লিখেছেনঃ আশিক
দেশে বিদেশে – সৈয়দ মুজতবা আলী
শান্তিনিকেতনের পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে ২৩ বছর বয়সী যুবক সৈয়দ সাহেবের চোখমুখে অনেক সপ্নের ঝিলিক৷ তখন কাবুল কৃষি কলেজে ফার্সি ও ইংরেজী ভাষা শিখানোর জন্য আফগানিস্তান সরকারের অনুরোধের ঢেকি গিলতে বের হন নতুন রোমাঞ্চে। ভ্রমণ কাহিনীর শুরু হয় কলকাতা থেকে পেশওয়ার হয়ে কাবুল যাবার মহাকাব্যিক যাত্রা দিয়ে৷ কাবুলবাসের সময় বিভিন্ন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন এবং অত্যন্ত সূক্ষ রসবোধের সাহায্যে তাদের সাথে কথোপোকথন ও দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ তুলে ধরেন। বাচ্চায়ে সাকোর আক্রমণে বিপর্যস্ত কাবুলে যখন লেখকের বিদায়ের সুর বেজেছিল তখন আব্দুর রহমানের বাচ্চামি যেন নতুন রং তুলেছিল বেদনার সুরে৷
যারা এখনও পড়েনি দেশে বিদেশে। দেরি না করে ডুবে যান সৈয়দ সাহেবের সাহিত্য রসে৷
বুক রিভিউ
ভ্রমণ আমরা করি, কেন করি? সেইটা কি আত্মার খোড়াক না সাময়িক নাগরিক যন্ত্রনা থেকে বের হবার কল্পনা। ভ্রমণের পরিধি কত দিন পর্যন্ত হতে পারে সেইটা কি কোন সীমায় বেঁধে রাখা যায়। আমাদের নাগরিক যন্ত্রনার এই যান্ত্রিক শহরে শুক্র, শনি ছাড়া কি ললাটে লেখা থাকে কোন ভ্রমণ। তাই দিন দিন ভ্রমণের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে৷
চলুন না ভ্রমণের সংজ্ঞা ভুলে ফিরে যাই ৭০ বছর পিছে৷ সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া সেই পাকিস্তান পিরিয়ডে যখন বাঙালির রোমান্টিসিজম চলছে ধর্ম ভিত্তিক দেশের রসে৷ তখনই রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ভ্রমণ কাহিনী৷ লেখকের কাবুল বাসের সেই অস্থির সময় নিয়ে রচিত হয় অপূর্ব গল্পগাঁথা৷ সৈয়দ মুজতবা আলীর রম্য রসাত্নক বর্ণনার সাথে পরিচিত নন এমন মানুষ এই সময় এসে খুঁজলে হয়তো অনেক পাওয়া যাবে৷ কারণ এ সময়টা বই না পড়ার যুগ৷
১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত লেখকে আফগানিস্তানের ভ্রমণের উপর রচিত এই ভ্রমণ কাহিনীটি বাংলা সাহিত্যে এমন প্যারামিটার সৃষ্টি করেছে পরবর্তিতে অনেক ডাক সাইটে ভ্রমণ লেখক এসেও এর ধারে কাছে যাবার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেনি৷ কেন এই এই বই পড়বেন?
এই বই পড়লে আপনার জীবন নিয়ে মূল্যবোধ পরিবর্তন হয়ে যাবে। ভ্রমণ কে শুধু সাময়িক আনন্দের খোঁড়াক না ভেবে খোঁজার চেস্টা করবেন ভ্রমণের সাথে আত্মার আত্মিক সম্পর্ক। আর তখনই না একজন ভ্রমণকারির আদি আত্মা ছুয়ে যেতে পারবনে৷ যেমন ছুয়ে গেছে আমাদের ইবনে বতুতা, মার্কো পোলো, হিউয়েন সাং এর মত বিখ্যাত সব ভ্রমণকারি৷
ভ্রমণ কাহিনী হওয়ার সত্বেও এটি আফগানিস্তানের তৎকালীন সময়ের একটা চিত্র ফুটে উঠেছিল লেখকের লেখনীতে। সৈয়দ সাহেবের ট্রেডিশনাল রম্য রসাত্বক বর্ণনা, বিভিন্ন পরিচিতি ও অপরিচিত মানুষের সাথে রসালাপ, ভ্রমণের সময় বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা এবং কাবুল ছেড়ে আসার সেই করুণ বর্ণনা মনে দাগ কেটে রেখে যাবে না কেন৷ মনে হবে আপনিও লেখকের সাথে ঘুরছেন সময়ের পরিভ্রমণে৷ এই বইটি এত বিখ্যাত পরবর্তীতে বইটি In a Land Far from Home শিরোনামে অনুদিত হয়।
এত বছর পর দেশে বিদেশে নিয়ে রোমান্থন করতে গিয়েও ভুলতে পারি না আব্দুর রহমানের কথা৷ আমার কলেজ লাইফের প্রথম দিকে যখন দেশে বিদেশে পড়ি তখন আব্দুর রহমান কে মনে হত এক নরম মনের দৈত্যের মত। পুরা বইতে নানান হাস্য রসে ভরপুর গল্পের জন্ম দেওয়া আব্দুর রহমানের সাথে লেখকের বিচ্ছেদ আমার সেই কিশোর মনে দাগ কেটে গিয়েছে৷ জীবন সম্পর্কে এসেছিল ভয়ানক মূল্যবোধ৷ জীবন কেন এমন হয়, কেন হয় না আমার মনের মত৷
এরপর ভুলি কি ভাবে বাচ্চায়ে সাকোর কথা যার নেতৃত্বে আফগানিস্তানের আমানুল্লাহ’র পতন ঘটেছিল। ভুলে যাই কি ভাবে সেই তিন দিনের বাদশাহ ইনায়েতুল্লাহ’র কথা৷ আফগানিরা যে সেই সহস্র বছর ধরে রক্ত গরম জাতি তার ধারাবাহিকতা এখনও ধরে রেখেছে৷ তো বলতে গেলে দেশে বিদেশে ইতিহাসের এক প্রামাণ্য দলিলও বটে৷ অধ্যাপক বেনওয়া, শেখ আহমেদ আলী খান পাঠান, অধ্যাপক খুদাবখশ, অধ্যাপক বগদানফ, দোস্ত মুহম্মদ এর সাথে দেশে বিদেশের লেখকের কলমের জাদুতে চলতে চলতে দেখা হবে। জীবনের মূল্যবোধ, রস যেন নতুন আঙ্গিকে আসবে পাঠকের হৃদয়ে৷
তবে দুবোর্ধ কিছু বাংলা শব্দের সাথে বর্তমান প্রজন্মের উঠা বসা কতটুকু জানা নেই। এ বই শুধু ভ্রমণের জন্য নয় এ বই ইতিহাসের, এ বই রম্যে রসের, ই বই জীবনবোধের৷ তাই আপনি যদি এখন দেশে বিদেশে না পড়ে থাকেন সময় নষ্ট না করে শব্দের জাদুকরের কলমে চড়ে ঘুরে আসুন নতুন রোমাঞ্চে৷
সেই রোমাঞ্চের প্রথম রম্যে রস তো খুঁজে পাবেন একেবারে দ্বিতীয় পাতায়৷ এরপর লেখকের সাথে সময়ের পরিভ্রমণ করতে প্রস্তুত হয়ে নিন৷ প্রবেশ করুন সৈয়দ মুজতবা আলীর জগৎতে। যে জগতের ঘোর কাটবার নয়।