Skip to content Skip to footer

লিংকন সাইকেলওয়ালা

ইন্টার পরীক্ষা শেষ করার পর আমার জীবনে নতুন পথচলার সূচনা হলো। আব্বা বহু চেষ্টা করেছেন আমাকে পড়াশোনার জন্য জাপান, কানাডা কিংবা জার্মানির মতো উন্নত দেশে পাঠানোর। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছেন। একদিন আব্বা বললেন, “তোমাকে বড় কোনো দেশে পাঠাতে গিয়ে আমি ক্লান্ত। এখন তুমি সৌদি আরবে গিয়ে হজ করে শান্তভাবে জীবন যাপন করো।” তখনই টের পেলাম—আমার জন্য তিনি কত টাকা, সম্পদ ও পরিশ্রম ব্যয় করেছেন।

কিন্তু ঘোরাঘুরির নেশা মাথায় চেপে বসেছিল। মাত্র ৫০০ ডলার আর দু’চাকার প্রিয় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানা পৃথিবীকে জানার অভিযানে। দিল্লি থেকে পাঞ্জাবের গোল্ডেন টেম্পল, তারপর আটারি বর্ডার পেরিয়ে পাকিস্তান। ভিসা থাকা সত্ত্বেও সেখানে ইমিগ্রেশনের হয়রানি ছিল অবর্ণনীয়। কয়েকবার ডিপোর্ট করার চেষ্টা করা হয়েছিল, এমনকি ১২ ঘণ্টা লকআপেও থাকতে হয়েছিল। অবশেষে খানসামা বশিরের সহানুভূতিতেই মুক্তি মিলল।

ভারতের পথে একবার ভালুকের সামনে পড়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরেছিলাম। ইরানে গিয়ে দেখলাম—লোকজন ইংরেজি শুনতেই চায় না। ডলারের মানও জোর করে কমিয়ে দেয়। পাহাড়ঘেরা তেহরানে সাইকেল চালাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ভ্রমণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নামার সময় আবার নতুন উদ্দীপনা ফিরে পেলাম। সত্যিই, পৃথিবী বড় বিস্ময়কর।

গ্রিস

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যে দেশ পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত্তি গড়ে তুলেছিল, সেই গ্রিসে পৌঁছালাম চেশমে থেকে শিপে চড়ে। জাহাজে পরিচয় হলো শহরের মেয়র ও মার্কিন পর্যটক নিকের সঙ্গে। বিদায়বেলায় তারা আমার ডায়রিতে শুভকামনা লিখে দিলেন।

কিন্তু গ্রীসে নামার পর ইমিগ্রেশনের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। কুকুর দিয়ে লাগেজ তল্লাশি, পাসপোর্ট নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ—সব মিলিয়ে যেন দুর্বল হরিণকে ঘিরে বাঘের ঝাঁপ। শেষ পর্যন্ত ছাড় পেলেও আতিথেয়তার জায়গায় ভীতিকর অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় হলো।

বন্ধু আলমগীরের বাসায় গিয়ে শান্তি পেলাম। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে গল্প-আড্ডা জমে উঠল। বিদায়ের আগে বন্ধু মানিক জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আমায় ইতালির আরেক বন্ধুর ঠিকানা দিয়ে দিল।

ইতালি

দক্ষিণ ইউরোপের সংস্কৃতির ভাণ্ডার ইতালি। গ্রিস থেকে শিপে চেপে যাত্রা শুরু করি। সমুদ্রের বিশাল জলরাশির মাঝে জাহাজটিকে ক্ষুদ্র পোকা-পোকা মনে হচ্ছিল। তিনটার দিকে ইতালিতে পৌঁছাই। ইমিগ্রেশনে তিন মাস থাকার কথা বললেও তারা ছয় মাসের অনুমতি দিল।

এখানে আলম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো—দূরসম্পর্কের আত্মীয় আবার প্রিয় বন্ধু। ছয়-সাত বছর পর দেখা হওয়ায় তিনিও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। সেদিন রাতে তার হাতের রান্না খেয়ে দীর্ঘ আলাপ জমে উঠল।

বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি আক্তারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তার সহযোগিতা ছাড়া হয়তো ইউরোপ ভ্রমণ অসম্ভব হয়ে যেত। ফ্রান্সসহ পরবর্তী ভিসাগুলো পেতে তিনি অসীম চেষ্টা করেছেন। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার ঋণ চিরকাল থেকে যাবে।

সুইজারল্যান্ড

ইউরোপের ছোট্ট অথচ সবচেয়ে সুন্দর দেশ সুইজারল্যান্ড—যেন পৃথিবীর স্বর্গ। এখানকার মানুষ ভদ্র, শান্তিপ্রিয় আর আন্তরিক।

জেনেভায় পৌঁছে স্থানীয় প্রবাসী নজরুল ভাইয়ের বাসায় উঠি। পরে বন্ধুর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয়। জুরিখ, বার্ন ঘুরে বেড়াই। আওয়ামী লীগের নেতা তাজুল ইসলামের বাসায়ও আতিথেয়তা পেয়েছিলাম।

সুইসদের সৌন্দর্যবোধ, পরিপাটি পরিবেশ আর মানবিক আচরণ আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করে। আমার দেখা ৩০টি দেশের মধ্যে সুইজারল্যান্ড ছিল সবচেয়ে ভদ্র ও অতিথিপরায়ণ।

নিউইয়র্ক

প্রায় ৩০টি দেশ ভ্রমণের পর অবশেষে পৌঁছাই নিউইয়র্কে। সেখানে আমার স্কুল-কলেজের বন্ধু জাকিরকে পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই আনন্দ ম্লান করে দিল আব্বার মৃত্যু সংবাদ। মূলত পশ্চিম দিক দিয়ে বের হয়ে পূর্ব দিক দিয়ে দেশে ফেরার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নিয়তির খেলায় নিউইয়র্কেই স্থায়ী হতে হলো।

প্রথমদিকে দেশে ফেরার চিন্তায় কোনো কাজ করিনি। পরে টিকে থাকার জন্য নানা কাজ করেছি। প্রায় ২২ বছর ধরে ড্রাইভিং স্কুলের ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করছি। অনেক মানুষ এখান থেকে লাইসেন্স নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন—এটাকে আমি জনসেবামূলক কাজ হিসেবেই দেখি।

নিউইয়র্কে যোগ দিয়েছি ঢাকা ড্রামা থিয়েটার গ্রুপে, মিশে গিয়েছি সাংস্কৃতিক জগতে। আমার ভ্রমণের উপর প্রকাশিত হয়েছে দুটি বই— দিগন্ত ছোঁয়ার গল্পসাইকেলে বিশ্বজয়

সাইকেলই আমার জীবনকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছে। কেউ যেমন আইসক্রিম বিক্রি করলে হয় ‘আইসক্রিমওয়ালা’, রিকশা চালালে হয় ‘রিকশাওয়ালা’, তেমনি আমি হয়ে গেছি— “লিংকন সাইকেলওয়ালা”।

সাইদুর রহমান লিংকন