লিখেছেনঃ রথিন চক্রবর্তী
প্রাতরাশের টেবিলে বসে ভিক্টর স্মিত হেসে এমিলিকে বলল আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমাদের দলে তুমিই একমাত্র নারী সদস্য, তোমাকে অনেক শুভেচ্ছা।
ঠান্ডায় জমাট বাঁধা বৈকাল হ্রদের ওপর দিয়ে পাঁচ দিন হেঁটে গতকাল সন্ধ্যার মুখে আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। একটা সুন্দর কাঠের ঘরে আমাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা। সাইবেরিয়ায় গরমকালেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কদাচিৎ ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপরে উঠতে পারে, আর ফেব্রæয়ারি মাসের এই ভরপুর শীতে সেটা দিনদুপুরেই হিমাঙ্কের প্রায় ২০ ডিগ্রি নিচে চলে যায়। সঙ্গে আছে সব সময় শোঁ শোঁ হাওয়ার রুদালি। ঠান্ডা এবং হাওয়ার যুগলবন্দীতে আক্ষরিক অর্থেই স্বার্থপর দৈত্যের বাগান হয়ে ওঠে চরাচর, সাদা রং যে কত কর্কশ হতে পারে প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাসে, সেটা বাধ্য হয়ে অনুভব করতে হয়।
ঘরের ভেতরটা কিন্তু বেশ উষ্ণ ও আরামদায়ক। প্রাতরাশ করতে করতে আমরা দেয়ালজোড়া কাচের জানালা দিয়ে বৈকালের বিস্তার দেখছি। পাঁচ দিন পর আয়েশ করা দূরত্ব থেকে দেখে বৈকালকে কিন্তু আর ভিলেন মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে ভিন গ্রহের এক চিত্রকল্প। সেই কত যুগ আগে ভ‚গোলের বইয়ে পড়া পৃথিবীর বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ, পৃথিবীর গভীরতম ও প্রাচীনতম হ্রদ।
ভিক্টরকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিষ্টি হেসে এমিলি বলল, তোমার পরিচালনায় এই পাঁচটা দিন আমরা খুব সুন্দর কাটিয়েছি। কষ্ট হয়েছে খুব, কিন্তু কত অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর তাই আনন্দ হয়েছে এত বেশি। তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।
ভিক্টর আমাদের ৯ সদস্যের দলের একমাত্র গাইড এবং মালবাহক। হিমালয়ের মতো এখানে মালবাহক সহজলভ্য নয়। আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের মালপত্র নিজেদেরই বইতে হয়েছে, সঙ্গে দলের খাবারের কিছু অংশ। তার ওজনও কম নয়, সব মিলিয়ে এক-একজনের প্রায় ৩০ কিলোগ্রাম হবে। বাকি তাঁবু, রান্নার বাসনপত্র, অন্য খাবারদাবার, বরফ সরানোর বেলচা, কাঠ কাটার ইলেকট্রিক করাত ইত্যাদি সব ভিক্টর বয়েছে। সেসবের ওজন ৬০ কিলোগ্রামের ওপরে। এভাবেই আমরা বৈকাল হ্রদের পশ্চিম দিক ঘেঁষে গড়পড়তা রোজ কুড়ি কিলোমিটার করে হেঁটেছি। তবে এত ভারী ওজন বইতে কষ্ট তেমন হয়নি। পুরো পথটাই তো জমাট বাঁধা বরফের ওপর দিয়ে। নিচে কালো অথবা পান্না নীল রঙের শক্ত বরফ, খুবই পিচ্ছিল। তার ওপর ¯েøজ, সামান্য টান পেলেই আপনা-আপনি অনেকটা এগিয়ে চলে। তা ছাড়া মন তখন অন্য কিছুতে মজে থাকার এত রসদ পেয়ে যায় যে কষ্টের দিকে আর খেয়ালই থাকে না। পায়ের নিচে শক্ত বরফের স্বচ্ছ গভীরতায় পৃথিবীর সেরা শিল্পীদের সব বিস্ময়কর সৃষ্টি, জমাট বাঁধা বুদবুদের কারুকাজ। দাহ্য মিথেন গ্যাসের কী কাব্যিক হিমায়ন! অসুবিধা হয়েছে শক্ত বরফের ওপর রাতে পড়া নরম বরফের ওপর দিয়ে পথ চলতে। মাঝেমধ্যেই এমন পথ পেয়েছি। তখন নরম বরফে পা অনেকটা ঢুকে যাচ্ছিল, নিজেকে চলমান রাখতেই বেশ অসুবিধা হচ্ছিল, মালপত্রসহ ¯েøজ টেনে আনতে তো আরও কষ্ট হওয়ারই কথা। স্বাভাবিকভাবেই সেসব জায়গায় ভিক্টরের কষ্ট হয়েছে আরও বেশি। তবে সর্বত্রই এ ধরনের গাইড-পোর্টাররা যেমন হয় ভিক্টরও তেমন। ধৈর্য আর সহনক্ষমতাÑমানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই দুটি গুণকে আয়ত্ত করতে পারলে যে চ‚ড়ান্ত প্রতিক‚লতার সামনে দাঁড়িয়েও হাসিমুখে থাকা যায়, ভিক্টর তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। হাঁটার সময় তবু মন্দের ভালো। ওপরে ফেদার জ্যাকেটসহ সাতটি স্তরে এবং নিচে চারটি স্তরে গরম পোশাকে সুসজ্জিত হয়েও দিনদুপুরে মাইনাস কুড়ি-বাইশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পথ চলতে তবু কিছুটা স্বাভাবিক থাকতে পেরেছি, কিন্তু মাঝেধ্যেই দাঁড়াতে হয়েছে। হয় হাঁটার ক্লান্তিতে, নয়তো পিছিয়ে পড়া সহযাত্রীদের অপেক্ষায়। তখনই তিন স্তরে ঢাকা হাত ও পায়ের আঙুলের পাতায় তীব্র যন্ত্রণা, সারা শরীরে ঠকঠক করে কাঁপুনি। ভিক্টরের টুপিতে, গোঁফে, ভুরুতে বরফ। আমাদের অবস্থাও তা-ই। ও কিন্তু জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে আর হাসিমুখে পেছনের দিকে তাকিয়ে সঙ্গীদের দেখেছে। মাত্র একটি ক্ষেত্রেই ওর মুখের হাসিটা হারিয়ে যায়, যদি কেউ এক টুকরো কাগজ, বিশেষ করে পলিথিন বা প্লাস্টিক-জাতীয় কিছু ফেলে। রেগে গিয়ে গজগজ করতে থাকে, হু ডিড দিস? হাজার হাজার মাইলজুড়ে কোনো লোকবসতি নেই, ধু ধু তেপান্তর, এক টুকরো কাগজ পড়লে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়, কে জানে।
প্রায় ছয় ফুট লম্বা ভিক্টরের মুখটা মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৮৭ ফুট গভীর, ৬৩৬ কিলোমিটার লম্বা এবং গড়ে ৪৮ কিলোমিটার চওড়া বৈকাল হ্রদের পূর্ব প্রান্তের বুড়িয়াট উপজাতির মানুষ সে। আমাদের দেখা অন্য গাইডদের সঙ্গে ভিক্টরের অনেক তফাত আছে। সে নিজে একজন অণুজীববিদ (মাইক্রোবায়োলজিস্ট), বিভিন্ন জর্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়, ভালো টাকা পায়। এই যে বৈকালে ও গাইডের কাজ করে, সেটাও এ জন্য। প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির প্রাণসমৃদ্ধ এত জীববৈচিত্র্য বৈকালের মতো আর কোথায় পাবে? এই নেশার জন্যই সে বছরের পর বছর এখানে পড়ে থাকে, এমনকি এই নিষ্ঠুর শীতকালেও। সে জন্যই এই অঞ্চলে গাইডের পেশাকে বেছে নিয়েছে ভিক্টর। হাঁটতে হাঁটতেই এক দিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কি শুধু বৈকালেই গাইড করো? আশপাশে এই যে এত পাহাড়, এগুলোতে যাও না? খুব খুশি হয়েছিল ভিক্টর। বলেছিল, মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ও তো পাহাড়েই গাইডের কাজ করে। এরপর খুব সুন্দরভাবে শিক্ষকের মতো করে বুঝিয়ে বলেছিল, এই যে বৈকালকে ঘিরে এই পাহাড় সারি, যাকে তোমরা বলো বৈকাল রেঞ্জ, আসলে তা পাঁচটা রেঞ্জ।
উত্তর দিকে পূবে বাড়গুজিন রেঞ্জ আর পশ্চিমে বৈকাল রেঞ্জ। মাঝ-বরাবর পুবে মড়কয় রেঞ্জ আর পশ্চিমে প্রমরস্কি রেঞ্জ। দক্ষিণ দিকে একমাত্র খামার দাবান রেঞ্জ। খামার দাবানেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি আছে। ২০৯০ ফুট উঁচু এই শৃঙ্গটির নাম চেরস্কি, বিখ্যাত পোলিশ অভিযাত্রীর জ্যান চেরস্কির নামে নাম। পাসেই পাহাড়ের বুকে কত রকমের গাছÑপ্রæস আর পাইন বাদে কোনো গাছেরই নাম জানি না। সেদিকে তাকিয়ে ভিক্টরের কথা শুনছিলাম।
প্রাতরাশের পর সবাই মালপত্র ঠিকমতো প্যাকিং করে নিলাম। তারপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কিছুটা দূরে গলুস্তনয়ে গ্রামের উদ্দেশে। ছবি তোলার জন্য, তথ্য সংগ্রহের জন্য এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। এই গ্রামের মানুষদের জন্যই গতকাল আমাদের দুর্ভোগ চ‚ড়ান্ত হতে গিয়েও হতে পারেনি।
এ পথে দুর্ভোগ কী কী হতে পারে, সেসব সম্পর্কে এক বছর আগে থাকতেই আমাদের এত বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে বই আর নেট ঘেঁটে পাওয়া তথ্য মিশিয়ে একটা ধারণা খাড়া করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দিল্লি থেকে মস্কো এবং সেখান থেকে রাশিয়ার বিভিন্ন হিল্লি-দিল্লি কাটিয়ে ১০ দিন পর ইরকুটস্কে আসা পর্যন্ত আমাদের উচ্ছল আনন্দের তোড়ে সব আশঙ্কা বানভাসি হয়ে গিয়েছিল। বৈকাল হ্রদের নিকটতম বড় শহর ইরকুটস্ক। বøাদিভস্তক থেকে মস্কো, ৯ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিখ্যাত ট্রান্সÑসাইবেরিয়ান রেলপথে টানা সাত দিন, সাত রাত যাত্রাপথের মাঝামাঝি জায়গায় এই শহরের অবস্থান। আমরা অবশ্য ট্রেনে আসিনি, মস্কো থেকে বিমানে এসেছি। নতুন কোনো জায়গা দেখলে সবারই চোখ বড় হয়ে যায়। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে করে। আসার পথে আমাদের চোখও সুস্থির থাকতে পারেনি। সেটা কিন্তু রাস্তার দুপাশে বরফের উচ্ছ¡াস দেখে নয়। সে তো মস্কো বিমানবন্দরে নামা ইস্তক ১০ দিন ধরে সব জায়গায় দেখে আসছি। এই শহরটার অন্য কিছু একটা আছে। আছেই। কী আছে, সেটা খুঁজতেই চোখের এই ছটফটানি। গাইড রোমানের কোনো বকবকানিই আমাদের কানে ঢুকছিল না। ঘণ্টাখানেক পর একটা বহুতল বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। মালপত্র নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম তিনতলায়।
এটা কোনো হোটেল নয়, একটি বহুতল বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে হোমস্টে। গৃহকর্ত্রীর নাম ডাশা। ও নিজে অবশ্য এখানে থাকে না, থাকে এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে, শহরের উপান্তে। বছর সাতাশ-আটাশের সুন্দরী ডাশা মিষ্টি হেসে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। পালিশ করা কাঠের আগাপাছতলা অন্দরসজ্জা, পরিপাটি এবং পরিচ্ছন্ন। তিনটি ঘরে আমাদের সাতজনের থাকার ব্যবস্থা। দুটো টয়লেট এবং কিচেন-সংলগ্ন একটা খাবার কাম আড্ডাঘর। খাবার টেবিলে ব্রাউন ব্রেড, বিস্কুট, চা-চিনি ইত্যাদি রাখা, অতিথিদের প্রাথমিক প্রয়োজনের সুবন্দোবস্ত। ঘরে ঢুকে আমরা স্বভাবসিদ্বভাবে এলোমেলো ছড়িয়ে পড়েছিলাম। ডাশা দ্রæত আমাদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটা ছোটখাটো ক্লাস করাল আমাদের। জুতা পরে ঘরে ঢুকলে ঘর নোংরা হবে, শুধু তা-ই নয়, জুতার ঘষায় কাঠের পালিশ ও টেক্সচার নষ্ট হবে। বাথটবে বসে প্লাস্টিকের পর্দা টেনে স্নান করতে হবে, তারপর ওখানেই সব মোছামুছি করে নিচে নেমে পাপোশে পা ঘষে নিয়ে মেঝেতে পা রাখতে হবে, নইলে মেঝে ভিজে থাকবে। টুকরা নোংরা প্লাস্টিক ময়লার বাক্সে ফেলতে হবে ইত্যাদি। প্রতিটি নির্দেশের সঙ্গে হসিমুখে বারবার ‘প্লিজ’ বলতে ভুলছিল না। সব বুঝিয়ে দিয়ে ডাশা চলে গেল। সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে এসেছে, এখন স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে বলে। বেলা ১১টা নাগাদ কুনজিম এল। এই কদিন আমরা থাকা-খাওয়া, ঘোরাঘুরিÑসবই নিজেদের ব্যবস্থাপনায় করেছি। পরেও তা-ই করব। কিন্তু বৈকালে সেটা সম্ভব নয়। এখানে সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাই কুনজিমের। প্রথমেই ওর প্রাপ্য টাকা বুঝে নিয়ে আলোচনায় বসল। সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ আলোচনা শেষে আমাদের পায়ের মাপ ও শরীরের বহর আন্দাজ করে নিয়ে ও বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, কাল দুপুরে ও সব জিনিসপত্র-সরঞ্জাম নিয়ে আসবে। পরশু ব্রেকফাস্টের পর আমরা বৈকালের উদ্দেশে রওনা হব।
আর একমুহূর্তও গড়িমসি নয়। ঘর ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম সবাই। সাইবেরিয়া! খেলা কথা? তা-ও ভরা শীতে? আমার কেন, কজনের বাপ-চোদ্দ পুরুষ ভাবতে পারে? দলবদ্ধভাবে ছড়িয়ে পড়লাম শহরটার পথেঘাটে, পায়ে পায়ে। বেশ কয়েকটি সুন্দর চার্চ, স্ট্যাচু, মিউজিয়মÑযতই স্থাপত্যশৈলী, শিল্প ও বৈভবের চ‚ড়ান্ত নিদর্শন হোক না কেন, এগুলো তা-ও অন্যত্র পাওয়া সম্ভব। গত তিন বছর ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে বেশ কিছু জিনিস দেখে আমার মনে হয়েছে, এগুলো আমাদের দেশে অনেক ভালো। কিন্তু এসব দেশের আনাচকানাচে সাজিয়ে রাখা আনকোরা শিল্পীদের সৃষ্টি বিভিন্ন স্ট্যাচু দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। এ রকম একটিও স্ট্যাচু কি আমাদের সেরা শিল্পীরা ৩০১০ সালে করতে পারবেন? এই যে এখানে, কার্ল মার্ক্স স্ট্রিটে একটা কিশোর ব্যাক-প্যাকার দাঁড়িয়ে আছে, কোনো স্তম্ভের ওপর নয়, ফুটপাতের ওপরে, তার ছানাবড়া হয়ে যাওয়া চোখ দুটো তো আমারই। অথবা আরও মিনিট কুড়ি উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক লিওনিদ গেইদায়ের মূর্তিটি। সামনে পনেরো ফুট দূরে তিনজন অভিনয় করছে, চেয়ারে ঝুঁকে বসে বাঁ হাতের শিথিল আঙুলে সিগ্রেটটা হালকা ঝুলিয়ে ডান হাত দিয়ে নির্দেশ দিচ্ছেনÑঅনেক বছর আগের দৃশ্য নয়, যেন এখনকারই কোনো স্টুডিওতে চিত্রগ্রহণ করা হচ্ছে, আমরা সেই কর্মকাÐ দেখছি। ঠিক আছে, এসব নয় আমার মহান দেশে আমার নাতির নাতিও দেখতে পাবে না, কিন্তু পৃথিবীর অন্যত্র তো পাবে। কিন্তু এই কাঠের ঘরগুলো? শহরজোড়া সব আধুনিক ঘরবাড়ি, রেস্তোরাঁ, মল ইত্যাদির মাঝেমধ্যে সাধারণ কিন্তু মধুর উপস্থিতি। কথা না বলতে চেয়েও কত কথা বলছে। কথা তো নয় কবিতা। ব্যথার কবিতা, নির্বাসিতের বেদনার কাব্য।
সাইবেরিয়ার দিগন্ত ছাড়িয়ে দিগন্তজোড়া মর্গে কতজনকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। শুধু সোভিয়েত-শাসিত রাশিয়ায় নয়, তারও অনেক আগে জারের শাসনকাল থেকে। ১৮২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বিখ্যাত ‘ডিসেম্বরিস্ট রিভোল্ট’-এর জেরে খোদ রাজপরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সেনা ও বুদ্ধিজীবীকে এখানে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। অনেকের মৃত্যু হলেও ‘মরব না ভাই মরব না’ গান গাইতে গাইতে লড়াই করে যারা সমাধিক্ষেত্রে প্রাণসঞ্চার করেছিল, বধ্যভ‚মিকে ভালোবেসে নিজের দেশ ভেবে সব আবেগ ঢেলে দিয়েছিল, এসব কাঠের বাড়ি তাদের। এক-একটা শান্তিনিকেতন। ইরকুটস্ককে//// তাই সবাই রাশিয়ার অন্যতম প্রধান বৌদ্ধিক কেন্দ্র হিসাবে সম্মান করে। যে ভ্যালেন্টাইন রাসপুতিনের লেখা পড়ে অনেকেই আপ্লুত হন, তিনি এখানকারই মানুষ।
ইরকুটস্কের যে অন্য কিছু একটা আছে বলে মনে হচ্ছিল, সেটা কি এই কাঠের ঘরগুলো? হয়তো তা-ই। কিন্তু মনটা পুরোপুরি মানতে চাইছে না। কেবলই মনে হচ্ছে আরও কিছু একটা আছে। কী আছে, তার হদিস পেলাম একটু পরেই। নদী, আঙ্গারা নদী। পৃথিবীর সব বিখ্যাত শহরেই নদী আছে, তাহলে আঙ্গারা আলাদা কোথায়? আলাদা এখানেই যে অন্য নদীগুলো যতই প্রাণবন্ত হোক না কেন, আগাপাছতলা নাগরিক। জিমে গিয়ে মেদ ঝরায় আর ক্লেদ বাড়ায়, ঠোঁটে লিপস্টিক মাখে, ভ্রæ প্লাক করে, মাপা হাসি হাসে, মেনোপেজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে। কিন্তু আঙ্গারা? সুদৃশ্য বিল্ডিং কারখানা তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। অনেকটা পরিসর নিয়ে সে নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে শহরের আত্মায়। কোনো উচ্ছ¡াস নেই, নেই কোনো চপলতা। আছে শুধু বৈদগ্ধের স্নিগ্ধ লাবণ্য। এখন বরফের ধূসরতায় মিশে গিয়ে একাকার হয়ে আছে শহরের রাস্তাঘাট, পার্ক এবং আঙ্গারা নদী। আলাদা করা যাচ্ছে না, তবু যাচ্ছে। নদীর বুকে জমাট বাঁধা বরফের ওপর বসে আছে কিছু মৎস্যশিকারি। অনেক দূরে দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কোনো ব্যস্ততা নেই, প্রাপ্তির আনন্দ আছে, লোভ নেই। স্ট্যাচু বলে ভুল হয়, অথবা এক একজন ধ্যানমগ্ন ঋষি।
এত আনন্দের মাঝে দুর্ভোগের কথা এত দিন পর প্রথম মাথায় এল পরের দিন, কুনজিমের বকুনি খেয়ে। আমাদের জন্য গাদাগুচ্ছের পোশাক-আশাক নিয়ে হাজির হয়েছে সে। বইবার ভার কমানোর জন্য আমরা যখন ওর নিয়ে আসা জিনিসগুলো একটার পর একটা খারিজ করছি, তখন কুনজিম একসময় রেগেমেগে চিৎকার করে উঠল, ‘ইউ গাইজ হ্যাভ জিরো লেভেল অব এক্সপেরিয়েন্স, বিইকাল উইল বি হ্যাপি টু গাল্প ইউ অল টুগেদার।’
ইরকুটস্কে দুটো দিন কাটিয়ে ঘণ্টা দুই গাড়িতে করে আমরা এসে পৌঁছেছিলাম রোগাটকায়। বৈকাল হ্রদের ধারে একটা ছোটখাটো ছিমছাম জনপদ। গাড়ি সরাসরি এসে দাঁড়াল জমাট বাঁধা বৈকালের বুকের ওপরে। চাঁদের মাটিতে মানুষের প্রথম পা ফেলার উত্তেজনা ও বিস্ময় নিয়ে আমরা এক-একজন নিল আর্মস্ট্রং গাড়ি থেকে নামলাম। ছোটাছুটির চেষ্টা করব কী, পিচ্ছিল বরফের বুকে একটু হাঁটতে গেলেই পড়ে যাচ্ছি। শীতের লাদাখে জমাট বাঁধা জাঁসকর নদীর ওপর হাঁটার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। কিন্তু সে তো এগারো হাজার ফুট উচ্চতায়। দুই বছর আগে শীতকালে আমরা পনেরো হাজার ফুট গড় উচ্চতায় জমে থাকা প্যাংগং সো এবং সো মোরিরিতে হাঁটা সম্ভব কি না, পরীক্ষা করেছিলাম এবং চ‚ড়ান্ত দুর্ভোগ হলেও সফল হয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাসের জোরে এখানে কাজ শুরু করে দিলাম। অসুবিধা খুব একটা হলো না।
