Skip to content Skip to footer

ভয়ের মধ্যেও জয়

যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই বলে, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা আরো খারাপ।’ কেনিয়ার অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছিল এটাই পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট দেশ। এখন এর চেয়েও খারাপ! কেনিয়ায় জান নিয়ে বেরোতে পেরেছিলাম, এখানে বোধহয় সেটাও যাবে। সবার কথা শুনে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে একরকম মেনেই নিলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় মরতে যাচ্ছি।
কেনিয়ার ঘটনাটা বলি। সেবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি (তখন নাম ছিল নকআউট বিশ্বকাপ) কভার করতে কেনিয়া গেছি। কিছুদিন পরই বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলতে নামবে, তাই নিয়ে ধুন্ধুমার উত্তেজনা। সেই প্রেক্ষিতে একটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রমাণ করতে বাংলাদেশ দল মরিয়া। দেশের মিডিয়াও মরিয়া সে উত্তেজনায় পাঠক-দর্শকদের যথাসাধ্য শামিল করতে। তখন কাজ করি দৈনিক প্রথম আলোতে, দেশের শীর্ষ দৈনিক, তাদের প্রতিনিধি হয়েই চললাম কেনিয়ায়। আজকালকার মতো গুগল যুগ নয় বলে এক ক্লিকেই সব জানার সুযোগ নেই। তবু কেনিয়া সম্পর্কে যা শুনলাম কোনোটাই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। একটা সম্মেলনে কেনিয়া ঘুরে আসা এক সিনিয়র সাংবাদিক জানালেন, ‘সাবধানে থাকবেন কিন্তু।’
বিদেশে গেলে সাবধানে থাকা নিয়ম। মাথা নাড়লাম, ‘থাকব।’
‘পকেটে টাকা-পয়সা খুব বেশি রাখবেন না।’
এবার একটু খটকা। ‘কেন? টাকা-পয়সাতে সমস্যা কী?’
‘সমস্যা আছে। ওখানে চুরি-ডাকাতি খুব হয়।’
‘ও আচ্ছা।’
খুব একটা পাত্তা দিলাম না। ঢাকা শহর আমাদের একটা বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছে। মনে করি, এখানে চলতে পারলে দুনিয়ার কোনো জায়গাতেই আর সমস্যা হবে না। আর তাই কেনিয়ার চুরি-ডাকাতির তথ্যকে বিশেষ পাত্তা দিলাম না। ঢাকায় ওসব কত সামলালাম! আর কিনা কেনিয়ার চোর-ডাকাত। ওদের গুনতে বয়েই গেছে।
কিন্তু গুনতে হলো। ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ শেষেই সম্ভবত ঢাকায় লেখা পাঠাতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফ্যাক্সের আমলে লেখা পাঠিয়ে অফিসে ফোন করে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফেরার পথ ধরা যায় না। সেদিন ফোন লাইনটা পেতে এত দেরি হলো যে অফিসে কথা শেষ করে দেখি আমরা বাংলাদেশি সাংবাদিকরা ছাড়া প্রেসবক্সে কেউ নেই। বেরোনোর সময় ভারতীয় কর্মীটি হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘তোমরা যাবে কিভাবে?’
‘এইতো একটা গাড়ি ধরে নেব।’
‘এখানে গাড়ি পাবে কোথায়?’
‘পাব না?’
‘ট্যাক্সি ফোনে ডাকতে হবে। দাঁড়াও দেখি।’
বলে সে ট্যাক্সি ডাকার জন্য ফোন ঘোরায়।
আমরা ওর ব্যস্ততায় একটু অবাক। বললাম, ‘তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা ঠিকই পেয়ে যাব।’
সে হেসে বলল, ‘নাইরোবি সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণাই নেই। সন্ধ্যার পর কালো মানুষ ছাড়া রাস্তায় কোনো ভারতীয় চেহারার মানুষ হাঁটে না। হাঁটলেই শেষ।’
‘তাই নাকি?’
