Skip to content Skip to footer

আদিনাথের মহেশখালী দ্বীপে

চকরিয়া ছাড়ার পরপরই চোখে পড়ল পথজুড়ে নদী আর খাল। মনে হলো, এরা যেন নীরবে জানিয়ে দিচ্ছে—তাদের স্রোতধারা গোপনে গিয়ে মিশেছে সাগরে। যদিও সাগর তখনো অনেক দূরে, তবুও নদী-খালগুলোয় জোয়ার–ভাটার ছাপ স্পষ্ট। মনে হচ্ছিল, কক্সবাজার অঞ্চলে ‘খালী’ নামের জয়জয়কার—খোটাখালী, ফাসিয়াখালী, বাটাখালী, বদরখালী আর মহেশখালী!

আমাদের অটোরিকশা গিয়ে থামল বদরখালীতে—মূল ভূখণ্ডের শেষ প্রান্তে। মাঝখানে মহেশখালী চ্যানেল, ওপাশে মহেশখালী দ্বীপ। ভাটা চলছে; উপকূলীয় বনের শ্বাসমূল ভেসে আছে কাদায়। শোনা ছিল, মহেশখালীতে যেতে হয় স্পিডবোটে সাগর পাড়ি দিয়ে। কিন্তু এখানে তো দেখি সেতু পেরোলেই দ্বীপে পৌঁছে যাওয়া যায়! সহযাত্রী সোহেল আর গুগল ম্যাপ মিলে সংশয় দূর করল—চ্যানেলটি মোহনায় প্রশস্ত হলেও উজানে গিয়ে খালের মতো চিকন হয়ে যায়। যেন কুমিরের মোটা পেট আর সরু লেজের মতো আকৃতি।

মহেশখালী উপজেলা সদরে যাওয়ার দুইটি পথ। আমরা বেছে নিলাম চ্যানেলঘেঁষা রাস্তা, কারণ আদিনাথ মন্দিরে যাওয়ার জন্য এটি কাছের পথ। প্রথমে সমতল জমি, ধানের ক্ষেত আর বসতি—তারপর হঠাৎই অটোরিকশা ঢুকে পড়ল টিলাময় অরণ্যে। দুপুর রোদও সেখানে আবছা হয়ে আসে, চারপাশ পাহাড় কেটে বানানো আঁকাবাঁকা পথ। কখনো খাড়া দেয়াল উঠে গেছে ওপরে, আবার কখনো গভীর খাদ নেমে গেছে নিচে। খাদের নিচে ছড়া, সেখানে কচুর দঙ্গল আর কুলুকুলু স্রোতধ্বনি।

সবুজ বন-পাহাড় পেরিয়ে পৌঁছালাম আদিনাথ বাজারে। দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীর ভূপ্রকৃতি অনেকটা পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো। ইতিহাস বলে, ১৫৫৯ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পেই দ্বীপটি মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহেশখালী চ্যানেল তৈরি হয়।

বাজার থেকে রিকশায় চড়ে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে—মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আদিনাথ মন্দির। পাদদেশ থেকে শুরু হয়েছে পাকা সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে সারি বেঁধে তাঁতের কাপড়ের দোকান, আর সেসব দোকান সামলাচ্ছেন স্থানীয় রাখাইন নারী-তরুণীরা। রঙিন কাপড়ের সম্ভার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

ধাপে ধাপে ওপরে উঠতেই চূড়ায় পৌঁছে যায় মনোরম দৃশ্যপটে। একপাশে সংকীর্ণ ট্রেইলে নারীরা ঘাস কাটছিলেন—যা দিয়ে পানের বরজ ঢেকে রাখা হয়। অন্য পাশে দূর থেকে দেখা যায় সাগরের নীল জলরাশি আর উপকূলীয় বন। নিচে বিস্তৃত সবুজ বরজ।

পাহাড়ের মধ্যিখানে আদিনাথ মন্দির। ভিতরে শিবলিঙ্গ, আর পাশে খাদের গভীর খাদ। কথিত আছে, রামায়ণের যুগে রাবণ কৈলাশ থেকে লঙ্কায় শিবলিঙ্গ বহন করার পথে এখানে সেটি নামালে আর তুলতে পারেননি—ফলে এখানেই শিবের অবস্থান স্থায়ী হয়। মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাগা সন্ন্যাসীদের ইতিহাস, গোরক্ষনাথের নাম থেকে গোরকঘাটার নামকরণও হয়েছে বলে জানা যায়।

মন্দিরে দেখা হলো বৃদ্ধ সেবক আরাধন নাথের সঙ্গে। বয়স সত্তরের ওপরে, দেশভাগের স্মৃতিও এখনো মনে আছে তাঁর। জানালেন, প্রতি বছর ফাল্গুনে আদিনাথ মেলায় দেশ-বিদেশ থেকে অগণিত পূণ্যার্থী আসে—মেলা চলে টানা ১৩ দিন।

মন্দির থেকে নামার পথে কাপড়ের দোকানে ঢুঁ মেরে একটি গামছা কিনলাম। তারপর রওনা দিলাম আদিনাথ জেটির পথে। সরু পাকা সেতু উপকূলীয় প্যারাবনের বুক চিরে এগিয়েছে সাগরের দিকে। পড়ন্ত বিকেলে বন কাঁপিয়ে শত শত পাখি উড়ল—শালিক, কাক, চিল আর অচেনা সামুদ্রিক পাখি। এই প্যারাবনের আয়তন প্রায় ১৭ হাজার একর, একচেটিয়া বাইনগাছের আধিক্য। কাদামাটিতে লাল কাঁকড়া আর মাডস্কিপারের খেলা দেখে মুগ্ধ হলাম। মনে হলো, যেন সুন্দরবনের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ।

জেটির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সামনে বিস্তৃত সাগর, পেছনে সবুজ প্যারাবন। বনের কিনারায় জেলে নৌকায় তখন রান্নার ধোঁয়া উঠছে। হাঁক দিলাম—“ও মাঝি ভাই, মাছ ধরা পইন্নে নে?” উত্তর না এলেও নৌকা থেকে ফিরে এল হাসি।

ফেরার পথে পানের বরজে নেমে দেখি থরে থরে সাজানো পানগাছ। মহেশখালীর জীবনে পান, লবণ, চিংড়ি আর কাঁকড়ার চাষ মিলেমিশে আছে। আদিনাথ বাজারে পানচাষীদের ব্যস্ত বেচাকেনা দেখে এবার আমাদের যাত্রা শেষ হলো গোরকঘাটায়।

কিভাবে যাবেন

স্থলপথে গেলে চকোরিয়া–বদরখালী–গোরকঘাটা রুটে অটোরিকশায় পৌঁছাতে পারবেন। ভাড়া জনপ্রতি প্রায় ১৫০ টাকা। সারাদিন ঘুরে বিকেলে চাইলে সাগরপথে কক্সবাজার ফেরত আসতে পারেন। কিংবা উল্টোটাও করতে পারেন—তাহলে একই যাত্রায় সাগর ও স্থলপথ দুই অভিজ্ঞতাই হবে

লেখক পরিচিতি
শিমুল খালেদ সিলেট এমসি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বর্তমানে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে কর্মরত। জন্মস্থান সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা, বর্তমান বাস সিলেট শহরে। ভ্রমণ, নিসর্গপ্রেম, পরিবেশ সচেতনতা ও লেখালেখি তাঁর নেশা। কৈশোরকাল থেকেই লিখে আসছেন, আর তাঁর ভ্রমণ গল্প প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।