প্রথম দিন মাত্র ঘণ্টা তিনেকের হাঁটা। যেকোনো অবস্থানে প্রথম দিনের হাঁটা বেশ কষ্টকর হয়। পরিশ্রমে অনভ্যস্ত শরীরকে ‘বাবা-বাছা’ বলে কাজে লাগানো ছাড়াও ভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে সময় লাগে। বৈকালের মতো খেপচুরিয়াস হোস্ট হলে তো কথাই নেই। তীর ধরে হাঁটা সম্ভব নয়। বিশাল বিশাল বরফের ¯ø্যাব, তীর বরাবর ডাই হয়ে জমে আছে। প্রধানত তীব্র হাওয়া আর তার ফলে বৈকালের অন্দরে-বাইরে তাপমাত্রার ও চাপের মেজাজ বিগড়ানো বিপ্রতীপ পরিবর্তনের ফসল। এর ওপর দিয়ে হাঁটার কোনো গল্প নেই, কিন্তু এগুলো ডিঙিয়ে বৈকালের বুকে পা রাখব কী করে? যাহোক করে সেটাও হলো। মালভর্তি ¯েøজ টেনে বৈকালের তীরে প্রথম দিনের ক্যাম্পে এলাম। দারুণ জায়গা। উৎসাহে টগবগ ও ঠান্ডায় ঠকঠক করতে করতে তাঁবু খাটালাম, আগুন জ্বালনোর কাঠ এনে জড়ো করলাম, অনেকটা দূর থেকে ¯েøজে করে রান্নার জন্য বরফের ¯ø্যাব নিয়ে এলাম। আগুন ঘিরে রান্না হলো। কিন্তু না খেয়েই এমিলি দৌড়ে ঢুকে গেল তাঁবুর ভেতরে। বলে গেল খাওয়ার জন্য সারাটা জীবন পড়ে আছে, এই ঠান্ডায় আপনি বাঁচলে বাপের নাম। অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে তাঁবুর বাইরে আনা গেল না। সে যে কত বুদ্ধিমান, সেটা বুঝলাম খাওয়া শেষ করে তাঁবুতে ঢুকে। মাত্র সাড়ে ছয়টা বাজে, সারা রাত কাটাব কী করে? ঘুম দূরের কথা, সারা রাত কেউ একটানা শুয়ে থাকতে পারিনি। দুজন ‘পদ্মশ্রী’র দাবিদার কোনোমতে বসে থাকতে পেরেছিল। আর আমরা বাকিরা? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকেও যে রাতভর ব্যায়াম করা যায়, সেটাই যেন কাদের শেখাচ্ছিলুম।
পরের দিন সকালে ভিক্টর দেখল যে বøাডি ইন্ডিয়ানগুলো বেঁচে আছে। নিশ্চয় ওর মনুষ্যত্ব জেগে উঠেছিল। না হলে নিজেই কেন বলবে, ‘মাস্ট ফাইন্ড আউট আ শেল্টার অনয়ারডস। ফিউ ডেসারটেড উডেন হাউজেস আর দেয়ার অন আওয়ার ওয়ে।’ বাকি দিনগুলো সত্যিই পরিত্যক্ত ঘর পেয়েছি। আরাম পেয়েছি, তার থেকেও বেশি পেয়েছি শিক্ষা। প্রতিটি ঘরের চাবি দরজার পাশে ঝোলানো। চাবি আছে মানে ঘরে ঢুকে চুরি করার মতো জিনিসও আছে, এমনকি খাটও আছে। শুধু কি তা-ই? ঘরে ঢুকে চা খেতে ইচ্ছে হতেই পারে। চা শুধু নয় বিস্কুটও আছে, আরও আছে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ। অতিথির কাজে লাগতে পারে ভেবে সব প্রাথমিক জিনিস রাখা আছে। ‘নারায়ণ’কে না জনলেও ওরা জানে যে ‘অতিথি নারায়ণ’। বাকি চার দিন মোটামুটি একই রকমের পথ ধরে চলা, একই রকমের ঘরে রাত্রিবাস। কষ্ট কিছু হলেও প্রাপ্তির ভাগ ছিল অনেক বেশি। কিন্তু দুর্ভোগ যে কিছু হতে পারে, সেটা বুঝলাম গতকাল, আমাদের হাঁটাপথের শেষ দিনে।
কাল পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার পর বেলা একটা নাগাদ বৈকালের বুকে তীব্র হাওয়া শুরু হয়েছিল। পাকিয়ে পাকিয়ে আসা হাওয়া আর মিহি বরফের এলোপাতাড়ি ঝাপটা। তীর থেকে অনেকটা ভেতরে বৈকালের বুকে আমরা হাঁটছিলাম। তখনো গন্তব্য অনেক দূরে। ক্লান্ত শরীরে পথ চলতে এমনিতেই খুব কষ্ট হচ্ছিল, সঙ্গে এই দুর্যোগ। ভিক্টরের চোখেমুখে আতঙ্ক। আপন মনেই বারবার বলে চলেছে ‘ডেঞ্জারাস…ডেঞ্জারাস’। গন্তব্য ও তীরের মাঝ-বরাবর আমরা কোনাকুনি হাঁটতে থাকলাম। ওই অবস্থায় আরও দুই ঘণ্টা হাঁটার পর তীরের কিছু কাছে এলাম। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিক্টর ওর পকেট থেকে হাত-কামান জাতীয় কিছু একটা বের করল এবং পরপর তিনবার ফায়ার করল। শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, প্রতিধ্বনিত হতে থাকল পাশের পাহাড়ে, আকাশে ছড়িয়ে পড়ল লাল রঙের ধোঁয়ার কুÐলী। আবার আমরা হাঁটতে থাকলাম একইভাবে। চলতে পারা যাচ্ছে না, তবু। আধঘণ্টার মধ্যে দেখি দুটি গাড়ি বরফের ওপর দিয়ে আমাদের দিকে আসছে। ওরাই আমাদের এখানে নিয়ে এসে তুলেছিল। নাহলে কাল কী হতো কে জানে!
