আমার সফরের শুরুতেই সঙ্গী হলো প্রায় আড়াই ফুট লম্বা একটি বটগাছের চারা। ছোট্ট এক টিনের কৌটায় লাগানো। ঘর থেকে বের হতেই মানুষের কৌতূহল – “এটা কিসের চারা?” কিংবা “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
সবাই বিস্মিত, কারণ বটগাছের চারা এভাবে যত্ন করে কেউ কোথাও নিয়ে যায়, এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। অথচ বাস্তবতা হলো—পথের ধারে বা দেয়ালের কোণায় অবহেলায়ই বটগাছ জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। এই অদম্য টিকে থাকার গুণেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার সফরের সঙ্গী করবে এই বটচারা। প্রায় দুই বছর ধরে বারান্দায় লালন করা এই চারাটি এবার চললো বঙ্গবন্ধু দ্বীপে।
আমার ভ্রমণ অভ্যাসেই আছে, যেখানে যাই সেখানেই একটা চারা রোপণ করি। সেই ভাবনা থেকেই বটগাছের এই ছানা এবার পাড়ি জমালো সুন্দরবনের বুকে জেগে ওঠা নতুন দ্বীপে।
বঙ্গবন্ধু দ্বীপ ভ্রমণের মূল পরিকল্পনা করেছিলেন বাকোর সেক্রেটারি জেনারেল তৌহিদ ভাই। আমি পুরো টিমকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, তবে নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল বনবিভাগের দুইজন অস্ত্রধারী প্রহরী।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে আমাদের দুটি দল মিলিত হয়—একদল মাইক্রোতে, আরেকদল বাসে। বাস ফেরিঘাটে আটকে পড়ায় আমরা আগে পৌঁছে বৃষ্টি রিসোর্টে কিছুটা সময় কাটালাম। রিসোর্টের সুবিধা ভালো হলেও আমরা গ্রামের হাটে ঘুরে খেয়ে নিলাম। সকালের নাস্তা হিসেবে জিলাপি আর পরোটা খেলাম এমনভাবে যে গোনারও সময় হয়নি! দোকানিকে শুধু বলেছিলাম—“খাবারের দাম আপনি আন্দাজ করে বলবেন।”
বিকেল নাগাদ বাসদল এসে পৌঁছালে সবাই মিলে রিসোর্ট থেকে ফ্রেশ হয়ে নৌকায় চড়লাম। দুপুরের খাবারের আয়োজন নৌকাতেই ছিল।
সুন্দরবনের পথে
দুটি নীল রঙের নৌকা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল। একপাশে ফুরিয়ে আসা লোকালয়, অন্যপাশে ঘন হতে থাকা বন। আকাশে ভিড় করছে কালো মেঘ। আমরা আয়োজকরা আবহাওয়া নিয়ে একটু চিন্তিত হলেও অন্যদের মন ছিল প্রকৃতির সৌন্দর্যে। নারী-শিশুসহ সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছিল নদী, বন আর মেঘেদের খেলা।
অন্ধকার ঘনিয়ে এলে নৌকার বাতাসে দুলুনি বাড়তে লাগলো। তবু কেউ খুব ভয় পায়নি। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যেন সব ভয় ঢেকে দিয়েছিল। চারপাশে নিরবতা, শুধু ইঞ্জিনের শব্দ নদীর বাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কোনো আলো নেই, নেই মানুষের অস্তিত্ব—শুধুই রহস্যময় নিস্তব্ধতা।
শেষ রাতে হিরণপয়েন্টে নোঙর ফেলা হলো। ঝড়-বৃষ্টি, জোয়ার-ভাটা আর চাঁদের লুকোচুরির মাঝেই কয়েক ঘণ্টার বিশ্রাম। তবে রাতেই ৩ নাম্বার সিগনাল ওঠায় নৌকায় দোল খেয়ে অনেকে মাথা ঘোরায়, বমিও করে। আমি কিছুটা চুপিচুপি পরিস্থিতি সামলালাম—নারী ও শিশুদের ভয় না দেখিয়ে টিমলিডারদের বললাম সবাইকে গল্পে-আড্ডায় ব্যস্ত রাখতে।
ভোরে আবার যাত্রা শুরু। প্রায় তিন ঘণ্টা পর ৯টার দিকে আমাদের দুটো নৌকা বঙ্গবন্ধু দ্বীপের কাছে ভিড়লো।
