লিখেছেনঃ হোমায়েদ ইসহাক মুন
মল বা মেল কথাটার সাথে প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম দার্জিলিং এ গিয়ে। পাহাড়ের উঁচুতে ছোট্ট একটা চত্ত্বর বা চৌরাস্তা, তাতে সুন্দর করে সাজানো বেঞ্চি পাতা, তাকেই সবাই মেল বলে। অবশ্য পুরো শহরটাইতো পাহাড়ের উপর। হিমালয়ান মাউন্টেইনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ছাত্র হয়েছিলাম বলে পুরো দার্জিলিং শহরের অলিগলি আমাদের ব্যগ-প্যাক নিয়ে দৌড়াতে হয়েছিল। আর মেল-এ বেঞ্চিতে বসে এমন ঠান্ডার মধ্যে এককাপ চা খেতে যে কি আনন্দ হয়, তা সেখানে গেলেই কেবল বুজতে পারবে!
তবে আমি যে মেল-এ এখন হেঁটে বেড়াচ্ছি, তার আয়তন দার্জিলিং শহরের মেল থেকে বেশ বড়সড়। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত হেঁটে বেড়িয়ে যেতে ঘন্টা খানেক এমনিতেই লেগে যাবে। তবে তা বলে আবার কত কিলোমিটার তা মাপতে বসবেন না যেনো। কারন এই মেল-এ এতসব নয়ন জুড়ানো জিনিসপত্র আছে, যা দেখতেই কখন ঘন্টা চলে যাবে টেরই পাবেন না।
লেহ শহরের মেল চত্ত্বরটা সত্যিই বৈচিত্র্যময়। কত রঙিন পোশাকে কত দেশের মানুষের সমাগম ঘটে এই চত্তরে। এক জীবনে যে লাদাখের লেহ শহর পর্যন্ত চলে আসবো কখনো ভাবিনি। ঢাকা থেকে লেহ শহরের এই মেল পর্যন্ত আসতেই লেগে গেলো পাক্কা পাচ দিন। আসার পথেইতো কত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হলো, তা বলতে হয়তো কয়েক পর্ব লেগে যাবে। এখন মেল চত্ত্বর-এ ঘুরে বেড়াচ্ছি তার গল্পই না হয় বলি।
ঢাকা থেকে কোলকাতা হয়ে মূলত পর্বতারোহণের জন্য একটা দলের সাথে এখানে চলে এলাম। কাংইয়াতজি নামের এই পর্বতের উদ্দেশ্যে আমরা যাত্রা করবো দিন কয়েকের মধ্যেই। আমাদের প্রস্তুতির জন্য কিছু বাজার সদাই করতে হবে, প্যকিং করা এবং আরও ২জন আসবে বলে অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের হোটেল মেল থেকে ২কি.মি. এর মত দূরে হবে। আমি কোলকাতা থেকে যে টিমের সাথে এসেছি তাঁরা লেহ শহরে এলে এখানটায় থাকেন। ইয়ন্তান গেস্ট হাউজ টা দোতলা একটা বাড়ি, তাতে উপর নিচ মিলে ৫টি রুম হবে। একে হোটেল না বলে হোমস্টে বলাই ভালো। বাড়ির মালিক এই বাড়িতেই থাকেন। শীতল পাহাড়ের প্রত্তেকটা বাড়িতেই বিচিত্র সব ফুলের গাছ থাকে। দেখতে ভারি সুন্দর। সঙ্গে শাক-সবজি-ফল আর ফুলের বাগান দেখে মনটা চাঙ্গা হয়ে যায়। এই অঞ্চলের জনবসতির বাড়িঘরগুলো বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন হয়।
আমরা একসাথে ৩জন কোলকাতা থেকে মানালি পর্যন্ত এসেছি, কৌশিক আর আদি। মানালিতে আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিল অর্পিতা।