বেলা দেড়টা নাগাদ দুটো গাড়ি এল। একটা গাড়িতে ¯েøজ, তাঁবু, বাসনপত্র এবং আমাদের স্যাকগুলো সব তোলা হলো, আরেকটা গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা সাতজন। এমিলি আর ওর পুরুষ বন্ধু আজান রয়ে গেল। ওরা ভিক্টরকে নিয়ে আরও দুদিন এখানে কাটিয়ে ফিরবে।
গাড়ি চলতে শুরু করল। কিছুটা গ্রাম্য পথ পেরিয়ে মূল রাস্তা ধরল মিনিট পনেরোর মধ্যে। তারপর ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ির ধাবমান হওয়া। দুপাশে সেই একই দৃশ্য। মাইলের পর মাইল শুধু বিরক্তিকর সাদা আর সাদা বরফ। মাঝেমধ্যে কয়েকটি পাতাঝরা গাছ, আকাশের দিকে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ আর্তনাদ করছে। কখনো-সখনো দু-চারটি ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি নিয়ে এক-একটি গ্রাম দেখা যাচ্ছে। বিশাল বললে কম বলা হয়, হাজার হাজার বিঘাজুড়ে এক-একজনের জমি, কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। জমি কেনার জন্য বোধ হয় এখানে পয়সা লাগে না। বেড়া দেওয়ার সামর্থ্য যার যত বেশি, তার ততটা জমি। গাড়ি চলতে চলতেই মেপে দেখেছি একজনের জমি লম্বায় ঠিক চার কিলোমিটার।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ ইরকটুস্ক শহরে আমাদের আস্তানায় ফিরে এলাম। ঘরে আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে বিদায় নেওয়ার আগে রোমান নির্দেশ দিয়ে গেল ঠিক সাতটায় ও আসবে, আমাদের জন্য আজ গ্র্যান্ড ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন প্রস্তুত হয়ে থাকি।
এবার কিন্তু সবাই বাইরে জুতা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়েই প্যাকিং করতে লেগে গেলাম। কয়েক ঘণ্টা পরেই আমাদের মস্কোর ট্রেন। যাওয়ার সময় বেশ কিছু লাগেজ আমরা এখানে রেখে গিয়েছিলাম। যে যার জিনিস ঠিকমতো নিয়ে প্যাকিং করে নিতে থাকলাম। তারই মাঝে দুজন দুজন করে স্নান করে নেওয়া। হঠাৎ বাইরে রতনদার চিৎকার শুনতে পেলামÑতোমরা কেউ কিছু মানছ না। ডাশা বারবার অনুরোধ করেছে যেন বাথরুমের মেঝেতে জল না থাকে। অথচ দেখ কী করে রেখেছ, ছি…।
ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় রোমান এল। কিন্তু কারোরই খিদে নেই। আসার পথে মাত্র তিন ঘণ্টা আগে নাভির নিচ থেকে গলা পর্যন্ত ঠেসে খেয়েছি। তা ছাড়া রাশিয়া এত বড় জায়গা, আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ, তাই জায়গায় জায়গায় সময়ের বিশাল ফারাক। কয়েক দিন আগেও ছিলাম উত্তর গোলার্ধে রাশিয়ার বিখ্যাত বন্দর শহর মুরমানস্কে। সেখানের সঙ্গে এখানের সময়ের তফাত প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এক জায়গার সময়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার আগেই অন্য জায়গায় ছিটকে পড়া। গোটা রাশিয়ায় এমন ১১টা সময়াঞ্চল বা টাইম জোন আছে। খাওয়া-ঘুমের দফারফা করার জন্য যথেষ্ট। রাতের বেলায় কখনো জেগে আছি দিনের বেলায় ঘুমাচ্ছি, কখনো উল্টো। এই যে কিছুক্ষণ পরেই আমরা মস্কো যাওয়ার ট্রেন ধরব সেটা আজ অর্থাৎ ৮ মার্চ রাত ১০টা ৫২ মিনিটে ছাড়বে, টিকিটে তাই লেখা আছে। অথচ আমরা জানি যে স্থানীয় সময় অনুযায়ী সেটা ৯ তারিখ সকাল ৩টা ৫২ মিনিট। এখন সন্ধ্যা সাতটা, আমাদের শরীরবৃত্তীয় চাহিদায় খিদে এখন দিনের ঠিক কোন জায়গায় আটকে আছে কে জানে। অপূর্ব রোমানকে বলল, রেস্তোরাঁয় গিয়ে গ্র্যান্ড ডিনারে আমাদের কাজ নেই। তুমি যা খাওয়াবে বলে ঠিক করেছ, দয়া করে সেটা এখানে নিয়ে এসো, আমরা পরে খেয়ে নেব। সানন্দে রাজি হয়ে রোমান চলে গেল। এবং আধঘণ্টা পর ফিরে এল গাদাগুচ্ছের খাবার নিয়ে, সঙ্গে একটা বড় ভদকার বোতল। আমাদের অন্তিম বিদায় জানিয়ে রোমান বলল, রাত ঠিক দুটোয় ডাশা আসবে এবং আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে। হুট করে বেরিয়ে গেল রোমান। ওর শেষ কথাটা হজম করতে আমাদের বেশ সময় লেগে গেল। রাত দুটোয় ডাশা আসবে! বাইরে যখন তাপমাত্রা কমপক্ষে মাইনাস পঁচিশ, সে সময় একটা যুবতী মেয়ে এসে ঢুকবে একটা ঘরে, যেখানে সাত-সাতটা পুরুষ আছে, তা-ও ভদকায় ভরপুর হয়ে! অসম্ভব। সবাই নিজের কানকে সন্দেহ করতে থাকলাম। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো ডাশা আসবে না। কোনোমতেই নয়। তবু আমরা রাত সোয়া দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপরও দেড় ঘণ্টা সময় হাতে থাকবে। এখান থেকে স্টেশন হাঁটাপথে খুব বেশি হলে আধঘণ্টা সময়ের দূরত্ব। এত ঠান্ডায় কষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা তো বৈকালে রোজ কম করে আট ঘণ্টা হেঁটে এসেছি। স্টেশনটা ঠিক কোন জায়গায় মনে নেই, তবে আন্দাজ একটা আছে। অসুবিধা হবে না। এবার টেবিলে রাখা খাবারগুলো পর্যবেক্ষণ করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সত্যিই গ্র্যান্ড ডিনারের ব্যবস্থা। কিন্তু আমাদের সবার অবস্থাই এখন সক্রেটিসের মতো। শহরের বিপণীতে এত পসরার সম্ভার দেখে সক্রেটিস বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এত অসংখ্য ধরনের জিনিস আছে এই পৃথিবীতে! অথচ এর একটিরও আমার দরকার নেই।’ টলভাই ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি বললÑট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলে সাড়ে তিন দিন কাটাতে হবে। ট্রেনে খাবারের দাম প্রচুর, এই খাবারগুলো কাজে লাগাতে হবে। এখন বরং আমাদের সঙ্গে যে চাল-ডাল-আলু আছে, সেগুলো সেদ্ধ করে নিই। সঙ্গে মাখন আছে, ভালোই জমবে, কি বলো?
