Skip to content Skip to footer

বাবার লুঙ্গী আর আমার হংকং এর মায়া

বাবার লুঙ্গী আর আমার হংকং এর মায়া

এক বদ অভ্যাসের দরুন হংকং নামটার সাথে আমার পরিচয়,বদ অভ্যাসটা হচ্ছে পুরাতন পত্রিকা পড়া! আমার আব্বা লুঙ্গীর ব্যবসা করতেন,বাসায় লুঙ্গীর টাল থাকতো সবসময়!সময় পেলেই লুঙ্গীর ভেতরে থাকা পত্রিকাগুলি বের করে করে পড়তাম,আর এই কারনে বাপের কাছে বকাঝকা কম খাইনি আমি!বকা দেয়ার কারণ হচ্ছে, পত্রিকা বের করার সময় লুঙ্গীর ভাজ নষ্ট করে ফেলতাম আমি!তো কোন একদিন হংকং এর আবাসন সংকট নিয়ে একটা আর্টিকেল চোখে পড়েছিল,সেই লেখাটার সাথে ছিল বিশাল বড় এক বিল্ডিং এর ছবি!
বিল্ডিংটি ছিল এক্কেবারে হিজিবিজি ঘিঞ্জি টাইপ,ভেবেছিলাম এইখানে মানুষ থাকে কিভাবে?

এরপর তো এল সোস্যাল মিডিয়ার যুগ, প্রায়শই সেই ছবি দেখতাম!কিন্তু নিজ চোখে দেখার পর বুঝলাম এতদিন যা দেখেছি তার বেশীর ভাগই ফেইক, বিল্ডিংগুলি অবাক করার মত তবে ততটা নয় যতটা এতদিন আমি দেখে আসছি!তবে এটা সত্যি যে বিল্ডিং এর ভেতরের থাকার ব্যবস্থা খুবই ভয়াবহ,অনেকটা পাখির খাচার মত ছোট্ট একটু জায়গায় মানুষ কিভাবে বসবাস করে তা ভেবেই কূল পাচ্ছিলাম না!সে যাজ্ঞে মূলত এই বিল্ডিং দেখার কারনেই আমার হংকং ভ্রমণ!তবে ভিসা ম্যানেজ করা ছিল যন্ত্রণাদায়ক একটা কাজ!সিউলে অবস্থিত চাইনিজ ভিসা সেন্টারের মাধ্যেমে ভিসা পেতে সময় লেগেছিল প্রায় ৩৫ দিন!হংকং এর ভিসা পাওয়া নিয়ে আমার অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা ছিল!

কোম্পানী থেকে আমার ছুটি ছিল কনফার্ম,এই ছুটির আগুপিছু হবেনা!তো তারা যদি আমার ট্রাভেল প্লান অনুযায়ী ভিসা না দেয় তাহলে সেই ছুটির দিনগুলি বাসায় বসে বসে কাটাতে হবে আমার!আমি তাদের নিয়মানুযায়ী ভিসার জন্য এপ্লাই করেছিলাম!৩০ দিন পাড় হবার পর যখন দেখি ভিসার কোন আপডেট আসে না তখন হংকং ইমিগ্রেশনে রাগের বসে উল্টা-পাল্টা লিখে মেইল করি যে “ভিসা দিলে দেন না দিলে কেন্সেল করে দেন আমি অন্য জায়গায় ভিসার জন্য এপ্লাই করি!আপনাদের দেশ সুন্দর তবে আমার সময় তার চেয়ে বেশী সুন্দর!আমার ছুটি কনফার্ম এই সময়ের মধ্যে ভিসা না পেলে আমার ছুটির দিনগুলি মাটি হয়ে যাবে” এই মেইল দেয়ার ঠিক পরের দিনই অনলাইনে ভিসার আপডেট চেক করার সময় দেখি আমার ভিসা হয়ে গেছে!

এরপর আরকি প্লান অনুযায়ী ম্যাকাও এর উদ্দেশ্যে সিউল থেকে রওনা দিলাম,ম্যাকাও এ ২ দিন কাটিয়ে বাসে চড়ে হংকং চলে আসলাম!হংকং খুব একটা সময় কাটাইনি!
মাত্র ৩ দিন ছিলাম এখানে,তবে ৭ দিন থাকলেও হংকং দেখার সাধ মিটতো না আমার!আকাশ থেকে হংকং এর রাজকীয় সুউচ্চ দালানকোঠা দেখা ছাড়াও অনেক কিছুই আছে এই দেশে!ছোট্ট এই দেশে পাহাড় আর আইল্যান্ডের অভাব নেই!
ব্যস্তময় শহুরে জীবনের সাথে প্রাকৃতিক দিক থেকেও হংকং বেশ সমৃদ্ধ!চলমান রাজনৈতীক সমস্যার কারনে শুধু চলাচলে
একটু সমস্যা পোহাতে হয়েছিল,বাদবাকি হংকং ট্যুর ছিল আমার জন্য সেরা!তবে হংকং বাসী আমাকে নিরাশ করেনি,আসার আগে যতটুকু ভয় পেয়েছিলাম,তার ছিটেফোঁটাও গায়ে লাগেনি!এরা যে এতটা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল,কারন ছোটবেলা থেকে আন্দোলন মানেই দেখেছি মারামারি আর ভাংচুর!

