Skip to content Skip to footer

বান্দরবানের রহস্যঘেরা আলীর সুড়ঙ্গ

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল বরাবরই রহস্য, রূপ এবং রোমাঞ্চে ভরপুর। বান্দরবানের সৌন্দর্য যতই দেখা হোক না কেন, বারবার মুগ্ধ করে দেয় তার বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতি। ঠিক এমনই এক স্থান—আলীকদমের ‘আলীর সুড়ঙ্গ’। ইতিহাস, লোককথা, এবং প্রকৃতির বিস্ময় মিলিয়ে এই সুড়ঙ্গ হয়ে উঠেছে অনেকের কল্পনার রহস্যময় গন্তব্য।

পর্বতারোহণপ্রীত এক আত্মীয়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম ‘আলীর সুড়ঙ্গ’-এর গল্প। আলীকদম থেকে প্রায় ৩–৪ কিলোমিটার দূরে, মাতামুহুরী নদী এবং তৈন খালের মাঝামাঝি এক পাথুরে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই গুহা। পাহাড়টির নাম আলীর পাহাড়, আর সেই পাহাড়েই সৃষ্টি হয়েছে সুড়ঙ্গ। স্থানীয়রা একে বলেন ‘আলীর সুরম’। সরকারি নথিতে এটি পুরাকীর্তি হিসেবেও চিহ্নিত।

একাধিক লোককথা ঘিরে রয়েছে এই গুহাকে কেন্দ্র করে। বলা হয়, হযরত শাহজালালের সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার একজন আলী নামের আউলিয়া ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন এই অঞ্চলে। তাঁর নামেই নাকি আলীকদম নামের উৎপত্তি। যদিও সুড়ঙ্গের নামের আসল উৎস আজও রহস্যঘেরা।

ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ (TOB)-এর একটি পোস্ট থেকেই আলীর সুড়ঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়। যাত্রা শুরু হয় ‘তুক অ দামাতুয়া’ ট্রেইল দিয়ে। পরদিন আলীর সুড়ঙ্গ অভিযানে নামার আগে ভ্রমণের ধকল শরীরে থাকলেও আমরা বুঝিনি সামনে আরও রুদ্ধশ্বাস ট্রেকিং অপেক্ষা করছে।

ছোট্ট একটি দল—চান মিয়া, কায়েস, ঈসমাইল ভাই আর আমি—মিলেই এগিয়ে চলি সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে। আঁকাবাঁকা পিচঢালা রাস্তায় চলতে চলতে চোখে পড়ে মাতামুহুরীর অপরূপ রূপ। নদীর দুই পাড়ে তামাকক্ষেত, আর সকাল সকাল জলে নেমেছে পাহাড়ি কৃষক পরিবারেরা। এমন দৃশ্য দেখে মনেই হয়, এ যেন জীবনের সংগ্রামে নেমে পড়া মানুষের ছবি।

হঠাৎ অটোচালক দেখিয়ে দেন: “ওই যে, আলীর পাহাড়!”—দিগন্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

অটো রেখে স্থানীয় এক দোকানে বিশ্রাম নিতে গেলে দোকানদার বললেন, “গাইড লাগবে মামা?” সম্মতি দিতেই এসে হাজির হয় এক ছোট্ট গাইড—যার বয়সে এখনও লেংটি পরার বয়স শেষ হয়নি। তিনিই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন সুড়ঙ্গের পথে।

নদী পার হয়ে শুরু হয় ট্রেকিং। প্রথমে গিরিখাদ, তারপর ঝিরিপথ। চারদিকে পাথর, শুকনো গাছের গুঁড়ি আর নির্জনতা। আলীর সুড়ঙ্গ যত কাছে আসছিল, আশপাশ তত ঠান্ডা হয়ে উঠছিল।

এক সময় পৌঁছে যাই সেই রহস্যময় লোহার সিঁড়ির মুখে—যা কিছুটা ভাঙা ও বিপজ্জনক। সিঁড়ির মাথায় উঠে দেখি এক আঁধারচ্ছন্ন সুড়ঙ্গ। আলো ফেলতেই বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। দেয়ালে আলোর প্রতিফলনে দেখা যায় সোনালি আভা।

সুড়ঙ্গের ভিতরে যাওয়ার জন্য কখনও হামাগুড়ি দিতে হয়েছে, কখনও পাথরের খাঁজ বেয়ে উঠতে হয়েছে। পথ ক্রমশ সরু, নিচু এবং ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল। কোথাও কোথাও মাথা নিচু করে হামাগুড়ি ছাড়া গতি নেই। অন্ধকারের মাঝে শোনা যায় সাপের হিসহিস ধ্বনি। ভয়, কৌতূহল আর উত্তেজনায় মুহূর্তটা যেন রুদ্ধশ্বাস হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় সুড়ঙ্গ থেকে তৃতীয়টির মুখ দেখা যায়, তবে যেতে হলে পিচ্ছিল গিরিখাদ পার হতে হয়—যার জন্য দরকার ছিল রশি বা বাড়তি নিরাপত্তা। সেটা আমাদের কাছে না থাকায় ফিরে আসতে হয়।

একটি স্থানে দেখা যায় একটি পাথরের উপর রাখা পবিত্র কুরআন শরীফ এবং কিছু মোমবাতি। অশ্রদ্ধার এমন দৃশ্য দেখে বিস্ময় আর সন্দেহ মিশে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, এ অঞ্চলের কিছু গভীর গুহায় নাকি কালো যাদু ও টোনাটুনির চর্চা হয়—যদিও এর সত্যতা প্রমাণ হয়নি।

আলীর সুড়ঙ্গের পর্যটন সম্ভাবনা সম্প্রতি আরও প্রসার লাভ করছে। ২০২৪ সালে বান্দরবান জেলা প্রশাসন এই এলাকাকে প্রাথমিক পর্যটন এলাকা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। নিরাপত্তা, রাস্তাঘাট ও গাইড লাইনের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে পর্যটক সহায়ক বানানোর কাজও চলছে।

আলীর সুড়ঙ্গ শুধু একটি প্রাকৃতিক গুহা নয়—এ এক অভিজ্ঞতা, রহস্য আর সাহসিকতার গল্প। প্রকৃতির সৌন্দর্য, লোককাহিনির মোহ আর অ্যাডভেঞ্চারের সংমিশ্রণে এটি হয়ে উঠেছে ট্রাভেল লাভারদের জন্য এক অনন্য গন্তব্য। প্রস্তুত থাকলে এই রহস্যময় জগতে আপনি নিজেই হারিয়ে যেতে পারেন।