Skip to content Skip to footer

অর্ধ সূর্যের দেশে

লিখেছেন ঋতা বসু

আর যেখানেই যাই না কেন সপ্তসাগর পার নাইজেরিয়া যাবো এটা কোনোদিন ভাবিনি। দীর্ঘদিন শিশু শিক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে আচমকা একটা সুযোগ এসে গেল। কয়েক বছর আগের এক অগাস্ট মাসে কয়েকজন স্কুল শিক্ষিকাকে মন্টেসরি ট্রেনিং দেবার জন্য নাইজেরিয়া রওনা দিলাম। থাকার মেয়াদ তিন সপ্তাহ। আফ্রিকার পশ্চিম উপকুলে সিন্ধুর বিন্দু লাগোস শহর আমার গন্তব্য।

কলকাতা থেকে দুবাই হয়ে নাইজেরিয়া। দুবাইয়ের পর থেকে আফ্রিকার লোকজনেই প্লেন ভর্তি দেখলাম। দুবাইয়ের কেঠো ব্যবহারের পর প্লেনের ভেতর সম্পূর্ণ অন্য এক জগত। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে আড় ভাঙার জন্য মাঝরাতে প্লেনের ভেতর হাঁটছিলাম। সরু সরু বিনুনি বাঁধা বিমানবালা গায়ে পড়ে আলাপ করে পোলারয়েড ক্যামেরায় ছবি তুলে তক্ষুণি কাগজের ফ্রেমে  আটকে ওপরে নিচে পান আকৃতি হৃদয়ের ছবি এঁকে একটি চুমুসহ আমাকে উপহার দিল।মাঝরাতের ঝিমন্ত প্লেনে এত দুরন্ত ব্যাবহারে যা অবাক হলাম বলার নয়। বিমানসেবিকাদের থেকে সব সময় আমরা এক ধরনের সদয় যান্ত্রিক ব্যবহার পেয়ে থাকি। সেটা ধনী গরীব সব দেশেই এক -প্রবলভাবে আন্তর্জাতিক। এই জাতীয় পাগলামি যে কোথাও সম্ভব সেই জ্ঞানও লাভ হল।

লাগোস এয়ারপোর্টটা খুবই ছোট।কনভেয়ার বেল্টটা আরও ছোট। মালের জন্য দাঁড়াতে হলো প্রায় দু’ঘণ্টা। সেনা বিদ্রোহে নিহত প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্তালার নামে এয়ারপোর্ট।১৯৬০ সালে নাইজেরিয়া ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর নাইজেরিয়ার কুখ্যাত বায়ফ্রার গৃহযুদ্ধ।সেই থেকে  ১৯৯১ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময়টাই সেনাশাসন। শেষ সেনাপ্রধান  স্বৈরাচারী আবাচার পর থেকে এখন পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। এখানে আমেরিকার মতো প্রতিটা স্টেটের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ পদে আছেন প্রেসিডেন্ট। তারপরে স্টেট থেকে নির্বাচিত সেনেটরের দল।

নাইজেরিয়া আসছি শুনে শুভাকাঙ্ক্ষীর দল একটা কথাই বলেছিল –সাবধান। এটা সত্যি পাশ্চাত্য দুনিয়া অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য মনে করি বলে বলে ওই দেশগুলো আমাদের কাছে যত পরিচিত আফ্রিকা তত নয়। তার মধ্যে নাইজেরিয়া তো নয়ই। কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ নাইজেরিয়া আসেনা।অজস্র রোজগার করেও খরচের কোন উপায় নেই সেখানে। পর্যটক এর জন্যও কোন লোভনীয় হাতছানি নেই । সবমিলিয়ে একটু উদ্বেগ নিয়েই রওনা দিয়েছিলাম।কিন্তু প্লেন থেকে নিচে রাঙামাটি আর ঘনসবুজ দেখেই মনটা খুশি হয়ে গেল।

লাগোস ভারতবর্ষের যে কোনো মাঝারি শহরের মত। সমস্ত  সরকারি প্রতিষ্ঠানের গায়ে নাইজেরিয়ার প্রতীক অর্ধসূর্য আঁকা। পেট্রোল সস্তা বলে গরিবী সত্ত্বেও গায়ে গায়ে লাগা গাড়ি অথচ রাস্তা নেই ফলে অনন্ত ট্র্যাফিক জ্যাম। সব গরিব দেশের মত গাড়ী এখানেও সামাজিক সম্মানের চিহ্ন। ব্যবহার হোক বা না হোক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যেকের বাড়ির সামনে দারোয়ানের মত। ইউরোপের যত সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি চলে আসে নাইজেরিয়ায়। সেই জন্য রাস্তায় কত রকম যে গাড়ি আর বিশেষ করে মার্সিডিসের ছড়াছড়ি। এই ট্রাফিক জ্যাম মোকাবিলা করতে এক অভূতপূর্ব পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্ম হয়েছে।তার নাম ওকাডা । যেটা এখন আমাদের এ্যাপ ক্যাব কম্পানীগুলোও অনুসরণ করেছে- ,মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাতে বাড়তি হেলমেট নিয়ে মোটরবাইকে  অপেক্ষা করে ছেলের দল। যাত্রী পেলেই পেছনে বসিয়ে ছুট।একটি বাহন, একজন চালক,এক যাত্রী। গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সময় মত পৌছনোর জন্য আবালবৃদ্ধবনিতার নির্ভরযোগ্য বাহন ওকাডা। মাইলের পর মাইল নিশ্চল গাড়ির মিছিলের মধ্যে বসে এঁকেবেঁকে পথ করে চলে যাওয়া ওকাডার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি কতবার।

