Skip to content Skip to footer

অতিথিপরায়ণ চন্দননগর

লেখক: আসমা বেগম

প্রাত্যহিক কাজের একঘেয়েমি কাটাতে আমরা অনেকেই নতুন জায়গা, নতুন মানুষ ও নতুন অভিজ্ঞতার খোঁজে ভ্রমণে বের হই। আমার পেশার কারণেই বাংলার নানান প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়। ভ্রমণের আনন্দটাই হয়তো আমাকে অবসাদগ্রস্ত হতে দেয় না—প্রতিটি সফর যেন নতুন কিছু শেখার ও অনুভব করার সুযোগ এনে দেয়।

আজকাল ফেসবুকে অনেকের ভ্রমণের গল্প চোখে পড়ে, সেখান থেকেই গড়ে ওঠে নতুন বন্ধুত্ব। তেমনই এক বন্ধু অভিষেক, যার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক শহর—চন্দননগর। একসময় ফরাসিদের উপনিবেশ ছিল এই শহর, যা ইংরেজ শাসিত কলকাতার সাথে পাল্লা দিত।

কলকাতায় বহুবার যাওয়া হলেও চন্দননগর দেখা হয়নি। অভিষেকের বহুদিনের অনুরোধ এবার আর ফিরিয়ে দিলাম না। হায়দ্রাবাদ যাওয়ার পথে কলকাতা হয়ে কয়েকদিন চন্দননগরে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলাম।

চন্দননগরে প্রথম দিন

নির্ধারিত দিনে করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডে নামতেই অভিষেক তার শৈশবের বন্ধু রুদ্রকে নিয়ে হাজির। পথে হালকা নাস্তা করে রওনা দিলাম—কলকাতা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের চন্দননগরের পথে। জুনের প্রচণ্ড গরমে গাড়ির এসি যেন রক্ষা করল। দীর্ঘ যাত্রা শেষে পৌঁছে দেখি—আমাদের জন্য পুরো বাড়ি অপেক্ষায়। মাতৃস্নেহে ভরা কাকিমা, যাকে আগে কলকাতায় দেখেছি, এবার নিজের ঘরের মানুষ হয়ে গেলেন।

অভিষেকদের ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমাদের জন্য দুটো ঘর আগে থেকেই প্রস্তুত। রাতে জম্পেশ ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে কাকিমা হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা মাঠা নিয়ে হাজির—শুনলাম, খালি পেটে মাঠা নাকি খুব উপকারী।

ঐতিহাসিক শহরের পথে পথে

চন্দননগরের প্রতিটি অলিতে-গলিতে লুকিয়ে আছে ইতিহাসের ছাপ। ফরাসি উপনিবেশ হওয়ায় ব্রিটিশ পুলিশকে অনুমতি নিয়ে এখানে ঢুকতে হতো—এই সুযোগে বিপ্লবীরা আশ্রয় নিতেন এখানে। আমরা ঘুরে দেখলাম বিপ্লবী মাখনলাল ঘোষালের বাড়ি, যেখানে প্রতিটি ঘর তার উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে আছে। এমনকি সেই পুকুরটিও দেখলাম, যেখানে তিনি ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ছিলেন।

শহীদ কানাইলাল বসুর শৈশব কেটেছে এই শহরে—এখানে আছে তার ভিটে, নামাঙ্কিত বিদ্যালয় ও ক্রীড়াঙ্গন। বিকেলে গঙ্গার তীরের ঘাটে বসে নদীর হাওয়া খেতে খেতে উপভোগ করলাম বৈকালিক ভ্রমণ ও পানিপুরির স্বাদ।

রবীন্দ্রনাথ ও পাতালবাড়ি

চন্দননগরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিকবার এসেছেন। তার স্মৃতিবিজড়িত পাতালবাড়ি—স্ট্র্যান্ডের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত এক ভূগর্ভস্থ বাড়ি, যার সর্বনিম্ন তল গঙ্গার জলে নিমজ্জিত। গঙ্গার উত্তাল স্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে অভিষেকের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শোনা—সে এক অন্য অভিজ্ঞতা।

বাজারে গিয়ে গরমের মাঝে খেয়েছি দোকানির হাতে তৈরি লাচ্ছি। মৌসুমি ফলের স্বাদও মিস করিনি।

মন্দির, মিষ্টি ও মানুষের ভালোবাসা

চন্দননগরে আছে ষোড়শ শতাব্দীর বহু মন্দির—নন্দদুলাল মন্দিরসহ। একদিন মন্দির দর্শনে গিয়ে বন্ধু হুমায়ুন দেয়াল টপকে ফুল তুলে দিলো—আমি সেগুলো মাথায় গুঁজে নিলাম, যেন ভ্রমণের স্মৃতি আরও রঙিন হয়ে উঠল।

এ শহরের মিষ্টির খ্যাতি সুবিদিত। প্রথমবার খেলাম বিখ্যাত ‘জলভরা সন্দেশ’ আর বেক্টেড রসগোল্লা—স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে।

মানুষের টান

চন্দননগরের সবচেয়ে বড় সম্পদ এর মানুষ। অভিষেকের যৌথ পরিবারের আন্তরিক আতিথেয়তা, নতুন বন্ধুদের হাসি-খুশি মুখ—সবকিছু মিলে এই শহর আমার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রইল। হয়তো একদিন আবারও ফিরে যাব, মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা সঞ্চয় করতে।