এই দ্বীপ প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে অনুসন্ধান করেছিলেন অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন একটি দল, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর নানা সময় এডভেঞ্চার ট্যুরিস্টরাও এখানে গিয়েছেন। স্থানীয় জেলেরা অবশ্য নিয়মিত দ্বীপে আসে। ১৯৯২ সালে জেলে মালেক ফরাজি বঙ্গবন্ধুর নামে দ্বীপটির নামকরণ করেন। বর্তমানে দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৭.৮৪ বর্গকিলোমিটার, চারপাশে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বালুকাবেলা।
অবশেষে দ্বীপ আমাদের সামনে উন্মোচন করল তার নির্মল রূপ। কোমরসমান পানিতে নেমে কয়েকশ গজ দূরে গিয়ে নোঙর ফেলতে হলো। সৈকতে চোখে পড়লো অগণিত লাল কাঁকড়া, কেওড়াবন আর কাশবনের সারি। দূর থেকে মনে হয় যেন লাল গালিচা বিছানো।
এখানে এখনো বাঘের পদচারণা হয়নি, তবে হরিণ আর ছোট সাপ দেখা যায়। সৈকত একেবারেই পরিচ্ছন্ন। সাগরের ঢেউ আর স্নিগ্ধ বাতাসে মন ভরে গেল। সবাই ছবি তুললো, গান গাইল, বালিতে শুয়ে থাকলো কিংবা বালি দিয়ে ভাস্কর্য বানালো।
আমি সঙ্গে আনা বটগাছের চারাটি লাগিয়ে দিলাম। জানি না টিকে আছে কিনা, তবে আশা করি আগামীতে কেউ গিয়ে তা দেখতে পাবেন।
দ্বীপে একটি মৃত তিমির বাচ্চা পড়ে থাকতে দেখলাম—মনে হলো কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে। সেই দৃশ্য মন খারাপ করে দিল। সৈকতে প্লাস্টিক বোতল ভেসে এসেছে নানা দেশের লেখা নিয়ে, যা আবারও মনে করিয়ে দিল মানুষের অবহেলার কথা।
দুপুরে ফিরে আসার সময় জোয়ারের জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো। তারপর সুন্দরবনের কেওড়া ও সুন্দরী গাছের সারি পেরিয়ে আমাদের নীল রঙের নৌকা ফিরে চললো। আকাশের সাদা মেঘ, কাশবনের সাদা রঙ, সৈকতের সোনালি বালি আর কাঁকড়ার লাল গালিচা—সব মিলিয়ে যেন বাংলাদেশের পতাকার রঙের মতো হয়ে উঠলো পুরো যাত্রা।
কিভাবে যাবেন?
আমরা গিয়েছিলাম সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ হয়ে নীলডুমুর ফরেস্ট রেঞ্জ দিয়ে।
বিকল্পভাবে মংলা, খুলনা বা সাতক্ষিরা থেকেও যাওয়া যায়।
মংলা থেকে রেগুলার ট্যুরিস্ট ভেসেল রয়েছে।
এছাড়া জোয়ার ইকো রিসোর্ট থেকে সপ্তাহে একদিন সী-প্লেন যায় (ভাড়া ১৪,০০০ টাকা, কখনো ৫,৮০০ টাকা)।
ঘাট থেকে দ্বীপে যেতে পারমিটেড বোট নিতে হবে। এজন্য স্থানীয় গাইডের সহযোগিতা নেয়াই উত্তম।কোথায় থাকবেন?
আমরা ছিলাম মুন্সিগঞ্জের বরসা রিসোর্টে, যেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভাড়া ১,৫০০–২,২০০ টাকা।
খুলনা বা সাতক্ষিরা শহরেও থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। তবে বনের ভেতর প্রবেশ করলে থাকা-খাওয়া সবই নৌকাতেই করতে হয়।
দুটি কথা
১. যেখানে ভ্রমণে যাবেন, চেষ্টা করবেন ওই এলাকার প্রকৃতি বা মানুষের জন্য কিছু রেখে আসতে—অন্তত একটি গাছ লাগান।
২. ভ্রমণে হইচই, আবর্জনা, প্লাস্টিক ফেলা কিংবা রাজনীতি-ধর্ম নিয়ে বিতর্ক থেকে বিরত থাকুন।
সতর্কতা
ভ্রমণের আগে আবহাওয়া ও রাস্তার খবর জেনে নিন।
জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি রাখুন।
সাঁতার বা গোসলের জন্য বাড়তি কাপড় ও তোয়ালে নিন।
পানি ও অতিরিক্ত খাবার রাখুন।
বাঁশি, টর্চলাইট, আয়না, সুতলি, ছোট ছুরি, টিস্যু, ফার্স্ট এইড সাথে নিন।
গন্তব্য সম্পর্কে আগে পড়াশোনা করুন, আর ভ্রমণে একটি বই সঙ্গে রাখলে যাত্রা আরও সুন্দর হয়।
এভাবেই কাটলো আমার বঙ্গবন্ধু দ্বীপ ভ্রমণ। একদিকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, অন্যদিকে দায়িত্বশীল ভ্রমণের শিক্ষা—সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতা চিরস্মরণীয় হয়ে রইলো।