সবাই হইচই করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ চাল ধুচ্ছে, ও আলু কাটছে, সে ওভেন জালাচ্ছে…কেউ ভদকার বোতলটার কথা ভাবছে না। রোমান যে এই বোতলটা দিল, সেটার কী হবে? তিনটেই উপায় আছেÑহয় না খেয়ে বোতলটাকে এখানেই ফেলে যাওয়া, অথবা মস্কো পর্যন্ত এটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া, না হলে এখানেই এটার সদ্ব্যবহার করা। প্রথমটা ঠিক নয়, এক মহিলার বাড়িতে মদের বোতল রেখে যাওয়া খুবই কুরুচিকর। ট্রেনে মদের বোতলের মতো দাহ্য পদার্থ বহন করা আরও অনুচিত। তাহলে শেষ পর্যন্ত একটাই উপায় রয়ে গেল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে আমাদের এই সাতজনের দলে একজনের কাছে মদ হরিজন। অন্য তিনজন বড়দিনের সময় স্কটিশরা যেমন এক টুকরো রুটি চিবিয়ে নিয়মরক্ষা করে, তেমন আচমনেই আহুতি। আমি আর বাকি দুজনের কাছে এক ফোঁটা মদ মানে এক ফোঁটা রক্ত। গোরাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বোতলটার কী হবে? কাজ করতে করতেই আমায় উল্টো প্রশ্ন করল গোরাদা, আগ্রায় গিয়ে তাজমহল না দেখে থাকতে পেরেছিস? বললাম, দূর, তা হয় নাকি? ‘তাহলে রাশিয়ায় এসে ভদকা না খাওয়ার মতো পাপ করাও উচিত নয়।’
ভদকার অপার মহিমায় কাম্পফায়ার বেশ জমে গেল। আট দিনের উপোষী আত্মা শান্তি পেল। ১১টার মধ্যে খাওয়াদাওয়া, দাঁত মাজা সব শেষ। এখনো তিন ঘণ্টা সময় আছে। রতনদার ওপর সময়মতো জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাত দেড়টার সময় রতনদার হাঁকডাকে উঠে পড়ে সবাই প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। স্যাকগুলো সব দরজার কাছে এনে এক জায়গায় রাখা। তারপর যে যার শীতের পোশাক সব পরে নিলাম। ঠিক দুটো বাজতে পাঁচ মিনিটে কল বেল বাজল। দরজা খুলে দেখি ডাশা দাঁড়িয়ে আছে। স্মিত হেসে পরস্পরকে অভিবাদন জানালাম। ঘরে ঢুকে ডাশা একবার রান্নাঘর, খাবার জায়গা, টয়লেট এবং শোবার ঘরের অবস্থা দেখে নিল। মুহূর্তের জন্য ওঁর চোখমুখের বিরক্তি চাপা থাকল না। টয়লেটের মেঝেতে হালকা জল আছে। আমরা যেমন বাথরুমের মেঝেতে জল থাকবে না, এটা ভাবতেই পারি না, ওরা ঠিক উল্টোটাই ভাবে। কিন্তু তা বাদে সবই তো আমরা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে রেখেছি। বোঝাই যাচ্ছে যে ডাশার তা পছন্দ হয়নি। মুখে হাসি ফুটিয়ে ডাশা বলল, তোমরা এই কোণের দিকটায় একটু অপেক্ষা কর প্লিজ। হাতে সময় আছে, আমি একটু গুছিয়ে নিই, কেমন?
দূর থেকে দাঁড়িয়ে আমরা ওর মেহনতের জাদু দেখছিলাম। দশ-বারো মিনিটের মধ্যে ঘরটা ছবির ঘর হয়ে গেল। ডাশা হাসিমুখে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালে বিদ্যুৎ কাঁচুমাচু মুখে বলল, সরি ডাশা। ওর কাঁধে একটা মৃদু চাপড় মেরে ডাশা বলল, লেটস মুভ অন। পেছনে রুক-স্যাক আর সামনে ন্যাপ-স্যাকের ভেতর নিজেকে ঢেকে সবাই তিনতলা থেকে সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই একটা ছোট দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দরজার সামনেই রাস্তার ওপর জমে থাকা শক্ত বরফ, পিচ্ছিল হয়ে আছে। গাছের ছায়ায় জমাটি অন্ধকার। সবার সামনে ছিল সুদীপ্তিদা। একটা ছোট্ট গোল পাথরে পা পড়ে যাওয়ায় সুদীপ্তিদার পা হড়কে গেল। একটু হলেই সামনে-পেছনে স্যাক নিয়ে উল্টে পড়ত, ধরে ফেলল ডাশা। সুদীপ্তিদার কাঁধ থেকে স্যাক দুটো নামিয়ে নিয়ে গাড়ির পেছনে রাখল, তারপর কাছে এসে সুদীপ্তিদার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করল, লাগেনি তো?
