Skip to content Skip to footer

ভ্রমণের বাংলাদেশ

অরুন সেন

বন্ধুরা দেখা হলে প্রায়ই আমাকে ঠেগ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ থেকে কবে এলে, কিংবা যাঁরা আরও রগিক তাঁরা। বলেন, এখানে কতদিন আছো! দোষের মধ্যে এই, গত পনেরো বছরে যে কবার বাংলাদেশে যাওয়ার গুযোগ করে নিয়েছি তার হিসেব বারোয় পৌঁছেছে। উদ্দেশ্য বেড়ানেই। কিন্তু সেইগঙ্গে কখনও থিয়েটার দেখা, কখনও স্নেহভাজন কারও বিছের আমন্ত্রণে গাড়িা দেওয়া, কখনও রবীন্দ্রগংগীত গম্মেলন বা পয়লা বৈশাখের উৎগবে হাজির হওয়া, ইত্যাদি অছিলা থাকে। গুরুগম্ভীর সেমিনারও কখনও। ভৌসোলিক দিক থেকেও এত কাছের এই দেশ, বহরমপুর বা মালদা বা শিলিগুডড়র চেয়ে বেশি তো কখনওই নয়, তবু লোকে চোখ বড় বড় করে আমার এই ঘন ঘন ‘বিদেশ যাওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে, তার কারণ তো একটাই, পাসপোর্ট ভিসা না করে যেখানে যাওয়া যায় না। আর উদ্যোগ নিয়ে তা করা হয় না বলেই যাব যাব করেও যাঁদের যাওয়া হয়নি, মনের মধ্যে ইচ্ছেটাই শুধু চাপা পড়ে রয়েছে, তাদেরই বোধহয় আমার যাওয়া নিয়ে এত চোখ টাটায়! না গিয়ে কী হয় তা জানলাম। কিন্তু গিয়ে কী হয়। তাও দেখেছি। পূর্ববঙ্গ নিয়ে পূর্বস্মৃতি বা পারিবারিক স্মৃতি নেই, হয়তো একটু উদাসীনতাই আছে, এমন জনকেও দেখেছি, একবার ঘুরে এলে কী রকম আবেসে আত্মহারা হয়ে যান।
অনেক সময়ই ভাবি, কারণটা কী? প্রকৃতি? একদা পূর্ববঙ্গ নিয়ে স্মৃতিচারণ যাঁরা করতেন, তাঁদের গল্পে থাকত, থইথই বর্ষায় কীভাবে খুদে নৌকোয় লগি ঠেলে বাড়ির দাওয়া থেকেই যেতে হচ্ছে বাজারে ইস্কুলে। সে পূর্ববঙ্গ আর নেই। বহু নদীতেই চড়া পড়েছে, জলাজমি ভরাট করে রাস্তা হয়েছে, বাড়ি হয়েছে। নদী হয়তো পড়বে পথে পথে। কিন্তু তার ওপর ব্রিজ হয়েছে, বিদেশ থেকে কেনা দৈত্যাকার বার্জ পার করে দিচ্ছে বাস লরি। ভাবা যায়, যে বরিশালে যাতায়াত নিয়ে একসময় কত কী হাসিঠাট্টা করা হত, এখন চৌরঙ্গিতে গাড়িতে উঠে, পা না ভিজিয়েই, চলে যাওয়া যায় হুশ করে! বন্যার সময় জল-ডাঙা এক হয়ে যায় বহু জায়গায় এখনও, কিন্তু সে কী আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও হয় না? বন্ধুরা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, পটুয়াখালি নিয়ে যাবেন। বর্ষায় এই দেখাতে যে পূর্ববঙ্গ আছে পূর্ববঙ্গেই। বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য পূর্ববঙ্গেও, সে আর এমন কী কথা। শরৎ, হেমন্ত আর বর্ষার বাহার হয়তো আজও আকুল করবে স্বদেশ-বিদেশের ভ্রমণার্থীকে। ভরা বর্ষায় যাইনি কখনও-কিন্তু ওখানকার বন্ধুকবিরা খোপা দেন, বর্ষায়নো গেলে নাকি বাংলাদেশ দেখাই হয়না। কিন্তু গেই ঝুঁকি নিতে বলায় যায় কজনকে!
