Skip to content Skip to footer

প্রাহা

লিখেছেন মোহাম্মদ আবুল বাশার

প্রাহা যাকে বিশ্ববাসী চেনে প্রাগ নামে, বর্তমান চেক রিপাবলিক এবং সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী। অনিন্দ সুন্দর এই শহরটা শত্রু মিত্র সবার পছন্দের। প্রাগের অলিগলি,চারকোনা ছোট ছোট পাথর বিছানো পথ, লাল টালির বাড়ি স্থাপনা, প্রায় প্রতিটা বাড়ি স্থাপনার গায়ে শিল্পী এবং শিল্পের ছোঁয়া, মনোলোভা ভালটাভা নদী,পুরনো দিনের লাল রঙয়ের রোমান্টিক ট্রাম,এগুলো হচ্ছে প্রাগের শরীরের আভরন। যা সৌন্দর্যে ঝলমল।  

প্রাগের শরীরের মতো এর অন্তরের সৌন্দর্য সবাইকে আরো বেশি বিমোহিত করে। পথে পথে বেহালার সুর, রাস্তার ধারে ধারে বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি, রাস্তার মোড়ে মোড়ে কফিশপ গুলোতে শিল্প সাহিত্য নিয়ে গুণীজনদের তুমুল হাসিমাখা বিতর্ক, মানুষের প্রাণ ভারে জীবন্ত এক শহর। কি দিন, কি রাত।

এমন সুন্দর শহরের সামান্য ক্ষতি করতে প্রচন্ড পাষান হৃদয়েরও ইতস্ততা জাগে। জগত কুখ্যাত পাষণ্ড হিশেবে পরিচিত হিটলারের কাছেও এই প্রাগ শহর ছিলো ভালবাসার ধন। শিল্প সাহিত্যের আধার এই প্রাগ ছিলো তার কাঙ্ক্ষিত, কিন্ত সেই কাঙ্ক্ষিত শহর হস্তগত করতে যেয়ে তার শহরের গায়ে যেন সামান্য আঁচর না পড়ে তার বিষয়ে হিটলার ছিল সচেতন। কথিত আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন সাবেক চেকোশ্লোভাকিয়া দখলের স্বিদ্ধান্ত নেন হিটলার, তখন তার সেনাপতিদের উপর স্পষ্ট করে নির্দেশ জারী করেন যাতে স্বপ্নের শহর প্রাগের সামান্য সৌন্দর্য চ্যুত্যি না হয়।

হিটলারের জেনারেলরা কথা রেখেছিলো,তার প্রাগ অক্ষত উপহার দিয়েছিলো হিটলারকে। তবে যুদ্ধের দাগ প্রাগের গায়ে পরেছিলো ঠিকই এবং সেটা মিত্র পক্ষের বিমান হামলায়। মিত্র বাহিনীর সেই তিনবারের বিমান হামলায় প্রাণ হারায় প্রায় ১২০০ মানুষ। তবে এর কোনটাই প্রাগের সৌন্দর্যমন্ডিত ঐতিহাসিক স্থাপনায় আঘাত হানেনি। আর এর ফলেই মহাযুদ্ধের তাণ্ডবের মাঝেও রক্ষা পেয়ে যায় প্রাগের শৈল্পিক সৌন্দর্য।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি স্নাত হয়েছিলো প্রাগ শহর। ১৯২১ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের পর সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট ডঃ টমাস মাসারিকের আমন্ত্রণে ২১শে জুন প্রাগে পৌছান। এর পরে আরো একবার ১৯৩৫ সনে প্রাগে আসেন কবি।

বিশ্বযুদ্ধের দামামায় বিক্ষত তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার দু;খে ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেন,“Friends in Czechoslovakia. In the terrible storm of hated violence raging over humanity, accept the goodwill of an old idealist who clings to his faith in the common destiny of the East and West and all people on the Earth.

