লিখেছেনঃ ফুয়াদ বিন ওমর, A Walk in the World
মাস্কট বিমানবন্দরে ট্রানজিটে বসে আছি – ইন্টারনেটে ঢোকার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছে। ফ্রি ওয়াই ফাই খুঁজে বের করে ঢোকার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলাম রেজিট্রেশন করতে হবে ফোন নাম্বার দিয়ে। সেই নাম্বার আবার ভেরিফাই করতে হবে মোবাইলে আসা ওটিপি দিয়ে – কিন্তু বিদেশ – বিভূঁইয়ে আমার দেশী নাম্বার কাজ করবে কিভাবে, রোমিং তো করে যাইনি। ব্যর্থ মনরথে মন খারাপ করে চারদিক দেখছিলাম এমন সময় জোব্বা পরা এক আরবিয় তরুণকে দ্বিধা নিয়ে আমার সামনে আসতে দেখলাম। ছেলেটা আমার মতই লাজুক প্রকৃতির। বুঝতে পারলাম মাস্কট বিমানবন্দরের উপর একটা জরিপ চালানোর দায়িত্ব কাঁধে পড়েছে তার – বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করতে হবে সেখানে অবস্থানরত যাত্রীদের কাছ থেকে। আর তাকে যে খুব কম যাত্রীই উদাত্তভাবে সাহায্য করছে এটা তার ভাব সাব দেখেই বোঝা গেল।
আমার বেশ মায়াই লাগল, ছেলেটার জন্য – তার কাছে গিয়ে প্রশ্নের জরিপের কাগজটা নিয়ে উত্তর দিতে শুরু করলাম। সেও হাফ ছেড়ে বাঁচল – একটু পর পর কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগল। আমি কি করি, বয়স কত, কোথায় যাচ্ছি, কতগুলো দেশে গিয়েছি,মাস্কট বিমানবন্দর কেমন লাগছে এরকম প্রায় গোটা তিরিশেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবেই আমার ছুটি মেলল। বিদায় বেলায় একটু সাহস করে বললাম যে বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকব, একটু ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে খুব উপকার হত। একগাল হাসি দিয়ে আমায় তার ফোন নাম্বার দিয়েই ওয়াই ফাই তে রেজিট্রার করে দিল। আমায় আর পায় কে! অনেক ধন্যবাদ বিনিময়ের মাধ্যমে ট্রানজিটে পাওয়া বন্ধুর কাজ থেকে বিদায় নিলাম।
ইন্টারনেট হাতের মুঠোয় পেয়ে প্রথমেই আমার গন্তব্য লেখে সার্চ দিলাম – “কায়রো”। গুগল আমায় যা দেখাল সেটা আমি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নেও চিন্তা করিনি। কিছুক্ষণ আগেই কায়রোর কপ্টিক গির্জায় সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে – মারা গিয়েছে অনেকেই। মনে হল, দুঃস্বপ্ন দেখছি – কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে প্রায়ই এমন হয় আমার। আর কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই যেই দেশে পৌঁছাব সেই দেশে বলা নেই কওয়া নেই বোমা ফুটবে কেন? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে অনেক পুরাতন খবর দেখাচ্ছে আমায়।
কিছুক্ষণের ভেতরেই নিশ্চিত হলাম যে আমি বাস্তব জগতেই আছি, আর খবরটাও একেবারে তাজা। প্রত্যেকটা উন্নত দেশের একটা ওয়েবসাইট থাকে – সেখানে তাদের সিটিজেনদের বিভিন্ন ধরণের ট্রাভেল অ্যাডভাইস দেওয়া হয়। সেসব সাইটে দেখলাম অতি দ্রুত মিশর ত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাদের দেশের লোকদের। আমি দ্রুত বিমানবন্দরে টাঙ্গানো একটা মনিটরে গিয়ে দেখলাম যে আমার কায়রোগামী ফ্লাইট টা ঠিক আছে কিনা। নাহ! বাতিল হয়নি এখনও। ইন্টারনেট দেখা বাদ দিয়ে মনিটরই দেখতে লাগলাম। এভাবেই দেখতে দেখতে বোর্ডিং এর সময় হয়ে গেল। বোর্ডিং গেটের সামনে গিয়ে দেখলাম যে বেশিরভাগ মানুষই গম্ভীর মুখে বসে আছে।
বিষণ্ণতাকে সঙ্গী করে কায়রো বিমানবন্দরের মাটি ছুঁলাম রাত এগারটার দিকে। ইমিগ্রেশন অফিসার কোন কথা জিজ্ঞেস করল না, কিন্তু প্রত্যেকটা পাতা এমন ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল যেন তার জীবন মরণের পরীক্ষার মন্ত্র লেখা আছে সেখানে। এসব ব্যাপারে আমি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি তাই খুব একটা গায়ে লাগালাম না। শেষ পর্যন্ত একটা আরবি ভাষার সিল নিয়ে জীবনে প্রথমবারের মত ঢুকলাম আফ্রিকায়।
আমার হোটেল ছিল গিজায়। ট্যাক্সিতে করে নিশুতি রাতে রাস্তায় নেমে বুঝলাম যে শহরটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। চারদিকে কেমন যেন বদ্ধ, ছমছমে ভাব। কায়রোর রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে আমার গাড়ি। এর মাঝে বুকে হিম ধরে গেল রাস্তায় টহল দিতে থাকা বেশ কিছু ট্যাঙ্ক দেখে। ট্যাঙ্ক শুধু বইয়ে, জাদুঘরে আর টিভির পর্দায় দেখেছি, বাস্তবে রাস্তায় এই প্রথম। এমন সময় একটা পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের থামাল। ট্যাক্সির চালক কে জেরা করতে লাগল – বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারলাম না – সব আরবিতে। এরপর পুরো গাড়ি তল্লাসি করল। আমার পাসপোর্ট দেখল, আমায়ও দেখল। তারপর ছাড়া পেলাম তাদের হাত থেকে। বুঝলাম যে কপালে দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে পরবর্তী কদিন।
ঘণ্টা খানেকের ভেতরে গিজাতে পৌঁছালাম। গিজার রাস্তা যথেষ্ট নোংরা আর অগোছাল বলে মনে হল – উট বাঁধা দেখতে পেলাম বিভিন্ন জায়গায়। হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দুইটা। ভেতরে ঢুকতেই কেমন যেন একটা গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিল – সুগন্ধি। আগরবাতি নাকি, কে জানে! এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মত শক্তি ছিল না, ফর্মালিটিজ সেড়ে বিছানায় শুতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
ছোটবেলায় যখন থেকেই বইয়ের পাতায় সপ্তাশ্চর্যের ছবি দেখতাম তখন থেকেই পিরামিড আমার কাছে এক অদ্ভুত আকর্ষণের নাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা “মিশর রহস্য” সেই আকর্ষণ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সন্তু আর কাকাবাবুর হাত ধরে পিরামিডে আমি কল্পনায় আগেই ঘুরে এসেছি। আমি যে একদিন সেটা নিজ চোখে দেখতে পাব সেটা কখনই আশা করি নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন মনে হল যে ছাদে গেলেই আমি সেই পিরামিডের দেখা পাব তখন তখন থেকেই এক গা ছমছমে অনুভূতি হতে লাগল। কিন্তু দেখলেই তো শেষ হয়ে যাবে ভেবে বিছানা থেকে উঠতে একটু দেরি করলাম। একসময় ধীরে সুস্থ্যে বিছানা থেকে উঠে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম ছাদে। ভোরের আলো ফুটেছে সবে মাত্র – সোনালী আভা চারিদিকে – চোখের সামনেই দেখতে পেলাম।
ছাদে বেশিক্ষণ থাকিনি। একজন গাইড ভাড়া করে আসল জায়গায় চলে গেলাম তাড়াতাড়ি – পিরামিড অফ গিজা কম্পাউন্ডে। আমার একদম সামনেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে – একটার পরে একটা – গুনে গুনে তিনটা, পাশাপাশি – প্রাণহীন – তাও মনে হয় প্রাণ আছে।
৪৫০০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিস্ময়কর এই স্থাপত্যশৈলীর সামনে দাঁড়িয়ে গা ছমছম করছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, যুগে যুগে সব কিছুই প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, কত ঘটনা ঘটে গিয়েছে এই পৃথিবীতে, কিন্তু এই অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর জিনিসগুলো টিকে আছে, কত শত শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে!
সারা মিশরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য পিরামিড আছে, কিন্তু গিজার পিরামিডগুলোই সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত।
এর ভেতর সর্ব ডানের পিরামিডটি সবচাইতে বড়, যেটাকে গ্রেট পিরামিড অফ গিজা অথবা গ্রেট পিরামিড অফ খুফু বলা হয়। এটির উচ্চতা ১৪৬.৫ মিটার (আমার উচ্চতা ১.৭২ মিটার, আমার মাথার উপর আমার মত ৮৫ জন উঠলে এর সমান হবে)। এই পিরামিডটিই ৩৮০০ বছর ধরে মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্যশৈলী ছিল। পরে আরও অনেক উঁচু উঁচু জিনিস তৈরি হয়েছে, কিন্তু এই পিরামিডটির আবেদন একটুও কমেনি।
মাঝখানের পিরামিডটির নাম পিরামিড অফ খাফরে, আর বামেরটা পিরামিড অফ মেনকাউর। আর সবচেয়ে ছোট তিনটা ছিল রাণীদের জন্য বরাদ্দ, রাণীদের পিরামিড। উল্লেখ্য, খুফু, খাফরে এবং মেনকাউর, এরা সবাই ই কোনও না কোনও সময় মিশরের শাসনকর্তা ছিলেন, যাদেরকে তারা ডাকতেন ফারাও।
পিরামিডগুলো কেন তৈরি করা হয়েছিল?
