Skip to content Skip to footer

শান্তি, ফিরে এসো

‘এদের কি সবই সুন্দর? এই পাহাড়, উপত্যকা, চিনার গাছ, টিউলিপ, জাফরান, আপেল, গোলাপ আর লাবণ্যমাখা সুন্দর মুখ – প্রকৃতি যেন এদের উজাড় করে সাজিয়েছে। কিন্তু, পৃথিবীর এই স্বর্গে এত বারুদের গন্ধ কেন? কেন এত রক্ত, এত আশান্তি?’
ভেরিনাগের বাগানে বসে এইসব এলোমেলো ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কাশ্মীর উপত্যকা কি গোলাগুলি, কার্ফু, আর্মি – এই করেই শেষ হয়ে যাবে? কিছুক্ষণ আগেই আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইড বিট্টু সিং-এর সঙ্গে ট্যুর প্ল্যান বানাচ্ছিলাম। সে তো উলার হ্রদটা তালিকা থেকে কেটে বাদ দিয়ে দিল। বলল, ওপথে পর্যটকদের জন্য সেনাবাহিনীর নিষেধাজ্ঞা আছে। মন খারাপ হয়ে গেল। এ পর্বের যাত্রায় ডাল লেক, নাগিন লেক আর মানসবল লেক দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।নিজের দেশের সীমানার মধ্যে ইচ্ছেডানা মেলার অধিকারটুকুও আমাদের নেই।
গোলাগুলির ভয় কাটিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে এসেছি। ভেরিনাগের বাগানে মখমলে সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে ডিজিট্যাল ক্যামেরার স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। দুপুরেই ‘টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট’ এর দৃষ্টিনন্দন শোভা বন্দী করেছি ক্যামেরায়। দূরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো। তারই পাদদেশে সুবিস্তৃত উপত্যকায় পাকা ধানের খেত আর জোতগুলোকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে আছে লম্বা লম্বা পাইন গাছ। যেন হলদে ক্যানভাসে গাঢ় সবুজ প্যাস্টেল রঙ দিয়ে কেউ ত্রিভুজ, বহুভুজ, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র প্রভৃতি জ্যামিতিক আকার তৈরি করেছে। এক অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ।
ভেরিনাগের এই উদ্যানটি কাশ্মীর উপত্যকার মোগল উদ্যানগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার মতো হবে। শুধু উদ্যান নয়, ৫৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ভেরিনাগ আসলে ঝিলাম নদীর উৎস। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তৈরি করেন এই উদ্যান। ভেরিনাগ থেকে ফেরার পথেই রাজওয়ারী তালুকে মারা যান সম্রাট। বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি এই উদ্যানে রংবাহারী ফুল, প্রজাপতি আর সবুজের সমারোহ। চারপাশ নির্জন পাহাড়ে ঘেরা। পাহাড়ের নামও ভেরিনাগ। পুর্বে এর নাম ছিল নীলনাগ। কথিত আছে-বিরাটাকার এক সাপ বাস করত এখানে।
পাহাড়ের পাদদেশে ঝরনার কাছে চলে এলাম। আটকোণা চত্ত্বর থেকে জল বেরিয়ে এসে জমা হয়েছে গোলাকার এক জলাশয়ে। এই জলাশয়ের চারপাশ ঘিরে মোগল আঙ্গিকে তৈরি হয়েছে এক স্থাপত্য। গোধুলি বেলায় জলাশয়ের বুকে এই স্থাপত্যের প্রতিচ্ছবি খুবই সুন্দর লাগছে। স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ট্রাউট মাছ।
স্থানীয় মানুষের বৈকালিক আড্ডা, শিশুদের হুটোপুটি, কেউ বা তার মায়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাদের লাল টুকটুকে গাল দেখে মনে হচ্ছে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা আপেল। আর তাদের মায়েদের দেখে বেশ বোঝাই যাচ্ছে, এ মুলুকে ফেয়ারনেস ক্রিমের বাজার একেবারেই মন্দা।
নিঝুম সন্ধ্যা ধীরে ধীরে চারপাশটা ঘিরে ধরেছে। আমরাও বেরিয়ে এলাম। আবার গাড়িতে উঠে চলা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনন্তনাগ শহর পেরিয়ে এবার পৌঁছতে হবে পহেলগাম।
