনেকটা টিভির রিমোট কন্ট্রোলের মত একটা যন্ত্র। এক থেকে ষোল পর্যন্ত বাটন টেপা যায়। পুরো প্রাঙ্গনটি ১৬টি অডিয়ো জোনে ভাগ করা।

একেক জোনে এলে সেই অনুযায়ী বাটন টিপলে অডিয়ো ডিভাইস কাজ শুরু করে। প্রথমে ইংরেজি ভাষায় ডিভাইসটি সেট করে নিলাম। তারপর গাইড বইয়ের মানচিত্র দেখে যে জায়গায় যাচ্ছি সেই জায়গার বাটন টিপে অডিয়ো ডিভাইসটি কানের কাছে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে বিবরন শুনছি আর চার পাশে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছি। নিশ্চই নেরুদা ফাউন্ডেশন এই বিবরনগুলো তৈরি করেছে। প্রানবন্ত বিবরন।

১৯৩৭ সনে ইয়োরোপ হতে কূটনৈতিক দায়িত্ব শেষে দেশে ফেরার পর পাবলো নেরুদা বাড়ি বানানোর জন্য একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলেন। আপদমস্তক কবি তিনি। তাই জায়গা নির্বাচনের সময়েও তাঁর কবিমনটাই বেশি জাগ্রত ছিলো। তিনি তাই কাব্য প্রেরনাপূর্ন একটা জায়গা খুঁজছিলেন। পাহাড়ের পাদদেশ বা সাগরের বেলাভূমি ছাড়া কোথায়ই বা এমন জায়গা মেলে। ‘ইসলা নেগ্রা’ মানে কালো দ্বীপ। অথচ ইসলা নেগ্রা অঞ্চলটা কোন দ্বীপই না। এই এলাকাটা পরিচিত ছিলো ’লাজ গাভিয়োটাস’ নামে। কবি এখানে এসে সমুদ্রের প্রবল স্রোতের সঙ্গে কালো কালো বিশাল শিলাখন্ডের নিয়ত লড়াই দেখে অভিভূত হয়ে যান। যেন ভালোবাসা আর ঘৃনার যুগপৎ অবস্থান। লড়াই যেমন, তেমন যেন প্রগাঢ় বন্ধুত্বও। সমুদ্র এসে নিয়ত শিলাখন্ডে চুমু খেয়ে যায়। কবির নিজের বোধের সঙ্গেও যেন মিলে যায়। যেমন তিনি সমুদ্রের বিশালত্বকে সমীহ করতেন, সর্বগ্রাসী রূপকে ভয় পেতেন, তেমনি তার শক্তিকে পছন্দ করতেন। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন। কবি নিজেই এলাকাটার নাম দেন, ইসলা নেগ্রা। চিত্রশিল্পীরা বিমূর্ত চিত্রকলার যেমন নাম দেয়, তেমন।

ডন ইলাডিও সব্রিনো নামের এক স্প্যানিশ নাবিক তখন জমি বিক্রির খদ্দের খুঁজছিলো। জমিতে তখন কেবল ছোট একটা পাথরের কেবিন ছিলো। নেরুদা তার কাছ থেকে জমি কিনেই তার উন্নয়নে নেমে পড়েন। কিন্তু উন্নয়নটা হয় সম্পূর্ন জৈবিক উপায়ে। নেরুদা নিজেই তাঁর এক লিখায় লিখেছেন, যেমন গাছ ছোট থেকে বড় হয়। যেমন মানুষ ছোট থেকে বড় হয়। আমার বাড়িটিও তেমন অল্প অল্প করে বড় হয়েছে।

সমুদ্র প্রেমের কারনেই নেরুদা সমুদ্র তীরবর্তী ইসলা নেগ্রা বেছে নিয়েছিলেন। আর সমগ্র বাড়িটা ডিজাইন করেছেন সমুদ্রকে মাথায় রেখে। পুরো বাড়িতে ছোট বড় পনেরোটা ঘর। সবগুলো থেকে সমুদ্র দেখা যায়। একটা মাত্র ঘর দোতলায়। বাকি সব সমুদ্রের সৈকতের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্থাপিত। পুরো বাড়িটা যেন একটা জাহাজ। আর কবি নিজে সেই জাহাজের নাবিক। বাড়িটার পৃথক দু’টো অংশ। মধ্যখান দিয়ে সমুদ্র সৈকতের দিকে হেঁটে যাওয়ার পথ। প্রথম অংশে দু’টো সালা, মানে ড্রইং রুম, একটি ডাইনিং, কিচেন একটি এবং তার সঙ্গে বার এবং মদ মজুত করে রাখার সেলার। এর ঠিক উপরে, দোতলায় কাঠের সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে বেডরুম। অন্য অংশটিতে একটা রুমের পর একটা রুম, এক সারিতে। প্রথমে মাস্ক রুম যেখানে দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন রকম মুখোশ ও অন্যান্য স্যুভেনির। পরেরটা ডেস্ক রুম। তারপর একটা সালা – লিভিং রুম, লাইব্রেরি, আরো একটা সালা এবং একটা শঙ্খ সালা। পুরো বাড়ি এমনকি সমগ্র প্রাঙ্গন জুড়ে কবির অসংখ্য সংগ্রহ। তাঁর যাবতীয় সংগ্রহের মধ্যেও তাঁর কবিমন প্রকটভাবে প্রকাশিত, উচ্চারিত। বাড়িসহ সমগ্র প্রাঙ্গনে কবির জীবদ্দশায় যে আসবাব বা সংগ্রহ সামগ্রী যেভাবে ছিলো সেভাবেই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার পর্যটনের শুরু দুটো ড্রইং রুম হতে। দু’টো ঘরেই কবির ব্যবহৃত আসবাবাপত্র এবং কবির বিরল সব সংগ্রহ। অনেকগুলো প্রমান আকৃতির ফিগারহেড। বেশ কিছু দেব দেবী এবং পুরানিক চরিত্রের ভাস্কর্য। জাহাজের মাস্তুলে বা দু’মাথায় যেমন অনেক সময় ফিগার হেড থাকে, কবি হয়ত সেখান থেকে সংগ্রহ করেছেন। এগুলোর অধিকাংশই কাঠের কিন্তু রং করা। কিছু মার্বেলের বা পাথরের ভাস্কর্য। দেওয়াল থেকে, সিলিং থেকে ঝুলানো অনেকগুলো।

