থাই এয়ারওয়েজের ট্রিপল সেভেন সুপরিসর উড়োজাহাজে বিয়াল্লিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে সাড়ে দশঘন্টা উড়ালের পর আরলান্ডায় নামতেই বৃষ্টি বিপত্তি। শেষ আগস্টের সকাল। ব্যাংকক থেকে ৫ হাজার ৬শ’ ৬৫ কিলোমিটার উড়তে গিয়ে সাইবেরিয়ার আকাশে চন্দ্রালোকিত রাত, শুভ্র মেঘ বেশ উপভোগ্য হয়েছে। টেকঅফের আগে ওপর থেকে কালো মেঘের ফাঁকে সুইডেনের সবুজ বন, নীল সাগরের শান্ত জলরাশি দৃষ্টি কেড়েছে। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকতার পাঠ চুকিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতেই আকাশ ঝাঁপানো বৃষ্টি। দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তির পর ইউরোপের এই বৃষ্টিও আমাদের জন্য উপভোগ্যই হলো। মেশিনে সুইস মুদ্রা ‘ক্রোনার’ ফেলে টিকেট হাতে ডাউনটাউনমুখী বাসে ওঠার ব্যবস্থা। দশ মিনিট পর পর শার্টল বাস। টিকেট কেটে ঘাড় ঘোরাতেই দেখি বাস হাজির। অর্ধশত আসনের বাসে যাত্রী জনাাবিশেক। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ সুইডেন বলে কথা। যাত্রীর জন্য বসে থেকে চলাচলের সিডিউলে এক মিনিট বিচ্যূতিতেও এরা রাজি নয়। নরম গদিওলা আসনে বসার পরই বাস ছাড়ল।
বৃষ্টি তখনও ধরেনি। এসি বাস কাচের জানালায় টাইটফিট। বাইরে হাত গলিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার উপায় নেই। বৃষ্টি- শীতল কাচের জানালায় জলবাতাসের আবছা আস্তরণ। হাত দিয়ে কাঁচের জানালা পরিস্কার করে সকালের শহর দেখতে ভালই লাগছিল। বিমানবন্দরের জনহীন সড়ক ছেড়ে বাস যখন শহুরে রাস্তায় ঢুকতেই নানা দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকল। সারবাঁধা প্রাইভেট কার, রাস্তার মোড়ে ছাতা মাথায় অপেক্ষমান স্কুলগামী বালক বালিকা, দু’পাশে কাচঘেরা দোকান। সুইডিশ জাতি এমনিতে একটু আয়েশী। শহরের কর্মব্যস্ততা বলতে যা বোঝায়, তা শুরু হয়নি এখনও। মনে হলো, একটি শান্ত, স্নিগ্ধ বৃষ্টিমুখর সকালে স্টকহোমবাসীর ঘুম ভেঙেছে কেবল।
আমাদের এই ইউরোপ মিশনের একটি ছোট্ট ছুতো কেবল সুইডেনের বিশ্ব পানি সম্মেলনে যোগ দেয়া। আমাদের যোগ দেয়ার কথা শেষদিকে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়ে গেল শেষদিন। বিমানবন্দর থেকে ‘টি সেন্ট্রাল’ বা প্রধান রেল স্টেশন হয়ে ট্রেনে ‘এ্যালপখো’ এলাকার স্টকহোমাসান সম্মেলন কেন্দ্রে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। বাস আর রেলস্টেশন কাছাকাছি। বাস থেকে নেমে স্টেশনে গিয়ে সুইডেনের বৃহম্ম সম্মেলন কেন্দ্র স্টকহোমাসানমুখো ট্রেনে উঠে পড়লাম। ইউরোপের ট্রেন সেকেন্ড মিনিট ধরে চলে। মিনিটে মিনিটেই স্টেশন থেকে নানা গন্তব্যের ট্রেন মেলে। পনেরো মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম আলপখো স্টেশনে। স্থানীয়রা এই উচ্চারণ করলেও স্টেশনে নামটি লেখা অবশ্য এ এল ভি এস জে ও। আমার উচ্চারণে তা আল্ভস্জো হওয়ার কথা। উল্টো দিকে বের হলেই স্টকহোমাসান। আমাদের মতো অনেকেই বিমানবন্দর থেকে ল্যাগেজপত্র নিয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়েছে সরাসরি । এ ধরনের সম্মেলনে যোগ দেয়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য শিক্ষনীয়। আমার সফরসঙ্গী আরিফ জিয়াউদ্দিন। ইউরোপ দর্শন, এতো বড় সম্মেলনে যোগদান সবকিছুই তার জন্য নতুন।
কাকন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ভিপি ছিলেন। আশির দশকের স্বনামখ্যাত ছাত্রনেতা। সুইডিশ সরকারের কর বিভাগের উচ্চপর্যায়ে ‘ইকনমিক এ্যাডভাইজার’ পদটিতে আসীন হয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। কাকনের স্ত্রী নাগরিকত্বে সুইডিশ, বংশে বাংলাদেশী। ছাত্রজীবনের বন্ধুত্বের সূত্রে তাঁর আবদার, হোটেলে নয় তার বাড়িতে উঠতে হবে। এখানে সাড়ে আটটা-নয়টার আগে সূর্য ডোবে না। আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী কবি শাকিল রিয়াজও স্টকহোমে থাকেন দীর্ঘদিন। শাকিল স্বাস্থ্য বিভাগে ভাল চাকরি করে, তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নায়িকা তামান্না সেখানকার নামকরা ডেন্টিস্ট। দুইমেয়ে নিয়ে থাকেন স্টকহোমের হাগস্তান এলাকায়। তাদের বাসায় যাওয়া বা থাকার ব্যাপারেও ঢাকা থেকে কথা হয়েছিল। তবে কাকন নাছোড়।
স্টকহোমাসান থেকে অনুষ্ঠানের পর দুুপুরে খেয়েই বেরুতে হলো। বৃষ্টি তখনও পিছু ছাড়েনি। অনুষ্ঠানস্থল থেকে হেটে স্টেশনে যেতে কাকভেজা। আলপখো’র গেটমুখে সাদা সব চেহারার মধ্যে বাদামী চেহারার এক টগবগে যুবক। সামনে এসে হাত বাড়িযে বললেন, আমি নুরুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জের নুরুল। দিনমান সঙ্গে আছি, কোথায় যাবেন বলেন। নুরুল স্টকহোমে পড়াশুনা চাকরি দুটোই করেন। তাকে বললাম, নগরকেন্দ্রে ফিরে আমাদের প্রথম কাজ পরবর্তী গন্তব্যের টিকেট কাটা। ট্রেনে টি সেন্ট্রালে গিয়ে হেটে ট্রাভেল এজেন্সীতে গেলাম নুরুলের সঙ্গে। ফ্রাঙ্কফুট হয়ে প্যারিসের বিমান টিকেট ফেললাম। নুরুল আমাদের গাইড করে হেটে হেটে স্টকহোমের নানা জায়গা ঘোরাতে লাগলেন। এর মধ্যে একটি জায়গা হচ্ছে, স্টকহোমের জিরো পয়েন্ট খ্যাত এলাকা। ট্রি সেন্ট্রালের কাছেই। তখনও টিপটিপ বৃষ্টি চলছে। সিটি সেন্টারের আশপাশে হাটাহাটির জন্য একটা ছাতা কিনে নিলাম।