‘ঠিক তাই।’
কাজেই এরপর সে যখন প্রস্তাব দেয়, ‘তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি তোমাদের নামিয়ে দেব’ তখন আর না করার অবস্থা নেই।
দামি বিএমডব্লিউ গাড়িটাতে উঠে মনে হলো, এখানে নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত। দুশ্চিন্তাটা তাই একরকম দূরই হয়ে গেল। উপভোগ করতে শুরু করলাম রাতের আফ্রিকার চলতি পথের সৌন্দর্য।
গাড়িটা গিয়ে একটা মার্কেটমতো জায়গায় থামল। দুই কর্মীর একজন নামবে। জনবহুল এলাকা। আফ্রিকান দেশের ভিড়ের একটা মজা আছে। সবাই নাচ-গান করে, একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। সেই ভিড়টাতে মজে গিয়েছিলাম বলে খেয়াল করিনি কখন আমাদের গাড়ির দুই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুজন পিস্তলধারী। তারপর একজন শিস বাজাতেই ছুটে এলো আরো দুজন। আর যে গতিতে ওরা গাড়িতে ঢুকল তুলনা দিতে গেলে বিদ্যুতের গতিটাই মাথায় আসে। ওরা চারজন, আমরা চারজন। একটা সিডান গাড়িতে আটজন। আমরা আমাদের সিটেই বসে। এখানেও ওদের দক্ষতার গল্প। ওরা পায়ের সামনের জায়গায় নিজেদের যেভাবে স্থাপন করল সেটা অবিশ্বাস্য। ও, হ্যাঁ, এর মধ্যে একজন আমাদের ড্রাইভারকে একটা কড়া ঘুষি মেরে ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই বসেছে ড্রাইভারের আসনে। এখন তাই গাড়ি চলছে ওদের হিসাবমতো। ফাঁকে চলছে আমাদের জিনিসপত্র কেড়ে নেয়া। আগে থেকে কিছু সাবধানতা ছিল বলে যার যা ছিল তা দিয়ে দিয়েছি। তবু একটা ঘুষি খেলাম আমার মানিব্যাগে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা ছিল না বলেই সম্ভবত। ওরা এগোচ্ছে নাইরোবি শহরের মূল রাস্তা ধরেই। রাস্তাভর্তি মানুষজন। পুলিশও আছে। তবু কিছু করার নেই। আশা জাগে, হঠাৎ হয়তো কোনো পুলিশ গাড়িটা থামাবে…তারপর…
হয় না অবশ্য সেরকম কিছু। গাড়ি শহর ছাড়ে। এবার নির্জন রাস্তা। আর কিছু করার নেই মেনে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে অপেক্ষায় থাকি। সেদিন একটা শিক্ষা হয়েছিল। চরম ভয়ের ঘটনায় একসময় ভয়টা কেটে যায়। তখন কেমন যেন নিজেকে দর্শক-দর্শক মনে হয়। মনে হয়, দেখি এরপর কী হয়!
এরপর যা হলো সেটাও অদ্ভুত। একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলা হলো, হাত উঁচু করে দাঁড়াতে। দাঁড়ালাম। এবার উল্টা ঘোরার নির্দেশ। ঘুরলাম। এবারের নির্দেশ, হেঁটে চলার।
হেঁটে চলছি আর ভাবছি এই বোধহয় একটা গুলি এসে…। আল্লা-খোদার নাম নেয়া। প্রিয়জনের মুখ মনে করা। এর সবই হয়ে গেছে।
গুলির শব্দ অবশ্য আসে না। তার জায়গায় অন্য শব্দ। গাড়ি স্টার্ট করার। উল্টা ঘুরে দেখি ওরা গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে। ‘মাই কার’ ‘মাই কার’ বলে স্থানীয় মিডিয়া কর্মীটি গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করছে আর আমরা তখন পারলে লাফাচ্ছি। দ্বিতীয় জীবন পাওয়ার আনন্দ কাকে বলে সেটাও জানা হয়ে গেল।
নির্জন জায়গা। অনেকক্ষণ হাঁটলাম। হেঁটে ক্লান্ত হয়ে লোকালয়ের দেখা মিলল। ওখান থেকে ফোনে যোগাযোগ হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে যাওয়া কর্তাদের সঙ্গে। সেই সূত্রে স্থানীয় পুলিশ। তাদের তৎপরতায় গাড়িও ফেরত পাওয়া গেল। কিছু জিনিসপত্রও। কিন্তু আমার কাছে উপসংহার ওটাই। জান ফেরত পাওয়া।