মানালিতে আরো দুবার আসা হয়েছে পাহাড়ের পথে যাওয়া আসার সময়, তাই এই স্থানের মেল চত্ত্বরটাও আমার জন্য পরিচিত জায়গা। এদিকটায় যারা ঘুরতে আসেন তারা একবার হলেও এই মেল ঘুরে যায়। বেশ জমজমাট জায়গাটা। মানালিতে রাতটুকু থেকে আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা আর প্যকিং করে আমরা ৪জনে বেড়িয়ে পড়লাম লেহ শহরের দিকে। ফ্লাইটে লেহ শহরে আসছে জান্নাত আর রাশেদ, পৌছে তাদের সাথে দেখা হবে। তারা থাকে গাজিপুর, তবে আমার সাথে এই লাদাখ শহরেই দেখা হবে প্রথমবার। মানালি থেকে লেহ আসার পথটা এতো সুন্দর যে, তার বর্ননা দিতে হয়তো আরেকটা পর্বের প্রায়োজন হয়ে যাবে। আমরা সুমু গাড়ি রিজার্ভ করে মানালি থেকে রওনা হয়েছি। সারাদিন গাড়ি চলার পরে রাতে আমাদের দারচা-তে থাকতে হয়েছে। পরদিন প্রায় সন্ধ্যায় আমরা লেহ শহরের মুখ দেখলাম। দীর্ঘ যাত্রায় স্বভাবতই ক্লান্ত ছিলাম তাই আর মেল-এর দিকে যাওয়া হয়নি, বাকিরা বের হয়েছিল। রাতের খাবারও নিয়ে আসলো। পরদিন সকালে হাটতে হাটতে মেল-এর দিকেই গেলাম। নাস্তার জন্য মেল-এর খাবার দোকানেই ঢুকে গেলাম। সকালে মেল-এর ফুটপাতে বাহারি শাক-সবজী নিয়ে বসে স্থানীয়রা। পাহাড়ি বাগানের টাটকা এসব শাক-সবজী দেখে রান্না করে খাওয়ার জন্য খুব লোভ হচ্ছিলো। পাতাসহ গাজর, বাঁধাকপি, লম্বা শিম আরো কত সবজি। নামগুলো আমাদের দেশের সবজির মতো হলেও দেখতে বেশ আলদা, সুন্দর আর টাটকা।
মেল চত্তরে বেশিরভাগ দোকানগুলো বাইরে থেকে আসা টুরিস্টদের উদ্দেশ্য করে সাজানো। পর্বতারোহি থেকে শুরু করে শুধু লেহ শহরেই ঘুরতে আসে বছরে প্রায় ২.৭৯ লাখ মানুষ , তার মধ্যে বিদেশি পর্যটকই থাকেন প্রায় আটান্ন হাজার। এটি ২০১৯ সালের সমীক্ষা থেকে বলছি।
‘লা’ শব্দকে লাদাখী ভাষায় বলে গলিপথ। যেমন, জজিলা, ফোতলা ইত্যাদি। ‘লা’ শব্দ যেমন পাস বা গিরিপথ, গিরিসংকটকে বলে তেমনই দেবতাকেও বলে। এদের মতে প্রতিটি গিরিপথেই দেবতার অধিষ্ঠান আছে তাই তার নাম লা। বহুকাল আগে, প্রাচীন লাদাখের রাজধানী ছিল বজগো গ্রামে। সম্পোলা থেকে তিন মাইল আগে সম্পোলা গিরিপথ। রিজোঙ -এর সম্পোলা থেকে সামনে খানিকটা সমতল ভূমি আছে, যার একপাশে নালার ধারে এই বজগো গ্রাম। লেহ, লাদাখে প্রচুর গুম্ফা রয়েছে, দেখতেও ভারি সুন্দর। লেহ শহরে টুরিষ্টরা ‘শান্তি স্তুপা’ দেখতে যায়। এটি চান্সপা এর হিল্টপে অবস্থিত একটি বিশাল গুম্বুজ আকৃতির সাদা বৌদ্ধ মন্দির। ১৯৯১ সালে এই শান্তি স্তুপা নির্মিত হয়। শহরের প্রধান আকর্ষনীয় যায়গা আমার কাছে মনে হয়েছে লেহ প্যলেস। এতো সুন্দর আর মায়াবী লাগে উপর থেকে লেহ কে দেখলে।