এখানে পা দিয়েই নাইজেরিয়ার মেয়েদের মাথায় চোখ আটকে গিয়েছিল। চুলের কথা না বললে এখানকার মেয়েদের কথা প্রায় কিছুই বলা হয় না। মাথা নিয়েই তাদের যত মাথাব্যথা। পোশাকে পুরোপুরি পাশ্চাত্যের অনুকরণ করলেও চুলের সাজসজ্জায় তারা সনাতনপন্থী। অজস্র সরু সরু বিনুনী সবার মাথায়। পরে শুনলাম এগুলো আলাদা কিনতে পাওয়া যায়। প্রায় নব্বই ভাগ মেয়েই এই গুলো ব্যবহার করে। নিজের চুলের সঙ্গে মিশিয়ে বিনুনির বোঝা এরা মাথায় আটকে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় বিনুনি বাঁধার সেলুন। মাসের-পর-মাস এই কেশসজ্জার ফলে এদের গায়ে ঘাম আঠা মেশানো বিচিত্র এক গন্ধ লেগে থাকে সবসময়। এছাড়া আছে পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং কাপড় মাথায় বাঁধা -সেটা সাধারণ হেয়ার ব্যান্ডের মত সরুও হয় আবার বিরাট পাখির বাসার মত পাগড়িও হতে পারে। প্রায় নব্বই ভাগ মেয়েই মাথা মুড়িয়ে নকল বিনুনি লাগায় নয়ত বিভিন্ন ফ্যাশনের পরচুল পড়ে।

নাইজেরিয়ায় আউসা ইবো ইরোবা এই তিন প্রধান উপজাতির মধ্যে আবার প্রায় দুশো রকমের নানা গোষ্ঠী আছে। এদের নিজেদের মধ্যে বর্ণভেদ প্রবল।মেলামেশা আরেকটু গভীর হতে দেখলাম আধুনিকতা শুধু পোশাকে ও ইংরেজি বুলিতে। সমাজের মধ্যে মধ্যযুগীয় পুরুষতন্ত্রের ঘাঁটি বেশ শক্ত। ট্রেনিংয়ের ফাঁক ফোকরে ছাত্রীদের ঘর-সংসারের কথা জিজ্ঞেস করতাম। বিবাহিতদের অনেকগুলো ছেলে মেয়ে। উর্বরা স্ত্রী-পুরুষের সম্পদ। অনেকে বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে তা প্রমাণ করে। পুরুষ মানুষের বহুগামিতা মেয়েরা দেখলাম মেনেই নিয়েছে যেন এটাই স্বাভাবিক। তার প্রতিক্রিয়াতেই বোধহয় সমাজের মধ্যেও যৌনতা নিয়ে শুচিবাই কম। ভাইবোনের পরিচয় দিতে গিয়ে সেম ফাদার সেম মাদার বলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

নাইজেরিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ আর তেলের জন্য আফ্রিকার মধ্যে অন্যতম ধনী দেশ কিন্তু দুর্নীতি এত প্রবল যে সম্পদ একাংশের মধ্যেই সীমিত।ধনীরা তাদের বিত্তের সঙ্গে বউ এবং সন্তান বৃদ্ধি করে চলে বেশ গর্বের সঙ্গে। আমাদের একটি মাঝারি মাপের আবাসনে একটি সংসারের সহাবস্থান সাধারণ ঘটনা। বিবিসির সাংবাদিক এইরকমই এক পরিবারের মহিলাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন তোমাদের এত জনের একটি স্বামী এটা খারাপ লাগে না? মেয়েরা বলেছিল- একটা মিষ্টি পেঁপে একা খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেটা যদি পচা হয় তাহলে যত জনের মধ্যে ভাগ হয় ততই ভাল।

উচ্চপদস্থ অবস্থাপন্ন এক নাইজেরিয়ান ভদ্রলোক খুবই গর্বের সঙ্গে জানালেন তিনি তার বাবার পাঁচ নম্বর স্ত্রীর আট নম্বর সন্তান।