কবি যখন এই রুমে বসতেন, নিশ্চই এদের সঙ্গে কথা বলতেন। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি। এরা কি এখনো কবিকে খুঁজে। এরা কি আমাদেরকে কিছু বলতে চায়। আমি এদের কারো কারোর চোখের দিকে তাকাই। কি উজ্জ্বল তাদের চোখগুলো। আহা, এদের চোখের ভাষা যদি বুঝা যেতো। কবির সঙ্গে কতোনা সখ্য এদের। কবির জীবনের বড় একটা অংশের সাক্ষীও এরা।

ফিগারহেডগুলো কবি অসম্ভব পছন্দ করতেন। বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে যখন ড্রইংরুমে আড্ডা মারতেন তখন এই ফিগারহেডগুলোকে তাঁর গার্লফ্রেন্ড বলতেন। কোনটা কিভাবে সংগ্রহ করেছেন তা আমার জানা নেই কিন্তু একেকটা একেকরকম। আমি এগুলোর পরিচয় খুঁজে বের করতে পারিনি কিন্তু নিশ্চিত যে এগুলো নিছক নারীমূর্তি না। এগুলোর মধ্যে বিখ্যাত সুইডিশ অ্যামেরিকান অপেরা গায়িকা জেনি লিন্ড এর মূর্তি আছে। রহস্যময় জাহাজ মারি সেলেস্তের স্মরনে নির্মিত নারী মূর্তি আছে। পাশের একজন পর্যটক একটা নগ্নবক্ষা নারীমূর্তি দেখিয়ে বললো ওইটি গ্যুইয়েরমিনা’র প্রতিকৃতি। মারি সেলেস্তে’র চোখ দিয়ে মনে হয় পানি গড়িয়ে পড়ছে। ক্রন্দনরতা কিনা জানিনা। তবে ভীষন মায়াবি। গ্যুইয়েরমিনার’র চোখ দুটো ভারি উজ্জ্বল – তার নগ্ন বক্ষের চাইতেও। কবি নাকি বলতেন যে তিনি এই চোখ দু’টোর প্রেমে পড়েছিলেন।

এক প্রান্তে একটা ফায়ার প্লেস। উপরে ধোয়া নির্গমনের চিমনি। কবি এই ফায়ারপ্লেসের চারপাশেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বসতেন। এখনো বসার ব্যবস্থাটা তেমনই আছে। কেউ বলবেনা যে কবি নেই, কোথাও নেই। বরং সর্বত্রই তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা যায়।

বাঙময় একটা নীরবতায় হঠাৎই ঘোলে ঢেলে দিলো কেউ। আমার বেরুতে হবে কেননা পরের টিম অপেক্ষা করে আছে। ড্রইং রুম থেকে ছোট বৃত্তাকার একটা ফইয়ার-এ ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকে প্রথমে এই জায়গাতেই আসতে হয়। অনেকটা ট্রাফিক মোড়ের মত। এইখান থেকেই হয় ড্রইং রুম নয় ডাইনিং রুমে যেতে হয়। সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার একটা দরোজাও আছে। দরোজাটা কাঁচের যাতে সমুদ্রের সর্বাধিক দর্শন পাওয়া যায়। ড্রইং রুম এবং ফইয়ার এর দরজা জানালাগুলোর কাঁচগুলো আবার হরেক রকম ডিজাইনে সাজানো। সমুদ্রের দিকের দরোজা জানালায় তিনি আবার রঙিন কাঁচও ব্যবহার করেছেন। কোন কোনটি পিয়ের মনড্রিয়েনের বিমূর্ত চিত্রের মত। আয়তকার লাল, নীল ও হলুদ রংয়ের কাঁচ দিয়ে সাজানো। হয়ত ভেবেছেন হরেক রকম রঙের ভেতর দিয়ে সমুদ্র দর্শন এক ধরনের মায়াজাল বা মাদকতা তৈরি করতে পারবে। কিভাবে এই জায়গা ছেড়ে যাই। এমন জায়গায় তো দিনের পর দিন পার করে দেওয়া যায়।

গাইডের তাগাদায় মোহ ভাঙলো। ড্রইং রুম ছেড়ে ঢুকলাম ডাইনিং রুমে। ঢোকার পথে মাঝের যে ফইয়ার তার মেঝেতে দৃষ্টি আটকে গেলো। আমরা যেমন মেঝেতে মোজাইক করার সময় মার্বেল চিপ্স ব্যবহার করি, তিনি তেমন ব্যবহার করেছেন ঝিনুক, বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন আকৃতির।

ডাইনিং রুমের দু’পাশে কাঁচের দেওয়াল, মেঝে থেকে সিলিং অব্দি। একদিকে সমুদ্র যেমন দৃশ্যমান, অন্যদিকে তেমনি বাড়ির সামনের লন। যেখানে আবার রেল ইঞ্জিনটা রাখা। ডাইনিং রুমে গোলাকার একটা টেবিল। চারপাশে দশটা চেয়ার সাজানো। টেবিলের উপর কিছু তৈজসপত্র। চেয়ার বরাবর টেবিল ম্যাটও রয়েছে, কবির ব্যবহৃত। যেন কবি কিছুক্ষনের মধ্যেই আসবেন। চেয়ারগুলো কাঠের, চিকন পায়া, পেছনের হেলান দেওয়ার কাঠামোটা একটু উঁচু। বসার জায়গাটা ক্যানভাসের চওড়া ফিতা দিয়ে আড়াআড়িভাবে বুনা। ঢাকায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্য অনুষদের ক্লাশ স্টুলগুলো যেরকম ছিলো। টেবিলের ঠিক মধ্য বরাবর সিলিং থেকে বড় অর্ধগোলাকার লাইটশেড নেমে এসেছে। দেওয়ালে কয়েকটা পেইন্টিং, আবক্ষ মূর্তি। সমুদ্রের দিকের কাঁচের দেওয়ালের নিচে কাঠের কাঠামোর উপর হরেক রকমের বড় বড় কাঁচের পাত্র, জার বা বোতল। একেক আকারের, একেক আকৃতির, একেক রঙের। কাঁচের পাত্রের কোন কোনটি পুড্ল জাতের কুকুরের মত। কোনটি রমনীর হাতের মত।

ডাইনিংয়ের পরই রান্নাঘর, খাবার মজুদ রাখার জায়গা, সেলার মানে মদের ভাঁড়ার এবং তার পাশে বার। বারের তিন পাশের দেওয়ালই কাঁচের। দেওয়াল জুড়ে আবার কাঁচেরই শেল্ফ। সেখানেও বিভিন্ন রকমের ছোট বড় বোতল, পানপাত্র এবং কাঁচের স্যুভেনির রয়েছে। এইটিকে গ্লাস রুম বললেও হয়। অবাক হইনি কারন এই রুমের পরিবেশেও তো এক ধরনের মাদকতা বা নাটকীয়তা রাখা দরকার। কবি নিশ্চই সেদিকে যত্নবান ছিলেন। এই রুম থেকেই প্রাঙ্গনে রাখা ঘন্টা-দোলনা এবং নৌকা সবচেয়ে ভালো দেখা যায়।

বারে বেশি সময় ব্যয় না করে আমি সরু সিঁড়ি ঘুরে উপরে উঠে গেলাম। কবির বেডরুম। বেডরুমে ঢোকার আগে মেজানাইন ফ্লোরে ওয়াড্রোব ও বুকশেল্ফ। ওয়াড্রোবের পাশপাশি কবির লাইব্রেরিও ছিলো এখানে। এখনো শেল্ফ আছে। বই নেই। কিন্তু সান্তিয়াগো-তে কবির লাইব্রেরি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভক্তদের সুবিধার্থে ইসলা নেগ্রা থেকে বইয়ের যাবতীয় সংগ্রহ সান্তিয়াগো-তে কবির অপর বাড়ি ‘লা চাসকোনা’-তে নিয়ে যাওয়া হয়। বেডরুম লাগোয়া একটা ছোট বারান্দা আছে। স্বাভাবিকভাবেই তা সমুদ্রমুখী। বাড়ির এই অংশ থেকেই কোথাও হয়ত গোপনে পালিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু তা যে ঠিক কোথায় ছিলো এখন আর তা কেউ বলতে পারে না।

জাহাজের ধারনা পাওয়ার জন্য সিঁড়িটা সরু, সিলিংটা নীচু, বেডরুমটাও ছোট। অবশ্য ছোট বলাটা ভুল হবে বরং জায়গা বাহুল্যহীন এভাবে বলা মনে হয় ঠিক হবে। বেডরুমটা দোতলায় হওয়ায় এখানকার কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে সমুদ্রকে আরো উপর থেকে দেখা যায়। মনে হয় উঁচু থেকে দেখার ধারনাটা কবি বেছে নিয়েছেন এজন্য যে সেরকম ক্ষেত্রে সমুদ্রের রুদ্র রূপ শয়নে ব্যাঘাত ঘটায়না। বেডরুমের আসবাবাপত্রও বাহুল্যহীন। কবির ব্যবহৃত কাপড় চোপড়ও কিছু ওয়াড্রোবে রাখা আছে। তাঁর ব্যবহৃত বিছানার চাদর শ্বেত শুভ্র। বিছানাটা সমুদ্রের ঈষৎ সমান্তরালে রাখা। এও হয়ত কবির ইচ্ছায়।

এই বেডরুমে বসেই নেরুদা তাঁর আত্মজীবনী ‘আই কনফেস, আই হ্যাভ লিভড্’ লিখেছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে আত্মজীবনীর শেষ ক’ পৃষ্ঠা তিনি তাঁর স্ত্রীকে উৎসর্গ করেছিলেন।

নীচে নেমে ভবনের প্রথম অংশ থেকে বের হয়ে আসলাম। রোদ যেন অকৃপন আজ। সমুদ্র তাজা নীল। অনেকটা প্রুশিয়ান ব্লু’র মত। একটা সবুজাভ ছায়া আছে। কিন্তু সমুদ্রের ডাক উপেক্ষা করে আমি ঢুকে গেলাম ভবনের দ্বিতীয় অংশে। শুরুতে সরু একটা রুম। রুম না বলে করিডোর বলা যায়। মুখোশ করিডোর। এই করিডোরের দেওয়ালে বিভিন্ন রকম মুখোশ ঝুলানো। অধিকাংশ নাকি আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা। আমি বছর পাঁচেক আগে যখন সেনেগাল গিয়েছিলাম, ডাকারের ফুটপাতে শ’য়ে শ’য়ে মুখোশ ঝুলানো দেখতাম, বিক্রির জন্য। কেনারও ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু ডাকারের ফুটপাত যেন ডাকাতের দখলে। এককটা মুখোশের দাম দেড়শো ইউরোর নিচে না। আমি ভুরু উঁচু করলে বিক্রেতারা বলতো, ওগুলো নাকি মামুলি মুখোশ না, অ্যান্টিক। বুঝলাম, পশ্চিমা পর্যটকদের প্রভাবে এদের মুখের বুলি বদলেছে। নিজেদের তৈরি দৈনন্দিন যে কোন প্রোডাক্ট তাই অ্যান্টিক না হলে চলেনা।

গুনতে থাকলাম। কতগুলো মুখোশ দেওয়ালে। কৌতুহলের যে এই রুমটা এবং একেবারে শেষের শঙ্খ সালাটায় কেবল প্রমান আকারের জানালা নেই। আমার মনে হয় কবি এই বৈচিত্রটা নিজেই বেছে নিয়েছিলেন, সচেতনভাবে। মুখোশের সঙ্গেও এর কোন যোগাযোগ থেকে থাকতে পারে। আর জাহাজের ছোট ছোট জানালার সঙ্গে মিল তো আছেই।

এই সারির দ্বিতীয় রুমটা মজার। এটাকে ডেস্ক রুম বলা যেতে পারে। লেখালেখির জন্য কবি যে টেবিলগুলো ব্যবহার করতেন তার একটা এই রুমে রক্ষিত। কবির সব সংগ্রহেরই একটা ইতিহাস আছে। এই টেবিলটারও তাই। একদিন সকালে কবি হঠাৎ খেয়াল করলেন সমুদ্রে একটা কাষ্ঠবস্তু ভাসছে। আর স্রোতের ঠেলায় ক্রমান্বয়ে তা কবির বাড়ির দিকে আসছে। যখন বেলাভূমিতে তা আছড়ে পড়েছে, কবি তখন তাঁর স্ত্রীকে চিৎকার করে ডেকে বলেছেন, ‘দ্যাখো, আমার লেখার টেবিল চলে এসেছে।’ সমুদ্রের কি অকৃপন দান। কবি নিঃসঙ্কোচে সে দান গ্রহন করেন। আদতে তা ছিলো কোন ভাঙ্গা বা ডুবে যাওয়া জাহাজের পরিত্যক্ত দরোজার পাল্লা। ওই হয়ে উঠলো কবির লেখার টেবিল। টেবিল ছাড়াও অন্যান্য অনেক সংগ্রহের মধ্যে বিশাল আকারের জুতো রয়েছে। কিছু হিন্দু পুরানের চরিত্র ও কাহিনী সম্বলিত কাঠের কাজ রয়েছে। হয়ত ভারত সফরের সময় সংগৃহীত।এই রুমে আছে বিভিন্ন রকম কম্পাস, টেলিস্কোপ, বাইনোকুলার। আর মুখোশ, মূর্তি, ভাস্কর্য, কাঁচের বোতল তো আছেই।

পরের রুমটা সমুদ্র তীরের সঙ্গে উলম্বভাবে স্থাপিত। এইটি আরেকটা সালা – ড্রইং রুম। পূর্ব ও পশ্চিমের দু’মাথা অর্ধবৃত্তাকার। ভেতরের আসবাবের মধ্যেও একটা বৃত্তাকার ভাব আছে। তার পরের রুমটা লাইবে্িরর। বই না থাকলেও অমূল্য সব সংগ্রহ এখানে। যেন কোন নাবিকের অপারেশন রুম। বিভিন্ন রকম মানচিত্রের বিশাল সংগ্রহ। বোতলে ভর্তি জাহাজের রেপ্লিকা। শেল্ফে থরে থরে সাজানো। আবার গুনতে শুরু করলাম। এবার ৪১-এ এসে থামলাম। এছাড়া দেওয়াল জুড়ে প্রজাপতির সংগ্রহও অনেক। কাঁচের ফ্রেমে বাঁধাই করা।

পরের রুমটাও সমুদ্র তীরের সঙ্গে উলম্বভাবে স্থাপিত। এই রুমের দু’টো অংশ। এক অংশে প্রমানাকার ঘোড়া, কাঠের তৈরি। অন্য অংশে বসার ব্যবস্থা। এখানে আবার হরেক রকম বাদ্যযন্ত্রের সমাহার, এই ঘরের দেওয়াল ছোট ছোট অসম গোলাকার পাথরের। মাঝে মাঝে ঝিনুক আছে তাতে। কবির এই ঘোড়া নিয়েও গল্প রয়েছে। শৈশবে ঘোড়া চড়া কবির শখের হলেও সেরকম সুযোগ খুব বেশি ঘটেনি। বড় হয়ে তাই তিনি প্রমানাকার ঘোড়ার খোঁজ করলেন। নিজ বাড়িতে নিয়েও এলেন আর বন্ধু বান্ধবদের দাওয়াত দিলেন ঘোড়ার আগমন উদ্যাপন করার জন্য। এর মধ্যে বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে রটে গিয়েছে যে সংগৃহীত ঘোড়ার লেজ নেই। তাই ঠিকমত একটা লেজ যুক্ত করতে বন্ধু বান্ধবদের অনেকেই সঙ্গে করে একটা লেজ নিয়ে এসেছিলেন, কারুরটা কাঠের তো কারুরটা চামড়ার, পশমের। পরে দেখা গেলো এক ঘোড়ারই অনেক ক’টি লেজ এসে হাজির। কবি সেই সবগুলো লেজই সংগ্রহে রেখেছেন। ছোট ছোট ঘোড়ার মোটিফও অনেকগুলো। সারা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। আর আছে ছোট বড় হরেক রকম আকার, আকৃতি ও রংয়ের কাঁচের পাত্র, সিরামিক জার, কাঠের ভাস্কর্য, পেইন্টিং।

পরের ঘরটা শঙ্খ সালা, বাংলায় শঙ্খশালাও বলা যায়। সারা ঘর জুড়ে শামুক, ঝিনুক, শঙ্খ। বিভিন্ন রকম। বিভিন্ন রংয়ের। পুরো সমুদ্রের তলদেশ যেন এই ঘরে উপস্থিত। আন্ডার ওয়াটার মিউজিয়ামের মত। আরো মজা হলো যে ফ্লোরেও ঝিনুক, শামুক, শঙ্খ। খালি পায়ে দাঁড়ালে মনে হয় কোন স্পা-এর মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছি।

নেরুদা ইয়োরোপে ছিলেন। কূটনৈতিক কর্মসূত্রে। এই-ই স্বাভাবিক যে ইয়োরোপের বহু প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী ও চিত্রকরের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন। কালজয়ী শিল্পী পাবলো পিকাসো তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কবির সংগহে তাই অমূল্য চিত্রকর্ম থাকতে পারতো। হয়ত ছিলো। ইসলা নেগ্রা-তে অল্প ক’টি আছে। সান্তিয়াগোতে বা অন্য কোথাও হয়ত বাকি কিছু আছে। অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আরো আছে নষ্ট হয়ে যাওয়ার, পুড়িয়ে ফেলার সম্ভাবনা। সামরিক শাসকের তো কোন পৃথক রং নেই। আছে শুধু একটাই পরিচয়, মানবতা আর সভ্যতার ধ্বংস।

কবি নেরুদা যখন এয়ায়েন্দের মৃত্যু সংবাদ এবং সামরিক অভ্যুত্থানের খবর শুনলেন, তিনি বস্তুতঃই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এমনিতে বয়োবৃদ্ধ তখন। আঘাতটা সহ্য করতে পারেননি। তার উপর সামরিক জান্তা তাঁকেও গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। বেডরুমে ঝিম হয়ে বসে থাকতেন। বিশাল সমুদ্রের সর্বগ্রাসী শক্তিও তাঁকে আর কোন প্রেরনা দিতে পারেনি। সপ্তা দুই পর সান্তিয়াগো হসপিটালে স্থানান্তর করার পর এভাবে তিনিও ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর প্রোস্টেট ক্যান্সার রোগ ছিলো। সুতরাং তাঁর মৃত্যু সংবাদে কোন অবিশ্বাস তখন জন্ম নেয়নি। কিন্তু অতি সম্প্রতি চিলিয়ান আদালত তাঁর মৃত্যুর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেননা দেরিতে হলেও প্রাথমিক অভিযোগে প্রমানিত হয়েছে তাঁকে ঔষধের সঙ্গে হয়ত বিষও প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।

মৃত্যর পর তাঁর ইচ্ছেতেই তাঁকে ইসলা নেগ্রাতে কবর দেওয়া হয়। তাঁর শেষ স্ত্রী উরুশিয়া মাটিলদে-ও এখন একই কবরে শায়িত। কিছু বুনোফুল এখনো তাঁর কবরের পাশে অপেক্ষা করে থাকে। যদি বা সমুদ্র বাতাসে কবির সমাধিতে রেনু ছিটাতে পারে। সমাধিটি পাথর দিয়ে বাঁধানো। বুনোফুল – ফ্লোরেস সিলভেস্ত্রেস। অ্যান্টনিওর কথা মনে পড়লো। বুনোফুলের মধ্যে রয়েছে হলুদ রঙয়ের ডেইজি, অ্যাস্টার বা এই ধরনের ফুল। আছে বেগুনি রঙয়ের পেরেজিয়া নয়তো অ্যাস্টরোয়াচি গোত্রের নানা রঙয়ের নানা ডিজাইনের ফুল।

আমরা পর্যটকরা কবির ব্যক্তিগত সবকিছুতে ভাগ বসাতে পারি এখন। তাঁর প্রাইভেসি বহু আগেই আমরা লংঘন করেছি যখন তাঁর চৌসীমানায় পা রেখেছি। বেডরুমের পাশে তাঁর টয়লেটের দরোজায় ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি নগ্ন রমনী চিত্র কোলাজ করে সাজানো। কবি কখনো হয়ত এভাবে সাজিয়ে ছিলেন। পর্যটকরা তাও দেখতে ছাড়েনা। রুমগুলোর ভেতর ছবি তোলা একেবারে নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষন না থাকলে আর মানুষ সংবেদনশীল কেন। তাই এদিক সেদিক ত্রস্তহাতে কতগুলো সতর্ক স্ন্যাপ নিলাম। পানপাত্র। মুখোশ, বোতলে ভর্তি জাহাজ। কাঠের বিশাল ঘোড়া, ডাইনিং টেবিল, সিলিং, শঙ্খ – কিছুই বাদ গেলো না স্ন্যাপের শিকার থেকে। বাইরে বের হয়ে উজ্জ্বল সূর্যালোকের সাহায্যে আরো অনেকগুলো ছবি তুললাম।

হাঁটতে হাঁটতে এলাম কবির সমাধি চত্বরে। পাথরের উপর বসে কবরের মাটিতে হাত রাখলাম। এতো উজ্জ্বল সূর্যের আলোতেও মাটিটা কি শীতল। কবি নিশ্চই শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। কাছেই যে তাঁর জাহাজ সদৃশ বাড়ি। অদূরে কোন এক পরিত্যক্ত জাহাজের নোঙ্গর। তার অদূরে ঘন্টা স্তম্ভ। দু’টো বৃহৎ ঘন্টাসহ সর্বমোট আটটা ঘন্টা বিভিন্ন উচ্চতায় ঝুলানো। যেন জাহাজের মাস্তুল কোন। কবি নাকি দূরে কোন জাহাজ দেখলে ঘন্টা বাজাতেন। যেন অতিথিকে আমন্ত্রন জানাচ্ছেন। এর কাছেই শাদা একটা বোট। শুধু প্রান্তগুলো লাল রং করা। বোটের নিচে আর চারপাশে নাম না জানা বনফুলের বাস। কবি নাকি পানপাত্র হাতে কখনো কখনো এই বোটে বসে থাকতেন। অভিনয় করতেন নৌকা চালানোর। কখনো মাতাল হয়ে বোটে শুয়ে থাকতেন। যেন সমুদ্রের কাছে আত্মসমর্পন করছেন। কবি নিজেই কোথাও লিখেছেন যে এই বোটটাই ছিলো তাঁর মাতলামোর একমাত্র জায়গা। তাঁর আত্মজীবনীতে কবি লিখেছেন, ‘সমুদ্রের কাছে আমি এক অপেশাদার মাত্র। সমুদ্রের কাছ থেকে যা কিছু শিখেছি তা দিয়ে কেবল মাটিতেই নৌকা চালানো যায়।’

এই বোট এখনও নিশ্চই তার সওয়ারির অপেক্ষায় থাকে। মাঝির অপেক্ষায় থাকে। হয়ত জোছনা রাতে, হয়ত অমাবস্যায়, কৃষ্ণপক্ষে – কবি কখনো এই বোটে ফিরে এসে বসেন। পুনরায় নৌকা চালানোর অভিনয় করেন। মাতলামো করেন। আবার লোকচক্ষুর আড়ালে ফিরে যান। খুব তো অসম্ভব না। কবির সমাধি তো পাশেই। আর এজন্যই হয়ত বোটটা আজো বেশ উজ্জ্বল। মনে যেন কোন দুঃখ নেই।

১৯৮৯ সনে নেরুদার শেষ স্ত্রী উরুশিয়া মাটিলদে ইসলা নেগ্রা-র বাড়ি পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশনের হাতে তুলে দেন। এই বাড়ির প্রতিটি সংগ্রহ বা প্রতিটি উপাদানের যেমন একটা ইতিহাস আছে, তেমনি আছে কবির জীবনে তার একটা ভূমিকা। কবি যাই বাড়ি বয়ে এনেছেন, সেগুলো তিনি ভালোবেসে এনেছেন এবং সবগুলো সংগ্রহ বা উপাদানই তাই তাঁর জীবনে একেক রকম প্রেরনার উৎস হয়ে রয়েছে। এজন্যই তিনি লিখতে পেরেছেন, ‘দি মাইন্ড এন্ড লাভ লিভ নেকেড ইন দিজ হাউজ।’ (লুমিনাস্ মাইন্ড, ব্রাইট ডেভিল্স)

১৯৭০ সনে কবি পাবলো নেরুদা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু এই পুরস্কার ছাড়াই কবি হিসেবে তিনি সমগ্র দক্ষিন আমেরিকা এবং স্প্যানিশ ভাষা-ভাষী বলয়ে সবচে’ জনপ্রিয় কবি।

বাগানের মধ্যে হঠাৎ একটা প্ল্যাকার্ডের দিকে নজর গেলো। মার্বেল প্ল্যাকার্ড, মাটিতে স্থাপিত। স্প্যানিশ লিখা, অর্ধেক হয়ত বুঝলাম। পুরো বুঝার জন্য ছবি তুলে নিলাম। পরে অনুবাদে যা বুঝলাম তা হলো। ওরাঁ সাবই জাহাজে উঠেছে/ জীবন যুদ্ধে ওঁরা/ আমার কবিতা তাঁদের করেছে উদ্ধার/ দিয়েছে নতুন ঠিকানা/ আমি গর্বিত। – পাবলো নেরুদা, উইনিপেগের স্প্যানিয়ার্ড, ১৯৩৯-১৯৯৭।

