লিখেছেনঃ গোলাম কিবরিয়া
সারি সারি পাহাড়। হ্যাঁ, রাস্তার দুপাশ ঘেঁষে সবুজ সারি সারি পাহাড়। আঁকা-বাঁকা এই রাস্তা ধরেই এগোতে হয় দার্জিলিং শহরে।
অপরূপ সুন্দর এই শহর ঘুরে এলাম আমরা চার বন্ধু শ্যামল, হাসান, বাবু ও আমি। ১৪ মার্চ রাতে যখন বুড়িমারী বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছি তখন ভারত ভ্রমণের উত্তেজনা তুঙ্গে। আর মেঘ-পাহাড়ের শহর দার্জিলিং দেখতে যাওয়ার আনন্দের পারদটাও যেন ঊর্ধ্বমুখী।
দীর্ঘ ভ্রমণের পর বুড়িমারী সীমান্তে বুড়ির হোটেলে উদরপূর্তি করে আমরা সেরে নিলাম ইমিগ্রেশনের কাজ। ভারত সীমান্তে যখন পা রাখলাম মনে হলো ঢাকার সব ব্যস্ততা পেরিয়ে আমরা বিশ্বজয়ের পথে। আমাদের যাত্রা শুরু হলো শিলিগুড়ির উদ্দেশে। স্থানীয় বাসে করে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম আড়াই ঘণ্টা পর। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ট্যুর গাইড নাওয়াং সোনম। নাওয়াং গ্যাংটকের স্থানীয় বাসিন্দা। রোশন নামের আরেক ট্যুর গাইড প্রাইভেটকারে আমাদেরকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল মেঘ-পাহাড়ের শহরে।
অবশেষে পৌঁছলাম দার্জিলিংয়। ইতিমধ্যে ঠাণ্ডা লাগা শুরু হয়ে গেছে। যদিও বছরের এই সময়টা অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল তুলনামূলক শীত কম থাকে এখানে, তবুও আমাদের শীত লাগছিল। দার্জিলিং পৌঁছেই ক্লান্ত দেহে একটানা ঘুম। লক্ষ্য পরদিন ভোর ৩.৩০ মিনিটে উঠে টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখা! পাঠক, অবাক হচ্ছেন তো! এই সময়টায় উঠে তৈরি হয়ে ৪.৩০-এর মধ্যেই বের হতে হবে। না হলে প্রচণ্ড ভিড়ে আপনি যে এগোতে পারবেন না।ভোর রাতে বের হয়ে টাইগার হিলের উদ্দেশে রওনা দিলাম। চলার পথে পাহাড়ি রাস্তা থেকে অসাধারণ সব দৃশ্য চোখে পড়ল।
টাইগার হিল পৌঁছে তখন অসাধারণ সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা। অবশেষে দেখলাম সূর্যোদয়ের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। পাহাড় ফুঁড়ে মেঘ থেকে বেরিয়ে আসছে সূর্যটা। কী অপরূপ! বিভিন্ন দেশের পর্যটকরাও আসেন এই অসাধারণ দৃশ্যটার সাক্ষী হতে। এরপর আমরা রওনা হলাম দার্জিলিংয়ের বিভিন্ন সাইড সিয়িং করতে।
ট্যুর গাইড প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল সামতেন চলিং বুড্ডিস্ট ঘুম মনেস্ট্রি মন্দিরে। সঙ্গেই একটি ক্যান্টিন, এখানে চায়ের আড্ডা জমে বেশ। সেখান থেকে আমরা গেলাম গোর্খা ওয়ারে। ভারতের যে সৈনিকরা শহীদ হয়েছিলেন সেই স্মরণে গোর্খা ওয়ার মেমোরিয়ালে, যা বাতাসিয়া সৈনিক রোডে অবস্থিত। এটি বাতাসিয়া লুপ নামেও পরিচিত। বাতাসিয়া লুপ ঘুরে গেলাম পিস প্যাগোডা ও জাপানিজ টেম্পলে।
লক্ষ্য করলাম, উপাসনালয়গুলোর স্থাপত্যশৈলীর বৈচিত্র্য ও এর আশপাশের পরিবেশ। দার্জিলিং শহরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো শহরটির পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বেশ সাজানো গোছানো। প্রায় সব বাড়িতে নানা রঙের ফুলের গাছ চোখে পড়ার মতো। এরপর পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে আমরা এলাম হিমালয়ান মাউন্টেনারি ইনস্টিটিউটে। এক সঙ্গেই অবস্থিত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা আর বেঙ্গল নেচারাল হিস্টরি মিউজিয়াম।
ভাবতে অবাক লাগে, একটা শহর তার জীববৈচিত্র্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে কতটা সচেষ্ট। পর্বতশৃঙ্গ আরোহীদের উদ্দেশ্যে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ১৯৫৪ সালে এটি উদ্বোধন করেন। রয়েছে প্রথম এভারেস্টজয়ী শেরপা তেনজিং নরগে স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ। সবুজঘেরা পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ বাংলাদেশের কথাও মনে পড়ে গেল। এর মাঝেই আমরা উপস্থিত টি-গার্ডেনে। ছবি তোলা আর চা-পান পর্ব শেষে স্থানীয় জনপ্রিয় খাবার মম; খাওয়া হলো।শ্যামল, হাসান আর বাবুর কাছে ভালো লাগলেও আমি দিয়েছি জিরো মার্ক!
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য তিব্বতিয়ান রিফিউজি সেল্ফ হেলফ সেন্টার। এই রিফিউজি সেন্টারটিকে তিব্বতিয়ানদের প্রতি ভারতীয় সরকারের উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৯ সালের ২ অক্টোবর। হাজার হাজার তিব্বতিয়ান শরণার্থীর জন্য এই পুনর্বাসন কেন্দ্র দেখতে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসেন। এখানকার শরণার্থীরা নিজেদের হাতে তৈরি পণ্য সামগ্রী বিক্রি করেন, যা দিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রের অনেকটা ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রদর্শনী কেন্দ্র উপাসনালয়। মেঘ-পাহাড়ের শহর ঘুরে অপরূপ সব প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে এ যেন আরেক সুন্দর দৃশ্য। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লেখকঃ সহ সম্পাদক, দৈনিক সমকাল
ছবিসত্ত্ব: গোলাম কিবরিয়া