মুসলমান খ্রিস্টান ও সনাতনপন্থী এই তিন ধর্মমত বজায় থাকলেও আমার সঙ্গে শুধু গরীব থেকে বড়লোক খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেই মুলাকাত হয়েছে। তবে তাদের রীতিনীতি স্থানীয় উপাদান নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক চেহারা নিয়েছে। এখানে খ্রিস্টানদের মধ্যে বহুবিবাহ অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা।ধর্ম এক হলেও এক গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেক গোষ্ঠীর প্রেম হলে পরিণতির পথে বিস্তর বাধা। যদি বিয়ে হয়ও স্বামীর অকাল মৃত্যু হলে স্ত্রীর দুরবস্থার সীমা থাকে না। সন্তান মেয়ে হলে অবস্থা আরও ঘোরতর। সকন্যা মাকে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও স্বামীরা ইচ্ছে করলে স্ত্রী পরিত্যাগ করতে পারে। আরও বিয়ে করতে পারে।রক্ষিতা  রাখতে পারে বুক ফুলিয়ে।

পুরুষতন্ত্রের শক্ত ঘাঁটি নাইজেরিয়ার সমাজ উইমেন্স বিলের জন্য লড়াই করছে বহুবছর। এতদিনে তারা সফল হয়েছে কিনা জানিনা।

মেয়েদের বলছিলাম স্বামীরা অন্যায় করলে তোমরা অন্তত অভিযোগ তো জানাতে পার।

সবথেকে উজ্জ্বল ছাত্রীটি বলল-মার খেয়ে নালিশ করলে পর ফিরে এসে আবার তো মার খেতে হবে।

অথচ চটি জামা-জুতো চলাফেরার স্বাধীনতায় এরা প্রথম বিশ্বের মেয়েদেরই মত। আশ্চর্য হচ্ছিলাম এই বৈপরীত্যে। জিজ্ঞেস করলাম-স্বামী ত্যাগ করলে তোমাদের খরচপত্র পাবার জন্য কী কর?

-যদি কোর্ট ম্যারেজ হয় তাহলে ডিভোর্স হলে খানিকটা খরচ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ট্রাডিশনাল বিয়েতে লবডঙ্কা।

অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা – জীবনযাত্রার প্রাথমিক ব্যাপার গুলো সবই খুব দামী।তাহলে বিচ্ছিন্ন অসহায় অবস্থার জন্য কোর্ট ম্যারেজই তো ভালো। সেটা বলায় তারা প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল- তা হয় না। তাহলে মনে হবে দুই পরিবারেই এই বিয়েতে মত নেই। সবার ব্লেসিং চাই।

আফ্রিকা হল ল্যান্ড অফ ফেস্টিভ্যালস।কত ফাংশন থাকে ট্র্যাডিশনাল বিয়েতে।  যার যত পয়সা তত লম্বা ফাংশন।কখনও কখনও ছমাস একবছর ধরে চলে ।

-সেটা কেমন?

– বিয়ের বেশ কয়েকদিন আগে থেকে মেয়েকে রেডি করা হয় বিয়ের জন্য। শ্বশুর বাড়িতে কেমন করে চলবে, স্বামীকে কিভাবে খুশি করবে সেটাই বিষয়। অভিজ্ঞরা সেক্স এডুকেশন দেয়। খাইয়ে খাইয়ে আর নানা রকম মাসাজ করে হবু বধূকে মোটা করা হয়। মোটা বউ স্বামীর সম্পদের প্রতীক। মোটা বউ শ্বশুর বাড়িতে বেশি আদর পায়। আহা-এই নিয়মটা যদি সব দেশে থাকত। জিরো ফিগারের করিনা কাপুর কিন্তু এদেশের বিচারে কুৎসিত। সেজন্য সব মেয়েরই লক্ষ্য বক্ষ ও নিতম্বে ওজনদার হয়ে ওঠা।

উৎসবের দেশ বলে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ এই উৎসবের ঠেলায় মানুষ কপর্দকশূন্য হয়ে যায়। আফ্রিকাতে বিয়ে শুনলাম ওপেন টু অল. আমাদের বিয়ের চিঠিতে ‘সবান্ধবে নিমন্ত্রণ” শুধু কথা কথা। এখানে সেটা যথার্থই কাজে পরিণত হয়।তিনশো জনের নিমন্ত্রিত হলে ছশো জনের আয়োজন করতে হয়। দেশে থাকতেই ডেবরার বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়েছিলাম। এদের অনেকেরই একবার চার্চে আবার গ্রামে গিয়ে ট্র্যাডিশনাল বিয়ে হয়। আজকাল কেউ কেউ রেজিস্ট্রিও করছে। খুব ইচ্ছে থাকা সত্বেও গ্রামের বিয়ে তো আর দেখা হবে না তাই চার্চের বিয়েতেই গেলাম। ওয়েডিং বুকে লম্বা অনুষ্ঠানসূচী।শুরু ও শেষের দীর্ঘ প্রার্থনা ও গান ছাড়াও রয়েছে হরেক অনুষ্ঠান।সবথেকে মজা লাগলো দেখে বিয়ের শেষে বর-কনে কার সঙ্গে কার আগে বা পরে ছবি তুলবে তার লম্বা তালিকা আগেই ওয়েডিংবুকে ছাপানো।ছবি তোলা একটা পর্ব।সেটা শেষ হলে পর নাচতে নাচতে সবাই ঢুকলে পর আবার বারো দফা অনুষ্ঠান– ইনভিটেশন টু দ্য হাই টেবল্‌,গ্র্যান্ড এন্ট্রি,কেক কাটিং,ফিডিং আওয়ার,ফার্স্ট স্টেপস্‌,গিফট গ্যালর, এমনি কত কী।শেষে লম্বা প্রেয়ার। নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা দেখে চোখ ক্রমশ বিস্ফারিত।ফিলিপ্পা মাত্র ছমাস আগে বিয়ে করে তিন মাসের গর্ভবতী। নানা দিক দিয়েই সে বিদ্রোহিনী।আড়ম্বরহীন ভাবে অন্য গোষ্ঠীর ছেলেকে বিয়ে করেছে।

