Skip to content Skip to footer

বাংলাদেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে পায়ে হাঁটার অবিস্মরণীয় এক অভিযান

জাহাঙ্গীর আলম শোভন

বাংলাদেশ—প্রকৃতির অসাধারণ এক উপহার। ছোট্ট এই দেশের বুকজুড়ে ছড়িয়ে আছে অপার বৈচিত্র। দক্ষিণে সাগরের উত্তাল ঢেউ, উত্তরে হিমালয়ের অপার গাম্ভীর্য। পূর্বে পাহাড়ের শান্ত চৌরাস্তায় অরণ্যের ছায়া, পশ্চিমে শস্যভরা সমতলভূমি। মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা বয়ে যাওয়া অসংখ্য নদী যেন রক্তনালীর মতো দেশের প্রাণ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তার পাশেই পাকা ধানক্ষেত, সবুজ গাছের ছায়ায় বসবাসরত কৃষকের ছোট ছোট কুঁড়েঘর। হাটে মাঠে আর নদীর ঘাটে প্রতিদিন জেগে ওঠে বাংলার জীবনচিত্র।

ছোটবেলা থেকেই দেশ ঘুরে দেখার অদম্য স্বপ্ন লালন করেছি। মনের জানালা খুলে কল্পনায় ঘুরে বেড়িয়েছি উত্তর মেরু থেকে অ্যামাজনের অরণ্য, কখনও চাঁদের পাহাড়, কখনও বা রবিনসন ক্রুশোর নিঃসঙ্গ দ্বীপে। কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে হয়ে এসব স্বপ্ন শুধু বইয়ের পাতায় কল্পনার ডানা মেলেছিল।

২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সেই স্বপ্নই বাস্তব রূপ নিতে শুরু করলো। বাংলাবান্ধা থেকে পায়ে হেঁটে শুরু করলাম এক অনন্য যাত্রা—উত্তরের তেঁতুলিয়া থেকে দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত।

প্রথম দিন দুপুরে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট থেকে হাঁটতে হাঁটতে বিকেলে পৌঁছাই তেঁতুলিয়া শহরে। মহানন্দা নদীর পাশে সূর্যাস্ত দেখে চোখে ভেসে উঠলো রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট নদী’ কবিতা। পরদিন সকালেই আবার পথে। পঞ্চগড়ের চা-বাগান, সরিষার ক্ষেত, গরুর গাড়ির সুর—সবকিছু পথচলার ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দিল।

দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির, রামসাগর, হিমালয়ের অববাহিকার ঐতিহ্যবাহী বরেন্দ্র ভূমি পেরিয়ে যাত্রা চলতে থাকে সৈয়দপুর, রংপুর, গাইবান্ধা হয়ে বগুড়া। করতোয়া নদীকে ঘিরে বিকশিত পুন্ড্রবর্ধনের সভ্যতা আমাকে ইতিহাসের গহীনে নিয়ে যায়। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মনে করিয়ে দেয় হিউয়েন সাঙের সেই ভ্রমণ বিবরণ।

চান্দাইকোনা পার হয়ে সিরাজগঞ্জে পা রাখতেই স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন ‘স্বাধীনজীবন’ আয়োজন করে সংবর্ধনার। যমুনা নদী পার হয়ে ঢাকায় আসার পথেও প্রতিটি জেলার মানুষের আলাদা জীবনধারা, ভাষা, চালচলন যেন আলাদা পরিচয়ের রেখা টেনে দেয়। গাজীপুরে “শিশুর জন্য আমরা” সংগঠনের তরুণেরা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়।

এরপর নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম হয়ে পৌঁছাই কক্সবাজারে। পথচলায় কক্সবাজারে প্রেট্রোনাইজ হাউজিং-এর মোজাম্মেল হোসেন হারুন ও হোটেল উপল-এর ব্যবস্থাপক আমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। কক্সবাজার থেকে শুরু হয় মেরিন ড্রাইভ ধরে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ টেকনাফ যাত্রা—পাহাড় এক পাশে, সমুদ্র আরেক পাশে। সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতায় আমি অভিভূত।

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে শুরু হয় শেষ দিনের যাত্রা। দুপুরে পৌঁছাই শাহপরীর দ্বীপের কাছে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের শেষ বিন্দুতে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকজন বন্ধু এসে যোগ দেন। স্থানীয় সাংবাদিক জসিম, বিজিবি কর্মকর্তাসহ অনেকেই ছিলেন পাশে। সেখানে লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে। দেশের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশকে ভালোবাসার যে উপলব্ধি হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

এই হাঁটার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি বাংলাদেশকে, তার প্রকৃতি ও মানুষকে। এ যাত্রায় পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছি প্রায় ১১৭৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে রয়েছে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ ২০টিরও বেশি জেলা। পথে কোনো গাড়ি ব্যবহার করিনি। মানুষের ঘাম, হাসি, চোখের স্বপ্ন আমাকে শিখিয়েছে—এই দেশকে সত্যিকারের চেনা যায় শুধু হেঁটে হেঁটে, মানুষের পাশে থেকে।

নতুন তথ্য (২০২5 অনুযায়ী):
বর্তমানে লেখক এই অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যাতে পথের মানুষ, গল্প ও প্রান্তিক জীবনের বাস্তব রূপরেখা তুলে ধরা হবে। বইটির সম্ভাব্য নাম: “পথের মানুষের পাশে”