এক্সপেডিশন শেষ করে আসার পরে মেল এ দেখা হলো জাফর সাদেক আর দিপু সিকদার ভাই এর সাথে। তাঁরা যাবেন স্টোককাংরি পর্বতে। কোরবানির ঈদের ছুটি মিলিয়ে সবাই পরিকল্পনা করেছে পাহাড় পর্বতে ঘুরে বেড়ানোর। তখন পর্বতারোহী রত্না-ও লেহ তে দু’দিন আগেই এসেছে, আমাদের সাথে মেল -এ দেখা হলো, অনেক গল্প হলো। আমরা সবাই একসাথে লেহ প্যলেস দেখার জন্য মেল চত্তরের রাস্তা ধরলাম। প্যলেস এর অবস্থান শহর থেকে বেশ উঁচুতে। আমাদের রিতিমত পাহাড় বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে হলো। যেহেতু সবাই ট্রেকিং এর উদ্দেশ্য নিয়ে আসা, তাতে আমাদের এক্লামাটাইজেশনে উপকার হবে। ঘুরা পথে গাড়িতে টুরিষ্টরা লেহ প্যলেস-এ যায়। লেহ শহরটাই হিমালয়ের বেশ উঁচু স্থানে, এর উচ্চতা ৩৫০০মিটার বা ১১৫৫০ফিট। হুট করে বিমানে চলে আসলে প্রথম কয়দিন বুকে পালপিটিশন হবেই। এর জন্য বেশি করে হাটাহাটি আর লিকুইড খেতে হয়। এই প্যলেস যেহেতু শহরের উচ্চতা থেকে আরো খানিকটা উপরে তাই আমাদের পাহাড় বেয়ে যাওয়াটা বেশ উপকারে দিয়েছে।
প্রাসাদের দানবীয় গেটের কাছে এসে টিকিট নিতে হলো। পাহাড়ের উপর থেকে শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে বার বার বিমোহিত হচ্ছি। এই প্রাসাদ তৈরি করেন ১৬০০ খৃস্টাব্দে
তৎকালিন রাজা সেঙ্গি নেমগিয়াল, যাকে তার বিভিন্ন ভালো কাজের জন্য প্রজারা নাম দিয়েছলো ‘লায়ন কিং’। নয় তলা বিশিষ্ট এই প্রাসাদ এখন আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। সমগ্র প্রাসাদ এখন সমৃদ্ধশালী এক যাদুঘরে রুপান্তর করা হয়েছে। এখানে প্রায় ৪৫০ বছরের পুরনো তিবেতান থাংকা বা চিত্রকর্ম রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে অমূল্য সম্পদ। দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে এই প্রাসাদকে বেশ প্রকাণ্ড, মনে হয়, আর প্রাসাদ থেকে পুরো লেহ শহরকে দেখায় পোকামাকড়ের ঘর-বসতি। কি অবিশ্বাসঃ করা সুন্দর প্রকৃতি, পাহাড়ের মাহাবি আর মহনীয় রুপ। নীল আকাশটা চকচক করছে, আর দুরের পাহাড়গুলো মাতালের মত চেয়ে আছে আমাদের দিকে। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছি। এই পাহাড়ের কোলেই মনে হয় থেকে যাই বাকি জীবনটা। রত্না পেছন থেকে ডাক দিলো একটা ছবি তুলে দিতে। ততক্ষনে আমাদের আলাপ জমে গেছে। নিম থেকে সে এডভান্স কোর্স করে আসলো বেশি দিন হয়নি। অনেক উঁচু পাহাড়ের চুড়াতে যাবার ইচ্ছা তার। রত্না লাদাখে এসেছে দুইটা পিক সামিট এর উদ্দেশ্যে, একটি স্টো্ককাংরি উচ্চতা ৬১৫৩ মিটার, অন্যটি কাংইয়াতজি ২ উচ্চতা ৬২৭০ মিটার। এক অভিজানে দুই দুইটা পিক সামিট এর পরিকল্পনা করতে বুকের পাটা লাগে। তার ধৈর্য্য আর সাহসের তাই