সে বলল, আমি শুধু একদম কাছের আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুদের বলেছিলাম। -কতজন সবসুদ্ধ?

– খুব কম। আসলে আমরা গাড়ি কিনব বলে পয়সা জমাচ্ছি তাই চারশো জনের বেশি নেমন্তন্ন করিনি। নামকরণ ও ব্যাপ্টিজিমও আমরা খুব সাধারন করে করব ওই জাস্ট আত্মীয় আর বন্ধুরা।

ওই “ জাস্ট আত্মীয়” আর বন্ধুর সংখ্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আফ্রিকানদের উষ্ণ হৃদয়।

মৃত্যু যদি একেবারে অকালে না হয় তাহলে উৎসবের আয়োজনের জন্য মৃতদেহ দু-তিন মাস ধরেও ঠাণ্ডা ঘরে থাকতে পারে। রোজমেরির ঠাকুরদাকেই নাকি এভাবে রাখা হয়েছিল। তারপর সবার সুবিধামত দিন দেখে টাকা-পয়সার যথেষ্ট ব্যবস্থা করে মৃতদেহ সমাধিস্থ করে বিশাল ভোজ। আমাদের শ্রাদ্ধও কখনও কখনও বেশ জমকালো ব্যাপার কিন্তু সেটার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট। উৎসবের আয়তন বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করা হয় না।ক্লাসের ছাত্রীরা সেটা মানতে চায় না।বলে ওল্ড পিপ্ল্‌ ক্যান নট গো আন নোটিসড্‌।

এখানকার অন্যতম প্রধান খাদ্য ইয়াম মেটে আলুর মত। আয়তনে এত বিশাল যে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম গাছের গুঁড়ি। সেই ইয়াম পরিণত হলে পর হয় নিউ ইয়ামস ডে।মনে পড়লো আমাদের নবান্নর কথা। তাছাড়া মেনস্‌ ডে, রিটার্ন অফ নিউ ইয়াম,বেকিং অফ ফয়েল উড আরও কত কি।অজস্র গোষ্ঠী আর তাদের অন্তহীন উৎসব। কথা বলে যা বুঝলাম নাম আলাদা হলেও সবই ঐতিহ্যকে স্মরণ করে অশুভকে তাড়িয়ে শুভকে বরণ করার উৎসব।

এইরকম যেকোন ছুতোয় ছোট-বড় নানা উৎসব উৎসব মানে নাচ-গান আর ভোজ ।নাচ এদের রক্তে ।আধুনিক মলের সেলস বয় এক পাক নেচে তাক থেকে জিনিস পারে।আবার ট্রাফিক পুলিশ দেখি মাঝে মধ্যে নাচের ভঙ্গিতে ট্রাফিক কন্ট্রোল করে একঘেয়েমি কাটায়।

একদিন গেলাম বাডাগ্রি।।ওইদিনই প্রথম নিজেকে একটু ট্যুরিস্ট বলে মনে হয়েছিল।এখানে একা কেউ বেড়াতে যায় না। আমাদের সঙ্গে আর একটি পরিবারও যাবে। পথে যা খাওয়া হবে তার বিরাট আয়োজন দেখে একটু নিরাশ হলাম কারণ স্থানীয় খাবার চেখে দেখার এমন সুযোগ মাঠে মারা গেল।

ভাগ্যিস অভিজ্ঞরা আমার কথায় কান দেননি।মাইলের পর মাইল ধু ধু রাস্তার দু ধারে নিরাপত্তার অভাবে এবং পর্যটন শিল্পের অনুপস্থিতির জন্য একটি দোকানও নেই।এমনকি ছোটখাট কোল্ডড্রিঙ্কের দোকান পর্যন্ত নেই। তবে উপচে পড়া প্রকৃতি দেখে মন ভরে যায়। লাগোসের গাছপালা প্রকৃতি সবই আমার চেনা।বিশেষ করে আমগাছ দেখেছি যেখানে সেখানে আর অগাস্ট মাসেও প্রচুর আম ফলে আছে।গাছের একদিকে মঞ্জরী অন্যদিকে ফল দেখে জিজ্ঞেস করে জানলাম এগুলো সবই বারোমেসে গাছ। তবে দুষ্টু ছেলেরা গাছ তছনছ করে আম পাড়ে না কেন তার জবাব অবশ্য পাইনি।

আটলান্টিকের একেবারে পাড় ঘেঁসে বাডাগ্রি। স্লেভ ট্রেডের জন্য ঘানা সেনেগলের মত বিখ্যাত না হলেও আফ্রিকার সবথেকে প্রথম দাস ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে এর গুরুত্ব।সাড়ে পাঁচলাখ মানুষ এই পোর্টের মাধ্যমে পাচার হয়ে গিয়েছে। একেবারে আটলান্টিকের খাঁড়ির গায়ে বাডাগ্রি ভৌগোলিক কারণেই দাসব্যবসার প্রধান কেন্দ্র ছিল ১৭৪০ থেকে ১৮৯০ পর্যন্ত।আমরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেই ঐতিহাসিক জলরাশির সামনে।

বাডাগ্রির মিউজিয়মে দ্রষ্টব্য বলতে ক্রীতদাস প্রথা সংক্রান্ত যা কিছু। দাসব্যবসার কথা না জানলে তো আফ্রিকার প্রায় কিছুই জানা হয় না।দেখলাম দাসেদের ব্যবহৃত লোহার শেকল,হাতকড়া, পায়ের বেড়ি।মানবশৃঙ্খল তৈরি করার জন্য হাড় ফুটো করার লোহার ঘুর্ণি শিক দেখে শিউরে উঠেছিলাম।এইখানেই আছে আফ্রিকার প্রথম দোতলা বাড়ি। খোলা উঠোনে দু ধাপ সিঁড়ি দেওয়া দাসদের নিলাম  মঞ্চ ।নিলামশেষে ক্রীতদাসের বুকে জ্বলন্ত লোহার শলাকা দিয়ে বিশেষ চিহ্ণের সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্বপরিচয় মুছে যেত। বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে মানুষদের জন্তু র মত তাড়িয়ে এনে নিলামের আগে যে গুদামের মত যে বাড়ীটায় রাখা হত সেটাও দেখলাম।লোহার একটা বিশাল কড়াই সাক্ষী দিচ্ছে দাসেরা একসঙ্গে মুখ ডুবিয়ে কি ভাবে জন্তুর মত জল খেতে বাধ্য হত। দাসেদের প্রতি অত্যাচারের সচিত্র বিবরণী,অত্যাচার করার নানারকম যন্ত্রপাতি,দাসব্যবসার খোলাখুলি বিজ্ঞাপন,খরের কাগজের কাটিং সবই আছে।

আর কী অবাক কাণ্ড! আফ্রিকান গাইড আলমারির মধ্যে রাখা কতগুলো কড়ি দেখিয়ে বলল-এগুলো কওরি।সেইসময় টাকার কাজ করত।

বাংলাদেশেও এই নারকীয় ব্যবসা চালু হয়েছিল কিন্তু আফ্রিকার মতো এতো দীর্ঘ সময় ধরে তা স্থায়ী হয়নি। প্রায় দেড়শ বছর এই নিষ্ঠুর জঘন্য প্রথা টিকে থাকার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত প্রথম থেকেই তারা তাদের গোষ্ঠীপতি ও অদেখা নানা দেবতার কাছে মনে মনে বলি প্রদত্ত। সাদা চামড়ার লোকদের তারা প্রথমে দেবতাই ভেবেছিল। কষ্টসহিষ্ণু সরল পরিশ্রমী এই মানবগোষ্ঠীর রক্ত ঘাম ও চোখের জলের ফায়দা তুলেছে পশ্চিম দুনিয়া। দ্বিতীয়তঃ  আফ্রিকান গোষ্ঠীপতিদের নির্বোধ লোভ। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এরা গ্রাম কে গ্রাম উজাড় করে মানুষ তুলে দিয়েছে বিদেশিদের হাতে শুধু মূল্যহীন বিলাস সামগ্রীর লোভে। তৃতীয়তঃ ভৌগলিক অবস্থান।আটলান্টিকের তীর ধরে গ্রামগুলো থেকে অত্যন্ত সহজে পাচার হয়ে গিয়েছে হাজার হাজার কালো মানুষ। কত পরিবারের পাঁচটি  প্রজন্মই কেটেছে ক্রীতদাস হিসেবে।বিখ্যাত তারকা গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের পূর্বপুরুষ ছিলেন এই বাডাগ্রিরই বাসিন্দা।

নিজেদের রাজার বিশ্বাসঘাতকতায় নিয়তিকে স্বীকার করে স্বাধীন কালো মানুষের দল অসহায় দাসের জীবন মেনে নিত প্রথমে। তারপর সহ্য করতে না পেরে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করত। পালাতে গিয়ে বিশেষভাবে শিক্ষিত কুকুরের খাদ্য হত।সর্বসমক্ষে নির্মমভাবে অত্যাচারিত হত অন্যদের শিক্ষা দেবার জন্য। এইসব ছবি রাখা আছে মিউজিয়ামে।আশ্চর্য উপায়ে তাদের একটি দল বিদেশী প্রভুদের শায়েস্তা করেছিল। তারা যখন বুঝতে পেরেছিল তাদের সন্তানও হবে ক্রীতদাস তখন তারা সন্তানধারণ বন্ধ করে দিয়েছিল।

ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের বিবরণ অতি সাধারন ভাবে ধূলিধূসরিত হয়ে পড়ে আছে। লোহার বিবর্ণ শিকল হাতকড়া ইত্যাদি চোরেদের আগ্রহের বস্তু নয় তাই পাহারাও নেই। শুধু অতলান্তিকের হাওয়ার হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস জানিয়ে যাচ্ছে কত মানুষের চোখের জল এই সাগরে মিশে আছে।

এই দিনেই বাডাগ্রির পর গেলাম পাশের স্টেট আবেয়কুটায়।লাগোস থেকে প্রায় দুশো মাইল দূরে বাঙালিরা আসেন মাছ কিনতে।ভেটকি পার্শে ট্যাংরা সবই পাওয়া যায়। মাছ যে অত স্বাদু হতে পারে আবেওকুটার মাছ না খেলে জানতেই পারতাম না। অনেকেই আমাকে বলেছিলেন বরফে জমিয়ে এই মাছ দেশে নিয়ে আসতে। কারা নাকি এইভাবেই এখানকার চিংড়ি দেশে নিয়ে গিয়েছেন। মাছের আয়তন ও স্বাদ দেখে মনটা একটু দূরে উঠেছিল কলকাতার মৎস্যপ্রিয় আত্মীয় বন্ধুর জন্য। এর থেকে ভালো উপহার আর কি হতে পারে? শেষটায় অবশ্য সাহসে কুলোয়নি।

আবেয়কুটা বিশাল পাথরের স্তুপের জন্য বিখ্যাত। লিফটে করেও পাহাড়ের মাথায় ওঠা যায়। এখানেই প্রথম বেশ কয়েকজন টুরিস্ট চোখে পড়ল। বেশিরভাগই কালো মানুষ। আমাদের মত খয়েরী বা সাদা নেই। আমি মুগ্ধ হলাম সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ছোটবেলায় শান্তিনিকেতন খোয়াই দেখেছিলাম যা এখন সম্পূর্ণ ইতিহাস। সেই লাল ঢেউ খেলানো খোয়াই উদ্ধত গর্বিত ভঙ্গিতে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল জায়গা জুড়ে।

লেগোসের রবিবার দেখে অবাক হয়ে গেলাম।সাগরের দিকে ছুটে চলা নদীর মতো এরকম চার্চগামী মিছিল আগে কখনও দেখিনি। কত রকম ঝলমলে পোশাক আর চুলের বাহার করে এরা চার্চে যায়। গান-বাজনা সামাজিকতা ট্যালেন্ট শো আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সব ওই চার্চে। একটি চার্চে দেখলাম আমাদের মন্দিরের মতো বাইরে জুতো ছেড়ে সবাই ভেতরে ঢুকছে। প্রত্যেকে নিজের রোজগারের অন্তত টেন পার্সেন্ট নিয়ম করে চার্চকে দেয়।

স্কুল কলেজ হাসপাতাল দোকান বাজার অফিস নিয়ে ক্যাননল্যান্ড চার্চ বিশ্বের অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান।কিন্তু এর কোন  পরিষেবাই চার্চের বলে সস্তা নয়। খরচের যা বহর মধ্যবিত্তদের পক্ষেও সম্ভব নয়। আমাদের ফুটপাতের সিঁদুর মাখানো ইঁট যে ভাবে মার্বেল মন্দির হয়ে যায় ঠিক সেভাবে এখানেও একটা সামান্য ছাউনি  বিশাল চার্চ হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ কোনো না কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করে থাকতে ভালোবাসে এখনও-হয় মোড়ল নয় চার্চ।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই জায়গাতেই। সেইজন্যই বুঝি এতদিন ধরে দাসপ্রথা টিঁকে ছিল।

আমাদের কাজের মেয়েটি অসুস্থ হলে পর গ্রামের ওঝার কাছে গেল। পাশের বাড়ির শিক্ষিত ভদ্রলোকটি ডাক্তারের বদলে চার্চের জলপড়ায় বেশি বিশ্বাসী। সেই জন্য আধুনিক চেহারার সঙ্গে গ্রাম্য আদিম বিশ্বাস সংস্কার ধর্মাচরণ সবই প্রবলভাবে বর্তমান নাইজেরিয়ার সমাজে।

