Skip to content Skip to footer

ভূস্বর্গ কাশ্মীরে স্বপ্নে ভরা কয়েকদিন

লিখেছেন তাহমিনা খাতুন

কাশ্মীর! ভূস্বর্গ কাশ্মীর!! আমার মত হয়তো অনেক মানুষেরই স্বপ্ন থাকে কাশ্মীরের অপার সৌন্দর্য একবার নিজের চোখে দেখারএবং প্রান ভরে উপভোগ করার। সেভাবেই পরিকল্পনা করা হল। এপ্রিল থেকে আগস্টমাস কাশ্মীর ভ্রমনের জন্য আদর্শ সময়। কারন এরপর শীত কাল শুরু হয়ে যায়। আর অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় বরফপাত।আমাদের যাত্রা দিল্লীথেকে জম্মু, জম্মু থেকে শ্রীনগর। শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের গাড়ী অনেকক্ষন ধরে চেক করা হল। বিমানবন্দর থেকে গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত চারবার চেকিং হল। কারন আমরা যাঁর গাড়িতে যাচ্ছিলাম, তিনি ছিলেন একজন কাশ্মিরী ডাক্তার। তিনি জানালেন মুসলিম হওয়ার কারনে তাঁকে প্রতিদিনই এই দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর। ৯৬০ খৃষ্টাব্দে বিখ্যাত ঝিলাম নদীর তীরে নয়নাভিরাম শ্রীনগর কাশ্মীরের গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী হিসাবে মর্যাদা পায়। ইতিহাসবিদদের মতে মৌর্য সম্রাট অশোক কর্তৃক দুই হাজার বছরেরও বেশী আগে শ্রীনগরের প্রতিষ্ঠাহয়েছিল।শ্রীনগর নামটির মধ্যেই রয়েছে একটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা।’শ্রী’ অর্থ লক্ষী নগর অর্থ শহর-এই দুই মিলে হয়েছে শ্রীনগর।শ্রীনগরকে রৌদ্র করোজ্জল শহর বা ‘ সিটি অব সান’ বলা হয়। আবার শ্রীনগরকে blessed city বা আশীর্বাদপুষ্ট শহর ও বলাহয়ে থাকে।নয়টি ব্রীজ, সমৃদ্ধ জলপথের কারনে শহরটিকে ইটালীর ভেনিস শহরের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। শ্রীনগরের ‘শিকারা’ নামের নৌকাকে ভেনিসের ‘গন্ডোলা’হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

যাই হোক, আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল শ্রীনগরের বিখ্যাত ডাললেকে। ২৬ কি.মি আয়তনের ডাল লেকটি শ্রীনগরের প্রান।ডাল লেককে ‘কাশ্মিরী মুকুটের রত্ন’ বলা হয়ে থাকে। ডাললেকের ভিতরে নৌকার উপর একটি তিন কামরা বিশিষ্ট গেষ্ট হাউস।গরম পানির ব্যবস্থা সহ বাথ টাব থেকে শুরু করে আধুনিক জীবন-যাপনের সব ধরনের ব্যবস্থাই আছে বোট হাউসে। ডাল লেকেএ ধরনের অসংখ্য হাউস বোট রয়েছে। এমনকি ড্রয়িং, ডাইনিং বারান্দাসহ পাঁচ, ছ্য় বেডের হাউস বোটও রয়েছে ডাল লেকে।হাউসবোট গুলির অবস্থান ডাললেকের মাঝামাঝি বা মূল সড়ক থেকে লেকের অন্য প্রান্তে। যে কারনে হাউস বোটে পৌঁছানোরজন্য লেকের সামনেই ভিড়ানো থাকে রকমারী বাহারী সাজে সজ্জিত ছোট ছোট নৌকা। এই নৌকা গুলির নামই ‘শিকারা’।ভ্রমণকারীরা এই ‘শিকারায়’ চড়ে পুরো ডাল লেক ঘুরতে পারে।

