Skip to content Skip to footer

আকাশ-পাহাড় আর পাথর-নদীর মিতালী

নিজামুল হক বিপুল
আমাদের দেশটা বরাবরই উৎসবের দেশ। নানান উৎসব লেগে থাকে বারো মাস। ঈদ, পূজা-পার্বন, বৈশাখি উৎসবের বাইরে আরো কত রকমের উৎসব থাকে। চৈত্র্য সংক্রান্তি, বারুণি মেলা, পৌষমেলা, মাছের মেলা, হরেক রকম মেলা আর উৎসব। ছোটবেলায় এসব উৎসবের অপেক্ষায় থাকতাম আর দল বেঁধে চলে যেতাম মেলায়। মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ আর হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের দূর্গা পূজা হচ্ছে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।
গত হওয়া বছরে ঈদ উৎসবে বাগড়া দিয়েছিল ‘ডেঙ্গু’ নামের রোগ। মশার কামড় যে মানুষের জীবননাশী হয়, জীবনকে বিপন্ন করে তোলে- ডেঙ্গু হচ্ছে তার প্রামাণ্য উদাহরণ। ২০১৯ সালের কুরবানী ঈদে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে মা, ভাই-বোন আর আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করা সম্ভব হয়নি।
মন পড়েছিল গ্রামেই। যেখানে আমার নাড়ী পুঁতা। গ্রামের আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছি। সেখানকার মাটিতে শীতের শিশির ভেজা সকালে আমি দৌড়ে বেড়াতাম। সে স্মৃতিমাখা জনপদে যাবার জন্য মন উচাটন করছিল। দুই সন্তানও প্রতিনিয়ত গ্রামে যাওয়ার জন্য অস্থির ছিল। তার অন্যতম কারণ হলো, গ্রামে গেলেই যে ক’দিন থাকি প্রায় প্রতিদিনই প্রকৃতির লীলাভূমি বৃহত্তর সিলেটের কোন না কোন দর্শনীয় এলাকা ঘুরে বেড়ানো হয়। ফিরে এসে সন্তানদের সে সব এলাকার গল্প বলি, শুনে তাদের আবার নানা প্রশ্ন থাকে। এগুলো আমাকে বরাবরই আন্দোলিত করে।
এবার শেষ পর্যন্ত আমরা যেতে পেরেছিলাম। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেই মৌলভীবাজারে যাই। গ্রামের বাড়ি রাজনগরে পা রেখেই অন্যরকম এক ভালোলাগা, অনুভূতি…। পরের দিন ছুটে গেলাম সিলেটের সীমান্ত জনপদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ। যেখানে পাহাড়, পাথর, শীতল-স্বচ্চ জলের নদী, আর আকাশ মিলে হয়েছে একাকার। এক কথায় আকাশ-পাহাড়,পাথর আর নদীর মনোহর মিতালী।
সরু একটি নদী। তার দু’টি নাম। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বের হয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে। সীমান্তের ওপারে সে নদী ‘ছেলা বা চেলা নদী’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রবেশ করেই সে নাম পরিবর্তন করে হয়ে গেছে ‘ধলাই’ নদী। দুই দেশে দুই নামের সে নদী দিয়েই ছলাৎ ছলাৎ শব্দে গড়িয়ে আসছে শীতল জল পাথরের ধার ভেঙ্গে। নদীর পুরোটা জুড়ে শুধু পাথর আর পাথর। কোনটা অতিকায় ছোট আবার কোনটা বিশাল বিশাল। আছে নানান সাইজের নুড়িও। বাহারী তাদের রং। বর্ণ আর আকারের এসব পাথর প্রতিনিয়তই পানির শ্রোতের সঙ্গে গড়িয়ে আসছে বাংলাদেশে। ঝক্ঝকে স্বচ্চ জলের তিন-চার ফুট কোথাওবা আরও একটু গভীরে চোখ রাখেলেই দেখা যায় সে পাথরের রাজ্য। জলের নিচে শান বাধানো ঘাটের মতোই অনেকটা পিচ্ছিল সে পথ। চোখ ধাঁধানো তার সৌন্দর্য্য। সে জলে ছোট ছোট মাছের দেখাও মিলে। যেন উন্মুক্ত একুরিয়াম।
ভোলাগঞ্জে স্বচ্চ শীতল জলে পা রাখলে আপনার মন মুহুর্তেই ভালো হয়ে যাবে। আপনি এক অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করবেন ক্ষণিকের জন্য হলেও। সব চিন্তা উবে যাবে। ঠান্ডা হজম করতে পারলে আপনি সে জলে সাঁতারও কাটতে পারবেন। কয়েক মুহুর্ত কাটিয়ে দিতে পারবেন অবলীলায়। তবে সাবধান, ওপাড়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীর শীতল জলে শ্রোত আছে প্রবল। তার উপর পিচ্ছিল পাথর। একটু ভুল হলেও খেসারত দিতে হতে পারে।
ধলই নদীর আরেক পাড়ে একেবারে জিরো পয়েন্টে গেলে সেখানে দেখা মিলবে এই পাথরের রাজ্যের। বিস্তৃীর্ণ এলাকা জুড়ে প্রকৃতি যেন নিজহাতে সে পাথর সাজিয়ে রেখেছে । সে পাথরে হাঁটতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারবেন না কিন্তু, কারণ পাথরগুলো তখন প্রচন্ড রোদে উত্তপ্ত হয়ে থাকে। এই পাথরের রাজ্য থেকে আপনাকে ওপারের সবুজ পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকবে। চাইলেও হয়তো যেতে পারবেন না কারণ মানুষের তৈরী বৈৗগুলিক নিয়ম আমাদের প্রকৃতির কাছে যেতে কখনো কখনো বাঁধা দিয়ে থাকে। এখানেও সিমান্তীক সীমাবদ্ধতা আপনাকে সে পাহাড়ের কাছে যেতে বারণ করবে। মনে রাখবেন, এই পথ ধরে ঘুর্ণাক্ষরেও জিরো পয়েন্ট ক্রস করা যাবে না। পাহাড়ের পাদদেশে যাওয়া যাবে না। কারণ ওপাড়ে আছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা। আছে কাঁটাতারের বেড়াও।
ছবির মত ঝকঝকে দৃশ্যের অনিন্দ্য সুন্দর এই ট্যুরিস্ট স্পট দেখতে খুব ভোরে আমরা রাজনগর থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম। সঙ্গী আমার স্ত্রী, দুই কন্যা রূদবা, রুধীরা আর ভাতিজি মিশমি ও ভাতিজা ইয়াফি। নিজে ছিলাম চালকের আসনে। সিলেট শহরে পৌঁছার পর চা পানের বিরতি সাংবাদিক নাজমুল কবীর পাভেল এর বাসায়। স্বল্প সময়ের মধ্যে ভাবীর আন্তরিক আতিথেয়তা পর পাভেলকে সঙ্গী করে ছুটলাম ভোলাগঞ্জের পথে। শহরের আম্বরখানা থেকে বিমানবন্দর সড়ক ধরে ছুটছে গাড়ি। লাক্কাতুরা, মালনিছড়া চা বাগানের ভিতর দিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর সব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের ছুটে চলা।
তখন আজেকর মত এতো সুন্দর পাকা সড়ক ছিল না। ওসমানি বিমানবন্দর লাগোয়া চেঙ্গের খালের উপর ছিল না কোন সেতু। অনেক কষ্ট হত, সময়ও ব্যয় হত। কিন্তু এখন বিমানবন্দর পুরোটাই প্রাচীরে ঘেরা। বিমাবন্দরের পাশ দিয়েই নির্মাণ হয়েছে চার লেনের সড়ক। পিচ ঢালা পথ নয়। একেবারে কংক্রিটের তৈরি সড়ক। এমন সড়কে গাড়ি চালানোর মজাই আলাদা। সাঁ সাঁ শব্দে ছুটছে ফোর হুইলার…। বিমানবন্দর থেকে ভোলাগঞ্জের দিকে যতই অগ্রসর হচ্ছি দূরের সবুজ পাহাড় যেন ততোই কাছে চলে আসছে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে সে পাহাড়ের অনেক স্থানে জলপ্রপাত…। পানি গড়িয়ে পড়ছে…। তার সঙ্গে আবার সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ যেতে রাস্তার দুই পাশে দেখা মিলে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার অসংখ্য গ্রামের। সবুজে ঘেরা, পাখি ডাকা গ্রাম। সে সব গ্রামের ছোট চোট বাচ্চারা রাস্তার পাশেই খেলায় মগ্ন। কেউবা ফুটবল, কেউবা হা ডু ডু, আবার কেউবা অন্য কোন খেলায় মগ্ন। বাচ্চাদের এমন গ্রামীণ খেলা দৃশ্য দেখে নিজের শৈশবের সে ছবিগুলোই ভেসে উঠে চোখের সামনে।
সিলেট শহর থেকে টানা প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম একেবারেই ভোলাগঞ্জ। মাথার উপর সূর্য, কাঠ ফাটা রোদ। তারমধ্যেই একটি নৌকা ভাড়া করা হল। নদী পথে একেবারে সাদা পাথর এলাকায় পৌঁছার জন্য। মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কাংখিত গন্তব্যে।
এই সাদা পাথর এলাকা বহুদিনের পরিচিত। আমার একবার যাবার সুযোগ হয়েছিল ২০০০ সালের দিকে। তখন সাপ্তাহিক ২০০০ এ কাজ করি। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি নিয়ে রিপোর্ট করতে প্রথম বারের মত ওই এলাকায় যাই। তখন আজকের মত চেহারা ছিল না। ঠিক ছবির মত ছিল পুরো ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকা। যেন সাদায় ছেয়ে আছে চারদিক। অদূরে পাথর শ্রমিকরা ছোট ছোট নৌকায় করে নদী থেকে পাথর আহরণ করতো। তখনকার সে অপূর্ব সূন্দর দৃশ্য এখনও আমার মনসপটে ভেসে উঠে ঠিক সাদা পাথর এলাকার স্বচ্চ জলের মত।
এবারও দেখলাম পাথর শ্রমিকরা পাথর আহরণের কাজেই ব্যস্ত। এবার চোখে সাদা পাথর সংলগ্ন এলাকায়ও পাথর আহরণ চলছে দেদারছে। কোন নিয়মনীতির বালাই নেই। এমন দৃশ্য দেখে কিছুটা আতংকিত না হওয়ার কারণ নেই। যে কোন পর্যটকই আতংকিত হবেন। যদি এভাবেই পাথর আহরণ চলতে থাকে তাহলে এক সময় হয়তো হারিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক পর্যটন স্পটি। থাকবে না বুক ভরা নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গাটি। তাই সরকারের উচিত হবে দ্রুত এটিকের রক্ষা করা। এখান থেকে পর্যটন খাতকে উন্নত করতে পারলে দেশের অর্থনীতিই সমৃদ্ধ হবে।
শান্তির প্রতীক সাদা আর কঠোরতার জন্য আমরা পাথর শব্দটা ব্যবহার করি। সাদা ও কঠোর দুয়ে মিলে হয় কঠোর শান্তি। কঠোর শান্তির সাদা পাথরের প্রতি বুক ভরা ভালোবাসা জানিয়েই এখানেই ইতি।