অভিবাদনের খুব ঘটা।দিনের প্রতিটি প্রহরে যতবার দেখা হয় এক মুখ হাসি ও বিনয় নিয়ে গুড মর্নিং, গুড আফটারনুন। এমনকি দিনের মধ্যে আর দেখা হবার সম্ভাবনা না থাকলে সকাল দশটাতেই বিদায় কালে গুড নাইটটাও সেরে রাখে। প্রথম দিন শরীর হাঁটু পর্যন্ত নুইয়ে ড্রাইভার জন গুড মর্নিং বলে জিজ্ঞেস করেছিল হাউ ওয়াজ ইয়োর নাইট? তখন অবাক হলেও পরে দেখলাম ওটাই রেওয়াজ। শুনলাম যে কোন কর্মারম্ভেই প্রেয়ার মাস্ট।ক্লাস শুরুর আগে প্রার্থনা শুরু হল।  ভাবছি এইবুঝি শেষ হবে। অন্তহীন প্রার্থনা থেকে আবিষ্কার করলাম এরা ভগবানকে থ্যাংকস জানাচ্ছে ঊনকোটি চৌষট্টি জিনিসের জন্য। তার মধ্যে ঋতা ম্যাডামকে পাঠিয়ে ট্রেনিংয়ের কথাও আছে। তালিকায় স্কুলের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আরও সব মাথারা এল সারি বেঁধে।

বিনয় ও প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রায় সবার মধ্যেই। যদি কখনো ক্লাসের মধ্যে হেঁচে কেশে ফেলি বা ঢেকুর তুলি সবাই মিলে ‘সরি ম্যাডাম, সরি ম্যাডাম” করে ওঠে। একসঙ্গে উদ্বিগ্নমুখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে যতক্ষণ না ধাতস্থ হই যেন আমার হাঁচি কাশির জন্য ওরাই দায়ী।

একদিন ক্লাসে খেয়াল করলাম ফেইথ ঘুমে ঢলে পড়ছে। এমনিতে মেয়েটি বুদ্ধিমতী মনোযোগী। পড়ানো থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কাল রাতে ঘুমোওনি?

-না।

-কেন?

– প্রেয়ার করছিলাম।

আমি সত্যি ভেবেছি ও ঠাট্টা করছে। তারপর শুনি প্রতি সপ্তাহে একদিন ওরা রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নেচে-গেয়ে প্রার্থনা করে। ঘুমন্ত মানুষ শয়তানের কাছে অসহায় তাই জেগে থেকে অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা করা হয়। সামান্য নিয়ম বদল করে বিভিন্ন চার্চে এই রকম নানা কর্মকাণ্ড লেগেই থাকে।

ওদের কাছে নানা রকম গল্প শুনে আমার আর আশ মেটে না। চার্চ প্রধানকে এরা প্যাস্টার বলে। তারা প্রভূত প্রভাবশালী। অসবর্ণ বিয়ের থেকে সম্পত্তি ঘটিত গোলমাল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সবই তারা নিয়ন্ত্রণ করে।

বিয়ের সময় ছেলেকে বেশ দাম দিয়ে বউ কিনতে হয়। এখানে বলে রাখি ভারতবর্ষে মেয়েপক্ষ এই টাকা দেয় এবং টাকার পরিমাণ মনের মতো না হলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে এই খবর এরা রাখে এবং এই অসভ্য নিয়ম এখনো টিঁকে আছে বলে বেশ অবাক হয়। যাই হোক এদের ব্রাইড প্রাইসের দরদস্তুর পর্যন্ত প্যাস্টারের দায়িত্ব।প্যাস্টার মত না দিলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ পর্যন্ত সম্ভব হয় না।

প্যাস্টাররা যে যার মত করে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। যিনি যত জনচিজয় করতে পারেন তাঁর চার্চ সাধারণ মানুষের ভয়-ভীতি ভক্তিকে কেন্দ্র করে ততই ধনী আর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে।

আমাদের মিষ্টির দোকানের মত পাড়ায় পাড়ায় চা।র্চ তাদের অদ্ভূত সব নাম– রিয়েল যিশাস চার্চ,অনেস্ট যিশাস চার্চ,হাউস অফ লাভ চার্চ,রিডিম ক্রীশ্চান চার্চ ইত্যাদি। যেকোনো কারণেই হোক সমস্ত পৃথিবী জুড়েই কিন্তু কালো মানুষদের চার্চ প্রীতি অসাধারণ। এখানে চার্চ গুলোতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব বিচিত্রানুষ্ঠান হতে দেখেছি। বিনোদনে যত সক্রিয় মানুষের বিপদে তত নয় এখানকার চার্চগুলো। সাধারণ নাইজেরিয়ানরা জীবনে ফুটবল ছাড়া চার্চেই তাদের মনপ্রাণ সমর্পন করেছে।প্যাস্টারা সব দারুন ইভেন্ট ম্যানেজার ও সঞ্চালক। তাই চার্চ ঘিরেই এদের জীবনের সুখদু;খআনন্দ।সেইজন্য গরিবস্য গরিব পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ পোশাকটি পরে মেকআপ করে যখন চার্চে যায় তখন বোঝার উপায় থাকে না পয়সা নেই বলে দুদিন উপোস দিয়ে এসেছে। এখানকার চার্চগুলো ভারতবর্ষের মতো কোনো রকম সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে না। এমনকি চিকিৎসা বা অশুভ শক্তি তাড়াবার জন্য যে জলপড়া তার জন্য পর্যন্ত পয়সা নেয়। রোজগারের মোটা অংশের বদলে রবিবার সকালের বিনোদনটুকু ফ্রি।

