Skip to content Skip to footer

রহস্যে ঘেরা ইজিপ্টের কালো ও সাদা মরুভূমির রোমাঞ্চকর রাত

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মিশরের পর্যটন মানচিত্র তৈরির সময় হঠাৎ চোখে পড়ল বাহারিয়া মরূদ্যানের কাছাকাছি অবস্থিত দুই ভিন্নধর্মী ভূখণ্ড—কালো ও সাদা মরুভূমি। বিস্ময়কর ভূতাত্ত্বিক গঠনের এই অঞ্চলটি যেন পরাবাস্তব কোনো প্রাকৃতিক চিত্রশালা। ঠিক করলাম খুঁজে দেখি—এটা কোথায়, কীভাবে যাওয়া যায়, থাকার সুবিধা কেমন। গিজা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৫০৮ কিলোমিটার (সূত্র: গুগল ম্যাপ)। এই দূরত্ব দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার মতো নয়। তখনই রাত্রিযাপনের বিভিন্ন বিকল্প দেখতে শুরু করি। মরুভূমির মাঝখানে তাঁবুতে রাত কাটানো—ভাবতেই গা শিউরে উঠল, তবে কৌতূহলও বেড়ে গেল।

তীব্র শীতের সময় মরুভূমিতে থাকার বিষয়টা নতুন ভয়ের জন্ম দিল। রাতে তাপমাত্রা প্রায় ৬-৮ ডিগ্রিতে নেমে আসে। আরও গভীরে গিয়ে জানলাম, শুধু ঠান্ডা নয়—এলাকাটি নিরাপত্তার দিক থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ। সীমান্তঘেঁষা হওয়ার কারণে এটি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জঙ্গি ও চোরাকারবারিদের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিরাপত্তা বাহিনী ভুলবশত ১২ জন মেক্সিকান পর্যটক ও তাদের গাইডকে সন্ত্রাসী ভেবে গুলি করে হত্যা করে। এরপর থেকে ওয়েস্টার্ন ডেজার্টে সরকারিভাবে পর্যটন নিষিদ্ধ করা হয়।

তবুও সাহস করে কায়রোভিত্তিক কয়েকটি ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি, কিন্তু সবার জবাব এক—এখন তারা আর এই রুটে ট্যুর পরিচালনা করে না। বাধ্য হয়ে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিই। কিন্তু ঠিক এক মাস পর ট্রিপঅ্যাডভাইজরে দেখি দুইটি স্থানীয় কোম্পানি এখনও ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকে। বিস্তারিত আলাপের পর আমরা ভোর ছয়টায় যাত্রা, দুপুরে লাঞ্চ, বিকেলে ক্যাম্প, এবং পরদিন সকালেই ফেরার প্ল্যান করি। যদিও মন কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, তবু শর্ত দিই—যদি ক্যাম্পে আরও অন্তত দুটো গ্রুপ দেখি, তাহলে থাকব; না হলে ফিরে আসব।

ভোরে হোস্টেল ছাড়ার সময় জানতে পারি, ৬-৭ জনের একটি চাইনিজ পরিবার আমাদের হোস্টেল থেকেই একই গন্তব্যে যাচ্ছে। খানিক স্বস্তি পেয়ে তিনটি গাড়ি একসাথে রওনা দিলাম। গিজা ছাড়িয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ কষ্টকর—সে ইংরেজি বোঝে না। আর ফোনে এতটাই আসক্ত যে প্রায় ৮ ঘণ্টার যাত্রায় অন্তত ৭ ঘণ্টা সে দুইটি ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সঙ্গী ছিল উচ্চ ভলিউমের র্যা প মিউজিক—একবার উম্মাহকে জাগানোর আহ্বান, পরক্ষণেই “হাই সেক্সি লেডি”।

লাঞ্চের পর স্থানীয় গাইড মোহাম্মদ আমাদের দায়িত্ব নিল। তার গাড়িটি মরুভূমির জন্য কাস্টমাইজ করা টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার। সে বিনয়ী, প্রযুক্তি বিমুখ, বেশিরভাগ সময় কোরআন তিলাওয়াতে নিমগ্ন। আমরা প্রথম থামলাম ব্ল্যাক ডেজার্টে—সেখানে আছে আগ্নেয়গিরির চূড়ার মতো অসংখ্য পাহাড়। এরপর গেলাম ক্রিস্টাল মাউন্টেনে—যেটি হঠাৎ হাইওয়ে নির্মাণের সময় আবিষ্কৃত এক পরাবাস্তব স্ফটিক আকৃতির পাহাড়।

সবশেষে পৌঁছালাম হোয়াইট ডেজার্টে, যার স্থানীয় নাম সাহরা এল বেইদা। এখানকার শুভ্র বা ক্রিম রঙের পাথরের গঠন দেখে মনে হয় বরফে ঢাকা কোন ভিনগ্রহ। এই জায়গাটি শুধু ভূতত্ত্ববিদদেরই নয়, প্রকৃতিপ্রেমিকদের জন্যও বিস্ময়কর।

ক্যাম্পসাইটে গিয়ে দেখি আরও তিন-চারটি দল এসেছে। মোহাম্মদ আমাদের তাঁবু তৈরি করে দেয়, তারপর নামাজ পড়ে রাতের খাবারের প্রস্তুতি নেয়। খাওয়া শেষে স্থানীয় গান-বাজনার আয়োজন হয়—যদিও সেটা আমাদের কল্পনার মতো মনমুগ্ধকর নয়, তবে পরিবেশটা ছিল মজার।

রাতে ঠান্ডায় ঘুম ভেঙে যায়। তাঁবু থেকে বের হয়ে সূর্যোদয়ের অপার্থিব দৃশ্য দেখি—যেটা শুধু চোখে দেখেই উপলব্ধি করা যায়, কোনো ক্যামেরা তা ধারণ করতে পারে না।

ফেরার পথে ব্ল্যাক ডেজার্টের একটি পাহাড়ে ওঠার সুযোগ চাই মোহাম্মদের কাছে। সে রাজি হয়ে যায়। ওপরে উঠে মনে হল—এ যেন পৃথিবীর নয়, অন্য কোনো গ্রহের দৃশ্য। তখন আফসোস হল, ড্রোনটা সাথে আনলে দুর্দান্ত ফুটেজ পাওয়া যেত। পরে জেনেছি, ‘কাভি খুশি কাভি গম’ সিনেমার ‘সুরজ হুয়া মধ্যম’ গানটির শুটিং এখানে হয়েছে।

পরিবেশ সচেতনতার কথা

প্রকৃতি আমাদের দেয় নিঃস্বার্থ সৌন্দর্য, আমাদের উচিত সেখানে শুধুই পদচিহ্ন রেখে আসা। পাথর বা প্রাকৃতিক কিছু সংগ্রহে না রাখা এবং ক্যাম্প এলাকা পরিষ্কার রাখা একজন সচেতন পর্যটকের ন্যূনতম দায়িত্ব।

বর্তমানে (জুলাই ২০২৫) মিশরের পর্যটন মন্ত্রণালয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আবারও সীমিত আকারে ওয়েস্টার্ন ডেজার্টে ট্যুর পরিচালনার অনুমতি দিচ্ছে, তবে পর্যটকদের স্থানীয় ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে পূর্ব অনুমতি ও অনুমোদিত গাইড ছাড়া না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।