তারিফ করেছিলাম, এছাড়াও রত্না একাই ঢাকা থেকে চলে এসেছে এক্সপেডিশনের জন্য। সে অপেক্ষা করছে তার নিমের একজন শিক্ষকের জন্য, তার সাথেই রউনা দিবে পাহাড়ের পথে। ইতোমধ্যে যেহেতু আমরা কাংইয়াতজি পর্বতের গোড়া থেকে ঘুরে এসেছি ফলে তাকে আবহাওয়া, সেখানখার সার্ভাইভাল সিচুয়েশন এবং রুট নিয়ে কিছু শেয়ার করলাম। আমার হোটেল যাওয়ার পথেই রত্নার হোটেল ছিল, তাই আমারা একসাথে ফেরার পথেও পাহাড় পর্বত নিয়ে, সমাজের একঘেয়ামি জীবিন থেকে পাহাড়ে ঘুরার জন্য যে ফিলসফি আর তার জন্য নানা ত্যাগ তিতিক্ষা- নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম।
এক্সপেডিশনে যাওয়ার আগে এবং পরে বেশ সময় পেয়েছিলাম, তাই বার বার মেল-এ এসেই সময় কাটাতাম। সকালে নাস্তার সময় একবারে বের হতাম রাতে হটেলে ফিরতাম। ইকুয়েপমেন্ট ভাড়া নেওয়ার জন্য মেল এর কাছে জাঙ্কস্তি রোডে মাউন্টেন এডভেঞ্চার নামে একটা দোকান ছিল, সেখানে গিয়ে আমাদের এক্সপিডিশন এর জন্য জিনিসপত্র বাছাই করতাম। শীত প্রাধান দেশে চা-টা হলে একটু জমে বৈকি, তো ওই দোকানে গেলেই দাদা চা খাওয়াতেন। কোলকাতা থেকে লেহ শহরে অর্ণব দা আর তার সহধর্মিনী এসেছে অনেক বছর হয়ে গেলো। ট্রেকিং আর ঘোরাঘুরির শখটা পাকাপক্ত করারা জন্য এখানে এডভেন্সার সপ দিবে বলে ভেবে নেয় আর দিব্বি এখানে এই পাহাড়েরর কোলে কাটিয়ে দিচ্ছে। জীবনটা কত সুন্দর তাই না। দূর থেকে সবাই আসলে তাই ভাবে, পেছনে কাটায় জড়ানো পথটা আর কেউ দেখতে আসে না। পরিবার আর বন্ধুদের ছেড়ে এখানে পাহাড়ের নেশায় ব্যবসা দাড় করিয়েছে। এখানে আসার আরো একটা কারন হচ্ছে, দেশি বিদেশি পর্বতারোহি আর ট্রেকারদের হরহামেশা আনাগোনা চলতে থাকে অর্ণবদার কাছে। কেউ হয়তো আসলো রুট পার্মিটের জন্য, কেউবা এক্সপেডিশন থেকে কেবল ফিরলো। পর্বত আর সামিটের টাটকা খবরটা জানা গেলো, সবাই কনগ্রাচুলেশন্স বলছে, আবার যারা ওই পর্বতে দু’দিন পরেই যাবে তারা যেকে বসলো, ভাই একটু বলো কেমন কঠিন ছিল সামিট পুশ, আবহাওয়াটা কেমন ছিল, কতজন ছিল টীম মেম্বার? কেউ ক্র্যম্পন, স্লিপিং ব্যাগ, স্নো বুট, স্টোভ সহ আরও নানা পর্বতারোহনের জিনিসপত্র নিতে আসে এই দোকানে। এক কান দুই কান করে অর্ণবদার দোকানের বেশ নামডাক হয়েছে ট্রেকার মহলে। তারা ট্রেক পার্মিট থেকে শুরু করে একটা এক্সপেডিশনের সব কিছু আয়োজন করে দিতে পারে।
বিকেল বেলা মেল-এ হাটতে বের হলে আরো হরেক রকম জিনিস নজরে পড়ে যাবে। একটা জটলা দেখে এগিয়ে গেলাম, দূর থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম বেহালার মত একটা সুর। কাছে গিয়ে দেখলাম ইরানি একজন ইয়া লম্বা চুল-দাড়ি ওয়ালা লোক খামেঞ্চি বাজাচ্ছে। এটি ইরানি একটি সুমধুর বাদ্যযন্ত্র। বেশ মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। বেশ ভালো বাজালো। পরে যখন আমি হোটেল চেঞ্জ করলাম দেখি ওই হোটেলে ইরানি একটা দল আছে যারা প্রায় মাস খানেক আগে লাদাখে এসেছে। একটা মেয়ে আছে তাদের সাথে সে মেল-এ এরাবিক ক্যলিগ্রাফি করে তা বিক্রি করছে। মেল এ গান গেয়ে সেখানেও তার বেহালার বাক্সে টুরিস্টরা যে যা পারছে দিচ্ছে। তাতে তাদের থাকা খাওয়ার পয়সাও উঠে যাচ্ছে। তাবৎ পৃথিবী যারা ঘুরে বেড়ায় তারা খুব সামান্য নিয়েই বের হয়, আর পথে পথেই তাদের অন্ন- বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যায়। ব্যকপ্যকিং যারা করে তারা পথকেই তাদের পথের দিশা বানিয়ে নেয়। যারা মনে করে অনেক টাকা থাকলেই কেবল ঘুরে বেড়ানো যায় বা ভাই কিভাবে এতো ঘুরেন অনেক টাকা আছে বোধহয়, তারা নিছক একটা ধন্ধের মধ্যে থাকে। কারন এই ঘুরে বেড়ানো কারও কারও জন্য একটা সাধনা। অর্থ – বাস্তবিক অর্থে একটা প্রধান অনুষঙ্গ, তবে তা যে প্রধান নয় তা অনেক মহারথী ভ্রামনিকরা পৃথিবী ঘুরে দেখিয়ে দিয়েছেন। তারা বিলাসিতা করেননি, অনেক আহ্লাদকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। তারা ঘুরে বেড়ানোকে জীবনের প্রধান কাজ হিসেবে গণ্য করছেন আর সারা জীবন সাধনা করে গেছেন। এও এক ধরনের ফিলোসফি যা নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির মধ্যে বাঁধা সমাজের মানুষের মাথায় ঠিক ঢুকতে চায় না।
মেল চত্ততে একটা ফিল্ম ফেস্টিবলের পোস্টার দেখে থামলাম। পোস্টারে লিখা ‘লিটল টিবেত ফিল্ম ফেস্টিবল’। শর্ট ফিল্ম এর একটা লিস্ট দেওয়া ছিল, টুরিস্টরা সূচি অনুযায়ী টিকেট কেটে টিবেত আর পাহাড় বিষয়ক ছবি দেখবে। এখানে এমন ফিল্ম ফেস্টিবল দেখে ঢাকা ইন্টারন্যশনাল ফিল্ম ফেস্টিবলের কথা মনে পড়ে গেলো। কাজ করার সুবাধে কত দেশের ছবি আর ছবির পরিচালকদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলাম। হাতে সময় কম আর বাজেট সীমিত, তাই এ যাত্রায় সিনেমা দেখার চিন্তা বাদ দিলাম। এই মেল এ ঘুরে-ঘুরে এতসব নতুন জিনিস দেখছি তা সিনেমা থেকে কোন অংশে কম না।
এক্সপেডিশন শেষ করে লেহ তে যখন চলে আসলাম তখন কোরবানি ঈদের আর কয়েকদিন বাকি। এই ছুটিতে পর্বতারোহি মীর শামসুল আলম বাবু ভাই, অল্টিচুড হান্টারের টিমসহ লেহ তে আসছে ‘কাংইয়াতজি ২’ পিক সামিট করতে। দিপু ভাই আর জাফর এর সাথেও দেখা হয়ে গেলো। এক-দুইদিন থাকলে বাবু ভাই দের সাথে দেখা হবে। পাহাড়ে যাবার সুবাধে বাইরে ঈদ করেছি অনেকবার। লেহ তে যেহেতু কাশ্মীরি আদমি লোগ বেশি তাই এখানে ঈদের নামাজ পড়াও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সেদিন আবার জাফর ও টিপু ভাই রওনা করবেন স্টক ভিলেজ এর পথে, সেখান থেকেই ‘স্টক কাংরি’ পাহাড়ে যাবার রাস্তা শুরু। যে এজেঞ্ছির মাধ্যমে যাচ্ছেন, তারা ঈদের দিন বলে একটু কন্সিডার করে একটা গাড়ি রেখে দিয়েছে, নামাজের পরে তাদের নিয়ে যাবে। বাকি ইন্ডিয়ান টিম আগেই চলে গেছে। গাড়িটা তাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে, তাই আমিও স্টোক ভিলেজ দেখার লোভটা হাতছাড়া করলাম না। লাদাখ এর রাস্তা দিয়ে কোথাও যাওয়াই অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করে। রুক্ষ আবার সঙ্গে পাহাড়ের মায়াবি একটা সুন্দর্য। স্টোক ভিলেজ লেহ শহর থেকে ১৭কিমি দূরে আর যাওয়ার পথে ইন্দুস নদীও দেখা যাবে যা স্টোক গ্রামের উপর দিয়ে চলে গেছে জাম্মু কাশ্মির আর লাদাখের পথে।
ঈদের দিন সকালে পাহাড়ি রাস্তা ধরে প্রায় ৫কিমি হেটে ঈদগা তে গেলাম অন্য সবাইকে অনুসরন করে। তখন কেবল মাত্রই লাদাখ কে কাশ্মির থেকে আজাদ করা করা হয়েছে। সুতরাং পরাধীনতা থেকে মুক্ত লাদাখে প্রথম ঈদের নামাজ হচ্ছে, তাই নিউজ করতে কয়েকজন সাংবাদিক দেখলাম লোকজনের ইন্টারভিউ নিচ্ছে। এখন থেকে লাদাখ প্রশাসন নিজের মত করে সব কিছুর ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বিশাল ঈদের জামাতে নামাজ পড়লাম, ইমাম উর্দু তে দোয়া করলেন এর পর কোলাকুলি করলেন সবাই। বাড়ি থেকে, আপন জন থেকে দূরে ভিন্ন আমেজে ঈদের দিন কেটে গেলো ।
এখানকার খাবারের মধ্যে কাবাব আর ফলের মধ্যে খুবানি এর কথা না বললে অপুর্ণ থেকে যাবে। মুসলমান অধ্যুষিত এই লাদাখে মাংসের কাবাবের প্রসংসা করতেই হয়। ‘রগেন জোস’ এই অঞ্ছলে প্রথম খেয়েছিলাম কারগিল এ। আমাদের দারচা থেকে পাদুম এর ট্রিপ এ লুতফর ভাই অর্ডার করলেন খাসির মাংসের এই বিখ্যাত আইটেম রগেন জোস। লেহ তেও দু-এক বেলা এটি খেলাম। মেল চত্তরে একটা কাবাবের দোকান ছিল জমজমাট। আমরা বেশ কয়েকবার সেখানে খেলাম। ঈদের দিন একটু সাহস করে গরুর মাংসের কাবাব আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে জানালো এখানে তাদের অনুমতি মেলে না গরু কোরবানির। খাসির মাংসই সব জায়গায় পাওয়া যায়। ঈদের দিন বিকেল বেলা বেড়িয়ে দেখলাম, মেল চত্তরে যে বড় মসজিদ আছে তার সামনে মাংস দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে যারা কোরবানি দিতে পারেনি। ঈদগা থেকে আগেই ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে মাংস বিতরণ করা হবে। এই অঞ্ছলের একটা সুমিষ্ট ফল হচ্ছে খোবানি বা এপ্রিকট। এই ফল প্রথম খেয়েছিলাম ওমান-এ। বেশ রসালো আর মিষ্টি একটা ফল। ওমানে এই ফলকে বলতাম মিশমিশ। মেল এ যারা শাক সবজি নিয়ে বসে তারা তাদের গাছের ফল খোবানিও সঙ্গে বিক্রি করে। এই ফল শুকিয়ে আলু বোখারার মত খেতেও বেশ স্বাদ পাওয়া যায়। মেল এ হাটতে বের হয়ে আধা কেজি কিনে রাখতাম, পকেট থেকে বের করে একটা মুখে পুরে দিলেই রসে কলিজাটা ভরে যেতো।