সন্ধ্যায় স্টেশন লাগোয়া শপিং মলের বার্গার কিংয়ে কাকন এসে যোগ দিলেন। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখতে বেরুলাম। সাগর তীরে হেটে প্রথমেই গেলাম ঐতিহ্যবাহী সুইডিশ একাডেমীতে। নোবেল পুরস্কার প্রদানের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত এই একাডেমী। ১৭৮৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন তৃতীয় কিং গুস্তাভ। সাগরের চ্যানেলের ওপর একটি সেতু। অপরপারে সুইডেনের রাজার রাজপ্রাসাদ। ছয়শ কক্ষ বিশিষ্ট এই রাজপ্রাসাদ আঠারো শতকে নির্মাণ করা হয়। এর অন্তত পাঁচটি যাদুঘর সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ভেতরের যাদুঘরে আর ঢুকতে পারিনি। সাগরচ্যানেল পারে এ্ই রাজপ্রাদা নয়ন জুড়িয়ে দেয়।
পাশেই সুইডেনের সংসদ ভবনটাও একনজর ঘুরে ফিরে এলাম সেন্ট্রাল স্টেশনে। ট্রেনে চেপে যেতে হবে মাস্ত্রা স্টেশনে। সেখানে কাকনের গাড়ি পার্ক করা। ব্যস্ত নগরীতে পার্কিং বড় সমস্যা। উপকন্ঠের স্টেশনে গাড়ি রেখে ট্রেনযোগে কাকন ঢুকেছে নগরীতে। মাস্ত্রায় এক দু’দিনের জন্য গাড়ি ফেলে রেখে অনেকেই নানা জায়গায় চলে যায়। আমাদের মতো দেশ হলে চুরির প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসতো আগে। সুইডেন এমন দেশ সেখানে কোটি টাকা গাড়ি চুরি করে নেয়া তো দুরে, তাকানোরও কেউ নেই।
স্টকহোম থেকে উপশালা সত্তর কিলোমিটার। দু’পাশে লোকালয় নেই। সবুজ গাছপালায় ভরা সমতলে ঢাউস পিচঢালা সড়ক। রাতের বেলায় যানবাহন খুব একটা নেই। ড্রাইভিংয়ে কাকন সতর্ক বেশ। নতুন গাড়ির পিকআপে পা দিলেই গতির কাঁটা একশ বিশ কিলোমিটারে উঠে যায়। হেডলাইটের আলোয় গ্লাসের ওপর হুইপারের দাপাদাপি। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছেই।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালের আলো ফুটতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় এক অদ্ভুত জায়গায় নিজেদের আবিস্কার করলাম, যা বর্ণনাতীত। সামনে সবুজ ঘাসে ছাওয়া ফাঁকা জায়গা। এরপর ঘন সবুজ বন। তিনদিকে চোখ জুড়ানো মায়াময় প্রকৃতির সমারোহের মধ্যে খয়েরি টালি ছাওয়া দোতলা এ্যাপার্টমেন্ট ভবন। সবুজের মধ্যে খয়েরি কন্ট্রাস্ট যেন পটে আঁকা ছবির আবহ তৈরি করে রেখেছে। প্রকৃতির সঙ্গে নীবিড় মেলবন্ধন রচনা করতে স্থপতিরা জীবনের সব বিদ্যা ঢেলে দিয়েছেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ভবন চত্ত্বরের গাঢ় সবুজ মনে প্রশান্তি এনে দেয়। অনতি দূরের ঘন সবুজ বন এক নিরিবিলি গাম্ভীর্য তৈরি করে।
কাকনের গাড়িতে বের হয়ে আমরা উপশালাও আশপাশের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখলাম। দিনমানের কর্মসূচীর অন্যতম ছিল উপসলা মসজিদ, ইউরোপের প্রাচীন ক্যাথেড্রাল, গভর্নর’স গার্ডেন, ঐতিহাসিক গানিলা বেল, রাজপ্রাসাদ, গ্রানবেরী উপত্যকা দর্শন এবং গ্রন বি এলাকায় বাঙালি কমিউনিটির ডিনারে যোগদান। বিকালে বাল্টিক সাগরের স্করহালমেন সৈকতে বেড়াতে যাওয়ার সময় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলাম। মাইলের