Skip to content Skip to footer

যাই মধু আহরণে

মুস্তাফিজ মামুন
এবার সুন্দরবনে ১ এপ্রিল থেকে মধু সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে, চলবে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত। গ্রামে ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যায় বাজারে গেলাম। কড়াইয়ে গরম মিষ্টি দেখে হানা লোভ সামলাতে পারছিল না। দুজনে প্রথমে একটি করে ছানার জিলাপি খেলাম। হানা পরে আরো তিনটি খেয়েছিল। হানাও সাংবাদিক। চেক প্রজাতন্ত্রে তার বাড়ি।
বুড়িগোয়ালিনীতে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আমরা লঞ্চে ফিরলাম। এখানে অনেক মশা। সাফসুতরো হয়ে ওডোমস মেখে বসে রইলাম। রাতের খাবারও খেয়ে নিলাম আগেভাগেই। বেঙ্গল ট্যুরসের লঞ্চে করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সদর কার্যালয় বুড়িগোয়ালিনীতে এসেছি আমরা খুলনা থেকে।
লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দে ঘুম ভাঙল। জেগে দেখি, চলতে শুরু করেছে। চালকের নাম সঞ্জয়। জানাল, সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ যাচ্ছি। নদীটার নাম চুনা। ঢাকা থেকে রাতের বাসে দলের অন্যরা ওখানে আসবে। মুন্সীগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগল। লঞ্চ থামল বন কার্যালয়ের সামনে। গিয়ে দেখি দল হাজির। বিটু ভাই ও সালমানকে দেখলাম আগে। সবাইকে লঞ্চে তুলে আবার চললাম বুড়িগোয়ালিনী। পৌঁছে দেখি, মৌয়ালরা আটঘাট বাঁধছে। জানাল, আরো ঘণ্টা দুই লাগবে।
বছর কয় আগে প্রথম যখন মধু সংগ্রহ দেখতে গিয়েছিলাম সুন্দরবন, চমৎকার একটি উৎসব হতো তখন- সবাই মিলে প্রার্থনায় বসত, বন কর্মকর্তা বন্দুক হাতে দাঁড়াতেন জেটিতে, নৌকাগুলো বাঁধা থাকত পর পর। আনুষ্ঠানিকতা শেষে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়তেন কর্মকর্তা আর মৌয়ালরা জোর বৈঠা চালিয়ে ছুটে যেতেন বনে।
এখন আর তেমন হয় না। বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মীরা পট গানের মধ্য দিয়ে সচেতনতামূলক তথ্য দিল মৌয়ালদের। তারপর বনে চললাম। ঢালী চাচা আমাদের লঞ্চের সঙ্গে তাঁর নৌকাটি বেঁধে নিলেন। ঢালী চাচার মধু সংগ্রহের অভিজ্ঞতা ষাট বছরের। ডিসকভারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে।
খোলপেটুয়া নদী ধরে ঘণ্টাখানেক চলার পর ঢুকলাম ছোট্ট একটি খালে। নাম বুড়ির খাল। লঞ্চ নোঙর ফেলল। ঢালী চাচার দলের সঙ্গে আমরাও নৌকায় উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ চলার পর জঙ্গল শুরু হলো। মৌয়ালরা গেল চাক খুঁজতে, আমরা রইলাম বন প্রহরীদের সঙ্গে।
মিনিট দশেক পর আওয়াজ পেলাম ‘আল্লাহ আল্লাহ বলো রে’। ঢালী চাচার ছেলে মনিরুল দৌড়ে এলো- স্যার চাক পাওয়া গ্যাছে, ম্যালা বড়, পাঁচ কেজি মুধু হইব। আমরা চললাম মনিরুলের সঙ্গে।
মৌয়ালদের একজন টাইগার ফার্ন কেটে মশালের মতো তৈরি করলেন। এর ধোঁয়া দিয়ে চাক থেকে মৌমাছি তাড়ানো হয়। আমাদেরও মশারির জাল দিয়ে তৈরি মুখোশ দেওয়া হলো। মশালে আগুন দেওয়া হয়েছে, ধোঁয়া বের হচ্ছে।
মনিরুল মশাল নিয়ে উঠে গেল গাছে। মৌমাছিরা বেশি বেগড়বাই করল না, রণে ভঙ্গ দিল অল্প সময়েই। অভিযান সফল হলো। চাক কেটে ধামায় ভরে নিলেন মৌয়ালরা। জঙ্গলেই খাওয়া হয়ে গেল পুরোটা মধু।
একটু জিরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় চাকের খোঁজে গেল মৌয়ালরা। আমরা নৌকায় অপেক্ষায় থাকলাম। এবারও কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক এলো। গেলাম চাকের গাছে। কিন্তু ঢালী চাচা চাক না কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ আগেই চোরা শিকারিরা এক দফা ছুরি চালিয়েছে। সবাইকে চাক থেকে দূরে থাকতে বললেন চাচা। জানালেন, কাটা চাকের মৌমাছিরা খুব হিংস্র হয়। কিন্তু এত বড় চাক দেখে আমি আর সালমান ছবি তোলার লোভ সামলাতে পালাম না। ভালো কয়েকটা ছবিও তুললাম। হঠাৎ ভন ভন শব্দ! তাকিয়ে দেখি, পুরো চাক হামলে পড়েছে সালমানের ওপর। আমার মুখোশ ছিল। তার পরও হাতমোজার ওপর দিয়ে সমানে কামড়াচ্ছিল। সালমানের হাতমোজা নেই, মুখোশও নেই।
চিৎকার শুনে বেঙ্গল ট্যুরসের কর্মী সোহাগ সারা গায়ে কাদা মাটি মেখে দৌড়ে এলো। জড়িয়ে ধরল সালমানকে। নিয়ে তুলল নৌকায়। অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে নিতে হবে। জঙ্গল ছেড়ে সবাই গিয়ে লঞ্চে উঠলাম। সোজা গেলাম বুড়িগোয়ালিনী বিজিবি হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার সালমানকে ছেড়ে দিলেন দুপুরে। খাবার খেয়ে সবাই গেলাম বিশ্রামে।
দুপুরের পর আবারও চাক কাটতে বের হলাম। সালমান নাছোড়বান্দা। বারণ সত্ত্বেও সঙ্গে চলল। এ যাত্রায় বেশ কয়েকটি চাক কাটা হলো। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম লঞ্চে। রাতে নোঙর ফেলা হলো কলাগাছিয়া অভয়ারণ্যের সামনে।
পরদিন খুব ভোরে আবারও জঙ্গলে গেলাম। তবে এবার চাক কাটতে নয়, বন দেখতে। কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে নেমে কাঠের ট্রেইল ধরে হাঁটলাম ঘণ্টাখানেক। বন মোরগ এত কাছে পেয়েও ছবি তুলতে না পেরে আফসোস করলাম! বেশ কিছু বানর, চিত্রা হরিণও দেখলাম এখানে। ভ্রমণটা বেশ উপভোগ্য ছিল। এই লেখায় মধু সংগ্রহের স্মৃতি চারণ করা গেল। বাকীটা অন্যকোনো দিনে অন্যকোনো খানে।