কবির কিছু চিঠি ব্যাতিত কোন লেখায় প্রাগের উল্লেখ না থাকলেও প্রাগে কিন্ত কবিগুরুর নামে একটি রাস্তা আছে নাম Thákurova Ulice,এবং সেখানে কবির আবক্ষ মুর্তি শ্রদ্ধাভরে রেখেছেন চেক অধিবাসীরা।

প্রাগে রবীন্দ্রনাথ সাথে চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির শিক্ষক এবং পরে বিশ্বভারতীর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়া  অধ্যাপক Dr.Vincenc Lesny ।

রবীন্দ্রনাথের মুর্তির বেদীতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রাগবাসীরা লিখেছেন,

“Tagore was not only a poet and a writer. He was a Renaissance personality in this respect: that he was a great composer – he founded a new style of Indian music called Rabindrasangit, which is still popular in India, he was a great painter, he was also a pedagogue and so on. He even founded an agricultural school in India to teach the Indian peasants new methods of agriculture.”

প্রাগের ভালবাসায় জড়িয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। প্রাগ নিয়ে “বিশ্বভারতীর প্রাগ” লেখাটুকুতে প্রাগের সবচেয়ে সুন্দর বর্ননা।

“প্রাগ শহর বড় বিচিত্র শহর। সেখানে চেক আছে, জর্মন আছে, ইহুদি আছে, আরও কত জাত- বেজাতের লোক আছে – এবং বড় মিলেমিশে থাকে।

আর, পূর্বেই বলেছি, শহরটি বাস্তবিকই বড় সুন্দর।

মধ্যিখান দিয়ে মলডা নদী চলে গিয়েছে। ঠিক যে-রকম ভিয়েনার মাঝখান দিয়ে ড্যানয়ুব, প্যারিসের মধ্যিখান দিয়ে শেন, বুদাপেস্টের- এর মাঝখান দিয়ে ড্যানয়ুব।

অধ্যাপক ভিন্টারনিসকে নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবো।

হোটেলগুলোকে শুধোলুম, হোতায় কোন ট্রাম বা বাস-এ যেতে হয়।

সেদিন কি একটা পরব ছিল। ভিড়ে ভিড়ে হুজ্জুম।

অতএব বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয় বন্ধ। কিন্তু একটা স্কেলিটেন স্টাফ থাকবে তো। তারা নিশ্চয় অধ্যাপকের বাড়ির ঠিকানা দিতে পারবে।

ইতিমধ্যে এই হুজ্জুম কাটা না পর্যন্ত ট্রাম-বাস তো চলতে পারবে না।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাত দিয়ে ঘাড়ের বা দিকটা চুলকোচ্ছি, এমন সময়ে এক অপরুপ সুন্দরী এসে আমাকে শুধালে, ‘আপনার কি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন?”

এ শুধু প্রাগেই সম্ভবে!

অন্য দেশের মেয়েরা পুরুষকে মদত দেবার জন্য এরকম এগিয়ে আসে না। “

(‘বিশ্বভারতীর প্রাগ’ থেকে)

পৃথিবীর অনেক শহরের মতো প্রাগ শহরটাও গড়ে উঠেছে ভালটাভা নামের এক মায়াবতী নদীর তীরে। আজকের ভালটাভা নদীই সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই মলডা নদী। জার্মান ভাষায় ভালটাভা নদীর নাম মলডা এবং সৈয়দ মুজতবা আলী যেহেতু জার্মান ভাষায় দক্ষ এবং বহুকাল জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছেন তাই তার লেখায় ভালটাভাকে মলডা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য চেক Valtava এবং জার্মান Moldau নামটি এসেছে প্রাচীন Germanic শব্দ ‘Wilt Ahwa” যার মানে হচ্ছে Wild Water।

প্রাগের মানুষ,তাদের সৌন্দর্যবোধ এবং রুচি, তাদের শিল্প সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সর্বোপরি তাদের স্বধীন এবং মুক্ত জীবনের প্রতি অগাধ আগ্রহ পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রাগকে করে তুলেছে এক স্বপ্নময় শহর। এসব কিছু আলোচনার আগে আমরা প্রাগের সৌন্দর্য মণ্ডিত ঐতিহাসিক দর্শনীয় কিছু স্থাপনার তালিকা করে তাদের বর্ননা দেই তবে অনেকটা সুবিধা হয়।

চেক রিপাবলিকে গড়ে প্রতিবছর ২০ মিলিয়ন লোক ভ্রমণ করে আর শুধুমাত্র প্রাগে এই সংখ্যা প্রায় ৮ মিলিয়ন। এই আট মিলিয়ন মানুষের পছন্দের দশটি প্রাগের দর্শনীয় তালিকা তৈরি করলে প্রথমেই থাকবে  থাকবে প্রাগ ক্যাসল।

(চলবে)