Skip to content Skip to footer

আমেরিকান ড্রিম

ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
সকাল ১১টা মানে ঠিক ১১টাই। ওহাইও’র রাজধানী কলম্বাস শহরের রেসিডেন্স ইন হোটেল থেকে আমাদের বাস ছাড়লো। আজ ২১ জনের আন্তর্জাতিক দলকে দুই ভাগে ভাগ করা হলো। একদল গেল কেন্টাকি স্টেটের লুইভিলে, আর আমরা রওনা দিলাম পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গের উদ্দেশ্যে।

২৭ জানুয়ারি থেকে দৌড়ের ওপর আছি। বিমানে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই বাসে করে পিটসবার্গ যাত্রা অনেকের মনেই স্বস্তি এনে দিল। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই আয়োজনটিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, আমরা যখন যে স্টেটে যাই তখন সেই স্টেটের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অতিথি হই। পিটসবার্গে এর দায়িত্বে ছিল গ্লোবাল পিটসবার্গ। তারাই সকালে আমাদের নিতে বাস পাঠিয়েছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস কলম্বাস ছাড়িয়ে হাইওয়ে ধরে চলতে লাগল। আজ বাস ফাঁকা থাকায় সবাই জানালার পাশের সিট বেছে নিয়েছে। আমি বসেছি সামনের দিকেই— সামনে একটি টেবিলও আছে। টেবিলের ওপাশে বসেছে সার্জ ব্লাড, আমাদের তিনজন সমন্বয়কারীর একজন। ডান পাশে জানালার কাছে বসেছে জোনাথন ক্রিস্ট, সেও সমন্বয়কারী দলের আরেকজন।

ফেব্রুয়ারির শীতল আমেরিকায় রাস্তার দুপাশের গাছগুলো রঙ হারিয়ে কুঁকড়ে আছে। এই সময়ে যত রঙ সব যেন আকাশেই সীমাবদ্ধ— নীল আকাশে ছুটে চলেছে বিমান, রেখে যাচ্ছে মানুষের গন্তব্যের চিহ্ন।

কোথাও কোথাও ঘরবসতি দেখা যায়, কিন্তু বিস্তীর্ণ মাঠ পড়ে থাকে ফাঁকা। হঠাৎ মনে হলো— আমেরিকার ফসলের জমিতে আল নেই কেন? আমাদের দেশে তো জমিকে ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ করা হয়। এখানে কি জমিজমা ভাগাভাগি হয় না? নাকি এরা খুব বেশি সন্তান নেয় না বলে জমি ভাঙে না? নিজের মতো করেই উত্তর খুঁজে নিলাম।

কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে আবার জানালার বাইরে তাকালাম। সুন্দর সুন্দর বাড়ি, টিলার উপর কবরের সারি, বিস্তীর্ণ প্রান্তর— সব চোখে পড়ল। এদিকে খবরের কাগজে পড়লাম, সান ফ্রান্সিসকোর ৫৮ তলা একটি বিল্ডিং গত ছয় বছরে কয়েক ইঞ্চি দেবে গেছে। বাসিন্দারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, কারণ অনেকেই জীবনের সঞ্চয় ঢেলে সেখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন। আমাদের দেশেও তো ভবন দেবে যায়— ভাবতে মজা লাগল।

এসময় সার্জ ব্লাড আমেরিকান সমাজব্যবস্থা নিয়ে গল্প শুরু করলেন।

তিনি বললেন—
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। শহরের বাইরে শান্ত পরিবেশে নিজেদের একটি বাড়ি থাকবে, সাথে ছোট খামারও থাকবে। যুদ্ধ শেষ, এবার শান্তির জীবন চাই— এই ছিল তাদের আকাঙ্ক্ষা। ধীরে ধীরে কলকারখানা গড়ে ওঠে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।

অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো তখন স্থানীয় পরিবহন কিনে নেয় ও বন্ধ করে দেয়। এরপর সহজ কিস্তিতে নিজেদের গাড়ি বাজারে ছেড়ে দেয়। শহর থেকে দূরে গিয়ে থাকার প্রবণতা বাড়ে। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে আমেরিকান ড্রিম পূরণ হতে থাকে।

পারিবারিক সংস্কৃতির প্রসঙ্গ উঠলে সার্জ বললেন—
আমেরিকায় প্রায় প্রতিটি পরিবারেই সন্তানরা ১৮ বছর বয়স পার করলে পিতামাতার সঙ্গে থাকতে চায় না। এখানে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার (Individualism) প্রাধান্য বেশি। ফলে সন্তানরা আলাদা হয়ে যায়, শহর জমজমাট হয়, আর পিতামাতা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

জোনাথনও তখন মন দিয়ে শুনছিল। সার্জ তার নিজের অভিজ্ঞতার কথাও বললেন— খালার বাসায় গেলে অতিরিক্ত আপ্যায়নে বিরক্ত হয়ে তিনি হোটেলেই থাকতেন।

আমরা প্রশ্ন করলাম— সন্তানরা পিতামাতাকে ছেড়ে চলে গেলে তাদের কী হয়? সার্জ জানালেন—
পিতামাতার সঙ্গে দেখা হয় মাসে একবার বা তারও কম। এক গবেষণা অনুযায়ী, একজন আমেরিকান জীবনে গড়ে ১১ বার বাড়ি বদলায়। চাকরি, বদলি, শিক্ষার কারণে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াতে হয়। ফলে সন্তানরা ধীরে ধীরে অনেক দূরে চলে যায়।

বৃদ্ধ বয়সে বিশাল বাড়িতে একা থাকা, নার্সিং হোমে যাওয়া, কিংবা সম্পত্তি বিক্রি করে সন্তানের শহরের কাছে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকা— এভাবেই কাটে তাদের শেষ জীবন। আমেরিকান ড্রিম কোথাও বিস্তৃত হয়, কোথাও সংকুচিত হয়, আবার কোথাও আটকে যায় অট্টালিকার ভেতরে।

সার্জের মতে— ইনডিভিজুয়ালিজম যেমন মানুষকে নিঃসঙ্গ করে তোলে, তেমনি ব্যক্তি স্বাধীনতার আনন্দও সত্য। এটা তাদের জীবনধারা, তাই ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করা অন্যায়।

আমারও মনে হলো— আমরাও কি একই পথে হাঁটছি না? আমি কি আমার মায়ের পাশে সবসময় আছি? আমিও তো ঢাকায় চলে এসেছি। ভবিষ্যতে আমাকেও কি ছাড়তে হবে কাউকে?

তিন ঘণ্টার পথ শেষে বাস পৌঁছল পিটসবার্গে। নদী পার হয়ে উঁচু উঁচু ভবন আমাদের স্বাগত জানাল। জোনাথন হঠাৎ বলল—
“আমিও আমার বাবা-মার সঙ্গে থাকি না। আমি থাকি ওয়াশিংটনে, তারা টেক্সাসে। আমি বলেছি বাড়ি বিক্রি করতে, কিন্তু তারা রাজি নয়। তাদের যুক্তি— এত স্মৃতি আছে এই বাড়িতে। আমি বলেছি, স্মৃতি তো মাথায় থাকে, বাড়িতে নয়।”

বাস থামল কোর্টইয়ার্ড ম্যারিওট হোটেলের সামনে। এখানেই আমাদের চারদিনের আবাস। নামতে নামতে সার্জের বয়স জানতে চাইলাম। তিনি মৃদু হাসলেন—
“৬০ পার করেছি। জন্ম নিউ ইয়র্কে। চার বছরের এক ছেলে আছে, থাকে এস্তোনিয়ায়।”

মুনজুরুল করিম
সম্পাদক, প্রবাস কথা
উপস্থাপক, Move with Monjurul Karim