বিকালেই ‘শিকারা’য় চড়ে ডাল লেক ঘুরে আসা হোল।পুরো লেকটি জুড়েই রয়েছে হরেক রকমের নাম না জানা লতাপাতা, হাঁস, পানকৌড়ি, নাম না জানা পাখ-পাখালি। লেকের পানি এত পরিষ্কার যে অনেক গভীর পর্যন্ত তা দৃষ্টিগোচর হয়।স্থলের পাশাপাশিবিশাল ডাল লেক জুড়ে শ্রীনগরের ব্যবসা-বানিজ্য পরিচালিত হয়।একই সঙ্গে কৃত্রিম উপায়ে শাক-সবজী ফুল ফলের চাষাবাদ ওচলে ডাল লেকের ভিতর।
বোট হাউসের বারান্দায় অথবা সামনের খোলা পাটাতনে দাঁড়িয়ে ডানে বাঁয়ে যেদিকেই দৃষ্টি ফেরানো যায়, চোখে পড়বে সুউচ্চপর্বতমালা। রাতের বেলা বোট-হাউসের বারান্দায় বসে চাঁদের আলোয় কাশ্মীরের বুনো সৌন্দর্য উপভোগ করা-সত্যিই উপভোগকরার মত।মন জুড়িয়ে দেয় এক মায়াময় অপার্থিব ভাল লাগা।মনে করিয়ে দেয় আমাদের সুন্দর বনের হিরন পয়েন্টের কথা !যেখানে চারিদিকে ঘন বন আর খাল এক সাথে জড়াজড়ি করে আছে।
আবার রাতে বোট-হাউসের বিছানায় শুয়ে নৌকার দুলুনি উপভোগ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ার অনুভূতিও অনবদ্য। ভোরেপাখীর কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ছায়া সুনিবিড় শান্ত গ্রামের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বোটহাউসের সামনেই পরিষ্কার টলটলে স্বচ্ছ পানি।হাউসের মালিকের পরিবার ওই পানিতেই দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজকর্মসম্পাদন করে থাকে।নৌকায় হরেক রকমের পন্যের সম্ভার সাজিয়ে হাজির হয়ে যায় বিক্রেতা, যার মধ্যে রয়েছে পোশাক, বিভিন্নধরনের সুগন্ধি মশলা, হরেক রকমের বাদাম,আখরোট ইত্যাদি। নৌকার ফেরীওয়ালাদের কাছ থেকে কিছু কেনা গেল।কাশ্মীরেরঐতিহ্যবাহী পোশাকে ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যানও হাজির হয়ে যায়
হাউস বোটে। এ ছাড়া পুরো ডাললেক জুড়েই রয়েছে এমন বড় বড় বোটের মধ্যে সব ভাসমান দোকান। এই সব দোকানে মিলবেনিত্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের দ্রব্য সামগ্রী।’শিকারায়’ করে এসব বোটের দোকান থেকে কাশ্মীরি শাল, সোয়টার ইত্যাদি কেনাহলো।

আমাদের পৌঁছার পরের দিন থেকে শুরু হোল কাশ্মীর দর্শন।শ্রীনগর থেকে মাইক্রোবাসে প্রথম দিন যাওয়া হলো গুলমার্গ। যাত্রাপথে বাড়তি আনন্দ পেলাম ছোট বেলায় ভুগোলে পড়া ঝিলাম নদ দর্শনে। ঝিলামের এপারে কাশ্মীরের ভারতীয় অংশ, ওপারেপাকিস্তানের অংশ।সব নদীই সুন্দর। ঝিলাম ও তার ব্যতিক্রম নয়। রাস্তা ধরে ছুটে চলার সময় কাশ্মীরের গ্রামীন জীবনেরও কিছুধারনা পাওয়া গেল।গাড়ী চলছিল আপেল, আঙ্গুর, আখরোট, নাশপাতি ইত্যাদি বাগানের পাশ দিয়ে। হাইওয়ে দখল করে ঘুরেবেড়াচ্ছিল বড় বড় শিং আর কানের অধিকারী কাশ্মীরী ছাগলের পাল।এদের হাঁটার সময় ‘কাউকে গ্রাহ্য করি না’ ভাব ছিলসত্যিই দেখার মতো।এদের পিছনে আমাদের গাড়িকে এগুতে হচ্ছিল খুবই ধীরে ধীরে। কারন এরা স্বাধীন! তাই কারও জন্য রাস্তাছেড়ে দিতে নারাজ।মনে পড়ে গেল সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশের’ একটি বর্ননায় তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের পেশোয়ারশহরের স্বাধীন পাঠানদের কথা।স্বাধীন পাঠানরা কারো জন্য পথ ছেড়ে দেয না।তারা রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটে। গাড়ী ঘোড়াইএঁকে বেঁকে পথ করে চলে।
ছাগলগুলির বড় বড় কান আর লোম এত বড় ছিল যে তা মাটি স্পর্শ করছিল।এদের বিশাল বড় পালকে বাগে আনতে এদেরপালকদের রীতিমত গলদঘর্ম হতে হচ্ছিল। ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানা গেল এই ছাগলের লোম থেকেই কাশ্মীরের পৃথিবীবিখ্যাত পশমিনা শাল তৈরী হয়ে থাকে। এই বিশেষ জাতের ছাগলের লোম সংগ্রহের প্রক্রিয়াটির কারনে এই প্রানীটির অস্তিত্বওবিলুপ্তির পথে।তবে স্বস্তির বিষয় হলো এ প্রানিটির বিলুপ্তির কথা চিন্তা করে পশমিনা তৈরী নিষিদ্ধ করা হয়েছে।স্বার্থপর বিলাসীমানুষের বিলাসিতার জোগান দিতে গিয়ে কত প্রানির অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে!