লেখকঃ কাজী রওনাক হোসেন
পাহাড় আর সমুদ্র—প্রকৃতির এই দুই বিপুল সৃষ্টিকে আমি কখনোই এড়িয়ে যেতে পারি না। বিশাল সমুদ্রে আমি সাঁতার কাটতে পারি না, আর গগনচুম্বি শৃঙ্গের ওপর ট্র্যাকিং করতেও সক্ষম নই। তবু প্রকৃতির এই দুই অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে বারবার টানে। পাহাড়ের মাঝে একদিকে দেখা মেলে রুক্ষ পাথুরে ধূসর শৃঙ্গ, অপরদিকে গাছ-গাছালিতে ঢাকা সবুজ বনাঞ্চল, আর বরফে ঢাকা হিমালয়—এই সৌন্দর্য যেন আমাদের মনকে মুগ্ধ করে।
প্রায় ৫৬,৮২৭ বর্গমাইলের এই দেশটিকে বলা হয় হিমালয় কন্যা। নামের উৎপত্তি নেপালের—“নে” অর্থ পবিত্র এবং “পাল” অর্থ গুহা। নেপালে তিন ধরনের ভূমি সৌন্দর্য বিদ্যমান—উঁচু পাহাড়, পাহাড়ি ভুমি, এবং নিচু সমতল ভূমি বা তরাই। তাই ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা বারবার এই দেশটি দেখতে ছুটে আসে।
আমরা, নটরডেম কলেজের ৭৬ ব্যাচের ১২ জন অ্যালামনাই—রায়হান, মাহফুজ, মোস্তাক, পটল (মাহফুজ), ডা. নূর, ডা. নীলকণ্ঠ, মুনির, সেলিম, মারুফ, গণি, জাকারিয়া এবং আমি—ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে। মাহফুজ রহমান পটল শুধু এই ভ্রমণে যোগ দিতে আমেরিকা থেকে এসেছিল।
আমাদের ট্যুর সফল করতে ট্যুরিজন বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ফেরদৌস ও রাহাত, এবং তাদের নেপালের সহযোগী মদন ভান্ডারীকে ধন্যবাদ জানাই।
কাঠমান্ডুতে আগমন:
নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বিজি ০৬৯ ফ্লাইট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কাঠমান্ডুর আকাশ মেঘলা থাকায় এভারেস্ট শৃঙ্গ দেখা সম্ভব হয়নি। তবু মাঝে মাঝে ছোট ছোট করে দেখা যাচ্ছিল। অবতরণের পর ইমিগ্রেশনের নতুন প্রক্রিয়া আমাদের জন্য কিছুটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। লাইনে দাঁড়িয়ে ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন করতে হতে হলো, যা সময়সাধ্য এবং যারা ইংরেজিতে কমদক্ষ, তাদের জন্য কষ্টসাধ্য।
হোটেল পিলগ্রিম, থামেল–এ আমরা পৌঁছলাম। হোটেলটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, সুবিধাজনক অবস্থানে।
শম্ভুনাথ মন্দির ভ্রমণ:
পরদিন সকালে নাস্তা শেষে আমরা রওনা হলাম শম্ভুনাথ মন্দিরে। হোটেল থেকে শর্টকাট রাস্তা ধরে আমরা উপরে উঠলাম। মন্দিরের চারপাশে অসংখ্য বানর ছোটাছুটি করছিল। বেশিরভাগ বানরের কোলেই একটি বা দুটি বাচ্চা ছিল। এই দৃশ্য মনে করালো ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার ‘থ্রি কয়েনস ইন দ্য ফাউনটেন’ গানের দৃশ্য। মন্দির থেকে কাঠমান্ডু শহরের বিস্তৃত দৃশ্য দেখার সুযোগ পেলাম। সবাই প্রচুর ছবি তুলল এবং কিছু উপহারসামগ্রী কিনল।
ভক্তপুর ও দরবার স্কয়ার:
পরবর্তী গন্তব্য ছিল ভক্তপুর। দুপুরের রোদে সেখানকার ভ্রমণ সামান্য সীমিত রাখল। তাই শহরের দৃশ্য দেখে দ্রুত নাগরকোটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
নাগরকোট:
দুপুরে হোটেল নিভানিওয়া, নাগরকোট-এ পৌঁছলাম। হোটেলটি পাহাড় কেটে নির্মিত, চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম। হিমালয়ের অংশবিশেষ দেখা যায়। সূর্যাস্তের সময় পাহাড়ের চূড়া আর আকাশের রঙের খেলা সত্যিই স্বর্গীয়। ঝিরঝিরে ঝর্ণা, গ্রামীণ জীবনের ছোট ছোট দৃশ্য, শিশুদের খেলা, এবং পাহাড়ের ঘরবাড়ি—সব মিলিয়ে যেন এক অপরূপ চিত্র। সূর্য ডুবে গেলে আমরা গরম চা পান করে হোটেলে ফিরলাম। রাতে হোটেলে রোমানীয় পর্যটক গ্রুপের ফ্রি নাচ আমাদের আনন্দে ভরিয়ে দিল।
পরদিন সূর্যোদয় ও ফের কাঠমান্ডু:
ভোরে লনে ও হোটেলের ছাদে সূর্যোদয় উপভোগ করা হলো। বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়ায় রক্তিম আলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছিল। কাঠমান্ডু ফেরার পথে ধূলিখেলের রিসোর্টে দুপুরের খাবার। এরপর তওদাহা লেক দেখার জন্য রওনা। পুরো কাঠমান্ডু শহরও দেখা গেল।
চন্দ্রাগিরি হিল রিসোর্ট:
পরদিন ভোরে আমরা গেলাম চন্দ্রাগিরি হিল রিসোর্ট। সবাই একমত—এটি পুরো ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। রাতে বন্ধু খোরশেদ আলম হায়দার ললিতপুরে ‘নাসরিনস কিচেন’-এ ডিনার আয়োজন করেন। ব্যয়বহুল হলেও খাবারের মান চমৎকার।
পরের দিন, ১২ তারিখে আমরা বিমানে চড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এনডিসি ৭৬-এর বন্ধন চির অটুট থাকুক, ভবিষ্যতেও আমরা এমন সফরের আয়োজন করব ইনশাআল্লাহ।