তা এরকম অভিজ্ঞতার পর কেউ যখন বলে যেখানে যাচ্ছ সেখানকার অবস্থা এর চেয়েও খারাপ, তখন কী মনে হয়! মনে হয় না যে ফেরত পাওয়া জানটা এবার যাবেই যাবে।
বাংলাদেশ দল টুর্নামেন্ট থেকে আগে আগেই বিদায় নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে গেছে। কিম্বারলিতে একটা তিন দিনের ম্যাচ খেলে ততদিনে ব্লুমফন্টেইনে। আমরা নকআউট টুর্নামেন্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত কেনিয়ায় থাকায় ব্লুমফন্টেইনেই যেতে হবে সরাসরি। কিন্তু ব্লুমফন্টেইনে ডিরেক্ট ফ্লাইট নেই, ট্রানজিট নিতে জোহানেসবার্গে এক রাত থাকতে হবে এবং জোহানেসবার্গ ‘খারাপ’ দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে ‘আরো খারাপ’। ক্রাইম রেটে নিউ ইয়র্ককে সরিয়ে নাকি সেই বছর শীর্ষস্থানে উঠেছে।
নাইরোবি থেকে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার ফ্লাইটে বসে শুধু ভাবছি, নাইরোবির চেয়ে ভয়ংকর! তাহলে কেমন হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা! ভেবে ভেবে শেষে একটা ছবিও তৈরি হয়ে গেল। নাইরোবিতে চুরি-ছিনতাই হয় শহরে। দক্ষিণ আফ্রিকা এর চেয়ে এগিয়ে মানে এখানে ঘটনাটা তাহলে শুরু হবে বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই। হয়তো ওখানেই পিস্তল ঠেকিয়ে কেউ কেড়ে নিয়ে গেল সর্বস্ব।
বিমানবন্দরে নামার পর তাই সদাসতর্ক। কেউ কাছে ঘেঁষলেই সরে দাঁড়াচ্ছি। প্রচুর কালো মানুষের ভিড়। প্রত্যেকেই আমার কাছে সম্ভাব্য ছিনতাইকারী।
যে আরেকজন সঙ্গী বন্ধু, তিনিও সমপরিমাণ ভীত। প্লেনে বসেই তাই ঠিক হয়ে গেল, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নেয়ার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। যে হোটেল বুক করেছি ওদেরকে ফোন করব। ওদের গাড়ি এলে তবেই যাব। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ছুটলাম ফোন করার জন্য। ওখানে লম্বা লাইন দেখে সঙ্গী দাঁড়ালেন লাইনে। আমি একটু দূরে গিয়ে বসেছি। তখনই কালো-লম্বা একটা ছেলে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ফ্রেন্ড ইউ হ্যাভ লাইটার?’
আছে। দিলাম। সেটা হাতে নিয়ে বলল, ‘নাও গিভ মি এ সিগারেট।’
একি কান্ড! পরে দেখেছি প্রথম বিশ্বের শহরে অচেনা লোকও দিব্যি সিগারেট চেয়ে বসেছে। তখন এটা জানতাম না। তাছাড়া আগে লাইটার-পরে সিগারেট! এ তো ছিনতাইয়ের মতোই ব্যাপার। কিন্তু তা দিয়েও যদি রক্ষা হয়। দিলাম সিগারেট। সে সিগারেটটা ধরিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল।
না। লোকজন যা বলছিল, তাই তো ঠিক। অবস্থা তো কেনিয়ার চেয়ে খারাপ।
ততক্ষণে বন্ধুটি ফিরে এসেছেন। সুসংবাদ এই যে হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেছে। ওদের গাড়ি আসবে।
শক্ত হয়ে বসে দুজন গাড়ির অপেক্ষা করতে থাকি। গাড়ি এলো মিনিট পনেরোর মধ্যে। রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের মতো পোশাক, বিশাল বপু এবং পুরু গোঁফের ড্রাইভারটার চেহারার মধ্যে ভয়ের কিছু হয়তো ছিল না কিন্তু আমরা ঠিকই ওকে একটা সন্দেহজনক চরিত্র বানিয়ে দিলাম। লোকটি এরকম করে তাকায় কেন? ওভাবে হাসছে কেন? আমাদের ব্যাগগুলোর দিকে অমন মনোযোগেরই বা কারণ কী!