এক কথায় বলতে গেলে, ফারাওদের শবদেহ রাখার জন্য। সাধারণত, একটা পিরামিডের ভেতর একজন ফারাওকে রাখা হত, মমি করে। এমন প্রক্রিয়ায় এটা করা হত যেন শবদেহগুলোতে পচন না ধরে। এইজন্য এত শতাব্দী পরও আবিষ্কৃত মমিগুলো নষ্ট হয়ে যায়নি।
তখনকার মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে, মারা যাওয়ার পরও একটা জগত আছে, যেখানে সঠিক উপায় ছাড়া পৌঁছানো যায়না। তাদের শাসক, ফারাওরা যেভাবে পৃথিবীর বুকে তাদেরকে শাসন করেছে, ঠিক একইভাবে সেই জগতকেও শাসন করবে। তারা আরও বিশ্বাস করত যে, ফারাওরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও, তাদের সাথে তাদের আত্মা আছে। সেই আত্মাকে তারা বলত‘কা’। এই ‘কা’ যেন নির্বিঘ্নে পরবর্তী জগতে যেতে পারে তার জন্যই এত আয়োজন। আর সেই নতুন জগতে ফারাওদের যেন খালি হাতে যেতে না হয় তাই তাদের ব্যবহারের সব ধরনের জিনিশপত্র, সোনা-দানা পিরামিডের ভেতরে, মমির কাছে অথবা ভেতরে রেখে দেওয়া হত। তাই, এটাকে শুধু তাদের সমাধিস্থল ভাবলে ভুল হবে, বরং এটা ছিল তাদের পরবর্তী জগতে যাওয়ার জন্য এক ধরনের ‘ট্রানজিট’। ফারাওরা কেউ সেই নতুন জগতে শাসন করতে পেরেছেন কিনা অথবা নিদেনপক্ষে যেতে পেরেছেন কিনা সেটা জানা যায়নি, কিন্তু, মূল্যবান জিনিসগুলো যে তাদের সাথে নিতে পারেননি, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কারন, তাদের এই অমূল্য জিনিসগুলোই পরবর্তীকালে ছিল বিভিন্ন রাজা-রাজরা আর চোর-ডাকাতদের কাঙ্ক্ষিত বস্তু।
আমার গাইড আমাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগল আর ইতিহাস বলতে লাগল। দেয়ালে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক্স দেখে খুব বোঝার ভান করলাম। সিংহের শরীর আর মানুষের মাথা ওয়ালা স্ফিংক্স এর সামনে গিয়ে ছবি তুললাম অনেকগুলো। ছবি তোলার ব্যাপারেও ওখানকার লোকজন অনেক সিদ্ধহস্ত। আমাকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় পোজ দিতে হল – স্ফিংক্স কে চুমু খাওয়াও বাদ গেল না।
এরপর উটের পিঠে উঠে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। মিশরের সবকিছু ভাল হলেও, যেখানে পর্যটকরা যেসব জায়গায় যান সেখানে লোকদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্নাম আছে। আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানেই লোকজনদের মুখে “বখশিশ” কথাটা শুনেছি। হয়তো দাঁড়িয়ে আছি, একজন অযাচিত ভাবে এসে কিছু জিনিস ব্যাখ্যা করেই হাত পাতল। এমনকি এয়ারপোর্টের লাগেজ স্ক্যানারে লাগেজ দিয়েও টাকা চেয়েছে আমার কাছে! ইন্টারনেটে পড়েছিলাম যে উটের পিঠে ওঠানোর আগে কম টাকা ঠিক করে ওঠায়, এরপর উটের পিঠে বসার পর আরও টাকা না দিলে উটকে আর বসায় না। উট না বসলে তো আর লাফ দিয়ে নামা যায় না – তাই টাকা দিতেই হয় শেষ পর্যন্ত। আমি তাই একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম। তবে, আমার সাথে গাইড থাকাতে অল্পের উপর দিয়েই বাঁচলাম!
ততক্ষণে দুপুর পেড়িয়ে গিয়েছে। গিজার পিরামিড গুলোকে বিদায় জানিয়ে বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ রাস্তার মানুষজন দেখলাম। এরপর (ভয়ে ভয়ে) একটা ট্যাক্সি ডেকে চললাম দাশুরের পথে – ওখানকার রেড পিরামিড দেখার জন্য। রাস্তার দুইপাশে সবুজ গাছ, গ্রামের ভেতর দিয়ে ছুঁটে চলছে আমার গাড়ি। আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন আহমেদ – টুকটাক ইংরেজি তে গল্প করার চেষ্টা করছি তার সাথে। গিজার পিরামিডের ভেতরে ঢুকিনি ভিড়ের কারণে কিন্তু দাশুরের পিরামিডের ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা আছে আমার – সেই ইচ্ছা হয়তো একটু পরেই পূর্ণ হতে যাচ্ছে। আমার মিশরের ছয় দিনের এডভেঞ্চারের প্রথম দিন শেষ হবে আর কয়েক ঘণ্টা পর, বাকি সময়ের গল্পগুলো তুলে রাখলাম অন্যদিনের জন্য, কেমন?
এই লেখকের লেখা ভ্রমণ কাহিনী ইতিউতি হাঁটাহাঁটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।