Skip to content Skip to footer

সোনায় মোড়ানো পাহাড় ও এক স্থির হয়ে যাওয়া সকাল

যেকোনো ভ্রমণে আমার এক বড় আশীর্বাদ হলো—ভোর হতেই ঘুম ভেঙে যাওয়া। রাতে যতই দেরিতে ঘুমোই না কেন, সূর্য ওঠার আগেই যেন ভেতর থেকে কেউ জাগিয়ে দেয়। আর এই কারণেই প্রতিটি ভ্রমণের দিনই আমার কাছে হয়ে ওঠে দীর্ঘ ও প্রাপ্তিতে ভরা। আমি মনে করি, ঘুমাতে তো যাইনি; এসেছি দেখার জন্য, ছোঁয়ার জন্য, আর হৃদয় দিয়ে প্রকৃতিকে বুঝে নেওয়ার জন্য। তাই প্রতিটি সকালে প্রকৃতির রঙ, আলো, শব্দ, বাতাস—সবকিছু নিজের মতো করে উপভোগ করি। এভাবেই ভরে ওঠে আমার স্মৃতির ঝুলি।

আগের দিন বিকেলে পৌঁছেছিলাম বহুদিনের স্বপ্নের জায়গা—ভুজবাসা, গোমুখ ট্রেকের বেসক্যাম্প। রাতে সবুজ তাবুর ভেতর রুপালি নদীর শব্দ শুনতে শুনতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়েছিলাম। লেপের এক পাশে গরম হলেও অন্যপাশ ছিল একেবারে বরফঠান্ডা। সেই শীতের রাতে ঘুম আর ঘুমভাঙার টানাপোড়েনের মধ্যেই কাটল রাতটা। আর মাঝরাতে যে প্রাকৃতিক বিপদে পড়েছিলাম, তার কথা বলা বোধহয় এই লেখায় স্থান পাবে না!

একা এক সকালে সোনার পাহাড়ের মুখোমুখি

ঘুম ভাঙার পরেই প্রথম দ্বিধা—আবার লেপের নিচে ডুবে যাব, না কি বাইরে গিয়ে সূর্যোদয়ের অপার্থিব রূপ দেখব? বাইরে হালকা কোলাহল শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ট্রেক টিমের প্রস্তুতি দেখে বুঝলাম, তারাও আজ গোমুখের উদ্দেশে রওনা দেবে। আর আমার দুই তাবু সঙ্গী আগেই জানিয়েছিলেন, তাঁরা গোমুখ দেখে আজ বিশ্রাম নেবেন, কাল ফিরবেন। মানে আজকের যাত্রায় আমি একাই।

তাবুর বাইরে বের হয়েই আমার চোখ আটকে গেল পাহাড় আর আকাশের অপূর্ব রূপে। চূড়ায় সূর্যের প্রথম আলো পড়তেই পুরো শ্বেতশুভ্র বরফ মোড়া পাহাড়গুলো যেন সোনায় সোনায় ঝলমল করতে শুরু করল। কাল রাতেও যে চূড়াগুলো রুপার মতো দেখাচ্ছিল, সেই একই চূড়া আজ সকালে রীতিমতো সোনার মতো উজ্জ্বল!

এই রূপ এতটাই মুগ্ধ করল যে কিছু সময় আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম—কী করব বুঝতেই পারছিলাম না। তাকিয়ে থাকব? নাকি ছবি তুলব? ক্যামেরা না মোবাইল? একা আসার ছোট্ট আক্ষেপটা তখনই প্রথম একটু টের পেলাম—কোনো ছবি আমার নিজের সাথে তোলা হলো না। কেবল কিছু মুহূর্ত বন্দি করলাম ক্যামেরায়।

গোমুখ পথে সোনা ঝরা সকাল

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম সোনায় মোড়ানো সেই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গোমুখের পথে। চার কিংবা ছয় কিলোমিটারের এই ট্রেইল এতটা রঙিন আর জাদুকরী হবে ভাবিনি। পাহাড়ের চূড়াগুলো কখনো গোলাপি, কখনো কমলা, আবার কখনো রংধনুর মতো রঙে রাঙা হচ্ছিল সূর্যের আলোয়।

যখন হাঁটছি, তখনই সামনে উঁকি দিল তিন চূড়ার বিশাল পাহাড়, যাকে বলা হয় ভাগীরথী গ্রুপ। এখান থেকেই গলিত বরফ নেমে এসে গঙ্গা নদীর সূচনা হয় বলে ধারণা করা হয়। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ে আরেক অসাধারণ দৃশ্য—একটি বিশাল পাথরের মাথায় বসে আছে শিবলিঙ্গ! মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিই—উঠতে হবে ওখানে।

শিবলিঙ্গের সামনে স্থির হয়ে যাওয়া এক অনুভূতি

ক্যামেরাটা এক সহযাত্রীর হাতে দিয়ে এক দৌড়ে উঠলাম সেই পাথরের ওপর। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম, যা অনুভব করলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কেবল বসে রইলাম, চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম শিবলিঙ্গের দিকে। সূর্যের আলোয় তার রূপও বদলাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমি আর আমি নেই। আমি যেন প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র অনুরণন মাত্র।

এরপর আমায় অনুসরণ করে উঠে এলেন আরও দুই আরজেন্টাইন ট্রেকার। ওরাও মুগ্ধ, ওরাও স্থির। শেষে গাইডের তাগিদে সবাইকে নামতেই হলো। তবে নামা সহজ ছিল না। নিচের দিকে তুষারাবৃত পাথর, আর একটু এদিক-সেদিক হলেই বড় বিপদের সম্ভাবনা।

শেষে ফেরা, তবে রেখে যাওয়া মুহূর্ত

নেমে এসে আবার ট্রেক শুরু হলেও মন পড়ে রইল সেই পাহাড়চূড়ায়, সেই সোনার আলোর নিচে বসে থাকা মুহূর্তে। আমি হাঁটছিলাম, কিন্তু মন বারবার ফিরে যাচ্ছিল পেছনে—সেই শিবলিঙ্গের কাছে, সেই পাথরের মাথায়।

আজও চোখ বন্ধ করলেই সেই দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। যেন সময়টা থমকে আছে—চেতনাতে, কল্পনায়, স্মৃতিতে। এক সোনালি সকালে বরফের দেশে দাঁড়িয়ে দেখা সেই রূপ যেন কোনোদিন ভুলে যাওয়ার নয়।

গোমুখ ভ্রমণের জন্য ভুজবাসা থেকে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। ২০২3 সালের পর হিমবাহ সংরক্ষণের জন্য সরকারি নিয়ম আরও কঠোর করা হয়েছে। গোমুখে গিয়ে মূল গ্লেসিয়ারের ৫০০ মিটারের মধ্যে যাওয়া নিষেধ। তাই ভ্রমণ পরিকল্পনার সময় এসব বিষয় আগে থেকেই জানা জরুরি।

সজল জাহিদ