Skip to content Skip to footer

মৎস্যকন্যার দেশে

অর্ধেক নারী, অর্ধেক মাছের লেজ—এভাবেই কল্পনার জগতে মৎস্যকন্যার জন্ম। ইউরোপের লোককথায় বহু শতাব্দী ধরে এই চরিত্র বেঁচে আছে। বিশেষ করে ১৪শ শতকের মধ্যভাগ থেকে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ (ভারশাভা) শহরের কুলচিহ্নেই মৎস্যকন্যার প্রতীক ব্যবহার হয়ে আসছে।

কথিত আছে, একসময় বাল্টিক সাগরের তীর থেকে দুই বোন মৎস্যকন্যা গভীর সাগরে সাঁতার কাটতে শুরু করেছিল। একজন সাঁতরে পৌঁছায় ডেনমার্কে এবং আজও তাকে কোপেনহেগেন বন্দরের শিলার ওপর বসে থাকতে দেখা যায়। অন্য বোন সাঁতরে আসে ভিস্তুলা নদীর পাড়ে, বর্তমান ওয়ারশ শহরের কাছাকাছি। স্থানীয় জেলেরা তার সুমধুর গান শুনে বিমোহিত হত। কিন্তু এক লোভী ব্যবসায়ী তাকে বন্দি করে মেলায় প্রদর্শনের পরিকল্পনা করে। তখন এক তরুণ জেলে তাকে মুক্ত করে দেয়। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মৎস্যকন্যা প্রতিজ্ঞা করে, শহরবাসী বিপদে পড়লে সে তাদের রক্ষা করবে। তাই আজও ওয়ারশ শহরের প্রতীকচিহ্নে এক হাতে ঢাল ও অন্য হাতে তরবারি ধরা মৎস্যকন্যা দেখা যায়।

দীর্ঘ প্রায় ১৩ ঘণ্টার বিমানযাত্রা শেষে মস্কো হয়ে নামি ওয়ারশ ফ্রেডরিক শপাঁ এয়ারপোর্টে। আধুনিক ও সুশৃঙ্খল এই বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হতে পাঁচ মিনিটও লাগেনি। সিটি সার্ভিস বাসে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যাওয়া যায় সহজেই।

আগেই ই-মেইলের মাধ্যমে পরিচিত কিছু স্থানীয় বন্ধু বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ওদের সঙ্গেই কয়েকদিন থেকে শহরের ইতিহাস ও সৌন্দর্য আবিষ্কারের সুযোগ পেয়েছিলাম। সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল ২০০৮ সালের এয়ারশোতে ভিআইপি গ্যালারিতে বসে যুদ্ধবিমান প্রদর্শনী দেখা।

পোল্যান্ড মধ্য ইউরোপের দেশ। উত্তরে বাল্টিক সাগর, দক্ষিণে কার্পাথিয়ান পর্বতশ্রেণি। আবহাওয়া মিশ্র, তবে বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। মে-জুনে গরম পড়লেও শহরের সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় পোল্যান্ডের ১০টি স্থান অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ক্রাকোউ – ঐতিহাসিক নগর কমপ্লেক্স

  • ওয়ারশের পুরোনো শহর – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে নতুনভাবে গড়ে ওঠা নগর

  • টোরুন – বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপারনিকাসের শহর

  • জামস্ক – ইউরোপের অন্যতম পরিকল্পিত শহর

ওয়ারশের পুরোনো শহরে গ্রীষ্মকালে উন্মুক্ত কনসার্ট, পথনাটক ও চিত্রশিল্পীর প্রদর্শনী হয়। নদীর তীর ধরে হাঁটলে মনে হয় যেন কয়েক শতাব্দী আগের ইউরোপে ফিরে গেছি।

ওয়ারশের সবচেয়ে বিখ্যাত ভ্রমণপথ হলো রয়েল রুট। এখানে রয়েছে রাজপ্রাসাদ, ঐতিহাসিক গির্জা, প্রেসিডেন্ট ভবন, বিশ্ববিদ্যালয় ও অসংখ্য শিল্পসমৃদ্ধ স্থাপনা। ১৩শ শতকে নির্মিত রয়েল ক্যাসল ছিল পোল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ, যা দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।

অন্যদিকে ১৫৪৮ সালে নির্মিত বারবিকান দুর্গ পর্যটকদের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়। দুর্গের প্রবেশপথে হস্তশিল্পের দোকান ও শিল্পীদের জমায়েত রঙিন করে রাখে আশপাশের পরিবেশ।

বার্লিন দেয়াল পতনের পর পোল্যান্ড দ্রুত বদলে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, প্রাণবন্ত মানুষ ও সহজ যোগাযোগব্যবস্থা দেশটিকে ভ্রমণবান্ধব করে তুলেছে। ইউরোপের অন্য শহরগুলোর তুলনায় ভ্রমণ খরচও তুলনামূলক কম।

ভ্রমণকারীদের জন্য ওয়ারশ সিটি কার্ড বিশেষ আকর্ষণীয়। মাত্র ২০ ডলারে ২০টির বেশি মিউজিয়ামে প্রবেশ, গণপরিবহন ফ্রি এবং নানা ছাড় পাওয়া যায়।

ওয়ারশ এমন এক শহর, যেখানে অতীতের ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন আধুনিক নগর গড়ে উঠেছে। প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি চত্বর যেন ইতিহাসের সাক্ষী। মৎস্যকন্যার মতোই ওয়ারশ আজও তার মানুষদের পাহারা দিচ্ছে—ঢাল ও তরবারি হাতে।

মাহামুদুল হাসান