কোনও একটা জায়গা বেড়াবার জায়গা হতে হলে কী কী থাকা দরকার? গমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল? বাংলাদেশে সমুদ্র বলতে তো কক্সবাজার (গাহেববরা নির্ভুল বলবেন ‘কক্সেস বাজার’) চট্টগ্রাম শহরের বোল্ডার ছড়ানো পতেঙ্গা দেখতেও যাওয়া যায়্ আর কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তা তো দুরন্ত। একটু কষ্ট করলে পটুয়াখালি থেকে কিছুটা দুর্গম কুয়াকাটা। যা হয, প্রত্যেক গমুদ্রেরই আলাদা আলাদা রূপ, এখানেও তা-ই। কক্সবাজার চওড়া গৈকত, কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়। মনে হতে পারে, পুরী-কোভলম দেখেছে যে বাঙালি বৈচিত্র্যময় সমুদ্রে ঘেরা সেই ভারতের মানুষকে আর নতুন কী দেখাবে বাংলাদেশ? তাই কী? প্রত্যেকটি জায়গারই আছে আলাদা স্বাদ। বাইরে থেকে এক মনে হলেও সত্যিই কী এক? চট্টগামের অনুচ্চ জালালাবাদ পাহাড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পথে রাঙামাটির উঁচুনিচু রাস্তা আর ছায়াছন্ন টিলা, কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ নীল জল। ময়মনিসংহ যাওয়ার আগে বাঁকাপথে কিশোরগঞ্জ। নীলগঞ্জের গবুজ, সিলেটের পাহাড় ঢালে চা-বাগান- এসব আকর্ষণ করবে সেই বাঙালিকেও যিনি হিমালয়ে অহরহ ঘুরে বেড়ান, মাঝে মাঝেই গা এলান সাওতাল পরগনায় কিংবা ডুয়ার্সের জঙ্গলে যান বছরে অন্তত এক আধবার। যদি না করে তবে বুঝতে হবে তিনি সত্যিকারের ভ্রমণরিসিক নন।
জঙ্গলও আছে বাংলাদেশে, ক্রমশই ক্ষীয়মাণ সেই জঙ্গল- ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলে, গিলেট-সুনামগঞ্জে বা রংপুর-দিনাজপুরে। জঙ্গলের মানুষজন নিয়ে তারও একটা স্বাতন্ত্র আছে। এমনকী বেশি জায়গা জুড়ে যে সবুজ ধানি জমি– এই তো দু-বাংলাতেই সবচেয়ে চোখে পড়ার- কিন্তু বাংলাদেশে বাসে বা ট্রেনে বা স্টিমারে যাতেই পাড়ি দিই না কেন, মনে হয় তা যেন আরও ছড়ানো, মনে হয় সবুজটা যেন একটু বেশি সবুজ। বাংলাদেশের সুন্দরবনও আলাদা, আমাদের সুন্দরবন নয়।
আমি প্রথম দুবারই বাংলাদেশে গিয়েছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে। আগের রাতে সারা রাস্তা জুড়ে আল্পনা দেওয়া, ভোরের শিরশিরে হাওয়ায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একুশের গান শোনা, মিছিলে মিছিলে শহিদমিনারে পৌঁছে ফুল দেওয়া চলচ্চিত্রের- মতো ভেসে ওঠে এখনও।
