Skip to content Skip to footer

দিল্লি: স্মৃতি ও সমৃদ্ধির নগরী

অনেক প্রাচীনকাল থেকেই নানা সাম্রাজ্য ও ইতিহাসের সাক্ষী ভারতের রাজধানী দিল্লি। সাতবার ধ্বংসের পর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এই প্রাচীন নগরীর কথা মহাভারতে ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ হিসেবে উল্লেখ আছে। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নামে নামকরণ হয়ে শাহজাহানাবাদ নামে পরিচিত এই শহর মুগ্ধ করেছে বহু বিদেশী লেখককে, যেমন উইলিয়াম ড্যালেরেম্পেল, যিনি দিল্লি: দ্য সিটি অব জ্বিনস বইটির লেখক। ওবেরয়, ম্যারিয়ট বা তাজ হোটেলের বিলাসিতার সাথে এখানে রয়েছে ৭–৫শ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক নিদর্শণ।

গত বছরের আগস্টে, ঢাকা থেকে সহকর্মী তৌহিদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বাৎসরিক ছুটির জন্য মেঘলা আকাশে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করি। অনলাইনে ঠিক করা হোটেলের উদ্দেশ্যে শাটল বাসে চেপে যাত্রা শুরু করতেই পড়তে হলো রাজধানীর জ্যামে। দুপুর নাগাদ পৌছে গেলাম পাহাড়গঞ্জের হোটেলে।

পৌছানোর পথে নজর কাড়ল জমকালো কনট প্লেস, দিল্লির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র, যেখানে গ্রেগোরিয়ান ধাঁচের দালান ও আধুনিক ব্র্যান্ডগুলো ভারতের উন্নত দিক তুলে ধরছিল। হোটেলে ব্যাগ রেখে বের হয়ে আমরা গেলাম দিল্লি জামে মসজিদের পাশের মোঘলাই খাবারের স্বাদ নিতে। প্রথমবারের মতো পাতালরেল চড়ে ১০–১৫ মিনিটে পৌছে গেলাম।

আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল করিম’স রেস্তোরাঁ, যা ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাস মুঘল রসুইখানার পাচক। মেন্যুতেই নানা ঐতিহ্যবাহী আইটেমের নাম আজও বহন করে—মুসল্লম-ই-জাহাঙ্গীরি, মুর্গ মালাই টিক্কা, পনির টিক্কা, দিলপসন্দ কাবাব, পেশোয়ারী কাবাব। সঙ্গে বৃটিশদের ভেজিটেবল স্ট্যু দেখে আবিষ্কৃত মাটন ইস্ট্যু, ঝুরঝুরে রুমালী টাইপ রুটি। শেষ পর্যায়ে ঘন মাখন, বিভিন্ন ফল, কিসমিস ও জাফরান দিয়ে তৈরি দৌলাত-কি-চাট

এরপর আমরা কালে সাক্ষী দিল্লি জামে মসজিদে উঠলাম। এখানে একসাথে ২৫,০০০ জন নামাজ পড়তে পারে। ১৩৫ ফুট উঁচু সাদা গম্বুজের এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল ১৬৫০–৫৬ সালের মধ্যে। সম্রাট শাহজাহানের এই অমর কীর্তি মুসলিম ঐতিহ্যের সৌন্দর্যের নিদর্শন।

দিল্লির তিন রূপ

দিল্লির তিনটি রূপ আছে— নিউ দিল্লি, পুরনো দিল্লি ও বৃটিশ দিল্লি।
১৬৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত শাহজাহানাবাদ বা পুরনো মুঘল দিল্লি এখনো লাল কেল্লা, ফতেপুরী মসজিদ, রাজিয়া সুলতানার কবরসহ বহু ঐতিহাসিক নিদর্শণ বহন করে। এছাড়া খারী বাউলি, রাজঘাট, চাদনী চক ও অনেক মুঘল যুগের হাভেলী এখানে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল লাল কেল্লা, যা মাত্র ১০ মিনিট হাটার দূরত্বে। চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় অসাম্প্রদায়িক দৃশ্য—দিল্লি জামে মসজিদ, শিখদের গুরুদুয়ারা, বিড়লা মন্দির ও গির্জা। লাল কেল্লার চারপাশের পরিখা ধরে ঘুরতে গিয়ে দেখা যায় ২৫৪.৬৭ একরের এলাকা। তেরঙ্গা পতাকা উড়ছে, এবং ভারতের জাতীয় নেতাদের বক্তৃতার স্থান এখানে।

লাহোরি গেট দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ল ‘ছাতি চক’, যেখানে প্রাচীন কালের মসলা, সিল্ক ও অলংকারের বাজার। এর পাশে নিহিত নহবতখানা, যেখানে রাজদরবারে অতিথিদের জন্য সংগীত বাজত। একই গেটে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সম্রাট জাহান্দার শাহ ও ফররুখশিয়র।