গাড়ি চলতে শুরু করল। সন্ধ্যা পেরিয়েছে। সুনসান রাস্তা। আমরা একজন আরেকজনের যথাসাধ্য কাছে বসেছি। স্পিড লিমিট বা ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে গাড়ি একটু স্লো হলেই শক্ত হয়ে যাচ্ছি।
হোটেলটা অনেকগুলো কটেজের একটা সমষ্টি। তেমনি একটা কটেজে ঢুকে যত রকমের লক আছে সব লাগিয়ে বসে থাকলাম। সকাল ১০টায় ব্লুমফন্টেইনের ফ্লাইট, ৮টায় বেরোতে হবে, মানে রাতটাই শুধু ওখানে। কিন্তু রাতটা তো কাটতে হবে।
কোনো একটা শব্দ হলেই ভয় হচ্ছে, এই বোধহয় কেউ এলো! আবার চুপিচুপি গিয়ে চেক করি, লক সব লাগানো তো! বাথরুমের জানালা বেয়ে কেউ কি ঢুকে পড়তে পারে? সবরকম নিরাপত্তা পরীক্ষা শেষে দুজন বিছানায়।
লম্বা জার্নিতে শরীর ক্লান্ত ছিল, এত ভীতির মধ্যেও ঘুম এসে গেল। ভাঙল গভীর রাতে। প্রচন্ড শব্দে।
চমকে উঠলাম। না, এবার আর মিস নয়। নির্ঘাত কোনো এক ডাকাতের দল এসে ঢুকছে।
চুপিচুপি দাঁড়ালাম। আশপাশে অস্ত্রের সন্ধান না পেয়ে শেষে কারাতের ভঙ্গি করে পুরোপুরি প্রস্তুত।
সামনের আয়নায় নিজের সেই ছবিটা দেখা গেল। কিন্তু দুজনের ছবি যে! পেছন ফিরে দেখি সঙ্গীটিও ঠিকই একই রকম ঘুম ছেড়ে, একই রকম প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ও, হ্যাঁ, তার হাতে একটা অস্ত্র আছে। বিছানার কোলবালিশকে উঁচিয়ে ধরে আছেন তিনি। এরপর আর না হেসে পারা যায় না। দুজন হাসলাম। আস্তে আস্তে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। হোটেলের সিকিউরিটি গার্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর সঙ্গে একটা কুকুর। সেই কুকুর লাফাচ্ছে, ওকে থামাতে গার্ডকেও লাফাতে হচ্ছে। সেই লাফালাফিতেই এই শব্দ।
লজ্জা পেলাম। পেয়ে ঠিক করলাম আর ভয় করব না। নির্ভয় থাকব। যা হওয়ার হবে।
শেষ পর্যন্ত আর দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি। এবং ব্লুমফন্টেইন পৃথিবীতে আমার প্রিয় শহরগুলোর একটি। দক্ষিণ আফ্রিকা সুন্দর দেশগুলোর তালিকায় আছে প্রথম তিনের মধ্যেই।
আজ এত বছর পর যখন ফিরে দেখি তখন মনে হয় ব্লুমফন্টেইন বা দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন মোহিত হয়ে যাওয়ার কারণ বোধহয় ওটাই। ওই ভয়।
যখন কোথাও খুব ভয় লাগে এবং শেষ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না তখন সব কিছুই হয়ে ওঠে বাড়তি আনন্দের।
আচ্ছা তাহলে দেখা যাচ্ছে ভয়ও একটা কাজের জিনিস! ভয়ের মধ্যেও জয় আছে!

মোস্তফা মামুন