একটা দেশ বেড়াতে গিয়ে প্রকৃতিই বা শুধু কেন, গ্রাম-শহর জনপদও কি কম দ্রষ্টব্য! যতবার বাংলাদেশে সেছি ঢাকাতেই থাকতে হয়েছে বেশি সময়। উপর্যুপরি দাওয়াত এর প্রাণান্তকর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যখনই সুযোগ পেয়েছি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়য়েছি, কখনও একা কখনও বন্ধুদের সঙ্গে, পায়ে হেঁটে কিংবা ঢাকার সেই বিখ্যাত সাজানে গোজানে ও বিপজ্জনকভাবে দ্রুত রিকশায় বা ডিজেলের ঝাঁঝ ছড়ানো অটোতে, ওরা যাকে বলে বেবি-ট্যাক্সি। প্রথম প্রথম বয়সের জোরে হাঁটতেই চাইতাম বেশি- পুরনে ঢাকার অলিগলিতে, বুড়িগঙ্গার ধারে, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা শহিদমিনার বা বাংলা একাডেমির সংলগ্ন খোলা হাওয়ায়, রমনার মাঠের ভেতরে-বাইরে। এমনকী বড়লোকের পাড়া ধানমন্ডিতে গিয়ে লেকের ধারে বসেছি। আরও উজিয়ে মডেল টাউন বনানী, গুলশান বা উত্তরাতে গিয়ে বুঝেছি, বুড়িগঙ্গার ধার থেকে গ্যান্ডোরিয়া, ওয়াড়ি পুরনো আর নয়া পলটন, সেগুনবাগিচা আর মগবাজার, বড়জোর লালমাটিয়া আর মহম্মদপুর পর্যন্তই ঢাকার নিজস্বতা। প্রথম দিন মনে আছে, শুধুই বাংলায় লেখা সাইনবোর্ডগুলো পড়ছিলাম বিস্ময়ে। একাধিক বইপাড়ায় তা সে প্রাচীন বাংলাবাজার বা নিউ মার্কেট, অধুনালুপ্ত স্টেডিয়াম বা নবতম আজিজ মার্কেট যেখানেই হোক- বাংলাদেশের বই ও পত্রপত্রিকা খুঁজতাম আঁতিপাতি করে। মহাশ্বেতা দেবীর মতো আমিও তো মনে করি, নতুন জায়গার খাবার না খেলে সে জায়গার গঙ্গে আত্মীয়তাই হয় না। হাঁটতে হাটতে সেগব চেখে দেখতাম- বাখরখনি আর মাঠা থেকে শুরু করে ভুল বানানের রেস্তোরাঁ ‘নিরব’-এর ভর্তা বিচিত্রা- কিছুই বাদ যেত না। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মফস্বল শহরেও ঢুঁ মেরেছি। সেইসব ছোট শহরের মেজাজের ভিন্নতা যাঁরা চিনে নিতে পারেন, তাঁরাই জানেন, শুধু ছোট বলেই নয়, নানা দিক থেকেই তাদের রস আলাদা। বড় শহরের বিশ্রী চিৎকার আর ঘেমো ভিড়ের পাশে কিছুটা নীরব, কিন্তু সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ নয়, এই মফস্বলি হাওয়া। রাস্তা বা বাড়িঘরের বিন্যাস, দোকানবাজারের সাজসজ্জা, লোকজনের চালচলন, সবচেয়ে বেশি শহরের পাশের নদীটি রাজশাহীর পাশে পদ্মা, বগুড়ার পাশে করতোয়া, খুলনার পাশে রূপসা, ফরিদপুরের পাশে কুমার, ময়মনসিংহের পাশে পুরনে ব্রহ্মপুত্র, চট্টগ্রামের পাশে কর্ণফুলি, চাদপুরের পাশে ডাকাতিয়া আর মেঘনা- এই সমাবেশের কী তুলনা আছে! এ ছাড়া শহরে যা যা থাকে– নানা বিষয়নির্ভর মিউজিয়াম, ভিন্ন ভিন্ন আকারের বা চরিত্রের পার্ক, রাস্তার মোড়ে মো[ে ভাস্কর্যমূর্তি- তা ঢাকাতে তো থাকবেই, মফস্বল শহরেও কমবেশি চোখে পড়বে। হাঁটতে হাঁটতে এসব দেখাও ভালো বেড়ানোরই অঙ্গ।
ফ্রান্স ভ্রমণকারীকে যদি লুভর দেখতেই হয়, তবে বাংলাদেশ ভ্রামণিককে কেন দেখতে হবে না ঢাকার জাতীয় জাদুঘর বা শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি ? ঢাকার বড় বড় অফিসে চিত্রকলা বা ভাস্কর্যেও সম্ভার ঘুরে দেখিয়েছিলেন আমার এক বন্ধু। সেসময়েই দেখি এস এম সুলতানের সুবিখ্যাত ক্যানভাস- বাংলাদেশের প্রকৃতি আর মানুষকে নাঈভ দৃষ্টিতে দেখার সেই প্রচন্ডতা। প্রকৃতিই হয়তো সুযোগ করে দেবে সৌন্দর্য দেখার। ঢাকা বাইরেও যেতে হবে- ময়মনসিংহ শহরের উপকন্ঠে ‘জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায়’ কিংবা নড়াইলে সুলতানের সুবিখ্যাাত ডেরায়। কামরুল হাসা বা সফিউদ্দিন আহমেদকে, আরও অনেককেই অবশ্য পাওয়া যাবে জাতীয় জাদুঘরে। কিংবা ঢাকাতে ছড়ানো ব্যক্তিগত সংগ্রহে। কবে এমন দিন আগবে যখন বাংলাদেশের ভ্রমণকারীকে সুপরিকল্পিতভাবে এসব দেখানের ব্যবস্থাও করবেন কর্তৃপক্ষ?
প্রসিদ্ধ ঐতিহাগিক স্থান দেখার জন্য যারা বেড়াতে ভালোবাসেন, এমনকী স্বতন্ত্রভাবে পুরাতাত্ত্বিক উৎসাহ যাঁদের প্রবল, তাদেরও খোরাক আছে বাংলাদেশে। ঢাকা পুরনো শহর- সেখানকার সপ্তদশ শতকের লালবাগ দুর্গ বা বড় ও ছোট কাটরা বা ইওরোপীয় রেনেসাঁস স্থাপত্যে গরীয়ান নবাবপ্রাগাদ আহগান মঞ্জিল থেকে শুরু করে কার্জন হল পর্যন্ত ইতিহাসের কালানুক্রমে অনেক কিছুই দেখার। আর সাম্প্রতিক গৌরবময় লড়াইয়ের স্বাক্ষ্য শহিদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ তো আছেই। একটু বাইরে গেলে সোনারগাঁও প্রাচীন । ইতিহাসের কীর্তিতে সমৃদ্ধ। আর সারা বাংলাদেশে ঘুরতে পারলে তো কথাই নেই। স্থলপথে বাংলাদেশে ঢুকলে প্রথমেই পড়বে খুলনা বাগেরহাটের বিখ্যাত ‘ষাট গম্বুজ ৫ মসজিদ’ু সুলতানি আমলের স্থাপত্যে তৈরি এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বোধহয় শ্রেষ্ঠ মগজিদ। বাগেরহাটে আরও অনেক মসজিদ আছে। আর সারা বাংলাদেশ ধরলে তো উন্নত স্থাপত্যের মসজিদ সর্বত্র ছড়ানো যাদেও নির্মাণকাল পঞ্চদশ শতক থেকে সাম্প্রতিক পর্যন্ত। স্থাপত্যের বৈচিত্র্যও লক্ষ করবার। ঢাকায় দাড়িয়ে আছে এই শতকেরই বায়ুতুল মুকাররাম মসজিদ শহরে ঘুরতে ফিরতে চোখে পড়বেই এর চমৎকার স্থাপত্য। মন্দিরও সংখ্যায় অনেক। মন্দির-স্থাপত্যের সবরকম রীতিই লক্ষণীয়– রেখ, বাংলা, চালা, রত্ন বা তাদের মিশেল, সবই ত্ব আছে পশ্চিমবঙ্গের মতোই। ঢাকাতেও আছে ঢাকেশ্বরী মন্দির যাকে নিয়ে অনেক কাহিনী। চট্টগ্রামের কক্সবাজার থেকে রামুতে গিয়ে দেখার সুযোগ আছে বৌদ্ধমন্দির। কক্সবাজারে বৌদ্ধ প্যাগোডা। কুমিল্লা শহর থেকে অনায়াসে চলে ত যাওয়া যায় প্রাচীন যুগের ময়নামতীতে। বৌদ্ধমন্দির বা বিহার বা স্কুপের ভগ্নাবশেষ লালমাই ময়মামতীর নিচু ছোট ছোট পাহাড়-অঞ্চলে বিস্তারিত। এগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখার। তবে সগবই প্রায় সেছে, শুধু পোড়ামাটির ফলক বেশ কিছু রক্ষিত আছে স্থানিক মিউজিয়ামে। পোড়ামাটির ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন পূর্ববঙ্গে, অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশে যে বিপুলভাবে পাওয়া যায় তার কথা অনেকেরই । জানা। তবে তা চোখে দেখতে গেলে যেতে হবে । উত্তরবঙ্গে, বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে।
বগুড়া, যাকে বলা হয়। উত্তরবঙ্গে ঢোকার দরজা, সেখান থেকে চলে যাওয়া যায় প্রায় সবকটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ স্থানে। সবচেয়ে কাছে, প্রায় উপকণ্ঠে বলা যায়, মহাস্থানগড়। অখন্ড বাংলারই সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যনিদর্শন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে গড়ে ওঠা পুন্ড্রনগর যেখানে, সেখানে চারদিকে প্রত্যক্ষগোচর স্তূপ ও খোড়াখুড়ির চিহ্ন। একেকটা স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বেশ সময় কেটে যায় বেশি সময় লাগে গোকুল গ্রামে লখিন্দর মেধের সামনে। তারপর সেখান থেকে পশ্চিমে কিছুটা লম্বা পাড়ি দিয়ে পাহাড়পুর। বৌদ্ধ-স্থাপত্যের অসামান্য নিদর্শন। ৮ম-৯ম শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দির বা বিহার, তার ছবি তো দেখেছি অনেক, এবার তা চোখের সামনে। এখন আর স্তুপে উঠতে দেওয়া হয় না বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরেই মন ভরাতে হয়। মহাস্থানগড় আর পাহাড়পুর দু জায়গাতেই স্থানিক মিউজিয়ামে দেখা যায় ওখানকার পোঙড়ামাটির ফলকগুলো। অবশ্য শুধু পোড়ামাটির নয়, অন্য মাধ্যমের কাজও আছে কিন্তু পোড়ামাটির ওই ভাস্কর্য দেখতেই বেশি করে যাওয়া, কারণ ওগুলোই বৈচিত্র্যে ও শিল্পগুণে কিংবা লোকায়ত জীবনের প্রতিফলনে দর্শককে অবাক করে দেয়। রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্চের মিউজিয়ামেও তার নমুনা দেখতে যাওয়া যায়। ঠিক এরকমই, পোড়ামাটির মন্দিরগুলির মধ্যে বাংলাদেশের মন্দিরের বিশিষ্টতার কথা আগেও হয়েছে, শুনেছি বহুজনের কাছে। কিন্তু দেশ ভাগের পরে এ বিষয়ে উৎসাহী গবেষকেরাও খুব কম সুযোগ পেয়েছেন দেখার বা অনুসন্ধান করার। শুধু ডেভিড ম্যাককাচ্চনের মুখে শুনেছি এবং লেখাতে পড়েছি পূর্ববঙ্গের পোড়ামাটির মন্দিরের শিল্পগত অসামান্যতার কথা। জেমস ফার্গুসনের বই থেকে তার অনেক আগেই জেনেছি দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের প্রশংসা। বাংলাদেশে গিয়ে একটু চেষ্টা করলেই সেই নন্দনকীর্তির সামনে হাজির হওয়া যায়।
বগুড়া থেকেই দিনাজপুর হয়ে, সামান্য এগিয়ে ঢ্যাপা নদীর ধারে ওই কান্তজির বা কান্তনগরের মন্দির। উভয় বঙ্গেই অনেক পোড়ামাটির মন্দিরই তো আছে কিন্তু কান্তজির মন্দির তাদের মধ্যে নানা দিক থেকে কেন অনন্য বলে স্বীকৃত, এবার সে বিষয়ে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল। আঠেরো শতকে নির্মিত এই নবরত্ন মন্দিরটির চারপাশের রত্নগুলি ১৮৯৭-এর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়েছে। তাছাড়া পোড়ামাটির কাজ তো শেষপর্যন্ত খুব একটা টেকসই হয় না। তাই ক্ষয়ের চিহ্ন অনেক। তবু এখনও এর মহিমা বুঝতে দেরি হয় না। এর সর্বাঙ্গ পোড়ামাটির ফলকে ছাওয়া, ভেতরে এবং বাইরে, এমন নাকি বাংলার কোনও মন্দিরেই নেই। মহাস্থানগড় আর পাহাড়পুরের ধারাবাহিকতাতেই অনুভব করা যায়। এর ভাস্কর্যের শিল্পরহস্য।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের আরেকটা বড় টান: রবীন্দ্র স্মৃতিচিহ্নিত বেশ কয়েকটি জায়গা এখানেই পড়েছে। কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ– পদ্মার ধারের ওই লালবাড়িটি অনেক পাঠস্মৃতি টেনে আনে। বগুড়ায় যখন গিয়েছিলাম তখনও একদিন শাজাদপুরের কাছারিবাড়ি দেখে এরকমই স্মৃতিমগ্ন হয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের স্পর্শময় আসবাবপত্র এখনও যেটুকু রয়ে গেছে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রাসঙ্গিক তথ্যের প্রদর্শনী। কিন্তু বেশি ভালো লাগে এর চারপাশের আবহাওয়াটা বুঝতে পারি অনেক বদল হয়ে সেছে, তবু। পতিসরে যাওয়ার গুযোগ পাইনি। তবে রাজশাহী যাওয়ার পথে চলনবিলের কোনও একটি অংশের পাশে গাড়ি থামিয়ে স্মৃতিমুখর হয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের সে যুগ আর কোথায়? এখন মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। উত্তরবঙ্গের আধুনিক মসৃণ সড়ক।
একটা দেশের ভ্রমণের পক্ষে এই তালিকা খুব দীর্ঘ ও আকর্ষণীয় হল কিনা জানি না। আমার মতো অনেকের কাছেই বাংলাদেশে ভ্রমণ যে এত মনেরাম তার পিছনে কিন্তু এসবেরও বাইরে একটা বড় কারণ আছে এবং তা হল এর মানুষজন। শুধু আমার নয়, বাংলাদেশে গিয়ে । নির্লিপ্ত যাঁরাই মোহাচ্ছন্ন হন তাদের উচ্ছাসেও সেটাই ধরা পড়ে। এই মানুষ, তার সারল্য তার আবেগ তার সাংস্কৃতিক কাজকর্মের ধরন আমাদের সঙ্গে মিল-অমিলের ছন্দে এতই টানে যে তাকে উপেক্ষা করা যায় না।
বাংলাদেশের মানুষ বলতে ওখানকার । বাঙালি মুসলমানদের কথাই বেশি মনে আসে। তারা দেশভাগের পরে কীভাবে জেগে উঠল, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাঙালি হিসেবে আত্নপরিচয়কে স্থায়ী ও ব্যাপক করল, সেই অর্জনকে চিনতে হলে তো বাংলাদেশেই আসতে হবে।
আমি প্রথম দুবারই বাংলাদেশে গিয়েছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে ভাষা আন্দোলন উদ্যাপনের সেই স্মরণীয় দিনটিতে। আগের রাতে সারা রাস্তা জুড়ে আল্পনা দেওয়া, ভোরের শিরশিরে হাওয়ায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন প্রজন্মের নরনারীর মুখে একুশের গান শোনা, মিছিলে মিছিলে শহিদমিনারে পৌঁছে ফুল দেওয়া চলচ্চিত্রের মতো ভেসে ওঠে এখনও। ঢাকায় তো বটেই, বাংলাদেশের সর্বত্র যেন এই একই দৃশ্য। এই মিছিল এবং এই মানুষের মুখ দেখাই বাংলাদেশে বেড়ানো একটা বড় উপার্জন।
তখন আমার সঙ্গীদের অনেকেই ছিলেন গানের মানুষ, কবিতা পাঠের মানুষ। একুশে উপলক্ষে তারা নানা কর্মকান্ডে ব্যস্ত। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আমি রিহার্সালরুমে যাই, অনুষ্ঠানে যাই। তরুণ তরুণীদের স্বচ্ছন্দ আলাপেও একটা উৎসবের আমেজ লেগে থাকে। ক্রমশ আবিষ্কার করি, বাংলাদেশে রবীন্দ্রগংগীতের চর্চা নিছক শৌখিনতা ছাড়িয়ে তাদের বাঙালিয়ানার আত্মপ্রতিষ্ঠার একটা অস্ত্র কীভাবে হয়ে উঠেছে- মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান আমলের লড়াইয়ের সময়, মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সংকট-মুহূর্তেও।
ঢাকার ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রতে গিয়ে মনে হয়েছিল যেন একটা সংস্কৃতির তীর্থক্ষেত্রে এসে পৌঁছলাম। আমরা বারবার শুনেছি, বাংলাদেশের আত্ম-উদ্বোধনে ছাত্রযুবকদের ভূমিকা কতখানি। এখানে এসে সেই উত্তরসূরিদেরই যেন দেখা পেলাম। আবৃত্তিকারদের কণ্ঠশীলনের ঘরে গিয়ে নতুন একদল তরুণ বন্ধুদের কাছাকাছি হলাম। তারপর ‘ছায়ানট’-এর বিপুল কর্মকান্ড, আনন্দধ্বনি’র অন্তরঙ্গ জমায়েত, আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক আয়োজনের স্বাদ পেয়েছিলাম। আমার সবসময় মনে হয়, বাংলাদেশে যারা যান তারা যদি এইসব যুবাদের সঙ্গে পরিচিত না হন, তবে তারা কী দেখবেন বাংলাদেশের! আগেই বলেছি, এঁরা যে শুধু ঢাকা শহরেই আছেন তা নয়, চট্টগ্রামে রাজশাহীতে ময়মনসিংহে ফরিদপুরে বা বরিশালে কিংবা গিলেটে সর্বত্র তাদের দেখা মিলবে। আর রবীন্দ্রসংগীত নিয়েই। শুধু যাঁরা মেতে থাকেন, বাংলাদেশে এরকম। মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে অনেক।
কালক্রমে বাংলাদেশের যে আরেক গৌরব বাংলাদেশের থিয়েটার, তার লোকজনেরও কাছাকাছি চলে যাই। বেইলি রোডের থিয়েটার হল দুটি বেশ নিরেস, তা নিয়ে ওদেরও খেদের অন্ত নেই, কিন্তু ওখানেই বাংলাদেশের নাট্যচর্চার পরীক্ষানিরীক্ষা, বৈচিত্র্য ও গুণপনার যে নিত্য প্রকাশ ঘটছে, তার তুলনা নেই। ওই বেইলি রোডই, কৌতুক করে বলা হয়, জামদানি শাড়ির পাড়া আর থিয়েটারের পাড়া। বাংলাদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা যাঁরা করেন, তারা ওই থিয়েটার দেখানের কথা কী ভাবতে পারেন না— । কেরল-ভ্রমণের সময় যেমন দেখেছিলাম এনার্কুলামে ভ্রমণার্থীদের জন্য কথাকলি নাচের আখড়াগুলো তৈরি হয়েছে?
বাংলাদেশ ভ্রমণের সেরা সময় যদি প্রাকৃতিক দিক থেকে ব্যাকাল হয়, শত অসুবিধা সত্ত্বেও (জানি না আমাদের বন্ধু বিপাকে ফেলার জন্যই ওই প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিনা)- তেমনই সাংস্কৃতিক দিক থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়াও যে সময়টার কথা মনে উঠবে, তা হল পয়লা বৈশাখ। ওখানে পয়লা বৈশাখ আমাদের ঠিক একদিন আসে। এর পিছনে যে ইতিহাগ ও পঞ্জিকার কূটকচালি আছে তার কথা এখন থাক। পর পর দু-দুবার আমি প্রচন্ড গ্রীষ্মের মধ্যেও বাংলাদেশে গিয়েছিলাম ওই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষেই। প্রথমবার ছিল আবিষ্কার, পরের বার পুরনো সেই অভিজ্ঞতারই টান। আমাদের এ বঙ্গে নববর্ষ উৎসব তো শুধু পারিবারিক হুল্লোড় আর খাওয়াদাওয়াতেই নিঃশেষিত। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে প্রভাত ফেরিতে ঘুম ভেঙে যেত। এখন তাও আর শোনা যায় না। সেখানে, আবার বলছি শুধু ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশেরই শহরগুলিতে মহাসমারোহে পালিত হয় দিনটি। বিশেষ করে ঢাকায়, শহরের একটা বিরাট অংশ জুড়ে, মানুষের ঢল নামে। রমনার মাঠের দিকে খুব সকাল থেকে মানুষের মিছিল। তরুণীরা লালপেড়ে শাড়ি আর তরুণেরা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে চলেছে। মাঠ জুড়ে গাছ আর লেকের জলকে ঘিরে তারা বসে পড়ে। ছায়ানট-এর ছেলেমেয়েরা প্রশস্ত মঞ্চে সার দিয়ে বসে গান করে- রবীন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুলের গান। সেই অনুষ্ঠান শেষ হতেই আর্ট কলেজের ছাত্ররা সারা বছর ধরে আঁকা মুখোশ নিয়ে, জীবজন্তুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল বের করে। দুপাশে মানুষ জড়ো হয়। অনেকেরই মাথায় মুকুট, হাতে বাঁশি। রাস্তার পাশে মেলা বসে। পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ। ভাজা নিয়ে কেউ দোকান সাজায়। এরকম অসাম্প্রদাযড়িক উৎসব, বাঙালির উৎসব দেখাটাও তো হতে পারে বাংলাদেশ বেড়ানোর বড় পাওনা। এ বছর আরও একটি অভিজ্ঞতা হল ফাল্গুনের পূর্ণিমায় ধানমন্ডিতে বসন্তোৎগব দেখা। এখনও তত ছড়িয়ে পড়েনি, কিন্তু বোঝা যায়, ওখানে এ ধরনের উৎসবগুলো বেড়েই চলেছে। সবসময়েই অভিজ্ঞতা যে খুব সুখের তা নিশ্চয়ই নয়। যাদের নিয়ে এত উচ্ছাস তাদের অন্য চেহারাও দেখতে হয়। বাংলাদেশের মানুষের মুখে জোড়শব্দের একটা লবজো খুব উচ্চারিত হয়। তাকে অনুসরণ করে বলা যায় : মাঝে মাঝেই ‘পচা’ সময় তাদের আক্রমণ করে সাম্প্রদাযড়িকতা অসহিষ্ণুতা হিংসা তাদের জাগরণের ও স্বাধীনতার যে প্রাপ্তি তাকে নষ্ট করে দিতে চায়। বাংলাদেশে অল্পদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে মৌলবাদের চিহ্নগুলি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। কিন্তু সেজন্য তো আমরা শুধু বাংলাদেশের দোষ দিয়ে পার পাব না- মানব অস্তিত্বের এই ব্যর্থতা আজ কাউকে রেহাই দিচ্ছে না। বরং, এরইমধ্যে বাংলাদেশের এই মানুষেরা অনেকেই যে নিজেদের সত্ত্বাপরিচয়কে অটুট রাখতে মরিয়া, তার ছবিও বারবার দেখতে পাই। বিশ্ববিদ্যালছের চত্বরে, লেখালেখির জগতে, লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে, বইপাড়ার আড্ডায়, সভাসমিতিতে, গানের বা থিয়েটারের উৎসবে আত্মরক্ষার ও আত্নপরিচরে সেই মজাটাও টের পাওয়া যায় বাংলাদেশে গেলে।