পাবলো নেরুদা কূটনৈতিক পেশায় যোগদান করেছিলেন অনেক আগে। একেবারে যুবক বয়সে। ১৯২৭ সনে তিনি ইয়াংগুনে চিলিয়ান কনসাল হিসেবে চাকরি শুরু করেন। এরপর কলম্বো, জাভা, সিঙ্গাপুর, বুয়েন্স আয়ার্স, বার্সেলোনা, মাদ্রিদ, মেক্সিকো সিটি ও প্যারিসে দায়িত্ব পালন করেন। বহু পরে প্রেসিডেন্ট এয়ায়েন্দে তাঁকে ফ্রান্সেই রাষ্ট্রদূত করে পাঠান।

মাটিলদে উরুশিয়া ছিলেন একজন চিলিয়ান গায়িকা। কবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় অবশ্য মেক্সিকোতে, ১৯৪৬ সনে। কবি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন মাটিলদে তাঁর সেবিকা ছিলেন। চিলি ফিরে এসে বিয়ে করেন তাঁকে, তাও অনেক পরে, ১৯৬৬-তে। এই ক’ বছর মাটিলদে থাকতেন নেরুদার সান্টিয়াগোর বাড়িতে যেখানে কবি নিজে মাটিলদের একটা ছবি এঁকেছিলেন। সেই চিত্রে মাটিলদের দু’টো অবয়ব প্রকাশের ”েষ্টা হয়েছিলো। একটা গায়িকার। অন্যটি প্রেমিকার।

পাবলো নেরুদার আদি নাম অনেক বিশাল। অন্যান্য স্প্যানিশ নামের মত। কিন্তু কবিতা প্রকাশের সময় তিনি চেকোশ্লাভ কবি জান নেরুদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পাবলো নেরুদা ছদ্মনাম ধারন করেন এবং পরে এইটিই তাঁর আইনী নামে পরিনত হয়।

অডিয়ো ডিভাইসটি জমা দিয়ে কবি পাবলো নেরুদার বাড়ির প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে এলাম। আমরা আবার কবির বাড়ি আর ফাউন্ডেশন হলের মাঝামাঝি চত্বরে। লাগোয়া রেস্টুরেন্টে ফিরে গেলাম। কফি খাওয়ার সময় জেনেছিলাম লাঞ্চের মেন্যুতে যা আছে তাও কবির পছন্দ অনুযায়ী তৈরি। সূর্য ঠিক মাথার উপর। সুতরাং এই সময়ে কবি পছন্দ মেন্যু নিয়ে বসলে বাড়াবাড়ি হবেনা। মেন্যু হাতে নিয়ে পড়ছি। স্বাভাবিকভাবেই স্প্যানিশে লিখা। এমপানাদাস অনেকটা প্যাস্ট্রি বা সমুচার মত। শুরুতে এমপানাদাস দে পোইয়ো অর্থাৎ মুরগির সমুচা দিতে বললাম। এর মধ্যে ধীরে সুস্থে মূল খাবার তালিকা পরীক্ষা করার সুযোগ হলো।

নেরুদার যে সী ফুড পছন্দ হবে তা তো বলা বাহুল্য। কিন্তু কিভাবে সেগুলো তৈরি করা হয় তার মধ্যেই কবির মুন্সিয়ানা নিহিত। ‘সোপা দে মারিস্কস’ মানে সী ফুড স্যুপ। এর বাইরে দ’ুটো খাবার মেন্যু সারা চিলিতেই সমাদৃত। চিলিয়ান সালাদ যাতে পেঁয়াজ, টমেটো, ধনে বা স্পার্সলে পাতা, ছাগলের দুধের পনির আর অলিভ রয়েছে কিন্তু সবগুলো উপাদান বালসামিক ভিনেগারে দীর্ঘক্ষন ভিজিয়ে নরম করা হয়েছে। আমি অবশ্য সালাদ থেকে চিজ সরিয়ে অ্যাভোকাডো যোগ করতে বললাম। ‘আসাদো’, অর্থাৎ বার-বি-কিউ পদ্ধতিতে তৈরি মাংস। আর সর্বোপরি ‘পিসকো সাউর’, একটা ফ্রুট ককটেল যা পেরুতে উদ্ভব হলেও ভ্যালপারাইসোতে এসে একটা পৃথক চরিত্র নিয়েছে যেখানে উপাদান হিশেবে সোনালি রংয়ের আঙ্গুর হতে তৈরি ব্র্যান্ডি, চিলির পিকা অঞ্চলের লেবু এবং ডিমের শাদা অংশ ব্যবহৃত হয়। পেরু এবং চিলি দু’দেশেই পিসকো সাউর ‘জাতীয় পানীয়’ হিশেবে স্বীকৃত। পেরুতে তো প্রতি ফেব্রুয়ারির প্রথম শনিবার পিসকো সাউর পানীয়ের সম্মানে ছুটি উদ্যাপন করা হয়।