মেল-এ একটা ছোট্ট পোস্ট অফিস দেখে ঢু দিলাম দেখি স্ট্যম্প পাওয়া যায় কিনা। স্কুল থেকে স্ট্যাম্প জমানোর সখ, এখনও কোথাও গেলে স্ট্যাম্প খুজি। কিন্তু কিছুটা হতাশ হলাম, এখানে কাগজের ডাকটিকেট তারা বিক্রি করে না, চিঠিতে সিল মেরে দেয়। চিঠি লিখার চল ত আদতে উঠেই গেছে বলা চলে। আমার স্কুল বন্ধু রাজিবের সাথে এখনও আমরা স্ট্যাম্প নিয়ে কাড়াকাড়ি করি, বেশ মজা পাই ব্যপারটা।
সন্ধ্যার দিকে হঠাত করেই দেখা পেয়ে গেলাম বিকুল এর সাথে। কাংইয়াতজি বেইজ ক্যম্প এ তার সাথে বেশ ভাব জমেছিল। লেহ থেকে দুপুর দিকে মটরবাইক চালিয়ে খারদুংলা ঘুরে আবার লেহ তে ফিরে এলো। খারদুংলা যাওয়ার ব্যপারে বেশ উৎসাহ ছিল যখন আমাদের দেশ থেকে বেশ কয়েকজন সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার গল্প শুনেছিলাম। বিকুল আমাকে রয়েল এনফিল্ড-এ বসতে বলল, তারপর তার কোন এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে নিয়ে গেলো। ডিকাথলনে কাজ করার সুবাধে তার এখানে প্রায়ই আসতে হয়, তাই থাকার জন্য জায়গাও রেখে দিয়েছে সে। আমাকে নামগিয়াল দাই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, যিনি লাদাকের স্থানীয় এবং ট্রেক এজেন্সি চালায়। বিকুল আমি আর দাই মিলে বিয়ার আর চিকেল ঝাল ফ্রাই সহ বেশ আড্ডা জমলো। ঈদের দিনটা ভালই কেটে গেলো। সেদিন বিকেল এর আকাশটা বেশ মহনীয় ছিল। ফিরে যাবার আগে বাংলাদেশ থেকে আসা যাদের সাথে দেখা হয়েছে লেহ তে সবাই মিলে বসে আড্ডা আর খাই দাই হলো। আমাকে ধারামশালা যাবার টিকিট করতে হবে, লেহ থেকে পরবর্তি গন্তব্য সেখানেই। শীতের দেশে রাত ৩টার সময় একা বাস এ যাত্রা করার সে আরেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। অন্য দিন না হয় বলব।
পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্নার সাথে আমার লেহ শহরেই প্রথম এবং শেষ দেখা। আমার তুলে দেওয়া ছবিটা তার ফেইসবুক প্রফাইলে মৃতুর আগ পর্যন্ত ছিল। মৃতুর বেশ কিছুদিন আগেও তার প্রানীদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে সম্ভাবনাময়ী রত্না গত ৭ আগস্ট ২০১৯ এ গাড়ি চাপা পড়ে চন্দ্রিমা উদ্দ্যানের সামনের সড়কে নিহত হন। তাকে স্মরণ করে এই লিখাটি উৎসর্গ করলাম। আশা করি তার পাহাড় প্রেমের কর্মকান্ডগুলো তরুন প্রানে উৎসাহের খোরাক হয়ে রইবে।