এই অভিযান ছিল এক ধরণের চরম চ্যালেঞ্জ, যেখানে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে। লারকে পর্বতে, যেখানে তুষারপাত, ঝড়ো বাতাস, খাড়া ঢাল এবং ক্রেভাসের ঝুঁকি প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে আসে, সেখানে একজন পর্বতারোহীর মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
হাইক্যাম্পের প্রস্তুতি ও প্রথম পর্যবেক্ষণ:
গাইডরা সকালে হাইক্যাম্প স্থাপন করে ফিরে আসেন। তাদের চেহারায় ধকল স্পষ্ট। উপরে খাড়া ঢালে রোপ ফিক্স করা হয়েছে, কিন্তু ঝুঁকি কমেনি। পাথর পড়ার সম্ভাবনা, হাঁটু পর্যন্ত জমে থাকা তুষার, হিডেন ও ওপেন ক্রেভাস—এই সব দেখে বোঝা গেলো, অভিযান সহজ হবে না। আবহাওয়া একেবারেই খারাপ, তবু সিদ্ধান্ত হলো—যদি সকাল ভালো থাকে, হাইক্যাম্পের উদ্দেশ্যে বের হবে দল।
ঝড়ো বাতাস ও মধ্যরাতের আতঙ্ক:
সন্ধ্যার দিকে শুরু হয় ভীষণ ঝড়। পর্বতের গাঁ থেকে ভেসে আসে অ্যাভালাঞ্চের গর্জন, যা বুক কাঁপিয়ে দেয়। ঝড় থামার পরও ঘুম আসে না—মনের ভেতর উত্তেজনা ও ভয়ের এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
ভোরের অভিযান শুরু:
চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল সকাল। স্বপ্নের অভিযান শুরু, কিন্তু অজানা ও অনিশ্চিত। পাঁচজন পর্বতারোহী এবং তিনজন গাইড হাইক্যাম্পের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। মাল্লা ও নিমা শেরপা আগে চলে গিয়ে রোপ ফিক্স করছেন। পথে বাধা—স্লিপারি বোল্ডার, ক্রেভাস, হাঁটু পর্যন্ত তুষার। বাতাসের তীব্রতা এত যে মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। হোয়াইট আউট চারপাশ ঢেকে দেয়।
ক্র্যাম্পন পয়েন্ট ও মেইন রোপে আরোহণ:
এক ঘন্টা পর ক্র্যাম্পন পয়েন্টে পৌঁছালাম। এখানে হার্নেস ও ক্র্যাম্পন পরে মূল রোপে বাঁধা হলো। তাপমাত্রা শূন্যের পনেরো ডিগ্রি নিচে, খাড়া ঢাল এবং বরফ জমে হাঁটু পর্যন্ত। পা এগোলেই প্রায় সমান দূরে পিছিয়ে আসে। প্রতিটি পদক্ষেপ মৃত্যুর সীমারেখা পরীক্ষা করে।
হাইক্যাম্পে পৌঁছানো ও রাতের পরিকল্পনা:
শেষে হাইক্যাম্পে পৌঁছেছি। তিনটি তাঁবু খাড়া বরফ ও পাথরের দেয়ালে। পাশে ক্রেভাস, সামনে ও পেছনে বড় ক্রেভাস। ঝড় কিছুটা কমলেও তুষারপাত ও হোয়াইট আউট কমেনি। রাতেই সামিট পুশের পরিকল্পনা, কিন্তু শেরপা জানালেন উপরের অবস্থা বিপজ্জনক। জীবনকে প্রাধান্য দিয়ে সামিট পুশ স্থগিত করা হলো।
ফিরার বিপজ্জনক পথ:
উপরের অভিজ্ঞতা থেকে বেসক্যাম্পে নামা আরও কঠিন। সফট স্নোতে পা পিছলে যায়, প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর আশঙ্কা। মুহিত ভাইয়ের পা দুই পাথরের ফাঁকে আটকে যায়—নূন্যতম ভুলও বড় বিপদের কারণ। সতর্কতার সঙ্গে আস্তে আস্তে নামা হলো, তবু পনেরো ঘণ্টার এই যাত্রা শ্বাসরুদ্ধকর।
অভিযানের শিক্ষা:
সামিট হয়নি, কিন্তু আমরা নিরাপদে ফিরে এলাম। প্রমাণ হলো—পর্বত কখনো আরোহীকে ব্যর্থ করে না, সে শেখায়। শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি, সতর্কতা, দলগত সমন্বয় এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান—এগুলো ছাড়া চরম অভিযানে সফল হওয়া সম্ভব নয়। মৃত্যুর সঙ্গে কাছে সাক্ষাৎ হলেও অভিজ্ঞতা আমাদের শক্তি দিয়েছে।
মানসিক অনুভূতি:
প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যু এবং সৌন্দর্য একসঙ্গে উপস্থিত। চোখে জল, গাল জুড়ে বরফ, হৃদয়ে উত্তেজনা—এই অভিজ্ঞতা চিরকাল স্মৃতির মনিকোঠায় থাকবে। পর্বত শিখিয়েছে—ভয়কে সঙ্গী করে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয়।
অভিযান অসম্পূর্ণ থাকলেও, নিরাপদে ফিরে আসা একটি বড় অর্জন। পনেরো ঘণ্টার এই যাত্রা শেখিয়েছে—প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই, জীবনের মূল্য, দলের গুরুত্ব এবং প্রত্যেকটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকার প্রয়োজন। ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসব, আরও সাহসী এবং আরও প্রস্তুত হয়ে। পর্বতের শিক্ষা চিরকাল আমাদের পথপ্রদর্শক হবে।