হংকং ট্যুরের প্রথমদিন শেষ করি সিটি ট্যুর দিয়ে!সকাল থেকে হেটে হেটে clock tower, space museum,cultural complex,art museum,history museum,avenue of stars,sir burcc lee statute

ভিজিট করি!এইসব জায়গাগুলি সামান্য দুরত্বে অবস্থিত!
আগেই বলেছি চলাচলে একটু সমস্যা ছিল, তাই আমাকে প্রচুর হাটতে হয়েছে!এমনিতে আমি কোথাও ঘুরতে গেলে শহরের বাইরে চলে যাই,কিন্তু হংকং এর ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো,এই শহর আমার কাছে অমৃত্তের মত লেগেছে!তারপরেও পাহাড়ে যাওয়া ছাড়া আমার আবার চলেনা!

হাটাহাটির পর দুপুরের দিকে আমি চলে যাই mt. jonston,৩ ঘণ্টার ছোট্ট একটা ট্রেকিং ছিল!এখান থেকে বিকেলে নেমে চলে যাই নধু ধিঃবৎভধষষ!এই ধরনের ঝর্ণাধারা আগে কখনো দেখিনি,আবাসিক এড়িয়ার কোন এক কোনার এর অবস্থান আর ঝর্ণার পাণি গিয়ে মিলিত হয় সরাসরি সাগরের সাথে!ব্যাপারটা খুব জোস ছিল বলা যায়!ঝর্ণা দেখা শেষ করে আবার চলে আসি শহরে, রাতে Street Night Market একটু হাটাহাটি করে ফিরে যাই হোষ্টেলে!আমার হোষ্টেল মার্কেটের আশেপাশেই ছিল!

দ্বিতীয়দিন শুরু করি ferry tour দিয়ে,হংকং ট্যুরের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল এই ফেরি ট্যুর! দুইধারের বিশালাকার অট্টালিকা মধ্যে দিয়ে বহমান ভিক্টোরিয়া হারবারের এত সুন্দর নিল জলরাশি,মন চাচ্ছিল ফেরি থেকে লাফ দিয়ে পাণিতে গিয়েই বসে থাকি!
কিন্তু তাতো আর হবার নয়,কারন আমি সাতার জানিনা আর সাতার জানা থাকলেও হয়ত লাফ দেয়ার অনুমতি ই পেতাম না!
ফেরি ট্যুর শেষ করে observation wheel এ কিছু সময় কাটিয়ে golden bauhinia tample ভিজিট করে চলে যাই হংকং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিষ্ট স্পট Victoria peak G!tram train এ চড়ে গিয়েছিলাম এখানে!এখানে চাইলে হেটেও যাওয়া যায়!
তবে আমি আর হাটতে চাইনি,হাটতে হাটতে পায়ে আর জোর ছিলনা!

Victoria peak থেকে শহর আর সমুদ্রের যোগসাদৃশ্য দেখার পর টাওয়ার এর নিচে অবস্থিত madame tussauds ভিজিট করে চলে যাই “montane mansion”
মূলত এই বিল্ডিং দেখার জন্যই আমার হংকং এ আসা!এই এলাকায় সড়হঃধহব সধহংরড়হ এর মত অসংখ্য সুউচ্চ ঘিঞ্জি দালানকোঠা আছে!একেকটা একেকটার সাথে লাগানো,অনেকটা জমজ কলার মত!
হংকং দেশটা আয়তনে খুবই ছোট,মাত্র ১১০০ বর্গকিমি তার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল,আর এতটুকু জায়গার মধ্যেই প্রায় ৬০ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস!এদের হাউজিং সিষ্টেম ও আবার খুব প্যাঁচানো,
যার কারনে মধ্যম আয়ের মানুষদের কাছে এই টাইপের বাসস্থান ছাড়া অন্য কোথাও থাকার উপায় নেই!

এই বিল্ডিং এর পিছনে ছোট্ট একটা টিলা ছিল আবার একটু হাটাহাটি করে রাতে হোষ্টেলে ব্যাক করি!শেষের দিন শড়ষিড়হ সড়ংয়ঁব এ দুই রাকাত নফল নামাজ পরে সরাসরি চলে যাই এয়ারপোর্ট এর কাছাকাছি!কারন আমি টেনশনে ছিলাম ৫ তারিখের মত যদি ৭ তারিখেও হংকং এর সকল ফ্লাইট কেন্সেল করে দেয় তাহলে আমার চাকরী নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে!৫ তারিখ হংকং এর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন হয়েছিল!এদিন গিয়েছিলাম ঃরধহ ঃধহ ইঁফফযধ টেম্পলে!এখানে বাসে চড়ে গিয়েছিলাম,ঘণ্টা দেড়েক এর পথ ছিল!

Gici tian tian village এ একটু চক্কর মেরে হাটতে হাটতে fung wong shan এর চূড়ায় উঠে পরি! আমি আসলে জানতাম ও না এখানে পাহাড় আছে,তার মধ্যে এই চূড়াটি হংকং এর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া!উচ্চতা প্রায় ৯৩৪ মিটার!পাহাড় থেকে সাগরের সৌন্দর্য আর মেঘের মিতালী উপভোগ করে পাহাড় থেকে নেমে যাই!
তখন সময় ছিল বিকেল ৫ টার মতন!এরপর চলে যাই সধ ধিহ পযঁহম ারষষধমব
এয়ারপোর্ট এর খুব কাছেই এই গ্রামটি!
তারপর আরকি আমার সেই লুঙীর হংকং ভ্রমণের ইতি ঘটে!তবে আমি হনকং আবার যাবো,সময় আর সুযোগ হলেই চলে যাবো!কারন আমি হংকং এর প্রেমে পরে গিয়েছি!

তিনদিনে এই ট্যুরে আমার খুব একটা খরচ হয়নি,কারন আমি বাজেটের ভিতরে থেকে ঘুরার চেষ্টা করেছি!হোষ্টেলে তিনরাতের জন্য আমি পে করেছিলাম ১২৫ যশফ!আমি উঠেছিলাম tsim sha tsui এর  apple in হোষ্টেলে!আন্দোলনের জন্য হয়তো এত কমে বাংক-বেড পেয়েছিলাম!আমি কোরিয়া থেকে যাবার সময় রোমিং করে নিয়েছিলাম,কারন কোরিয়ার আর হংকং এর ইন্টারনেট খরচ প্রায় একই ছিল, এক্সচেঞ্জ রেট ২০০ যশফ এর মত হবে রোমিং খরচ ছিল!তিন দিনে ৬ বেলা খাবার খেয়েছি,এতে আমার খরচ হয়েছিল ৬০০(+-)যশফ এর মত!সকালের নাস্তায় খেয়েছিলাম বার্গার,দুপুরে যেখানে যা পেয়েছি তাই খেয়েছি আর রাতে এশিয়ান ফুড!

চলাচলের জন্য octopus card এ খরচ হয়েছিল ২৫০ হংকং ডলার এর মত!এই কার্ড যেকোন স্টেশনে গেলেই পাওয়া যায়!এই কার্ড যাববাহন ছাড়াও হংকং এর প্রায় সকল স্থানেই ব্যবহারযোগ্য!ডিপোজিট ৫০যশফ রাখে আর প্রথম রিচার্জ ১০০ যশফ!চলে যাবার সময় রয়ে যাওয়া টাকা আর ডিপোজিট রিফান্ড নেয়া যায়!আমি অবশ্য যেখানেই যাই আসার টাইমে কার্ড সাথে করে নিয়ে আসি স্মৃতি হিসেবে!আর হ্যা পিক ট্রামের প্যাকেজ টিকিট কিনেছিলাম ৩৮৫যশফ দিয়ে!এছাড়া আরো ২০০ যশফ কোথায় যেন খরচ হয়েছিল খেয়াল নেই!
তো এই তিনদিনে আমার সর্বমোট খরচ হয়েছিল ১৭৬০ যশফ!

পরিচিতি:-
আমি মোঃ শ্রাবন ইসলাম স্বপন,আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা শত সমস্যার শহর ঢাকাতে!এত সমস্যার পরেও ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও খুব একটা থাকতে পারতাম না!তবে পেটের তাগিদে মাতৃভূমি ছেড়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবৎ দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রবাসী হয়েই বেচে আছি!সৃষ্টিকর্তা আসলে সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন,নয়তো আমাকে অন্যত্র না পাঠিয়ে এখানেই কেন
পাঠালেন?পাহাড়ের প্রতি আমার খুব টান, আর এই বিষয়টাতে নিজেকে খুব লাকি মনে হয় কারন আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে পাঠিয়েছেন পাহাড়ি দেশেই!এখানে ৬৫% জায়গাই উঁচুভূমি!এখানে আসার পর থেকেই সময়-সুযোগ পেলেই পাহাড়ে গিয়ে বসে থাকি!সে যাই হোক আমি কোন লেখক নই,লেখক অনেক বড় মাপের জিনিষ!
লেখকদের দূরদৃষ্টি খুব তিক্ষ হয়ে থাকে!
আমি মাঝেমধ্যে আমার ভ্রমণকাহিনী লিখি, তবে তা শুধুই নিজের অভিজ্ঞতা!