পর মাইল ঘন বন। মাঝখান দিয়ে মসৃন পাকা সড়ক। কোথাও লোকালয় বলতে কিছু নেই। বনের মাঝে দুয়েকটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র বা অভিজাত বাংলো। উপত্যকাটিও নয়নাভিরাম। একদিকে বন অন্যদিকে নীলসমুদ্র। সুইডিশ ধনকুবেররা সখ করে মাছ ধরতে আসে এই নির্জন উপত্যকায়। বন্ধু কাকন বললেন, বাংলাদেশি তরুণ স্বপন ও তপনের মাছ ধরা নৌকাও এই ঘাটে আছে। তারা সেখানকার এ্যাংলার ক্লাবের সদস্য। আশপাশে কোন লোকালয় না থাকলেও এ্যাংলার বা মাছ শিকারীদের জন্য থাকা খাওয়ার ভাল হোটেল আছে।
গিয়ে দেখি, বৃষ্টিবিঘ্নিত দিন বলে মাছ ধরা ইঞ্জিনবোটগুলো ঘাটে বাঁধা। তবে বৃষ্টিভেজা আবহাওয়াও সুইডিশ শিকারী টমাসকে দমাতে পারেনি। দু’তিনটা বড়শি ফেলে লম্বা ছিপের সামনে ঠাই বসে আছে কাঠ- পাটাতনের ওপর। পাশের বালতিতে দুয়েকটি ছোট মাছও দেখলাম। কাকন ভাল সুইডিশ ভাষা জানেন। সাত ফুট লম্বা টমাসের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে সফরসঙ্গী আরিফের সিগারেট খরচ বেড়ে গেছে মনে হলো। তার হাতের ক্যামেরাটিও সারাক্ষণ সচল দেখা গেল । আমি টমাসের কাছ থেকে সবচেয়ে লম্বা ছিপওয়ালা বড়শি নিযে বাল্টিক সাগরের নীলজলে ফেললাম। বড়শিতে মাছের ঠোকর দিচ্ছে কি না তাতে নজর নেই। আদিগন্ত নীল সমুদ্র যেখানে নীল আকাশে মিশেছে, সেদিকে তাকিয়ে ভাবালুতায় আক্রান্ত হয়ে গেলাম।
রাতে উপসালায় ফিরে ডিনারের জন্য গ্রন বি এলাকায় যেতে হলো। কাকন ও তার শ্বশুর পরিবারের সবার দাওয়াত। বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে গিয়েছি বলে আমাদের খায়-খাতিরের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা আছে। প্রবাসী মোস্তফা কামালের ছোট ছেলে নাবিলের ১৮ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভুরিভোজনের আয়োজন। খানাপিনার সঙ্গে ঘরোয়া কায়দায় গান-বাজনা, ফটোসেশন, কৌতুকের ব্যবস্থা। প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গণি, আকরামুল ইসলাম, নাজমুল হাসান প্রমুখের মতো বর্ষীয়ানরা উপস্থিত। নাফিউজ্জামান, নাবিলদের মতো সুইডেনে জন্মগ্রহণকারী বাঙালি বংশোদ্ভূত নবীনদের উপস্থিতিও বেশ। ধনি দেশটিতে বসে মূহুর্তেই যেন এক টুকরো বাংলাদেশ দেখতে পেলাম। উপসলার রাতের বাতাসে ভাসতে লাগলো বাংলা জারি, সারি, ভাটিয়ালি। নাইরে…. নাওয়ের বাদাম তুইল্যা……কোন দূরে যাও…..।
দু’য়েকদিনের মাথায় আরলান্ডা বিমানবন্দর থেকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট গামী উড়োজাহাজে চড়ে বসতেই হলো। আধঘন্টার মাথায় আমাদের ধরতে হবে প্যারিসের চ্যার্জ দ্য গুল বিমানবন্দরমুখো বিমান। প্যারিস শত আকর্ষণ নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
মাহমুদ হাফিজ