দেওয়ান-ই-আম বা সাধারণ জনগণের মিলনস্থলে রয়েছে কাচে ঘেরা সম্রাট আওরংজেবের সিংহাসন, যার স্বর্ণ ও হাতির দাঁতের ইউরোপীয় কারুকাজ ফ্লোরেন্সের শিল্পী অস্টন দ্য বরদেয়ুর দ্বারা তৈরি। এরপর দর্শন করলাম রং মহল, খাস মহল, দেওয়ান-ই-খাস, তুর্কী প্যাটার্নে হাম্মাম খানা, হায়াত বখশ বাগান ও মতি মসজিদ।

সিপাহী বিদ্রোহের পর বৃটিশেরা কেল্লার ভেতরে ব্যারাক তৈরি করেছিল। শ’খানেক রুপিতে রাতের লাইট ও সাউন্ড শো উপভোগ করা যায়। চাঁদের আলোতে মার্বেলের সাদা মতি মহল, হিরা মহল ও মুমতাজ মহল স্বপ্নীল দেখায়।

পরের দিনের যাত্রা

পরের ভোরে আমরা গরম আলু পরোটা, চাট ও টক দই খেয়ে দিল্লি ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস এর প্যাকেজে রওনা হই। আমাদের গাইড ছিলেন হাসিখুশি, দক্ষিণী নায়কের মত গোঁফ ও হালকা ভুঁড়িওয়ালা অতুল পান্ডে।

নিউ দিল্লির সবুজে মোড়া, উন্নত দেশের ধাঁচের এলাকা দেখে বিশ্বাস করা মুশকিল যে এখানে ধুলির ঝড় ও বায়ুদূষণও রয়েছে।

প্রথম আকর্ষণ ছিল বিড়লা মন্দির, যা মহাত্মা গান্ধী উদ্বোধন করেছিলেন। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, লোকসভা, সামরিক সদর দপ্তর ও বিজেপির প্রধান কার্যালয় দেখলাম।

এরপর পৌছে গেলাম কুতুব মিনার ও এর আশেপাশের প্রাচীন স্থাপনাসমূহ—আলাউদ্দিন খিলজীর কবর, দিল্লির প্রথম মাদ্রাসা, সরাইখানা, আরবী ক্যালিগ্রাফি ও সালতানাতের স্থাপনা। কুতুব মিনারের পাশে আছে আলাই মিনার, যা আলাউদ্দিন খিলজী শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

পরের গন্তব্য ছিল সফদর জংয়ের সমাধি, নবাব সুজা উদ্দৌলের পিতার স্মরণে ১৭৫৩–৫৪ সালে নির্মিত। চারপাশে চারটি গম্বুজ রয়েছে। এরপর আমরা গেলাম মহাত্মা গান্ধীর বাড়ি ও দাহস্থান রাজঘাট। গান্ধীজির ব্যবহার্য্য চরকা, চশমা, কাপড়, চৌকি ও অহিংস আন্দোলনের চিত্রাবলী সংরক্ষিত। যেখানে গান্ধীজিকে গুলি করা হয়েছিল, সেখানে খোদিত আছে তাঁর শেষ শব্দ: “হে রাম, হে ভগবান।”

দিন শেষে পুরানা কেল্লা ও সম্রাট হুমায়ূনের সমাধি ঘুরলাম। স্থাপত্য তাজমহল দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও সামনের স্তম্ভ ও লাল পাথরের ব্যবহার পার্থক্য নির্দেশ করে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, সম্রাট হুমায়ূন প্রথমে তুঘলতাবাদের পুরানা কেল্লায় সমাহিত হন, পরে স্ত্রী হামিদা বানু নতুন সমাধি স্থাপন করেন।

ফেরার পথে খেয়াল করলাম, সারাদিন যথেষ্ট খাওয়া হয়নি। বৃষ্টির পরে ডুবন্ত সূর্য ফ্রান্সের ‘আর্ক অফ ট্রায়াম্ফ’ এর আদলে বানানো ইন্ডিয়া গেট-এ পড়ল। আমাদের যাত্রা শেষ হল স্যার এডউইন লুটিয়েন্সের হাতে গড়া ব্রিটিশ দিল্লিতে, যেখানে এখন আধুনিক ব্র্যান্ডের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়—অ্যাডিডাস, ম্যাকডোনাল্ডস, টিফানীস, লুই ভুটোন।

রাতের দিল্লিতে খুঁজে পাওয়া গেল শাহী লাচ্ছি, চাট ও ঝকঝকে শপিং মল। এই শহর একদিন ভিস্তিওয়ালা ও ক্রীতদাসকেও সম্রাট হতে দেখেছে, আবার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দাফনের জন্য মাটিও যোগ করতে পারেনি।

লেখক পরিচিতি:
নাম: মুনতাসির রশিদ খান
জন্ম: ৩০ মে, ১৯৯০, টাংগাইল জেলা
পেশায় ব্যাংকার হলেও দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মানুষের বৈচিত্র্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ রয়েছে। দেশ ও বিদেশে ভ্রমণ করে প্রাচীন নিদর্শণ, জমিদার বাড়ি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্বেষণ করেন।