Skip to content Skip to footer

বিলেতের সৈকতে কিছু সময়

লিখেছেন: শাকিল বিন মুশতাক

বিবিসির প্রশিক্ষণে এসে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সময়টা ২০১৩-১৪ হবে। মাসব্যাপী লন্ডন ভ্রমণে প্রতি শনি এবং রোববার নিয়ম মেনেই সাপ্তাহিক ছুটি উপভোগ করছিলাম। কাজেই ঠিক করলাম এক ছুটিতে শহরের বাইরে যাই। কোথায় যাওয়া যায়? খোঁজ নিয়ে জানলাম লন্ডনের কাছেই রয়েছে বিখ্যাত এক পর্যটন কেন্দ্র, নাম তার ‘ব্রাইটন’। এটি আদতে একটি সৈকত শহর। বলা যেতে পারে, ওখানকার ‘কক্সবাজার’। যে সময়টার কথা বলছি সেটি যুক্তরাজ্যের গ্রীষ্মকাল। গরমও পরেছিলো প্রচুর যদিও বাংলাদেশ থেকে আসা আমার গায়ে সূর্যের তেজ তেমন বিঁধছিলো না। তবে বিলেতিদের কথা আলাদা। ট্যাবলয়েডগুলোয় প্রতিদিন খবর বেরুচ্ছে কতজন নাগরিক হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ এবং মারা যাচ্ছে, সে সবের বিস্তারিত। তো ওইসব খবর থেকেই জানলাম লন্ডনের ৪৭ মাইলের মধ্যেই রয়েছে ব্রাইটন সৈকত। দলে দলে পঙ্গপালের মতো নাকি সেখানে ছুটছেন বিলেতের মানুষরা একটু ‘ঠান্ডা’ হওয়ার আশায়। পত্রিকায় পাতায় সাগরের নীল ছবি দেখে তাৎক্ষণিক নেট ঘেঁটে বের করলাম কীভাবে যাওয়া যায়, দিনে এসে একই দিনে ফেরা যায় কি না ইত্যাদি; এবং পেয়েও গেলাম সব তথ্য।

ইউস্টন স্টেশন। লন্ডনের পেটের ভেতরে এ এক বিশাল রেলস্টেশন। ওভার গ্রাউন্ড, আন্ডার গ্রাউন্ড-দুই ধরনের ট্রেনই চলাচলা করে এই স্টেশন থেকে। এখান থেকেই ট্রেনে চাপলাম; গন্তব্য ব্রাইটন, উদ্দেশ্য সৈকত দর্শন। ট্রেনে যাত্রার ফাঁকে একটু ইউস্টন স্টেশন সম্পর্কে বলে নেই।

১৮৩৭ সালে চালু হওয়া এই স্টেশনে রয়েছে ১৮টি টার্মিনাল। পুরো যুক্তরাজ্য ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলো স্টেশনের মধ্যে এটিকে বলা হয় ষষ্ঠ ব্যস্ততম রেলস্টেশন। বছরে সাত কোটিরও বেশি মানুষ ব্যবহার করে এ স্টেশন। যারা লন্ডন থেকে ট্রেনে বার্মিংহাম, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, এডিনবারা এবং গ্লাসগোতে যান, তাদের কাছে এই স্টেশন খুবই জনপ্রিয়।

স্টেশনটির নানা সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে টয়লেট ছাড়াও বেবি চেঞ্জিংয়ের ব্যবস্থা। যারা লন্ডন থেকে স্কটল্যান্ডে এই স্টেশন থেকে প্রথম শ্রেণিতে কালেডোনিয়ান স্লিপার ক্লাসে ভ্রমণ করতে চান, তারা স্নানের সুবিধাও পাবেন। আছে পে ফোন বুথ, দুটি এটিএম ছাড়াও মানি চেঞ্জিনিংয়ের ব্যবস্থা। ওয়েটিং রুম, গাড়ি বুকিং, ট্রলি, লস্ট প্রোপার্টি বা জিনিসপত্র হারানো গেলে ফিরে পাওয়ার মতো সাধারণ বিষয়ের পাশাপাশি ফটো বুথ এবং ওয়াইফাইয়ের সুবিধা। গাড়ির পাশাপাশি রয়েছে বাইসাইকেল রাখার আলাদা ব্যবস্থা। আরো রয়েছে দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা, যেমন ধাপবিহীন বা স্টেপ ফ্রি প্লাটফরম, টিকিট বুথে আলাদা ব্যবস্থা, বিশেষায়িত বিশ্রামাগার, সাহায্যের জন্য নির্দিষ্ট কর্মচারী, হুইলচেয়ার, মোবিলিটি ভেহিকল এবং বিশেষায়িত টয়লেট।

তো নানা সুবিধায় আলোকিত এই স্টেশন থেকে ব্রাইটন যেতে খরচ পড়ে সাতচল্লিশ পাউন্ড দশ পেন্স, সময় লাগে দেড় ঘণ্টারও কম। তবে প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণ করলে খরচ বেড়ে দাঁড়াবে সাতষট্টি পাউন্ড দশ পেন্স। ট্রেনের ভেতরটা বেশ শান্ত, সৌম্য ধরনের। জানালার কাঁচগুলো স্থায়ীভাবে লক থাকায় এবং ব্রিটিশদের স্বল্প আওয়াজে কথা বলার চর্চা থাকায় কম্পার্টমেন্টের পরিবেশ অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। হৈ হৈ করে উঠে বসা বিনা টিকিটের যাত্রী, কুলি কি হকারদের অনবরত দাম-দর, অধৈর্য যাত্রীর চেঁচামেচি-এসবই এখানে স্বপ্ন। এর পরও একজন বিনা টিকিটের যাত্রী পেয়ে গেলাম।

ঘটনা গুরুতর হতে পারত কিন্তু বিষয়টা তেমন জটিল নয়। কোনো কারণে যাত্রী উঠে পড়ার পর টের পেয়েছেন তার সঙ্গে টিকিটটি নেই। আর এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য বোধহয় তৈরিই থাকেন টিকিট চেকার বা টিটিরা। টিটি সঙ্গে করে পজ মেশিন নিয়েই ঘুরছেন, অর্থাৎ কেউ যদি নগদ দিতে না পারেন, তিনি ক্রেডিট কি ডেবিট কার্ডের মাধ্যমেও টিকিটের দাম এবং জরিমানার অর্থ পরিশোধ করতে পারেন। যাত্রী পরিশোধ করলেনও সেভাবেই, দেখলাম আর ভাবলাম বাংলাদেশ হলে কি ঘটতো।

বলে রাখা ভালো, যারা লন্ডনের চাকচিক্যে বিমোহিত কি বিরক্ত, তারা নিঃসন্দেহেই এই ট্রেনযাত্রা উপভোগ করবেন আর কিছু না হলেও লন্ডনের বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার কারণে। বাংলাদেশে ট্রেনযাত্রীর এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার, যারা দ্রুত সরে যেতে থাকা ধানখেতসহ প্রকৃতির সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হন না, এখানেও তেমনি বিলেতি প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে। পার্থক্য তো রয়েছেই, যেমন গরুর পরিবর্তে মাঠ ঘোড়ার পাল দেখবেন, ইটভাটার পরিবর্তে বিশাল ফিউচারিস্টিক নকশার পাওয়ার প্লান্ট-এসবই ট্রেনযাত্রায় উপভোগ করবেন।

এসব দেখতে দেখতেই ইস্ট সাসেক্সে অবস্থিত ব্রাইটন রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। ১৮৪০ সালে তৈরি স্টেশনটিকে বলা হয় লন্ডনের বাইরে সপ্তম ব্যস্ততম রেলওয়ে স্টেশন। বেশ উত্তেজনা নিয়েই নামলাম ট্রেন থেকে, হাতে সৈকতে যাওয়ার রুটম্যাপ। যদিও দেখাচ্ছে স্টেশন থেকে নেমেই বলতে গেলে সোজা হাঁটা পথ তবু ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না; এত কাছে কীভাবে? শুরু হলো ‘কুইন্স রোড’ ধরে হাঁটা।