পহেলগাম যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন প্রায় রাত ৮টা বাজে। এখনই মনে হচ্ছে সমগ্র অঞ্চলটা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দোকানপাট বেশিরভাগই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো খোলা আছে, মালিকরা ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। হাতে গোনা কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে।
জমজমাট অঞ্চলটা ছেড়ে আরও প্রায় ১ কিলোমিটার এগিয়ে গাড়ি থামল লিডার নদীর ধারে একটা ছোট্ট কাঠের সেতুর কাছে। সেতুটা পেরোলেই একটা খুব সুন্দর লজ। এখানেই আজ আমাদের নিশিযাপন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব বেশিদিনের নয়। দেওয়ালের গায়ে এখনও নতুনত্বের গন্ধ লেগে আছে। এ তল্লাটে হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁ প্রায় নেই বললেই চলে। বরং স্থানীয় মানুষদের বাড়িঘরই বেশি।
জম্মু পৌঁছনোর কয়েকটা স্টেশন আগে থেকেই সমস্ত প্রি-পেইড মোবাইল পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়টা আগে থেকে জানাও ছিল না। কলকাতার সঙ্গে দুদিন ধরে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বেশ কিছু জরুরি ফোন করা খুবই আবশ্যিক। অগত্যা পাবলিক বুথের উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই।
হোটেলে রিশেপসনের ফোনটা আস্থায়ীভাবে দেহ রেখেছে। লাগেজপত্র রেখেই প্রথম ও প্রধান কাজ যেটা, সেটা হল ফোন করতে বেরোনো। ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে আটটা ছুঁই ছুঁই। হোটেল ম্যানেজার জানালেন, কাছেই একটা মুদির দোকানে পাবলিক ফোনের ব্যবস্থা আছে। সেটা একটু বেশি রাত পর্যন্তই খোলা থাকে। এখনই গেলে হয়ত খোলা পাওয়া যাবে। সুতরাং বেশি দেরি না করে আমি আর বাবা বেরিয়ে পড়লাম।
কপাল মন্দ থাকলে যা হয়, দোকান বন্ধ। সামনের এক চিলতে বারান্দাটায় দুজন অল্প বয়সী ছেলে দাবা খেলছে। আমরা এসটিডি করতে চাই শুনে একজন বলল, ‘দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে, কাল সকাল ন’টা নাগাদ খুলবে।’
কি আর করি? ফিরে যাব বলে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় ছেলেটি পিছন থেকে ডাকল, ‘শুনিয়ে, আরজেন্ট ফোন? আইয়ে মেরে সাথ।’
ফোন করাটা সেই মুহূর্তে এতটাই গুরুত্বপুর্ণ ছিল যে কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কী তার উদ্দেশ্য – কিছুই চিন্তা করলাম না। সরু গলি দিয়ে ছেলেটির পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে ছোটো ছোটো স্থানীয় বাড়ি, অন্ধকার সরু পথ। এবার একটু ‘ভয় ভয়’ করতে লাগল। ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকালাম। দৃঢ় দৃষ্টিতে বাবা ইশারা করে যেন বলতে চাইল, ‘দেখাই যাক না, কী হয়।’
অশান্তির রাজ্য কাশ্মীরে স্থানীয় সদ্য পরিচিত একটা ছেলের সঙ্গে রাত্রে এই নির্জন গলিপথে কোথায় চলেছি কে জানে? সন্ত্রাসবাদীর আখড়ায় নিয়ে যাচ্ছে না তো? আমরা কিডন্যাপড হয়ে যাব না তো? র্ধু! যত্তোসব আজেবাজে চিন্তা। বিট্টুজী স্থানীয় লোক। ওকে সঙ্গে আনলেই ভালো হতো। তবে, সে হয়ত সারাদিন গাড়ি চালানোর পর এখন বিশ্রাম নিচ্ছে, তাকেও তো বিরক্ত করা ঠিক হতো না।
প্রায় মিনিট সাতেক হাঁটার পর একটা বড় উঠোন পার হয়ে একটা দোতলা  বাড়ির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে ছেলেটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। বেশ বুঝতে পারছি, প্রবল ঠাণ্ডাতেও আমার কপালে ঘামের ফোঁটা। দু মিনিটের মধ্যে ছেলেটি বেরিয়ে এল এবং আমাদের ভেতরে ডাকল, ‘অন্দর আইয়ে।’