আমরা মেন্যু দেখে যা কিছু বেছে নিলাম তার বাইরেও এলো ‘আলমেখাস এ লা পারমেসানা’ – অন দা হাউজ। ঝিনুকের মাংস, খোলসটা ছড়ানো। মাংসটা ভিনেগার ও অন্যান্য হার্ব দিয়ে মাখানো। কবিতীর্থে ভিন্ন যাত্রার সুযোগ নেই। আমরা তাই পুরো টেবিল সাবাড় করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম।

এই বার ফিরে চলার পালা। ঘন নীল সিল্কের কাপড়ে রূপালি রংয়ের একটা মাছের প্রতিকৃতি এমব্রয়ডারি করা। মাছটি আবার দু’টো বৃত্তাকার রেখায় বন্দি। পাবলো নেরুদার বাড়ির ছাদ থেকে এমন একটা পতাকা বাতাসে উড়ছে। যেন আমাদেরকে বিদায় অভিনন্দন জানাচ্ছে। এইটি পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশনের লোগো। এই লোগোর প্রতিকৃতি কবির সংগ্রহ থেকে নেওয়া।  মধ্যে পোটকা মাছের মত একটা মাছ। চোখ দু’টি বিশাল। মূল ভস্কর্যটি কবি প্রাঙ্গনের বাইরে শোভা পাচ্ছে।

স্যুভেনির শপে ঢুকলাম। ছোট শপ কিন্তু সুন্দর করে সাজানো। এক দিকে কবির লিখা বই কিংবা কবির উপর লিখা বই। সিলিং থেকে সিরামিকের ঘন্টা ঝুলছে। কবির আঁকা কিছু ছবি নিয়ে অনেকগুলো পোস্টার ছাপা হয়েছে। সিরামিকের প্লেটও আছে। আর আছে মাগ, ঘন্টা, বিভিন্ন রকম কাঁচের জার। টিশার্ট আছে কিন্তু সবচে’ জনপ্রিয় হলো টুপি – নেরুদা ক্যাপ নামে যার সমধিক পরিচিতি। ল্যাটিন আমেরিকার বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব চে গুয়েভারাও এই ক্যাপ ব্যবহার করতেন।

শেলফ্রে উপর দু’টো সী-গালের প্রতিকৃতি। এগুলোও বিক্রির জন্য। কাপড়ে স্ক্রিন প্রিন্ট করা অনেক রকমের চিত্র। আমি একটা মাগ কিনলাম, কবির লিখা কবিতা আর আঁকা চিত্র সম্বলিত সিরামিক স্ট্যান্ড কিনলাম। ঢাকা পর্যন্ত বইতে পারবো তো, ভেঙে না গেলেই হয়। দোকানের কর্মচারিরা পর্যটকদের সমস্যা বুঝে। বাব্ল কাগজ দিয়ে সুন্দর করে মুড়িয়ে দিলো। আর পোস্টারগুলো গোল করে পেঁচিয়ে হার্ডবোর্ডের তৈরি একটা সিলিন্ডার রোলে ঢুকিয়ে দিলো। সিলিন্ডার রোলে আবার পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশনের লোগো আছে। খুব খুশি হলাম।

বাইরে বেরিয়ে আবারো ছবি তোলায় ব্যস্ত হলাম। বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা আমার সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি বললেন, ‘সরকারকে বলে আপনাকে এখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে পাঠাবো।’ আমি মনে মনে ‘আমিন’ বললাম। গলির মাথায় এসে একটা রোড সাইনে হেলান দিয়ে দাঁড়ালোম। মাথার উপর মাছ আকৃতির একটা রোড সাইন, কাঠের তৈরি। রোড সাইনে খোদাই কওে লিখা, ‘২-১৯৮ পোয়েটা নেরুদা।’ অদূরে একটা ভাস্কর্য। তিনটি সী-গাল পাখা প্রসারিত করে আছে। প্রসারিত পাখায় তাদেরকে অনেক বৃহৎ মনে হচ্ছে। আমিও দু’হাত প্রসারিত করার চেষ্টা করলাম। বুকের ভেতর কবি পাবলো নেরুদার প্রিয় বাড়ি আর তার প্রাঙ্গনের বাতাসে ভর্তি। মনের ভেতর ভালো লাগা আর ভালোবাসার মোহমুদ্ধকর অনুভ’তি। হৃদয়টা এখনই তো প্রসারিত হওয়ার উপযুক্ত সময়। আমি মনে মনে মহানুভব, রোমান্টিক, সংবেদনশীল, আপাদমস্তক এক কবির সম্মানে নেরুদা ক্যাপ মাথা তেকে নামিয়ে মনে মনে উচ্চারন করলাম, কবি পাবলো নেরুদা, আদিয়োস্। বিদায়।

গাড়িতে উঠার পর অ্যান্টনিও আমাকে আমার অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, ‘মুই বুয়োনো, এক্সিলেন্তে, ফ্যান্টাসতিকো।’ অ্যান্টনিও স্মিত হাসলো, সমঝদারের হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘পাবলো এস উন গ্রান অমব্রে।’ বস্তুতই, পাবলো একজন মহান ব্যক্তি। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই ভাষাভাষী আমরা দুইজন তখন সম্ভবতঃ একই তরঙ্গ দৈর্ঘে অবস্থান করেছি। ফেরার পথে পাবলো নেরুদার লিখা সেই কবিতাটাই বারবার মনে পড়ছিলো, ‘লাভ ইজ সো শর্ট, ফরগেটিং ইজ সো লঙ্গ।’