মালপত্র সব ঠিকমতো তোলা হয়ে গেলে আমরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গাড়ির উষ্ণ আশ্রয়ে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট দিল ডাশা। সাতটা অকর্মণ্য ঘোড়াকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো সূর্য নয়, এক ঝলসানো চাঁদ। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না এই গভীর রাতে সবাই যখন সুখনিদ্রায় ডুবে আছে, তখন দিগন্তজুড়ে হিমাঙ্কের অনেক নিচে মর্গ হয়ে থাকা এই শীতলতায় সাতজন পুরুষকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে যাছেন একজন নারী।
গাড়িকে যেতে হবে অনেক ঘুরপথে, পেরোতে হবে অনেক ট্রাফিক সিগন্যাল। যদিও এই মাঝরাত্রিরে রাস্তাঘাট সুনসান, সিগন্যাল না মানলেও কিচ্ছু হবে না, এরা তবু বোকার মতো দাঁড়িয়ে যায়। আড়াআড়ি পেছনের সিটে বসে আমি একদৃষ্টে ডাশাকে দেখছি। প্রথম দিন দেখা সেই মিষ্টি সুন্দরীর সঙ্গে এই ডাশার অনেক তফাত। এর চোখমুখে অনেক কাঠিন্য, অনেক প্রত্যয়, হয়তোবা অভিমান। সার্চলাইটের তীক্ষè দৃষ্টি সামনে প্রোথিত করে সে ড্রাইভ করছে, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। মুহূর্তে মুহূর্তে আলোছায়া তার মুখের ওপর পড়ে পিছলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো এক আধিভৌতিক পথ ধরে আমাদের নিয়ে চলেছে ডাশা। একটা ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি দাঁড়াল। সিটের ওপর হাত ছড়িয়ে দিয়ে ডাশা একটা হাই তুলল। গোরাদা বলল, এই সেরেছে, ওর তো ঘুম পেয়ে গেছে। কোথাও না ধাক্কা মেরে দেয়। হালকা হেসে রতনদা বললেন, না না, ওর অভ্যাস আছে।
খুব রাগ হয়ে গেল দুজনের ওপর এবং নিজের ওপর। আধঘণ্টা হাঁটলে তো আমরা নিজেরাই স্টেশনে পৌঁছে যেতাম। কষ্ট কিছু হতো, কিন্তু বৈকালে হাঁটার থেকে তো তা অনেক কম। একটা মেয়ে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সংসারের আবশ্যকীয় কাজগুলো করে, তারপর মেয়েকে তুলে খাইয়ে-দাইয়ে পোশাক পরিয়ে স্কুলে নিয়ে যায়। এরপর নিজের উপার্জনের জায়গাটাকে আরও মজবুত ও আকর্ষণীয় রাখার জন্য মেহনত করে, এখান থেকে আবার স্কুলে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরে, সেখানে রান্না করা ঘর পরিষ্কার করা জামাকাপড় কাঁচা মেয়ের স্কুলের পড়া তৈরি করানো এ রকম হাজারটা কাজ সেরে আবার রাতে অতিথিদের স্টেশনে পৌঁছে দেয়। ঘুমানোর সময় পায় কখন? ট্যুরিস্ট যারা পয়সা দিয়েছে, তারা পরিষেবা তো নেবেই, ওটা তাদের অধিকার। কিন্তু আমাদের কথা বাদ দিলাম, রতনদা গোরাদা কি ট্যুরিস্ট? পায়ের ওপর পা তুলে অর্ডার দেওয়ার মতো ঘোরা তো ওরা কখনো ঘোরেনি। তাহলে এত বছর ধরে হিমালয়ের কত কঠিন কত অজানা পথ ধরে হাঁটা, নিজেদের মাল বওয়া, তাঁবু খাটান, হিম ঠান্ডায় রান্না করা, বাসন ধোয়া, চ‚ড়ান্ত কষ্ট তো বটেই, অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কঠিন গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করাÑসবই কি মিথ্যা? পয়সা দিয়েছি বলেই পরিষেবা নিতে হবে, তার কী মানে আছে? কেমন যেন মনে হতে থাকল মিথ্যা আমাদের এত পথচলা, কিছুই শিখতে পারিনি। বাজারের বেঁধে দেওয়া অন্ধকার গলি থেকে মুক্ত হতে পারেনি, মানবিক হতে পারেনি আমাদের তথাকথিত অভিজ্ঞ মন। গত আঠারো দিন রাশিয়ায় ঘুরেছি। বৈকালে কোনো উপায় নেই, কিন্তু অন্য সব জায়গায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজেরা পায়ে পায়ে হেঁটে ঘুরেছি, কতজনের সঙ্গে আড্ডা মেরেছি, তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছি জায়গাটার নিজস্ব মেজাজ। সকালে নিজেরা রান্না করে পেট পুরে খেয়ে বেরিয়েছি, রাতে বাড়ি ফিরেও তা-ই। দুপুরবেলায় শুধু কোনো কম পয়সার হোটেলে ঢুকে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিয়েছি। এত আনন্দ, কিছুতেই ট্যুরিস্ট না বনার এত পরিতৃপ্তিÑসব অন্তঃসারশূন্য মনে হচ্ছে।
সিগন্যাল খুলে গেল। আবার সেই স্টিয়ারিংয়ে হাত, গাড়ির চলতে থাকা। কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করতে থাকলাম ডাশার বিষণœ-কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে। ইউরোপের মেয়েদের জীবন এতটাই করুণ? হঠাৎ ভেতর থেকে একটা ‘না না’ চিৎকার শুনতে পেলাম। ডাশা নয়, ওর মুখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার পরিচিত অনেক নারীর ছবি। কত কত মুখ একের পর এক ডাশার মুখে দেখা দিচ্ছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে।
গাড়ি এসে দাঁড়াল স্টেশন চত্বরে। বাইরে এলসিডি ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে তাপমাত্রা -২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গাড়ির পেছনের ডালা খুলে মালপত্র তুলে নিয়ে সবাই পড়িমরি দৌড় লাগাল গেটের দিকে, স্টেশনের উষ্ণতায় দ্রæত আশ্রিত হতে। সুদীপ্তিদার স্যাকটা জোরজবরদস্তি নিজের কাঁধে তুলে নিল ডাশা। বলল, একটু পর থেকে তো নিজের ভার নিজেই বইবেন। বাইরে থেকে ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি। ট্রেন আসার সময় দেখাচ্ছে ০৮.০৩.২০১৮ রাত ১০টা ৫২ মিনিট। একে একে সবাই ভেতরে ঢুকে গেল। এবার আমার ঢোকার পালা। সবাইকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানানোর পর ডাশা আমার দিকে ঘুরল। আবারও একটা হাই, চাপার চেষ্টা করেও পারল না। ওর চোখেমুখে অনেক ক্লান্তি। এখন রাত তিনটে বাজে। এখান থেকে বাড়ি ফিরে শুতে না শুতেই আবার ওকে উঠে পরতে হবে, শুরু হবে নিংড়ে নেওয়া আরেকটা দিন। ভেতরে ঢুকে যাওয়ার আগে খুব ইচ্ছে হলো ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো আমি কোন হরিদাস, কোন উচ্চাসনে বসে আছি যে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দেব? আমার তো উচিত বরং ওর সামনে নতজানু হয়ে দুঃখ প্রকাশ করা। যদিও জানি তা পারব না। আমার একজোড়া গোঁফ আছে না! দীর্ঘ বছর ধরে পরিপাটি করে তৈরি করা গোঁফÑএকগুচ্ছ লোমের সমষ্টি। ডাশা জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগল আমাদের দেশ?
এখন এই সময়ে এসব ছেঁদো প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। কোনোমতে শুধু বলতে পারলাম, ভালো থেকো ডাশা…প্লিজ।