একটা ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুম। সোফায় আমাদের বসতে বলে ছেলেটি আবার চলে গেল। ফিরন পরা একটা সুন্দর মুখ ঘরের পর্দা ফাঁক করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে উঁকি দিয়েই চলে গেল। একটু পরেই ছেলেটির সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন ভীষণ হ্যান্ডসাম ষাট ছুঁই ছুঁই এক ভদ্রলোক। ছেলেটি তার আব্বুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি বললেন, ‘ওটা আমারই দোকান।আপনাদের যখন আরজেন্ট কল করার আছে, আমার মোবাইল থেকেই ফোন করুন।’
খান পাঁচেক এসটিডি হল কলকাতায়। ততক্ষণে ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছে।ভয়টাও কেটে গেছে। ওর নাম রিয়াজ, অনন্তনাগ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। হস্টেলে থাকে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। রিয়াজের আব্বু ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা পেমেন্ট করব বলে ওনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
উনি ঘরে ঢুকলেন, হাতে একটা ঠোঙা। ওদের বাড়ির গাছের আখরোট খাওয়ার জন্য দিলেন। শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও ফোনের জন্য একটা টাকাও নিলেন না। ওনার একই কথা, ‘আপনারা মেহমান। যদি দোকান থেকে ফোন করতেন আলাদা ব্যাপার ছিল। কিন্তু, আপনারা আমার বাড়িতে এসেছেন। অসুবিধায় পড়েছেন, এটুকু সাহায্য করব না?’
এর মধ্যেই চা এসে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নানান প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও এর থেকে বাদ গেল না। কথা প্রসঙ্গে রিয়াজ বলল, ‘আপনারা, মানে দেশের অন্য রাজ্যের মানুষরা সবাই ভাবেন, কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসবাদী। কিন্তু, সবাই তো তা নই। আমরা সাধারণ মানুষ, শান্তিতে থাকতে চাই।’
মনে মনে খুব খারাপ লাগল। আমিও তো তাই ভাবছিলাম। লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘ছিঃ! ছি! তা ভাববো কেন? কোনো দেশের সাধারণ মানুষই রক্তারক্তি, সন্ত্রাস, অশান্তি চায় না। কিছু মানুষের অপরাধের দায় চাপে সমগ্র সম্প্রদায়ের উপর।’
কথায় কথায় রাত বেড়ে যাচ্ছে। এবার ওদের বাড়িতে ডিনার করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু হল। বাকীরা সবাই হোটেলে অপেক্ষা করছে, এই বলে শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া গেল। তবে কথা দিয়ে আসতে হল, পরদিন সকালের নাস্তা রিয়াজের বাড়িতেই করতে হবে। এই অতুলনীয় আপ্যায়ন ও আন্তরিকতায় চোখে জল এসে গেল।
অন্ধকার গলিপথটা ধরে রিয়াজ বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। চারপাশটা খুব স্নিগ্ধ লাগছে। বিকালে মনের মধ্যে যে ভাবনাগুলো জমাট বেঁধেছিল, তার অনেক উত্তরই যেন পেয়ে গেলাম। জানি, এত সহজ নয়। তবু মনে আশা জাগে। একদিন ঝড় থামবেই। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, কাশ্মীর তার শান্তির বার্তা ঘোষণা করে সত্যি সত্যিই ভূস্বর্গ হয়ে উঠবে।
লেখক পরিচিতিঃ
শ্রেয়সী লাহিড়ী
কলকাতায় ১৯৭৭ সালে জন্ম। দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখি ও ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণ-কাহিনী প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার  এক্সিকিউটিভ কমিটির প্রথম মহিলা সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো।