সন্ধ্যা নেমেছে, সূর্য বিদায় নিয়েছে কিছুক্ষণ আগে, তবুও চারপাশে কিছুটা আলোর ফাঁদা থেকে যায়, যা কেমন বিষণ্ণ করে রেখেছে। আমি আধো ঘুম, আধো জাগরণের অবস্থায় বসে আছি, দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি শরীরে বাসা বাঁধছে। জানালার বাইরে তাকাই—চেনা সব দৃশ্য আমার চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে যায়। গ্রাম বাংলার সাধারণ কিন্তু প্রিয় সব দৃশ্য—দোচালা টিনের ঘরের উঠোনে খরের গাঁদা, ফসলের মাঠ, ঝড়-বাদলে বাঁকে বাঁকে ঝুঁকে থাকা পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি, স্থির পুকুরের উপরে অস্থির বাঁশঝাড়, রাস্তার ধারে দোকানপাট, পানের পিক ফেলা অলস বুড়ো, চায়ের স্টলে টেলিভিশনের সামনের ভিড়। সবকিছু সরে যাচ্ছে—কখনো দ্রুত, কখনো ধীরে। চোখের পাতা ভার হয়ে আসে।
চোখ বন্ধ করলে দৃশ্য বিদায় নেয়, কিন্তু অল্প খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া আসে, আর নাকে পৌঁছে গন্ধ—কে যেন উঠোনে খড় পোড়াচ্ছে, কেউ গোয়ালঘরে ধূপ জ্বালাচ্ছে, মাটির চুলায় কোন বাড়িতে কাঁচা মসলা দিয়ে ছোট মাছ বসানো হয়েছে। আধো চোখ খুলে দেখি, দিনের শেষ আলোয় দূরের ভুট্টার খেতের ওপর নীলচে সবুজ ছায়ার সাথে সাদা কুয়াশার ঘ্রাণ ভেসে আছে। কুয়াশা নাকি ধোঁয়া? নাকি সেই পাহাড়ের কোলে আমাদের দেখা দোষুলা পাসের? হঠাৎ বাস থেমে যায়—সামনের এক্সিডেন্টের শব্দ শুনে রাস্তার লোকজন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আমি নির্বিকার বসে থাকি। মিনিট বিশেক পর বাস আবার চলতে শুরু করে।
ভুটান
হঠাৎ মনে পড়ে সেই দেশ, বজ্রড্রাগনের দেশ—ভুটান। দশেক দিন আগে ভারতের জয়গাঁও সীমান্ত পার হয়ে ভুটানের মাটিতে পা রাখা মুহূর্তেই ভালো লাগা শুরু হয়। কয়েক গজের ব্যবধানেই ভুটানিজ আর্কিটেকচারের গেইট, আর পাশেই ভারতের এলোমেলো দোকানপাট, যানজট, হর্নের শব্দ। ভুটানের ফুন্টশোলিং শহর শান্ত, ছিমছাম, বসবাসকারীর সংখ্যা খুব কম, প্রায় ত্রিশ হাজার নয়। বর্ডারের আনুষ্ঠিকতা শেষ করে বিকেল পর্যন্ত পথ চলা, তাই থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় পরদিন সকালে।
গাড়ি ছেড়ে প্রথম ঘণ্টা পাহাড়ি পথ, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ির মত দৃশ্য, তবে ধীরে ধীরে পাহাড়ের রূপ পরিবর্তিত হতে শুরু করে। গাড়ি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় চলে—সাপের মতো নয়, বরং নিজস্ব গঠন অনুযায়ী। কখনো চোখের সামনে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়, কখনো তা কয়েক সেকেন্ডেই বদলে যায়। ভুটানের রাস্তায় সাতদিন ভ্রমণে একটানা ১৫ সেকেন্ড সোজা রাস্তা দেখা যায়নি।
থিম্পু
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রার পর থিম্পুতে পৌঁছে ঠাণ্ডা বাতাসের ধাক্কা খেলাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭,৫০০ ফিট উচ্চতা, তাই শীতের অবশিষ্ট রেশ আছে। পরিকল্পনা ছিল আজই ভুটানের অন্য স্থানগুলোর অনুমতি নেওয়া, কিন্তু সরকারি ছুটির কারণে তা সম্ভব হলো না। ট্যাক্সির পরামর্শে পারোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ড্রাইভার থিনলে, পঞ্চাশোর্ধ্ব, মাঝারি গড়ন, সজ্জন ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী।
পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলতে চলতে বসন্তের ফুলের রঙিন ছায়া চোখে পড়ে—গোলাপি, সাদা, দূর থেকে যেন ছোট ছোট মিঠাই। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি থাকলেও চোখের খাওয়াদাওয়ায় থেমে গেলাম না।
পারো জং
পারো শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২০০ ফিট উচ্চতায়। এটি ভুটানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। পারো জং বা রিনপুং জং“সম্পদের স্তূপ”—১৬৪৪ সালে সাবদ্রং গুয়াং নামগিয়াল নামক ধর্মীয় গুরু দ্বারা নির্মিত। মন্দিরের উপরে একটি ওয়াচ-টাওয়ার আছে—‘তা জং’, যা এখন মিউজিয়াম। জংগুলো শুধু প্রার্থনার জন্য নয়, প্রাচীনকালেও দুর্গ হিসেবে ব্যবহার হতো।
উৎসবের কারণে পারো জংয়ের চারপাশে মানুষজন ঘুরছে। সন্ধ্যার আলোয় মন্দিরের সান্ধ্য-বাতি জ্বলে, চারপাশে রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করছে। আমরা হোটেলে ফিরে এসে রাতে খাবার খাই—ভুটানের খাবার সীমিত, প্রধানত ভেজিটেরিয়ান। রাত নেমে শহর নিঝুম হয়ে যায়।
রাতের স্বপ্নে আমি দেখি, বাঘিনীর পিঠে চড়ে গুরু পদ্মসম্ভবের টাইগার নেস্টের গহীন পাহাড়ে পা রাখছি। সেই বংশধরের মধ্যে একজন এখনও এখানে আছে। আমার ভুটানিজ গাইড আমাকে অপরাধী কন্ঠে বলছে, “দেখো, সামান্য টাকার বিনিময়ে আমরা আমাদের সবচেয়ে পবিত্র প্রাণীদের একটি চুরি করতে সাহায্য করছি। তুমি ভালো করে খাওয়াবে।”
আমি প্রশ্ন করি, “এই বাঘগুলি কী খায়?” গাইড নির্বিকারভাবে উত্তর দেয়—“মম খায়।” আমি তাকাই, এই পরিচিত চেহারার মানুষটা আগে কোথাও দেখেছি মনে পড়ে।
পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল ভুতুড়ে এক স্বপ্ন থেকে। মনে হচ্ছিল, আমি টাইগার নেস্টের গহীনে পৌঁছেছি। বাঘিনীর পিঠে চড়ে, গুরু পদ্মসম্ভবার পথে হাঁটছি—হাজার বছর আগে যিনি সেই পাহাড়ে পা রেখেছিলেন, তাঁর বংশধর হয়তো এখনো এখানে আছে। আমার পাশে ভুটানিজ গাইড, যেন সবকিছু জানে, বলে যাচ্ছে, “দেখো, আমরা সামান্য টাকার বিনিময়ে এই পবিত্র প্রাণীদের একটাকে তোমার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। তুমি ভালো করে যত্ন নেবে।”
আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এই বাঘগুলো কী খায়?” গাইড নির্বিকারভাবে উত্তর দিল—“মম খায়।” আমার চোখ বড় হয়ে গেল। আমার দৃষ্টি গাইডের দিকে, যে পরিচিত চেহারা যেন কোথাও আগে দেখেছি। কোথায়? কোথায়? প্রশ্ন যেন ঘুরপাক খাচ্ছে।
সকালে হোটেল থেকে বের হয়ে আমরা পাহাড়ি পথ ধরে চলা শুরু করলাম। পারোর জং থেকে একটু দূরে, গাছের ছায়া আর নদীর কুলকুলের শব্দ আমাদের পথচলায় সঙ্গী। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট ঘর, নদীর পাশে টুকরো টুকরো বাঁধ, আর পাহাড়ের কোলে কোলে ছোট বৌদ্ধ মন্দির—এগুলো সব যেন প্রাচীন ভুটানের ইতিহাসের গল্প বলছে।
পাহাড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে আমরা পৌঁছালাম সেই স্থান, যেখানে বাঘিনীর বংশধররা লুকিয়ে আছে। গাইড সতর্কভাবে বলল, “একটু ধীরে, আওয়াজ কম, ওরা খুব সংবেদনশীল।” দূর থেকে দেখলাম ছায়ার মতো ধূসর প্রাণীগুলো শান্তভাবে বসে আছে, চোখে জ্বলন্ত আগুন। আমি যেন হিমশীতল নদীর মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বনাঞ্চলের পরিবেশ অবিশ্বাস্যভাবে রহস্যময়। চারপাশে কুয়াশা ভেসে আসছে, পাখির ডাক আর পাতার ঝরা শব্দ যেন সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সঙ্গীত তৈরি করছে। মুহূর্তগুলো যেন থেমে গেছে—স্মৃতি, বাস্তব, স্বপ্ন সব মিশে একাকার। আমি নরম ধাপে ধীরে এগোই, গাইড পাশে।
গাইড হঠাৎ বলল, “এখানে ওরা মানুষকে দেখে খুব কম ভয় পায়। তুমি শুধু ওদের জন্য মম নিয়ে যাও।” আমি ব্যাগ থেকে সেই ছোট মমের বাক্স বের করি। বাঘগুলো একে একে এগিয়ে আসে, তাদের বিশাল চোখে কৌতূহল আর শান্তি মিশ্রিত। আমি বাক্স খুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিই। অদ্ভুত আনন্দ—এমন অনুভূতি, যেন প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে এক মধুর সংযোগ স্থাপন হচ্ছে।
পাহাড়ি গোপন পথ দিয়ে নিচে নামার সময় মনে হল, আমি শুধু ভ্রমণ করিনি, বরং কোনো প্রাচীন রহস্যের অংশ হয়েছি। বাঘিনীর বংশধররা আবার তাদের ঘন বনাঞ্চলে মিলিয়ে গেল, আর আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম—এই গল্প, এই অভিজ্ঞতা, এই অদ্ভুত ভুটান আমার মনে চিরকাল থাকবে।
সন্ধ্যা নেমে গেলে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। পাহাড়ের শীতল বাতাস, জং-এর সান্ধ্য আলো, এবং বাঘদের সঙ্গে সংযোগ—সব মিলিয়ে মনে হল, এই ভ্রমণ শুধু চোখের আনন্দ নয়, বরং হৃদয়েরও এক গভীর ছাপ রেখে যাবে।
পরবর্তী ভ্রমণ কি হবে? কোন রহস্য আমাদের অপেক্ষা করছে? ভুটানের পাহাড়, জং, বাঘ—সব মিলিয়ে যেন নতুন কোনো কাহিনীর সূচনা।