হাঁটছি আর অবাক হচ্ছি। রাস্তা খুব প্রশস্ত নয়, কিন্তু যানবাহনের চাপও তেমন নেই। আর সৈকত কাছে থাকায় হয়তো বা মানুষজন সবাই যার যার মতো হাঁটছে। রাস্তার দুধারেই পর্যাপ্ত স্যুভনির এবং খাবারের দোকান, কিন্তু কোনো হল্লা নেই, রাস্তা কিংবা ফুটপাথ দখল নেই, কোনো ময়লাও চোখে পড়ল না। পেটে হঠাৎ গুড়গুড় করে ওঠায় মনে পড়ল কিছু খাওয়া দরকার। ঐতিহ্যবাহী ‘ফিস অ্যান্ড চিপস’ বিক্রি হয় এখানকার প্রায় সব দোকানে, ঢুকে পড়লাম একটায়। নানা দামে বিক্রি হয় এ খাবার, নানা সাজ, পরিবেশনা আর নানা মান তার। যে দোকানে ঢুকলাম সেটি ঠিক দামি রেস্তোরাঁ নয়, তবে ছয় পাউন্ডে যে পরিমাণ ‘ফিস অ্যান্ড চিপস’ তা একা সাবার করা কঠিন হয়ে পড়লো, মানটাও জিভে জল আনার মতোই ছিল। দাম চুকিয়ে আবারো হাঁটার পালা। হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম ধীরে ধীরে নিচের দিকে যাচ্ছি। অল্প সময়ের ভেতরেই সাগরের নীল চোখে পড়ল। এ এক অপার্থিব দৃশ্য তো বটেই। খাবারের দোকানে সময় না দিলে রেলস্টেশন থেকে মাত্র বিশ-পঁচিশ মিনিটের হাঁটা পথ ব্রাইটন সমুদ্র সৈকত। সৈকতের আগেই মূল সড়ক তাই সেটি পার হওয়ার জন্য রয়েছে পরিচ্ছন্ন একটি আন্ডার পাস। এটি প্রোকৌশলগতভাবে এমনভাবে তৈরি যে কেউ ‘ঝামেলা’ মনে করে এড়িয়ে যেতে চাইবেন না, আবার এটি যে ‘দুর্দান্ত’ গোছের কিছু তাও নয়, এই ‘সিমপ্লিসিটি’ অবশ্য যুক্তরাজ্যের অনেক স্থানেই দেখা যায়। আন্ডারপাস পেরিয়ে বিচের সামনে এসে একটু থমকালাম। কই? সৈকতে বালু গেল কোথায়? থমকালেও ভ্রম কাটতে দেরি হলো না। মনে পড়ল এটি ‘স্টোন বিচ’ বা পাথুরে সৈকত। এটিই এই সৈকতের বৈশিষ্ট্য। কক্সবাজার ঘুরে আসা বাংলাদেশিদের কাছে এই সৈকত অবশ্য ‘শিশু’ বলে মনে হতে পারে, নিতান্তই ছোট সৈকত এটি। তবে মানুষের ঢল দেখে বুঝলাম এটি কি পরিমাণ জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। অবশ্য সে সময়ের আবহাওয়াও এই জনবাহুল্যের একটি কারণ বটে। দলে দলে লন্ডন তো বটেই, অন্যান্য স্থান থেকেও মানুষ ছুটে এসেছে সাগরের কাছে এক দুদন্ড জিরিয়ে নিতে। কেউ স্নান সারছেন তো, আবার কেউ বউ-বাচ্চা নিয়ে মাদুর বিছিয়ে রীতিমতো পিকনিক করছেন। সবাই যে যার মতো আনন্দ করছেন কিন্তু কেউ কাউকে বিরক্ত করছেন না। সৈকতের এক পার থেকে শুরু হয়ে দীর্ঘ স্থানজুড়ে নানা দোকান, সবই খোলা আকাশের নিচে, কিন্তু কেউ নিজ সীমার বাইরে পণ্য নিয়ে বসেননি, কেউ এমনভাবে ডাকাডাকি করছেন না, যাতে পর্যটকরা বিরক্ত হন, কেউ এমনভাবে ঘোরাফেরা করছেন না, যাতে পর্যটকদের চলাফেরায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। বলতে গেলে পরিকল্পনা করে প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা কাজে লাগিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যেমন খোলামেলা পরিবেশ, তেমনি আবার বাণিজ্য। রয়েছে খোলা আকাশের নিচে খাবারের ব্যবস্থা, মিনিট টেনিস কোর্ট, ভলিবল খেলার ব্যবস্থা, আনপ্লাগড গানসহ রেস্তোরাঁও রয়েছে। যদিও সে গানের আওয়াজ বেশ দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রিত যাতে অন্যরা বিরক্ত না হন, রয়েছে শিশুদের খেলার নানা বন্দোবস্ত। পরিষ্কার বোঝা যায়, একটা নিরস পাথুরে সৈকতকে ‘সম্পদ’ বিবেচনায় নিজেদের সর্বোচ্চ মেধা বিনিয়োগ করেছেন ব্রিটিশরা। পর্যটক তা তিনি দেশি হোক আর বিদেশি, কোনোভাবেই যেন এখানে এসে নিরাশ হয়ে ফিরে না যান, বরং এসে সন্তুষ্টিচিত্তে দুটো পয়সা খরচ করেন, তৃপ্ত মন নিয়ে ফিরে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসা করেন, তার সব ধরনের চেষ্টা এই সৈকতজুড়ে দেখা যায়। সৈকতের কাছেই রয়েছে আধুনিক সিনেমা হল থেকে শুরু করে বিনোদনের হরেক রকম আয়োজন।

কিছুক্ষণ বিচে হেঁটে এক ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁয় বসে অ্যাপেটাইট আর ড্রিংকস অর্ডার দিলাম। একটু পর গ্লাস হাতে ভাবতে বসলাম, এরা কী করছে আর আমরা বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত নিয়ে কী করছি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ছবি: https://pixabay.com/ এর সৌজন্যে।