নানা ভাষার দেশ বলে নাইজেরিয়ায় ইংরেজিটাই যোগাযোগের ভাষা। সব দেশেই তৃণমূল মানুষ খুব সীমিত শব্দভাণ্ডার দিয়েই কাজ চালায়। আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভাষা বলে আমার অনভ্যস্ত কানে এদের কথোপকথন মাঝে মাঝে বড়ই অদ্ভুত শোনাত।যেমন  কম বেশির একটা কথাই এরা ব্যবহার করে বিগ অর স্মল। সেইজন্য গাড়িটা আচমকা বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে কর্তা ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতেন স্মল দ্য এসি। বাড়াতে হলে বলা হত বিগ দ্য এসি ।

আই ডান কাম মানে আমার আসা হয়েছে অর্থাৎ এসেছি। এই রকম আরও অজস্র।

কোর্সের শেষ দিন ছাত্রীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।প্রতিটা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ইয়োরবা ভাষায় বুঝিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান।সে কী উদ্দাম নাচ গান হাত তালি পা ও কোমরের সাংঘাতিক কারুকাজ। অনুষ্ঠান শেষে আমার জন্যই বিশেষ ভাবে বানানো নাইজেরিয়ার প্রধান খাবার ইয়াম প্ল্যান্টিন ও গারি সুন্দর বাসনে করে নিয়ে এল। প্রায় সব রান্নাতেই এরা শুকনো চিংড়ি মাছের গুঁড়ো দেয় বলে আমার গন্ধ লাগছিল তবুও হাসি মুখে খেলাম। ছাত্রীরা আফ্রিকার উইচক্রাফটের বই ও ওদের   পোশাক উপহার দিল। বলাবাহুল্য আরম্ভে ও অন্তে সেই লম্বা প্রেয়ার।

লেগোসে যে কটি  ভারতীয় ও বাংলাদেশী পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাদের আতিথেয়তা ও উষ্ণতার কোন তুলনা নেই। শুক্রবার রাত থেকেই নেমন্তন্নের পালা শুরু হয়ে যেত। সবার বাড়িতে এক মানুষ লম্বা ফ্রিজার।তার মধ্যে সম্বৎসরের রসদের সঙ্গে দেশের দই মিষ্টি পাটালিগুড় জমে বরফ হয়ে আছে। প্রত্যেকের বাড়িতে দেখতাম গ্লোরি, হ্যাপিনেস, চ্যারিটিরা আলুর দম, মাছের কালিয়া, মাংসের ঝোল, চাটনি, পায়েস রান্নায় ওস্তাদ।রুটি লুচি পরটা বাঙালি রাঁধুনির দক্ষতায় গরম পরিবেশন করে চলেছে রাত এগারোটা বারোটা  পর্যন্ত ।

একটি ব্যাপারে বাঙালি-অবাঙালি সবারই মিল দেখেছি। নাইজেরিয়া তাদের ঘরের বকাটে ছেলের মত। নিজেরা যথেচ্ছ গাল দেন কিন্তু বহিরাগতরা বললে বড়ই কষ্ট পান।

এখানে আসার আগে সবাই নাইজেরিয়ায় পদে পদে ডাকাতি লুটতারাজ নিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। কোন কারণে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়ালে যেন কখনোই জানালার কাচ না নাবানো হয় এইসব উপদেশ হাই কমিশন থেকেই দিয়ে দেওয়া হয়। এখানে এসেও যে কোন জমায়েতে নানা রকম রোমহর্ষক ডাকাতির গল্প শুনছি। আমি খুবই সুরক্ষিত এলাকায় থাকি। ছ টা বাজতে না বাজতেই চারদিকের লোহার গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সকাল বেলা কিছু বোঝা যায়না। স্থানীয় লোকজনকেও দেখি নিশ্চিন্ত মনে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে।ভাবি আমাদের দেশেও তো  অহরহ কত ঘটনাই ঘটছে। আমার চোখে তো কিছুই পড়ছে না। একটু বোধহয় অতিরঞ্জিত করেই বলা। এই করে এমন চমৎকার সমুদ্র পাহাড় জঙ্গল লাল মাটির দেশে পর্যটন শিল্প গড়েই উঠলো না।

কিন্তু চাপা টেনশন বোঝা গেল রাত্রিবেলা নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরবার সময়।ডাকাত  দেখিনি তবে সশস্ত্র পুলিশ এর ছড়াছড়ি। পুলিশের টর্চের আলো দেখা মাত্র গাড়ির ভেতরের আলো জ্বেলে দিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিতে হয়। নির্দেশ পালন না করলে পুলিশের গুলি করার অধিকার আছে।

এটুকু বলতে পারি আমার অন্তত প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা খসে যাবার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।তবে  এই চাপা ভয়ের ভাবটার জন্যই স্থানীয় বাজার হাট রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে ঘুরে ফিরে বেরিয়ে আরও ভালো করে এই  দেশটাকে জানা হলো না এই আফসোস নিয়ে নাইজেরিয়া থেকে বিদায় নিলাম।